তুমি এসেছিলে বলে পর্ব ২৯

তুমি এসেছিলে বলে পর্ব ২৯
নাদিয়া আক্তার সিয়া 

বিকাল সাড়ে ৪ টা। সবার ভীষণ ব্যস্ততা। সৌরভ এসেছে স্বপরিবার নিয়ে মিথিলার হাত চাইতে। রান্নার দিকটা বড়রা সামলে নিয়েছে। সিমরান, শাম্মী, মেহসান আর সৌম আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। ড্রয়িং রুমে সৌরভ লজ্জায় রাঙ্গা মুখখানা নিয়ে বসে আছে। মুখে নাজুক নাজুক ভাব। রৌফ, সিয়াম, সামির পিঞ্চ মারতে ছাড়েনি।

মেহতাব আর আহতাব ওদের পাশে বসেই হাসছে। সৌরভের মা সুহা বেগম আর বাবা আনোয়ার সাহেব বসে আছেন পাশের সোফাতে। তারা এই সম্বন্ধে বেশ খুশি। আনোয়ার সাহেব আর মিনহাজ সাহেব পুরনো বন্ধু। এই বন্ধুত্ব গভীর সম্পর্কে রূপান্তর হবে তা ভেবে তারা খুব খুশি। মিনহাজ চৌধুরী তাদের সাথে আলাপ আলোচনায় মেতে উঠেছেন। বহু ব্যস্ততার মাঝে এতদিন পর দেখা। অরিন বেগম, ইতি বেগম আর শিমু বেগম ট্রেতে খাবার এগিয়ে দিলেন। সুহা বেগম শুধালেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— এতো আয়োজনের কী দরকার।
অরিন বেগম হেসে বলে উঠলেন,
— এইটুকু আয়োজনকে এতো বড় করে দেখবেন না আপা।
মিনহাজ চৌধুরী মেহতাবকে মিথিলাকে ডেকে আনতে ইশারা করলেন। মেহতাব সোফা থেকে উঠে সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে গেলো।
মিথিলার সাজগোজ শেষ আপাদত প্রশংসার পর্যায় চলছে। দরজায় করাঘাতের শব্দ পেতেই শাম্মী দরজা খুলে দিল। মেহতাব তাড়া দিয়ে বলে উঠলো,

— অল কমপ্লিট?
শাম্মী হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।
— ঠিকাছে। মিথিলাকে নিয়ে আয়।
অহনা, শাম্মী, সিমরান মিথিলাকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। মেঘ পা বাড়াতেই পিছন থেকে নিজের হাতে টান অনুভব করলো। সবাই মিটিমিটি হেসে দরজা ভিড়িয়ে চলে গেলো। মেঘ পিছনে ফিরে মেহতাবকে বলে উঠলো,

— ছাড়ুন যেতে হবে। সবাই কী ভাবছে?
— ভাবার কী আছে? আমরা তো প্রেমিক প্রেমিকা নই? আমরা হাসবেন্ড ,ওয়াইফ এন্ড ইট’স লিগাল।
এই বলে মেহতাব মেঘের ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিলো। মেঘ ঈষৎ কেঁপে উঠলো। মেহতাব মেঘকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করলো। মেঘ লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো। লজ্জা ভীষণ ভাবে কাবু করলো তাকে। মুখ থেকে কথা বেরনোর জো নেই। মেহতাব স্মিত হেসে বলে উঠলো,

— এইটুকু ছোঁয়াতে এই অবস্থা! আর সবাই মিহির আসার হরতাল শুরু করে দিয়েছে। আমার উপর ১৪৪ ধারা জারি করেছে।
‘মিহি’ নামটা কর্নপাত হতেই মেঘের ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেলো। মেহতাব কে সরিয়ে বলে উঠলো,
— মিহি কে?
মেহতাব হাত পিছনে নিয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে উঠলো,
— ফিউচারে বুঝে যাবে।

এই বলে মেহতাব মেঘের অনেক কাছে চলে এলো। মুখটা মেঘের কানের কাছে এনে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
— সন্ধ্যায় সারপ্রাইজ আছে। ওয়েট ফর’মি।
এই বলে এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে মেহতাব রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। মেঘ স্থির দৃষ্টিতে মেহতাব বের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষনেই ওষ্ঠাধর প্রসারিত করে মুচকি হাসলো। রিনরিনিয়ে বলে উঠলো,
— মেহতাব কাছে আসলে দেহ শিউড়ে কেনো ওঠে?
নিজের কথার মানে নিজেই বুঝতে পেরে ম্লান হাসলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পরখ করে নিলো। মুচকি হেসে শুধাল,

— ভালোবাসলে হয়ত এমনি হয়। যাকে মন থেকে চাই তার ছোঁয়াতে ভালোলাগা বিচরন করে, দেহ শিউড়ে ওঠে!
মাগরিবের আজান দিয়েছে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। আকাশে কালো মেঘেরা ভির জমিয়েছে যেকোনো সময় বৃষ্টি হয়ে ধরণীতে নামবে। মেঘ মেহতাবের বলা শেষ কথাটা অর্থাৎ সারপ্রাইজের কথা ভাবছে। কিসের সারপ্রাইজের কথা বলেছে মেহতাব? মেঘ জানালা ধরে দাড়িয়ে আছে। দৃষ্টি বাইরে দূর আকাশে। মেহতাব বের আসার অপেক্ষা শুধু। এতো ধৈর্য্য সম্পন্ন মেয়েটার হৃদয়ও আজ ব্যাকুল হয়ে আছে। সময় যেনো আজ ফুরাতে চায় না।
বাড়িতে বেশ জমজমাট পরিবেশ। মিথিলা আর সৌরভের বিয়ের পাকাপাকিভাবে কথা হয়ে গেছে। সামনের শুক্রবার বিয়ে আর বৃহঃস্পতিবার গাঁয়ে হলুদ হবে সেই মোতাবেক বিয়েটা এগোবে।

বাড়ির ছেলেরা নামাজ পড়তে গেছে। আর বাড়ির মেয়েরা সবাই নামাজ শেষ করে দ্বিতীয় তোলার বৈঠকখানায় বসে আছে। অরিন বেগম , ইতি বেগম আর শিমু বেগম তাদের পুরনো দিনগুলোর কথা বলছেন। অহনা,মেঘ, মিথিলা,শাম্মী, সিমরান এতক্ষন কথাগুলো শুনছিল। মেঘকে ভাবুক দেখাচ্ছে! মিথিলা,সিমরান,শাম্মী মেঘের উপর কড়া নজরদারি চালু রেখেছে। হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ ভেসে আসলো।

মেঘ তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বেরিয়ে সদর দরজা খুলতে দৌঁড় লাগালো। সিড়ি দিয়ে নামার সময় মেঘের নূপুরের রিনঝিন আওয়াজ শোনা গেলো মাত্র। মেঘ যেনো বিদ্যুতের গতিতে ছুট লাগালো। এতো তাড়া! বেশ অদ্ভুত লাগলো সবার। পরক্ষনেই সবার মুখের অদল হাসিতে রূপান্তর হলো। সবাই মিটিমিটি হাসছে। মেহতাবকে চোখে হারাচ্ছে মেঘ। সবাই এই নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করতে লাগলো। অরিন বেগম বুকে প্রশান্তি অনুভব করলেন। বুকের উপর থেকে ভারী কিছু সরে গেলো যেনো! মেহতাব আর মেঘ স্বাভাবিক স্বামী স্ত্রীর মতো জীবন কাটাচ্ছে। ভাবতেই আলাদা প্রশান্তি!

মেঘ তড়িঘড়ি করে সদর দরজা খুলে দিল। এক এক করে সবাই প্রবেশ করলো। মিনহাজ সাহেব মেঘের মাথায় হাত বুলিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন। আহতাব মুখে হাসি ঝুলিয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেলো। সবাই ঢুকেছে এখন শুধু মেহতাব আর তার বন্ধুরা দাড়িয়ে আছে। রৌফ মুচকি হেসে বলে উঠলো,
— মেহতাবের জন্য অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো অবশেষে।
সৌরভ হেসে বলে উঠলো,

— আমার জন্য মিথিলা নামক নারী কবে এইভাবে মনমরা হইয়া দরজার আড়ালে দাড়াইয়া থাকবো? ভাবতেই বুকটা ধুক করে কেঁপে ওঠে।
সিয়াম মুখ টা বাঁকিয়ে বলে উঠলো,
— বেশরম কথাবার্তা। নাউজুবিল্লাহ।

ওরা এইসব কথাবার্তা বলতে বলতে ভিতরে প্রবেশ করলো।মেহতাব মেঘের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলো। সেও বুঝতে পেরেছে তার প্রেয়সী তার জন্যই অপেক্ষা করেছে। সবাই নিচে নেমে ড্রইংরুমে এসে বসে পড়লো। আজ বাড়িটা মানুষের সরাগমে বেশ মো!মো! করছে। বড়রা সবাই উপরের বৈঠকখানায় চলে গেলো। বাচ্চারা এতদিন পর এক হয়েছে একান্ত সময় কাটাক সবাই মিলে। মেহতাবের দাদীর ভিডিও কল এসেছে। উনি আসতে পারেন নি কিন্তু সৌরভ আর মিথিলার কথা শুনে তিনি খুব খুশি হয়েছেন।

আপাদত বাড়ির বাকি ছেলে মেয়েরা সবাই এক জায়গায় বসেছে। বাইরে বৃষ্টি‍র দাপাদাপির শব্দ ঘরেও শোনা যাচ্ছে। একাধারে বৃষ্টির শব্দ বেশ মনোমুগ্ধকর! শীতল শিরশিরে বাতাস বহমান, ঘরেও তার ঠাই বোঝাই যাচ্ছে। এই শিরশিরে ঠান্ডা বাতাস সবাইকে অদ্ভুত এক অনুভুতির জানান দিচ্ছে। কেউ দুলছে , কেউ খাচ্ছে কেউ বা চোখের ইশারায় কথা বলে যাচ্ছে। বেশ রোমান্টিক একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। অহনার বিশ্রামের সময় হওয়ায় আহতাব তাকে নিয়ে নিজেদের রুমে চলে গেছে।

মেহতাব চোখের ইশারায় বাকিদের কিছু বলতেই তারাও ঝটপট কেটে পড়লো। এখন শুধু তিনটি জিনিস বিদ্যমান। মেহতাব,মেঘ আর নিস্তব্ধতা। সবাই চলে যাওয়াতে মেঘ হতবিহ্বল হয়ে পড়লো। মেঘের অবস্থা দেখে মেহতাব ঠোঁট কামড়ে হাসছে। মেঘ হাসির কারণটা ধরতে পারছেনা। তবে অসস্তির থেকে লজ্জাটা বেশি লাগছে। লজ্জায় মুখখানায় লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে। মেহতাবের বেশ অদ্ভুত একটা ইচ্ছা জেগেছে! ভীষণভাবে ইচ্ছে করছে মেঘের লাল টুকটুকে গাল দুটো ছুঁয়ে দিতে। আপাদত ইচ্ছে টাকে পোষণ করে গভীর ভাবে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে বলে উঠলো,

— ভালোবাসো আমায়?
হঠাৎ ভালোবাসা শব্দটা কর্ণ অবধি পৌঁছাতেই মস্তিষ্কের শাখা-প্রশাখা নাড়া দিয়ে উঠলো মেঘের। আমরা আমতা করলো কিছুক্ষণ। মেহতাব ওই একই গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যেনো আকুল আর্জির জানান দিয়েছে। মেঘের একটা শব্দে যেনো দুনিয়া তোলপাড় করতেও থামবে না। মেঘ অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,
— হঠাৎ এই প্রশ্ন?
মেহতাবের সোজা উত্তর,
— না কি হ্যাঁ‍?

মেঘ মেহতাবের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলাতে পারছেনা। তার বুকের ভিতর তোলপাড় চলছে। অদ্ভুত এক অনুভুতির সাগরে ডুবে যাচ্ছে! মেহতাবের দৃষ্টিতে কিছু একটা আছে ‍যা তাকে কিছু বলতে চায়। মেহতাব কী ভালোবাসে তাকে? মেহতাব অধৈ‍র্য হলো না সে একই ভাবে তাকিয়ে আছে। সে অপেক্ষা করছে মেঘের উত্তরের আশায়। মেঘ অস্পষ্ট স্বরে ওষ্ঠ প্রসারিত করে বলে উঠলো,
— হুমম।

হুমম বলে আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সকল আলো চলে গেলো। মেঘ উঠে দাড়াতে যাবে হঠাৎ নিজেকে হাওয়ায় ভাসমান অনুভব করলো। মেহতাব তাকে কোলে তুলে নিয়েছে। হঠাৎ এই কাজে মেঘ ভয়ে মেহতাব বের শার্ট খামচে ধরেছে। বাইরে থেকে বজ্রপাতের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সেই আলোতেই মাঝে মাঝে মেহতাবের মুখ দেখতে পাচ্ছে সে। মেহতাব যেনো চাঁদ হাতে পেয়ে গেছে মেঘের একটা উত্তরে মুখে তার তৃপ্তির হাসি।

মেঘের ঘোর কাটিয়ে মেঘকে দার করিয়ে দিলো দরজার সামনে। মেঘ মেহতাবের মুখে তাকাতেই সে ইশারায় দরজা খুলতে বললো। মেঘ দরজা খুলতেই হতবাক। মোমবাতির নিভু নিভু আলোয় ঘরের অল্প অল্প দেখা যাচ্ছে। ফুল দিয়ে সাজানো ঘর তার প্রিয় ফুল সাদা গোলাপ। কখন করলো এইসব মেহতাব? অবাকের চরম পর্যায় অবস্থান করে সে ঘরে ঢুকে পড়লো। হঠাৎ মেহতাব এগিয়ে এসে মেঘের সামনে হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়লো। একটি হীরের আংটির বক্স খুলে এগিয়ে দিলো। বক্স থেকে নীল আভা বের হচ্ছে হীরে টা জ্বলজ্বল করছে। মেহতাব মুচকি হেসে বলে উঠলো,

— আমি জানতাম তুমি আমায় ভালোবাসো। কিন্তু তোমার মুখ থেকে স্বীকার করাতে চাইছিলাম।
— আপনি জানতেন?
— হুমম।
— আমিও জানতাম আপনি আমায় ভালোবাসেন।
— সত্যি?
— হুমম। যাকে ভালোবাসি তার মনের কথা বুঝবোনা।
মেহতাব কিঞ্চিৎ হাসলো। মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখে শূধাল,

তুমি এসেছিলে বলে পর্ব ২৮

— জানতে বলোনি কেনো?
— আপনি নিজে এসে বলবেন সেই অপেক্ষায় ছিলাম।
— হুমম ভালোবাসি ভীষণ যা তুমি কল্পনাও করতে পারবেনা। যেই কাছে আসার গল্প বিয়ে নামক প্রবিত্র বন্ধন দিয়ে শুরু সেই সম্পর্কে ভালোবাসা নামক অনুভুতি দিয়ে আরেক ধাপ এগোনো যায় না। ভালোবাসি তোমায়, বাসবো, বেসে যাবো। ডোন্ট ইউ ওয়ান্ট টু বি মাই লাভ? মাই জান।
মেঘ স্মিত হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। মেহতাব আংটিটা মেঘের হাতে পড়িয়ে দিলো।মেঘ এগিয়ে এসে মেহতাবকে জড়িয়ে ধরলো। মেহতাব আরো শক্তপোক্তভাবে মেঘকে জড়িয়ে ধরলো।

তুমি এসেছিলে বলে পর্ব ৩০