কুসুম কাঁটা পর্ব ৯

কুসুম কাঁটা পর্ব ৯
সাবিকুন নাহার নিপা

মাঝরাতে শ্রাবণ্যর ঘুম ভাঙলো ফোনের শব্দে। অ্যালার্মের জন্য ফোন সাইলেন্ট রাখে না। ও টের পাওয়ার আগে স্বপ্নীল টের পেল। স্বপ্নীলের পায়ের দিকে রাখা ছিলো। ওর ঘুম ভাঙলো, শ্রাবণ্যকে ডেকে বলল,
“ফোন টা ধরো তাড়াতাড়ি। ”
শ্রাবণ্য শুনেও অতো গুরুত্ব দিলো না। তিন বার বাজার পর স্বপ্নীল উঠে ফোন টা হাতে নিয়ে বলল,

“ও শ্রাবণ্য ওঠো, তোমার আপু ফোন করছে।”
শ্রাবণ্য উঠলো অনিচ্ছায়। বলল,
“দিতে থাকুক। এখন কেউ কাউকে দেয়। ”
স্বপ্নীল সময় দেখলো। দুটোর বেশী বাজে। বলল,
“মনে হয় কোনো বিপদ হয়েছে। তুমি কলব্যাক করো। ”
“হলে হোক, আমার তাতে কিছু যায় আসে না। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

স্বপ্নীল বিস্মিত গলায় বলল,
“তুমি এভাবে কেন কথা বলছ শ্রাবণ্য, স্বার্থপরের মতো। ”
শ্রাবণ্য চোখ খুলে তাকালো ভালো করে। স্বার্থপর শব্দ টা কানে লাগলো ভীষণ। স্বপ্নীল তখনও ওর দিকে তাকিয়ে আছে জিজ্ঞাসু চোখে। স্বপ্নীলের গলার স্বর এবার নরম হলো। বলল,
“তোমার আপুর বিপদ হতে পারে। তোমার কলব্যাক করা উচিত। ”

আকাশী দাঁড়িয়ে আছে মাঝরাস্তায়। হ্যাপি আপার বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে। আকাশীর গাল ভেজা, এতক্ষন কেঁদেছে। এখন আর কাঁদছে না, গলার কাছে কেমন অবশ ভাব। সামনে একটা হসপিটাল দেখা যাচ্ছে, ওখানে গেলে মনে হয় রাতের বাকী সময় টুকু কাটিয়ে দেয়া যাবে। তবে এখন আর ভয় নেই। যে ভয় পেয়েছিল!
হ্যাপি আপার হাবভাব ওর পছন্দ হয় নি। ওনাকে ভদ্রমহিলা ভাবলেও ভেতরে ইবলিশের বসবাস সেটা আকাশী স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি। ওই বয়স্ক লোকটা যাবার পর হ্যাপি আপাকে ফোন করে আকাশীর কথা কী যেন বলেছে। ও স্পষ্ট শুনতে পায় নি। তবে হ্যাপি ফোন রেখে বলল,

“ভাইজান রে তোর কথা বললাম। সে তোর কথা শুনে বলল একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিবে অতিদ্রুত। ”
“কিন্তু আপা আমার তো গ্রাজুয়েশন এর সার্টিফিকেট নাই। কমপ্লিট হয় নাই। ”
“আরে সমস্যা নাই। ভাইজানের কাছে চাকরিতে সার্টিফিকেট লাগবে না। ”
আকাশী শুকনো ঢোক গিলে বলল,
“পার্লারের চাকরি আমার খারাপ লাগে না আপা। আমার অন্য চাকরির দরকার নাই। ”

“আরে এইগুলান কী বালছালের কাজ করবি! পার্লারে কাজ করা আর বাসায় বুয়াগিরি করা একই। ভাইজান বলছে তোর চেহারা ভালো আছে, চাকরিতে সমস্যা হবে না। অফিসের বসদের পিএস হইতে কোনো সমস্যাই হবে না। কোনো কাজ নাই এসব জায়গায়। আরামে মোবাইল দেখবি। সপ্তাহে একদিন দুইদিন প্রাইভেট টাইম স্পেন্ড করবি। দেখবি এরপর আর তোর পিছনে ফিরে তাকাইতে হবে না। ”

আকাশী সব টা শুনলো। হ্যাপি সরাসরি বুঝিয়ে দিলো ও’কে কী কাজ করতে হবে। কোনো তর্কে গেল না। বলল,
“আপা আমি আপনার বাসায় থাকব না। ”
হ্যাপি আপা শান্তস্বরে কথা বলা আকাশীকে অতো গুরুত্ব দিলেন না। বললেন,
“কই যাবি বাদাইম্যা জামাইর কাছে। একটা সোজা জিনিস বুঝাইয়া দেই, ব্যডা মানুষ সব ই এক। ওই বাদাইম্যার সাথে থাইকা কিছু পাবি না। কিন্তু সেই সময় টা অন্য জায়গায় দিলে লাখ লাখ টাকার মালিক হইতে বেশী সময় লাগবে না। ”
আকাশী রাগে কাঁপছিল। বলল,

“আমি এখনই যাব আপা। আপনি আমার সঙ্গে ঝামেলা করবেন না। আপনার বাসার ঠিকানা, মোবাইল নাম্বার সবকিছুই আমার বোনের কাছে দেয়া আছে। ও আপনাকে ছাড়বে না। ”
হ্যাপি আপার কপালে ভাজ পড়লেও মুখের হাসি টা মিলিয়ে গেল না। বলল,
“আরে যা যা। তুই আমার বা*ল করবি। বের হ আমার বাসা থেকে। ”
আকাশী বের হওয়ার সময় হ্যাপিকে চার হাজার টাকা দিয়ে আসলো। এই ক’দিন থাকা খাওয়ার খরচসহ। হ্যাপি টাকা হাতে নিয়ে বলল,

“আমার অফার মনে ধরলে ফোন করিস। এই লাইনে একবার গেলে লাইফ সেট হয়ে যাবে।”
আকাশী বেরিয়ে এলো রাস্তায়। মানুষ না চিনতে পারার দু:খে ভীষণ কাঁদলো। সব মানুষেরই কী এমন দুইটা রূপ থাকে!

খানিকক্ষণ কেঁদে কেটে ঘড়িতে সময় দেখলো। প্রায় দুটোর কাছাকাছি। এতো সময় পেরিয়ে গেছে! চারদিকে এতো উজ্জ্বল আলো যে দেখে বোঝার উপায় নেই। ফোন বের করে হাতে নিলো। এই দুনিয়ায় এখন দুজন মানুষ ই আছে যাদের রাত, বিরাতে ফোন করা যায়৷ একজন ভাবী, আরেকজন শ্রাবণ্য। ভাবীকে ফোন করলো, তার নাম্বার টা যথারীতি বন্ধ আছে। রাতে ফোন বন্ধ করে ঘুমায়। বাকী রইলো শ্রাবণ্য। ও তো ছোট মানুষ! কী আর সাহায্য করতে পারবে। নতুন বিয়ে হওয়া শ্বশুর বাড়িতে আশ্রয় দিতে চাইলেও সেটা নেয়া উচিত না।
সাত, পাঁচ ভেবে শেষমেস শ্রাবণ্যকেই ফোন করলো।

শ্রাবণ্য কল ব্যাক করে বিরক্ত গলায় বলল,
“আপু এটা কী ফোন করার সময়? আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম।”
আকাশী কিছু বলল না। নি:শব্দে চোখের জল বিসর্জনের শব্দ শ্রাবণ্য শুনতে পেল না। ও জিজ্ঞেস করলো,
“কী হয়েছে?”
আকাশী বলল,

“আমি রাস্তায় আছি বনু। আমার কোথাও যাবার জায়গা নেই। আমি এখন কী করব?”
এতো রাগের মাঝেও শ্রাবণ্যর ভীষণ খারাপ লাগলো। স্বপ্নীলের সামনে থেকে উঠে গিয়ে চাপা গলায় বলল,
“কী হইছে তোর আপু? শুভ ভাইয়া ঠিক আছে? ”
আকাশী ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল,
“আমি অনেক দিন আগে শুভর বাসা ছেড়ে আসছি বনু। ”
শ্রাবণ্য অবাক গলায় বলল,
“কেন?”

আকাশী সংক্ষেপে যা বলার বলল। শ্রাবণ্য সব শুনলো। আকাশী ও’কে প্রশ্ন করলো,
“আমি এখন কী করব শ্রাবণ্য?”
শ্রাবণ্য চুপ করে থাকে। মেয়েদের জীবনে এই মুহুর্ত টা বোধহয় সবসময় ই আসে। আকাশী যেদিন শুভর হাত ধরে পালিয়ে এলো সেদিন রেহানা হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, ও শ্রাবণ্য আমি এখন কী করব! মানুষজন রে কেমনে মুখ দেখাব!

শ্রাবণ্যর জীবনেও এমন একটা দিন এসেছিল। ও শিউলিকে কাতর গলায় জিজ্ঞেস করেছিল, আমি এখন কী করব?
আজ আকাশীও সেই একই অসহায় প্রশ্নের মুখোমুখি। শ্রাবণ্য সময় নেয়। বলে,
“আমি দেখছি। কোথায় আছিস তুই। পুলিশ বক্সে গিয়ে দাঁড়া। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফোন করছি। ”

স্বপ্নীল জিজ্ঞেস করলো,
“কোনো সমস্যা শ্রাবণ্য?”
“হ্যাঁ। আমার আপু বাসা থেকে ঝগড়া করে বেরিয়ে এসেছে?”
“এখন কোথায়? ”
“রাস্তায়। ”
“তোমাদের বাড়িতে যাবে না?”

“না। আমার বাবার কাছে ও মরে গেছে। বাবা এখন সবাইকে বলে আমি তার একমাত্র মেয়ে। ”
স্বপ্নীলের গলার স্বর কোমল হলো। বলল,
“আমি বুবুকে জাগাই। তুমি তোমার আপুকে আসতে বলো। এই বাড়িতে গেস্ট রুম আছে। উনি এখানে থাকবেন। ”
“না থাক। ”
“কেন?”
“আমি অন্য ব্যবস্থা করছি। ”
“কী ব্যবস্থা করবে?”

শ্রাবণ্য স্বপ্নীলের কথার জবাব না দিয়ে আফরিন কে ফোন করলো। হোস্টেলে ওর সিট টা এখনো আছে। তিন মাসের এন্ট্রি করা। অন্য কাউকে ওঠানোর কথা না। তবুও আফরিন কে ফোন করে কনফার্ম হয়ে নিলো।
শ্রাবণ্য আকাশীকে ফোন করে হোস্টেলের ঠিকানা দিলো। বলল, সিএনজি নিয়ে যেতে।

কুসুম কাঁটা পর্ব ৮

যতক্ষন না পৌছায় ততক্ষন যেন ফোনে ওর সঙ্গে কথা বলে। সবচেয়ে ভালো হয় পুলিশ বক্সে যারা আছে তাদের কেউ সিএনজি খুঁজে দিলে। আকাশী সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলো।
হঠাৎ আকাশীর মনে হলো শ্রাবণ্যর যে বুদ্ধি আছে সেই বুদ্ধি ওর নেই। ওর আসলে বুদ্ধিই নেই কোনো।

কুসুম কাঁটা পর্ব ১০