আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পরিচ্ছেদ ২ পর্ব ৫

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পরিচ্ছেদ ২ পর্ব ৫
Raiha Zubair Ripte

অফিসে লোক ভর্তি সমাগমে জাপ্টে জড়িয়ে ধরলো তন্ময় কে ফারাহ্। মুহূর্তে হাত জোড়া কঠোর শক্ত হয়ে গেলো। মুখে জুড়ে ভাসমান হলো স্পষ্ট রাগ। সাব্বির,রাহাত,লারা,লিখন, বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে আছে। সায়ান ভ্রু কুঁচকে দেখছে মেয়েটার কাণ্ডকারখানা।

-“ তন্ময় তুমি কি সত্যি বিয়ে করে ফেলছো? কই আমাকে তো জানালে না। তুমি কি করে পারলে বিয়ে করতে। ইউ নোও না আই লাভ ইউ। কি করে পারলে বিয়ে করতে?
-“ আমি কখনও বলেছি আই লাভ ইউ?
ফারাহ্ কে নিজের থেকে ছাড়াতে ছাড়াতে কথাটা বলে তন্ময়। ফারাহ্ র চোখ ছলছল করছে।
-“ অ্যান্সার মি। আমি কখনও বলছি আই লাভ ইউ?
ফারাহ্ চুপ করে রইলো। তন্ময় আশেপাশে তাকিয়ে নিলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“ আমি এখন বিবাহিত এখন আই হোপ তুমি এই বেহায়াপনা অফ করবে। তা না হলে তোমার ট্রান্সফারের ব্যাবস্থা করতে আমার দু মিনিট ও লাগবে না, আন্ডারস্ট্যান্ড?
ফারাহ্ চমকে উঠলো। সে কিছুতেই কোনো কিছুর মূল্যে তন্ময়ের থেকে দূরে থাকতে চায় না৷
-“ না না আমাকে দূরে পাঠিয়ো না তন্ময়। আমি আর ডিস্টার্ব করবো না তোমায়।
-“ সেটাই তোমার জন্য ভালো।

সায়ান দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। বিষয় টা বেশ বুঝলো। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল-
-“ আপনাদের মধ্যে কেউ প্লিজ এই কেসের ফাইল টা আমার কেবিনে পাঠিয়ে দিবেন।
লারা উৎসুক হয়ে বলল-
-“ জ্বি স্যার আপনি যান আমি নিয়ে আসছি।
সায়ান চলে গেলো। তন্ময়ের ফোন টা বেজে উঠলো। তন্ময় ফোনের স্কিনে পরিচিত এক নম্বর দেখে স্মিত হাসলো। ফোন টা রিসিভ করে কানে নিয়ে হেঁটে বাহিরে চলে গেলো।

-“ কেমন আছো?
ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসলো-
-“ এই তো আছি ভালো তুমি?
-“ হুমম ভালো আছি।
-“ শুনলাম বিয়ে করেছো।
-“ হ্যাঁ ঠিক ই শুনেছো।
-“ বাহ্ আমাকে ছাড়াই বিয়ে সেরে নিলে। ভীষণ রেগে আছি।
-“ রাগ করো না ফুপি। সিচুয়েশনে পরে বিয়ে টা করতে হলো। দেশে আসছো কবে?
-“ টিকিট কাটা শেষ এই তো ফিরবো দু দিন পর।
-“ হুমম, তাড়াতাড়ি ফিরো। অনেক মিস করি তোমায়।
-“ আমিও মিস করি তোমাদের। এখন রাখি।
-“ হুমম আল্লাহ হাফেজ।

তন্ময় ফোন টা কেটে পাশে থাকা টঙের দোকান থেকে এক কাপ চা খেয়ে নিলো। তারপর খাঁন বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে গেলো।
সায়ান ফাইল গুলো সূক্ষ্ম চোখে উল্টেপাল্টে দেখছে। লারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সায়ান কে দেখছে। সায়ান বুঝতে পারছে, কিন্তু মুখের উপর চলে যেতে বলতে বারবার অস্বস্তি হচ্ছে। তাই ফাইল গুলো হাতে তুলে নিয়ে বসা থেকে উঠে কেবিন থেকে বের হতে হতে বলে-

-“ আমি ফাইল গুলো নিয়ে যাচ্ছি।
লারাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে গেলো। অফিস থেকে বের হতেই গাড়ির দিকে যেতেই দেখলো এক অচেনা মেয়ে মেজেন্টা কালারের সেলোয়ার-কামিজ পড়ে হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে তড়িঘড়ি করে এদিক ওদিক তাকিয়ে অফিসের ভিতরে যাচ্ছে। সায়ানের সন্দেহ হলো। গড়ির দিকে না গিয়ে ঐ মেয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মুখে মাক্স পড়ে আছে। শুধু চোখ দেখা যাচ্ছে।

-“ এই কে আপনি? অফিসের ভেতর ঢুকছেন কেনো? মাক্স খুলুন।
তুলি আকস্মিক সামনে কাউকে এসে দাঁড়াতে দেখে হকচকিয়ে গেলো। এর আগেও তো এসেছে কই তখন তো কেউ এভাবে বলে নি। তুলি লোকটার মুখের দিকে তাকালো। নতুন নতুন লাগছে মুখ। আপন মনে বিরবির করলো তুলি। তুলি কে এখনও মাক্স খুলতে না দেখে সায়ান ধমক দিয়ে বলল-

-“ হেই তোমাকে কিছু বলেছি তো। মাক্স খুলো কুইক। আর ভেতরে ঢুকছো কেনো?
একে তো শরীর ভালো না তুলির তারপর এই লোকের ধমক বেশ খারাপ লাগলো। কিছু বলার জন্য উদ্যত হলে তখনই অফিসের ভেতর থেকে লারা বেরিয়ে আসে। তুলিকে দেখতে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে তুলির দিকে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলে-

-“ আরে তুলা যে। অনেক দিন পর আসলে। ভুলেই গেছো নাকি আমাদের।
সায়ান বিরবির করে তুলা নাম টা ঠোঁটের কোনে আওড়ালো। তুলা কারো নাম হয়? জানা ছিলো না তো।
তুলি একবার সায়ানের দিকে তাকিয়ে পরক্ষনেই চোখ সরিয়ে বলে-
-“ ভাইয়ার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি। ভাইয়া আছে?
লারার মুখ ছোট হয়ে গেলো।

-“ তন্ময় তো নেই তুলা। ও তো একটু আগেই চলে গেলো। তুমি আসবে তন্ময় কি জানতো?
তুলি ডানে বামে মাথা নাড়ায়। তন্ময় জানতো না। তুলি আজ নিজের হাতে রান্না করেছে। অনেক দিন হলো ভাইয়ের সাথে দেখা হয় না। তাই ভেবেছে আজ নিজের হাতে রান্না করা খাবার নিয়ে ভাইকে দেখে যাবে।
-“ ওহ্ ভাইয়া তাহলে নেই? আচ্ছা এই প্যাকেট টা ধরো। তুমি আর সব ভাইয়া রা খেয়ে নিয়ো। অনেক টাই আছে খাবার। হয়ে যাবে।

-“ তন্ময় কে ফোন দিচ্ছি। তুমি আসছো শুনলে চলে আসবে।
-“ না থাক দরকারি কাজে ব্যাস্ত থাকতে পারে। আমি আসি আজ। পরে না হয় আরেক দিন আসবো।
তুলি চলে গেলো। সায়ান তুলির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ মেয়েটা তন্ময়ের বোন?
লারা তুলির যাওয়ার পানে তাকিয়ে বলল-
-“ হুমম, বোন ই বলতে পারেন।
-“ মানে?

-“ ওহ্ তেমন কিছু না। চলুন ভেতরে তুলির হাতের রান্না খেয়ে দেখুন, অনেক সুন্দর রান্না করে মেয়েটা। তন্ময়ের উছিলায় বেশ কয়েকবার তুলির হাতের রান্না আমাদের ভাগ্যে জুটে। আপনি খেয়ে দেখুন প্রশংসা না করে পারবেন না।
সায়ান খাবে না বলে জানালো। মনোক্ষুণ্ণ হলো লারার। সায়ান যারতার হাতের রান্না খায় না। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে গাড়ি নিয়ে চলে গেলো।
তন্ময় এসে বসে আছে খাঁন বাড়ির ড্রয়িং রুমে। দোলন রেডি হচ্ছে। রাফি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।

-“ কিরে তন্ময় বাপ আর কত বাসার বাহিরে থাকবি? আমাদের তো ইচ্ছে করে ছেলে ছেলে বউদের সেবাযত্ন পেতে। বয়স হয়েছে তো।
তন্ময় তাকালো রাফির দিকে।
-“ তোমাকে চাচা ডাকবো নাকি ফুফা। যাক ফুফাই ডাকি।
-“ এই না চাচা ডাক। কিসের ফুপা ডাকিস।
-“ ওকে। তোমার তো এখনও বয়স হয় নি। এখনও ইয়াং আছো। এখনও মেয়ে রা তোমায় দেখলে পাগল হয়ে যাবে। নিজেকে বুড়ো দাবি করো কেনো?
রাফি সন্দেহান গলায় বলে-

-“ সত্যি বলছিস? আমি এখনও ইয়াং? তর ফুপি যে বলে আমি নাকি বুড়ো হয়ে গেছি।
-“ খেপায় তোমাকে।
-“ হিংসে করে তোর ফুপি আমায় বুঝলি। তার থেকে এখনও ইয়াং দেখতে যে আমি সেজন্য।
তন্ময় মুচকি হাসলো। রোমিলা বেগম লাঠি ঠক্ ঠক্ করতে করতে তন্ময়ের পাশে বসলো। তন্ময় রোমিলা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল-

-“ কেমন আছো দাদু?
রোমিলা বেগম আফসোস করে বলে-
-“ তোকে ছাড়া কি করে ভালো থাকি বল? ছোট থেকে মানুষ করলাম,আর বড় হতে না হতেই দূরে চলে গেলি।
-“ কাজের জন্য বাহিরে থাকতে হয় দাদু। খুব শীগ্রই ফিরবো বাসায়।
রোমিলা বেগমের চোখ মুখ আনন্দে ভরে উঠে।

-“ সত্যি?
-“ হ্যাঁ।
তৃষ্ণা দোলন কে নিয়ে নিচে নামে। তন্ময় একবার দোলনের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।
তন্ময় বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। উপরে লুকিয়ে থাকা চিত্রার দিকে একবার তাকিয়ে দোলনের হাত ধরে আসি বলে বের হয়ে আসলো।

-“ কিরে মিথিলা ড্রেসে এভাবে কাদা লাগিয়ে এসেছিস কেনো? রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাস নাকি কাদায় গড়াগড়ি করতে করতে যাস কোনটা?
মরিয়ম মান্নানের কথায় রুম থেকে বেরিয়ে আসলো মিথিলা। মরিয়ম মান্নান রশিতে এলোমেলো করে রাখা কলেজ ড্রো নেড়েচেড়ে দেখলেন। বিরক্ত নিয়ে ফের শুধালো।
-“ কাপড় ও ভালো করে ধুতে শিখিস নি। শ্বশুর বাড়ি গিয়ে এমন ভাবে জামা কাপড় ধুয়ে দেখিস ঝেঁটিয়ে বিদায় করবে।
মিথিলা সোজা মায়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। কোমড়ে হাত গুঁজে বলল-

-“ আমি ইচ্ছে করে কাদা লাগাই নি মা। এক অসভ্য লোক কাদা ছিটিয়ে দিয়েছে। যার কারনে আমার এই ফকফকা ড্রেস লালচে হয়ে গেছে।
মরিয়ম মান্নান ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মেয়ের মাথায় গাট্টা মেরে বলল-
-“ নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে দেওয়া কবে বন্ধ করবি? তুই কেমন আমি মনে হয় জানি না? ড্রেস ছাঁদে শুকিয়ে দিয়ে আয়,এখনও ভিজা আছে।

মিথিলা কথা না বাড়িয়ে ড্রেস নিয়ে ছাঁদে মেলে দিলো।
সাঝ সন্ধ্যা, বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে চিত্রা। মন আজ ভীষণ খারাপ। দীর্ঘ বিশ টা বছর ধরে ছেলের সাথে দূরত্ব। কবে ঘুচবে এই দূরত্ব? কবে মা বলে ডেকে উঠবে? এক সন্তান কে হারিয়েছে আরেক সন্তান থেকেও না থাকার মতো করে আছে। এই আমৃত্যু যন্ত্রণা কবে জীবন থেকে দূর হবে? কথা গুলো ভেবে ডুকরে উঠলো চিত্রা। ইচ্ছে করছে গলা ফে’টে কান্না করতে কিন্তু পারছে না। কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে চিত্রা পিছু ঘুরে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে বলল-

-“ আমি আর পারছি না এমপি সাহেব। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কোন পাপের শাস্তি পাচ্ছি আমি? তন্ময়ের কাছে নিজেকে নিয়ে এই ক্রোধ রাগ আমি পারছি না নিতে। আমি কি সত্যি একজন ওয়ার্থলেস মা? এক সন্তান কে নিজের ভুলের জন্য হারিয়েছি আরেক সন্তান কাছে থেকেও নেই। আমার কষ্ট হচ্ছে এমপি সাহেব। কিছু করুন না। আমার মেয়েটাকে কি আমি আর কখনও খুঁজে পাবো না? আপনি পারলেন না আমার মেয়েটাকে খুঁজে দিতে! আপনি কথা দিয়ে কথা রাখতে পারেন নি এমপি সাহেব।

কথাটা বলে পাগলের মতো কান্না করতে লাগলো চিত্রা। প্রত্যেক টা কথা ছুড়ির মতো বুকে এসে বিঁধল তুষারের। পুরোনো অতীত, তুষার চিত্রার প্রাণভোমরা তৃষা সেই ছোট্ট মেয়েটা আজ উনিশ টা বছর হলো তাদের কাছে নেই।
তন্ময়ের যখন বয়স সাত তখন চিত্রা আবার প্রেগন্যান্ট হয়।

তাদের ঘর আলো করে এসেছিল মেয়ে। সে কি খুশি চিত্রা তুষার। পুরো বাড়ির চোখের মনি ছিলো তৃষা। আর সবচেয়ে তৃষা কে ভালোবাসতো তন্ময়। বোন কে কারো কাছে মিনিটের জন্য দিতো না। বোন অন্ত প্রাণ ছিলো। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস সেই ছোট্ট তৃষা তাদের কাছে বছর খানেকের মতো ছিলো।
চিত্রার বোকামির জন্য ই হারিয়ে ফেললো চিরতরে সেই ছোট্ট তৃষা কে।
১৯ বছর আগে,,,

দিনটি ছিলো মার্চ মাসের তিন তারিখ। তন্ময়ের স্কুলে ক্রীড়াপ্রতিযোগীর ফেস্টিভ্যাল ছিলো। সেই ফেস্টিভ্যালে চিত্রা, অধরা,তৃষ্ণা, আর রাহা গিয়েছিল। রাহা তৃষার থেকে আট মাসের বড়। তন্ময় দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল। সে নিয়ে চিত্রার খুশির শেষ নেই। চিত্রা জীবনে একটা প্রাইজ ও আনতে পারে নি খেলাধুলা করে। সেখানে তার ছেলে আনছে বিষয় টা গর্ব করার মতো চিত্রার কাছে।

তন্ময়ের স্কুলের ইয়া বড় মাঠ টাতে প্যান্ডেল সাজানো হয়েছিল। বিকেলের দিকে অনুষ্ঠান শুরু হয়। সন্ধ্যার পর দিয়ে পুরষ্কার বিতরন করা হয়। সেদিন যখন পুরষ্কার বিতরন করা হচ্ছিল কিন্তু আকস্মিক আগুন লেগে যায় প্যান্ডেলে। চারিদিকে মানুষ ছুটাছুটি করছিল। স্টেজে অলরেডি আগুন লেগে গেছে। সবাই প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ে চলে যাচ্ছে। ছোট্ট নয় মাসের তৃষা তখন চিত্রার কোলে।

তার চোখ গিয়ে ঠেকে আছে স্টেজে থাকা ছোট্ট তন্ময়ের দিকে। সবাই নামছে স্টেজ থেকে কিন্তু কেউ তন্ময় কে নামাচ্ছে না। কথায় আছে বিপদে পড়লে মানুষ আগে নিজের প্রাণ বাঁচায়। নিজের প্রাণ বাঁচাতে অন্যের প্রান চলে যাক তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। ছোট্ট তন্ময় ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন কখনই হয় নি। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের দিকে তো বোনের দিকে তাকাচ্ছে। অধরা বারবার চিত্রা কে টানছে বের হতে কিন্তু চিত্রা এক পা ও নড়ছে না। তন্ময়ের দিকে চেয়ে ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে বলল-

-“ অধরা আপা আমার তন্ময় স্টেজে। আপা আমার তন্ময় কে বাঁচাও না।
অধরা তাকাল স্টেজে। ছোট্ট তন্ময় ভয়ে গুটিয়ে আছে।
-“ আমি এখনই তন্ময়ের কাছে যাচ্ছি অধরা। তুমি তৃষা কে নিয়ে বের হও। আগুন ছড়িয়ে যাচ্ছে তো।
অধরা ছোট লাগালো স্টেজের দিকে। চিত্রা ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। কিন্তু তৃষ্ণা চিত্রা কে আর দাঁড়িয়ে থাকতে দিলো না। হাত টেনে বাহিরে নিয়ে গেলো।

প্রায় মিনিট বিশেক হয়ে যায় অধরা তন্ময়ের আসার নাম নেই। আগুন আরো ভয়াবহ রূপ ধারন করেছে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এসেছে আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে। চিত্রা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। গলা ছেড়ে অধরা তন্ময় কে ডাকতে লাগলো। কিন্তু কেউ কোনো সাড়াশব্দ দিলো না। চিত্রার বুক ধক করে উঠছে। তৃষ্ণা টাও কাছে নেই। চিত্রা আশেপাশে তাকালো। চিত্রার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে এক মধ্য বয়সী মহিলা। চিত্রা তার সামনে দাঁড়িয়ে অস্থির কন্ঠে বলল-

-“ খালা আমার বাচ্চা টাকে একটু রাখবেন? আমার ছেলেটা আগুনের ভেতর এখনও আছে। প্লিজ একটু রাখুন না আমি ছেলেটাকে নিয়েই আসি।
মহিলা টা তৃষা কে কোলে তুলে নিলো। চিত্রা আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না। ছুট লাগালো,চিত্রার ছুট লাগানো দেখে এক ফায়ার সার্ভিসের লোক বলে উঠল-

-“ আরে এই মহিলা কে কেউ আটকান। আগুন কন্ট্রোলের বাহিরে চলে গেছে।
কিন্তু ততক্ষণে চিত্রা ভেতরে ঢুকে যায়। স্টেজের কাছ টায় আসতেই দেখে অধরা তন্ময় কে কোলে নিয়ে সতর্কতার সাথে নামছে স্টেজ থেকে। অধরার হাতের এক পাশ পু’ড়ে গিয়েছে। চিত্রা দৌড়ে আসলো ওদের কাছে। ছেলেকে অধরার থেকে নিজের কোলে নিলো। তন্ময়ের পুরো মুখে অসংখ্য চুমু দিলো। অধরা তার পু’ড়ে যাওয়া হাতের দিকে একবার তাকিয়ে বলে-

-“ চিত্রা আমাদের বের হতে হবে। দেখো আগুন ছড়িয়ে যাচ্ছে।
চিত্রা মাথা ঝাকালো। অধরা কে নিয়ে বেরিয়ে আসলো আগুন থেকে। বাহিরে এসে ছেলে কে কোলে নামিয়ে পাশে তাকালো। ঠিক এই খান টাতেই তো ঐ মহিলার কাছে তার তৃষা কে রেখে গিয়েছিল। ঐ মহিলা তো নেই। পুরো বাহির টা হন্নে হয়ে খুঁজলো চিত্রা কিন্তু ঐ মহিলার ছায়াও খুঁজে পাওয়া গেলো না। চিত্রা মেয়েকে খুঁজে না পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলে অধরা ধরে ফেলে।
তৃষ্ণা একটু সাইডে গিয়েছিল। রাফিকে ফোন করে এখান কার অবস্থা জানাতে। চিত্রা কে অধরার উপর পড়ে যেতে দেখে অস্থির কন্ঠে বলে-

-“ কি হয়েছে আপু চিত্রার।
-“ তৃষা কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
কথাটা যেনো বাজের মতো এসে লাগলো মাথায় তৃষ্ণার। তৃষা তো চিত্রার কোলেই ছিলো।
-“ কি বলছো আপু। তৃষা তো চিত্রার কোলেই ছিলো।
অধরা সব খুলে বলল তৃষ্ণা কে। সব শুনে তৃষ্ণার মাথায় হাত। তড়িঘড়ি করে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে তুষার কে বলল।

তুষার কথাটা শোনা মাত্রই ছুটে আসে। চিত্রা তখনও সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে।
তুষার ইমিডিয়েটলি পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে। পুরো লোক লাগিয়ে হন্নে হয়ে খোঁজা শুরু করে মেয়েকে। তুষার চিত্রা কে নিয়ে হসপিটালে যায়। চিত্রার জ্ঞান ফিরা জরুরি। কি করে পারলো মেয়েটাকে যারতার কাছে দিতে?
হসপিটালে আনার ঘন্টা খানেক পর চিত্রার জ্ঞান ফিরে। চিত্রা জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর থেকে তৃষার খোঁজ চায়।

তুষার শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে কেনো সে মেয়েকে অচেনা মহিলার কাছে দিলো। চিত্রা সব বলে। তুষারের রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। এরমধ্যে পুলিশ আসে। মহিলাটার ফেস স্কেচ করার জন্য। কিন্তু চিত্রা তো মহিলা টার ফেস দেখে নি। ওড়না দিয়ে ঢাকা ছিলো। পুলিশ হতাশ হলো। জিজ্ঞেস করলো-

-“ কিচ্ছু কি দেখেন নি? তার ফিটনেস, চোখ নজড় কারার মতো কোনো জিনিস?
চিত্রা মনে করার চেষ্টা করলো। বেশ খানিকরা পর বলে উঠল-
-“ হ্যাঁ মনে পড়েছে। মহিলাটার কপালে আড়াআড়ি ভাবে দুটো ক্রস চিহ্ন ছিলো সম্ভবত কে’টে যাওয়ার চিহ্ন ওটা।
-“ আর কিছু মনে আছে?

চিত্রা না জানালো। ছোট্ট তন্ময় বাহিরে কান্নাকাটি করছে বোনের জন্য। রোমিলা বেগম সামলাচ্ছে বাচ্চা টাকে। অধরা কেবিনে শুয়ে আছে পুড়ে যাওয়া হাতে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে।
তুষার রেগে বাহিরে চলে গেছে। একটু পর পর একে ওকে ফোন করে জিগ্যেস করছে কোনো খোঁজ পেলো কি না। কেউ কোনো খোঁজ দিতে পারলো না।

পরের দিন সকালে,,,
পুলিশ এসেছে খাঁন বাড়িতে। চিত্রা পুরো অসুস্থ হয়ে পড়েছে মেয়েকে না পেয়ে। পুলিশ জিজ্ঞেস করলো তুষার কে তার কোনো শত্রু আছে কি না? তুষার ভেবে না জানালো। আকবর বা হালিম সরকারের সাথে প্রায় বেশ কিছু বছর ধরে যোগাযোগ নেই। তুষার অগোচরে খোঁজ নিয়েছিল তাদের হাত নেই এসবে। পুলিশ অফিসার তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল-

-“ তাহলে এখন মুক্তিপণের অপেক্ষায় থাকতে হবে। মহিলা টা যদি মুক্তিপণের উদ্দেশ্যে কিডনাপ করে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই ফোন দিবে।
তুষার রেগে উঠলো। দাঁত চেপে বলল-
-“ তার জন্য কি খোঁজা বন্ধ করে দিবেন? আমার মেয়েকে যেভাবে হোক আমার সামনে চাই। আকাশ পাতাল তোলপাড় করে হলেও খুঁজে এনে দিবেন।

-“ কিন্তু আপনার ওয়াইফ তো কোনো ক্লু দিতে পারলো না।
-“ যেটুকু দিয়েছে সেটার সূত্র ধরে খুঁজুন। আর আগুন টা লাগলো কি করে জানা গেছে?
-“ জ্বি। শর্টসার্কিটে আগুন লেগেছে। এটা এক্সিডেন্টলি ঘটেছে।
-“ আর ইউ শিউর?
-“ জ্বি ইনভেস্টিগেটর করে এটাই জানা গেছে।
-“ আমার মেয়ের খোঁজ করুন।
পুলিশ অফিসার মাথা নাড়িয়ে চুপচাপ চলে গেলো।

প্রায় পাঁচ দিন কেটে গেলো। কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি ঐ ছোট্ট তৃষার। খাঁন বাড়িতে শোকের ছায়া ছেয়ে গেছে। ছোট্ট তন্ময়ের দু চোখের বিষ হয়ে গেছে চিত্রা। চিত্রার ছেলের দিকে ধ্যান নেই। ছোট তৃষার জামাকাপড় বুকে জড়িয়ে কেঁদে কেটে দিন পার করে। তুষার সারা দিন মেয়ের খোঁজ করে রাতে বাড়ি ফিরলে চিত্রা দরজার পানে তাকায় এই আশায় তুষার তার রত্ন কে নিয়ে ফিরেছে। কিন্তু ফিরে না,তুষার খালি হাতে ফিরে।
তুষারের সারা রাত ঘুম হয় না। চিত্রা কে সামলাতে সামলাতে তার ঘুম আর আসে না।

প্রায় একমাস হয়ে গেলো মেয়ের খোঁজ আর পেলো না খাঁন পরিবার। চিত্রা এখন আর কাঁদে না, চোখের জল ফুরিয়ে গেছে। ছোট্ট তন্ময়ের মুখের এক বাক্য তাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
চিত্রা ঘরকুনো হওয়ার পর থেকে তন্ময়ের দেখভাল অধরা,তৃষ্ণা, রোমিলা বেগম ই করছেন। ছোট্ট তন্ময় বারবার বোন কে চাইছে। কত গুলো দিন হয়ে গেলো বোন কে সে দেখে না ছুঁতে পারে না। তৃষ্ণা খাবার নিয়ে বসে আছে। তন্ময় কিছুতেই খাবে না। তৃষ্ণা হাঁপিয়ে গিয়েছে। তন্ময়ের মুখের সামনে খাবার ধরতেই তন্ময় রাগে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। রাগ নিয়ে বলল-

-“ বললাম না খাবো না। আমার বোন কে এনে দাও। মায়ের জন্য আমি আমার বোন কে হারিয়ে ফেলছি। আই হেট মাই মম। আই হেট হার।
চিত্রা তখন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিলো। তন্ময়ের মুখে এই কথাটা শুনে তার পা থেমে যায়। বুকের ভেতর টা দুমড়ে মুচড়ে উঠলো। দৌড়ে ছেলের কাছে আসলো। টেনে বুকে জড়িয়ে ধরতেই ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলো। সেই থেকে মা ছেলের মাঝে দূরত্ব এখনও সেই দূরত্বই রয়েছে।

তন্ময় এখনও দাবি করে তার বোন কে তার মায়ের দোষেই হারিয়েছে। বোন কে হারানোর পরের বছর থেকেই তন্ময় হোস্টেলে থাকা শুরু করলো। কলেজ ভার্সিটি হোস্টেলে থেকেই শেষ করেছে। খুব কম এসেছে বাড়ি। তৃষা হারিয়ে যাওয়ার বছর চারেক পর অধরা দেশের বাহিরে চলে যায়। ভালো একটা কোম্পানি থেকে জবের অফার পাওয়ায়। তন্ময় তখন নাইনে পড়ে।

একদিন তন্ময় জানতে পারে তাদের এতিমখানায় পুতুলের মতো একটা মেয়ে এসেছে। তন্ময় সেদিন ছুটে আসে সেই পুতুল কে দেখতে। পুতুলের মতো দেখতে তুলি কে অজান্তে নিজের বোনের জায়গায় বসিয়েছে। তবুও নিজের বোনের আক্ষেপ টা থেকেই যায়। সেজন্য নিজের বোন কে খুঁজার জন্য সে সিআইডি তে যোগ হয়েছে বছর দেড়েক হলো।

দশতালা বিল্ডিংয়ের আট তলায় বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে এক মধ্য বয়সী রমণী। শরীরে শুভ্র রঙের শাড়ি। দৃষ্টি তার আকাশ পানে থাকা জ্বলজ্বল করতে থাকা লক্ষ্য লক্ষ্য তারার মাঝে থালার মতো থাকা চাঁদের দিকে। পুরনো কিছু তিক্ততা বড্ড ঝলসে দিচ্ছে তার হৃদয় কে। এতো বছর পেরিয়ে গেলো তবুও সেই আগের দিনগুলোতেই যেনো থেমে আছে অধরা। চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনা জল। সবচেয়ে জ্বলতে থাকা তারা টার দিকে তাকি মুচকি হেঁসে বলল-

-“ কেমন আছেন ওপারে প্রিয়তম? বড্ড মনে পড়ে আপনাকে। আবার ফিরছি আপনার শহরে বেশ অনেক গুলো বছর পর। আপনি কি ধরা দিবেন আবার এই রমণী কে, কোনো পাখির বেশে না হয় কোনো শীতল হাওয়ায় মিশে। শরীরের জ্বালা টাকে কমিয়ে দিয়েন একটু। হাঁপিয়ে গিয়েছি অনেক। বড্ড ক্লান্ত যে।

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পরিচ্ছেদ ২ পর্ব ৪

( এক এক করে সআ রহস্য উন্মোচন করবো। আর রাতুল যাকে দেখার জন্য এতো অপেক্ষা আপনাদের। রাতুল কে নিয়ে কিচ্ছু বলবো না। কোনো ক্লু ও দিবো না। আর এই বেশ অনেক চরিত্র, জানি আপনাদের মনে রাখতে কষ্ট হয়। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। সামনে আরো চরিত্র আসবে। তারা আরো রহস্যময়ী। )

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পরিচ্ছেদ ২ পর্ব ৬