আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পরিচ্ছেদ ২ পর্ব ৬

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পরিচ্ছেদ ২ পর্ব ৬
Raiha Zubair Ripte

দীর্ঘ ১৬ বছর পর নিজ মাতৃভূমি তে পা রাখলো অধরা। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে প্রান ভরে শ্বাস নিলো। নিজ মাতৃভূমির মাটির ঘ্রাণ ই থাকে আলাদা। চোখ থেকে সানগ্লাস টা খুলে এদিক ওদিক তাকালো। কিছুটা দূরে চিত্রা, তৃষ্ণা কে দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেলো।
চিত্রা, তৃষ্ণা এসেছে অধরা কে রিসিভ করতে। অধরা কে দেখামাত্র ই চিত্রা জড়িয়ে ধরলো। অধরা ও পরম আবেশে জড়িয়ে ধরলো চিত্রা কে।

-“ কেমন আছো চিত্রা?
চিত্রা অধরা কে ছেড়ে জবাব দিলো-
-“ এই তো আছি ভালো। তুমি?
অধরা স্মিত হেঁসে জবাব দিলো-
-“ এই তো তোমাদের দেখে ছুঁতে পেয়ে ভালো লাগছে এখন।
তৃষ্ণা অধরা কে জড়িয়ে ধরে বলল-

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“ অনেক মিস করছি তোমায় আপু।
-“ আমিও।
-“ চলো বাসায়,সবাই অপেক্ষা করছে।
অধরা,চিত্রা, তৃষ্ণা গাড়িতে উঠে পড়লো।

খাঁন বাড়িতে আজ খুশির আমেজ। ১৬ বছর পর বাড়ির মেয়ে বাড়ি ফিরেছে। রোমিলা বেগম কতগুলো বছর পর মেয়েটাকে সামনা সামনি দেখছে। বড্ড ভালোবাসে এই মেয়েটাকে রোমিলা বেগম। ভালো বাসবেই না বা কেনো? নিজের ছেলের ভালোবাসার মানুষ যে এই অধরা। ছেলের ভালোবাসার মানুষটিকে বড্ড স্নেহ করে রোমিলা বেগম। ছেলের মৃত্যুর পর দেখেছে এই মেয়েটা কিভাবে গুমরে জীবন পাড় করেছে। সেই সময় টাতে বাড়ির সকলে অধরা কে সাপোর্ট দিয়েছে মুভ অন করার জন্য। রাতুল চলে যাওয়ার আট মাস পর মুভ অন করতে পেরেছিল অধরা।
অধরা বাসায় এসেই রোমিলা বেগমের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। কেমন একটা মা মা গন্ধ নাকে ভেসে আসছে।

-“ অধরা।
রোমিলা বেগমের ডাকে অধরা রোমিলা বেগমের দিকে তাকালো।
-“ হু বলো মা।
-“ আবার কি ফিরে যাবে ঐ সদূর দেশে?
-“ না আর ফিরবো না ঐ দেশে। এখন থেকে তোমাদের সাথেই থাকবো।
রোমিলা বেগমের মুখে হাসি ফুটলো।

-“ সত্যি!
-“ হুমম। বয়স হচ্ছে, বাকি সময় টা তোমাদের সাথেই থাকবো।
রোমিলা বেগম থমথমে মুখ করে বলল-
-“ জীবন টাকে আরেক বার সুযোগ দেওয়া যায় না অধরা?

অধরা শোয়া থেকে উঠে বসলো। খোলা চুল গুলো হাত খোঁপা করে উঠে দাঁড়ালো। তারপর শক্ত মুখে বলল-
-“ জীবন কে বারবার সুযোগ দেওয়া যায় না মা। বেশ কয়েক বার জীবন কে সুযোগ দিয়ে দেখেছি,পৃথিবী বারবার শূন্য হাতে আমায় ফিরিয়ে দিয়েছে। তাই আমি আর নতুন করে শূন্য হতে চাই না।

রোমিলা বেগম হতাশ হলো। মেয়েটার জীবন টা কি আর আনন্দে পরিপূর্ণ হবে না? সবাই বিয়ে শাদি করে নিজেদের জীবন পাড় করছে আর এই মেয়ে এখনও রাতুলেই আঁটকে আছে। রাতুল চলে যাওয়ার পর কত বুঝিয়েছে বাড়ির লোক নতুন করে জীবন শুরু করতে,বিয়ে শাদি করতে কিন্তু অধরা আর বিয়ে শাদি করবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়।

অধরা নিজের রুমে চলে আসে। বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করে তন্ময়ের নম্বরে কল করে। এসেছে সেই কখন অথচ ছেলেটা এখনও এলো না দেখা করতে! অধরা বেশ রেগে আছে,চিত্রার কাছে শুনেছে তন্ময় এখনও সেই আগের রাগ জেদ নিয়ে দূরত্ব বাড়িয়ে রেখেছে মা ছেলের মাঝে। এবার সে মা ছেলে কে মিলিয়েই ছাড়বে,অনেক হয়েছে আর না। কথাটা মনে আওড়িয়ে কল লাগায়। দু বার রিং হতেই ফোন রিসিভ হলো। তন্ময় কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই অধরা বলে উঠল-

-“ কি ব্যাপার এখনও আসলে না কেনো এ বাড়ি? আমি এসেছি খবর কানে যায় নি?
তন্ময় ওয়াশরুমে গেছে ফ্রেশ হতে। দোলন বিছানায় বসে ছিলো। আকস্মিক তন্ময়ের ফোন বেজে উঠায় দোলন সেদিকে তাকায়। তারপর তন্ময় কে ডেকে বলে-
-“ শুনছেন আপনার ফোনে কেউ কল দিয়েছে।
তন্ময়ের কোনো সাড়াশব্দ আসলো না। রিং হয়ে কে’টে গিয়ে আবার বেজে উঠতেই দোলন ফোন টা রিসিভ করে। কানে নিতেই মেয়েলি কন্ঠ কানে ভেসে আসে। দোলন হকচকিয়ে যায়।
অধরা কথার পিঠে জবাব না পেয়ে ফের বলে উঠে –

-“ কি হলো চুপ কেনো? আসবে না?
-“ উনি ওয়াশরুমে গেছে।
অধরা ভ্রু কুঁচকালো। -“ কে তুমি?
-“ আমি দোলন।
অধরার কিছু মনে পড়তেই মুখে হাসি ফুটলো।
-“ তন্ময়ের বউ তুমি?
দোলন মৃদু স্বরে বলল-
-“ জ্বি। কিন্তু আপনি কে?
-“ আমি অধরা। তন্ময়ের ফুপি।

দোলন মনে মনে নিজেকে শ’খানেক বকাবকি করে নিলো। অধরাকে কি না কি ভেবে নিয়েছিল এই বজ্জাত মন।
ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ পেতেই দোলন সেদিকে তাকায়। তন্ময় নিজের ফোন দোলনের হাতে দেখে ভ্রু কুঁচকায়। এগিয়ে এসে বলে-

-“ আমার ফোন তোমার হাতে কেনো?
দোলন ফোন টা এগিয়ে দিয়ে বলে-
-“ অধরা ফুপি ফোন করেছে।
তন্ময় ফোন টা হাতে নেয়। তারপর বেলকনিতে গিয়ে কথা বলে। মিনিট দশেক পর রুমে এসে রেডি হয়।
দোলন চুপচাপ বসে বসে তন্ময়ের রেডি হওয়া দেখছে। দোলন কে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তন্ময় ভ্রু কুঁচকে বলে-

-“ ছেলেদের সাজ দেখো নি কোনোদিন?
দোলন একই ভঙ্গিতে জবাব দেয় –
-“ হ্যাঁ দেখেছি। আপনি এখন বের হবেন?
-“ হ্যাঁ। কেনো?
-“ নাহ্ এমনি। ও বাড়ি যাবেন?
-“ হ্যাঁ তবে এখন না,এখন অন্য কাজে যাচ্ছি। আমি এখন আসছি,বোরিং লাগলে টায়রার সাথে গিয়ে গল্প করবে।
কথাটা বলে তন্ময় চলে গেলো। দোলন বসা থেকে উঠে দরজা আঁটকে দিলো।

খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে রাহা। দৃষ্টি তার দূর আকাশে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে অধরা দৃষ্টি তার রাহার দিকে। সেই কখন থেকে মেয়েটা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে তো আছেই। অধরা এবার রাহার কাঁধে হাত রাখলো। রাহা দৃষ্টি আকাশ থেকে সরিয়ে অধরার দিকে তাকালো।

-“ কি দেখছিস অতো আকাশের দিকে তাকিয়ে?
রাহা মুচকি হেঁসে বলল-
-“ রং খুঁজছি ফুপি।
অধরা ভ্রু কুঁচকে বলল-
-“ কিসের রং?
-“ জীবনের রং ফুপি। আকাশের ও নিজস্ব সাত রং আছে। কিন্তু….
-“ কিন্তু কি?
-“ নাহ কিছু না। চলো রাত হয়েছে ঘুমাবো।

রাহা চলে গেলো। অধরা রাহার যাওয়ার পানে তাকিয়ে নিজেও হাঁটা ধরলো।
রাহা রুমে এসে দরজা বন্ধ করে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসে। ড্রয়ার থেকে একটা ডায়েরি বের করে। ডায়েরি টা আজ দীর্ঘ তিন টা বছর ধরে সাথে। কত অনুভূতি জমা আছে এই ডায়েরি তে তা কেবল এই ডায়েরি আর রাহা জানে। আজ দীর্ঘ দু মাস পর আবার সে এই ডায়েরি খুললো। আজ তার ভীষণ মন খারাপ। বড্ড মনে পড়ছে কাউকে। প্রায় আধ ঘন্টার মতো ডায়েরি টা হাতে নিয়ে বসে রইলো। কোনো শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না লিখার জন্য। ঐ পুরুষ টাকে নিয়ে আর কি লিখা যায়? গুগল ঘাটলো রাহা,তারপর চিঠি পড়লো অতঃপর আধঘন্টা পর বইয়ের ভাজ থেকে কলম টা বের করে রাহা লিখতে শুরু করলো..

কেমন আছেন আপনি অপ্রিয় পুরুষ? ভালো আছেন নিশ্চয়ই? ভালো থাকারই কথা। আপনার মতো এত দারুণ একটা মানুষ কি খারাপ থাকতে পারে? আজ জানেন আপনাকে না ভীষণ মনে পড়ছে। সেজন্য আপনাকে আমি লিখতে বসেছি। যেনতেন কিছু না কিংবা কোনো প্রেমপত্রও না। আপনাকে আমি চিঠি লিখতে বসেছি। জানেন কতো সময় ব্যায় করলাম কি লিখবো আপনায় নিয়ে এটা ভাবতেই, গুগোল ও ঘাটলাম শ’খানেক চিঠিও পড়ে ফেললাম তবুও আবেগগুলোকে মুঠোর মধ্যে বন্দি করে রাখতে পারছি না। সভ্যতার এ যুগে আমাদের আবেগ অনুভূতিকে মলিন করা চিঠি নামক ভালোবাসা ভরা কথাগুলো এখন হারিয়ে গেছে। আর এই হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের মাধ্যমে মনের কথাগুলোকে ভাসিয়ে দিলাম কোনো এক নাম না জানা ঠিকানায়।

আচ্ছা ভালোবাসা শব্দটা এতো সুন্দর কেনো! তবে একতরফা ভালোবাসার মতো হয়তো চমৎকার সম্ভবত আর কিছু নেই, হতেও পারে না তাই না! আমার মতো কতো মানুষ এমন একতরফা ভালোবেসে যায়। তাঁরা তো জানে প্রিয় মানুষটি তার জীবনে কোনোদিন ধরা দিবে না। যেমনটি আপনি দিবেন না ধরা। তবুও কেনো কমছে না ভালোবাসা বলতে পারেন! আশা তো ছেড়েই দিয়েছি আপনাকে পাবার।

বয়স তো হয়েছিল মাত্র সতেরো। সেই সতেরো তে পা দেওয়া এক কিশোরী পড়ে ছিলো আপনার প্রেমে। আপনায় আবেগের বশে প্রস্তাব ও দিয়ে ফেলছিলো। আপনি ও বয়সের দোষ আর বন্ধুর বোন বলে আবেগ ভেবে উড়িয়ে দিতেন,আমিও বারবার ছুটে যেতাম ইনবক্সের সেই মেসেজ অপশনে। বারবার আইডি ঘেটে দেখতাম আপনার নামের পাশে সবুজ বাতিটি জ্বলে নাকি। আপনার একটা রিপ্লাই ছিলো আমার কাছে ঘুটঘুটে অন্ধকার কালো ঢাকা মেঘের মধ্যে ও এক ফালি সূর্যের আলো।

বারবার মেসেজ দেওয়ায় বিরক্তির “চ” উচ্চারণ করতেন, আমার চঞ্চলতা,ঘনঘন মেসেজ দেওয়া ছিলো আপনার অপ্রিয়কর একটি জিনিসের মধ্যে অন্যতম।
জানেন তো কেউই আন্দাজ করে না কাউকে ভালোবাসা কতটা সুখের, কতটা আনন্দের, কতটা প্রশান্তির যদিও তাঁকে পাওয়া হবে না। তাঁর সঙ্গে পথচলা হবে না কোনো দিন।

বয়স বাড়তে লাগলো বুঝদার হতে লাগলাম বিরক্ত করা ছেড়ে দিলাম। চঞ্চলতা কেও মুঠোয় আঁট’কে রাখলাম। তাই বলে কি ভালোবাসা কমে গেছে! আগের মতো প্রকাশ করি না তাই বলে যে ভালোবাসি না তা কিন্তু নয়। ভালোবাসা তো প্রকাশিত করতে নেই আপনার ভাষা মতে, তাই হৃদয়ের সিন্দুকে খুব সযত্নে আগলে রেখে দিয়েছি।

এক জীবন চলে যাবে, মৃত্যু এসে দুয়ারে দাঁড়াবে। চোখের পানিতে বালিশ ভিজল অন্ধকার ঘরে, বুক খাঁ খাঁ করল বছরের পর বছর। দেখবেন না আর কোনো দিন। না পাওয়ার তীব্র ব্যথা নিয়েই চলে যাবো একদিন পৃথিবী ছেড়ে। ভেবেছিলাম অনেক কিছু লিখবো, মনে মনে গুছিয়ে ও রেখেছিলাম কিন্তু কলম ধরার সাথে সাথে সব এলোমেলো হয়ে গেলো। আপনাকে নিয়ে লিখতে বসলেই কেনো যেনো বেশি কিছু লিখতেই পারি না। আজ না হয় থাক এটুকুই, কোনো একদিন আপনাকে নিয়ে আবার শেষাংশটা লিখবো।

কতকাল পর আমি
আবার লিখবো আপনাকে নিয়ে চিঠি-
সেদিন ও হয়তো আসবে না ডাকপিয়ন,
দিবে না হাঁক
তবুও বসে থাকবো নিয়ে অপেক্ষার সেই ডাক…..
সময়ের বদল, গতিশীল সব
যাবে না চিঠি, ইথারে শুধু এসএমএস
নাই সেই আবেগের লেশ;
হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার একতরফা রেশ….
ইতি আপনার প্রেয়সী রাহা।

চিঠি টা লিখে থামলো রাহা। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। আহ এখন প্রশান্তি লাগছে। ডায়েরি টা আগের জায়গায় রেখে ফোন টা অন করলো। ফেসবুক সার্চ অপশনে গিয়ে রাহাত নাম সার্চ দিতেই কাঙ্ক্ষিত আইডিটি চোখে র সামনে ভাসমান হলো। অভিমান মিশ্রিত কন্ঠে বলল-

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পরিচ্ছেদ ২ পর্ব ৫

-“ বেশ ভালোই আছেন আমাকে ছাড়া তাই না অপ্রিয় পুরুষ? কিন্তু আমি যে ভালো নেই। খুব কি ক্ষতি হতো সেদিন আমায় গ্রহণ করলে? আপনি আবেগ বয়সের দোহাই দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলেন, কাজ টা কি ঠিক করেছিলেন? আপনি ভীষণ হার্টলেস একটা লোক। হার্ট থাকলে অন্যের হার্টে দুঃখ দিতেন না। আমি আপনাকে ভীষণ হেট করি ভীষন।
সার্চ অপশন থেকে কাঙ্ক্ষিত মানুষের নাম টা মুছে ফেললো রাহা। পাহাড় সম অভিমান জমে আছে এই পুরুষ কে ঘিরে।

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পরিচ্ছেদ ২ পর্ব ৭