তুমি এসেছিলে বলে পর্ব ৩১

তুমি এসেছিলে বলে পর্ব ৩১
নাদিয়া আক্তার সিয়া 

সবাই বাড়িতে ফিরেছে বেশ বেলা করে। কেনাকাটা করে রেস্টুরেন্টে খেয়ে দেয়ে একেবারে বাসায় ফিরেছে। গাড়ি পার্ক করে সবাই একসাথে ভিতরে প্রবেশ করলো। বাড়ির সাজগোজ কমপ্লিট। অরিন বেগম হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে সবাইকে তাড়া দিলেন রেডি হতে। কিছুক্ষণ পর গেস্টরা এসে পড়বে। মিথিলার গাঁয়ে হলুদের অনুষ্ঠান সন্ধ্যার দিকে পালন করা হবে। তাই কেউ আর দিরুক্তি না করে নিজেদের রুমে চলে গেল রেডি হতে।

সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেছে। মেঘ কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি পরেছে ম্যাচিং ব্লাউজের সাথে। কানে বড় ঝুমকো পড়েছে, হালকা মেকআপ। এতেই তাকে ভারী মিষ্টি লাগছে! মেঘ বেরোতে যাবে চোখ দরজায় ঠেস হয়ে দাড়িয়ে থাকা ব্যাক্তির দিকে গেলো। পড়নে হলুদ রঙের শার্ট। বেশ ভাবসাব নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।মেঘ দেখেও না দেখার ভান করে যেতেই। মেহতাব গলা খাঁকারি দিলো। মেঘ তবুও ফিরে তাকালো না। এবার মেহতাব ছুটে এসে পিছন থেকে মেঘের হাত ধরলো। মেঘের খোঁপায় হাত দিয়ে সন্তর্পনে কিছু একটা করলো। মেঘ হাত রাখতেই বুঝে গেলো গোলাপের গাজরা। মেঘ খুশি হলো তবুও প্রকাশ করলো না। মেহতাব কানের কাছে মুখ এনে ঘোর লাগা কন্ঠে শুধালো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মেহতাব : এতো সুন্দর না হলেও পারতে?
মেঘ মুচকি হাসলো। মেহতাব এর দিকে কড়া নজরে তাকালো। ভাবুক কন্ঠে বলে উঠলো,
মেঘ : আপনি পাঞ্জাবি কেনো পড়েননি?
মেহতাব বেশ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ভঙ্গিতে বললো,

মেহতাব : যতদিন বউ আমায় নিজের হাতে পাঞ্জাবি পড়িয়ে দিচ্ছে না, ততদিন পড়বো না বলে ব্রত করেছি।
মেঘ মেহতাবের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। মেহতাব ইতস্তত করে বলে উঠলো,
মেহতাব : সমস্যা নেই বউ। পাঞ্জাবি আমি নিজেই পড়তে পারবো কিন্তু তুমি চাইলে আমি তোমাকে শাড়ি পড়িয়ে দিতে পারি। আমার দিক দিয়ে কোনো আপত্তি নেই।

মেঘ কথাগুলো শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো। লোকটা ইদানিং উদ্ভট কথাবার্তা বলে। মেঘকে লজ্জায় ফেলতে ওস্তাদ লোকটি। মেঘ বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলো। গালে হাত রেখে নিজেকে শান্ত করলো। গাল দুটো আবার গরম হয়ে গেছে। মেহতাব মুচকি হেসে পিছন থেকে বলে উঠলো,

মেহতাব : যেখানেই যাও দেখা তো আবার আমার সাথে হবেই। ❝মেয়ে ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি তোমায়।❞
শেষ কথাটা মেহতাব বেশ জোড়ে বললো। আশেপাশে তাকাতেই দেখতে পেলো সবাই তার দিকে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কী অদ্ভুত সেই চাহনি! হুল্লোড় পার্টির গ্যাং নিচেই ছিলো তারা চাইলেও হাসি থামাতে পারলো না। মিটিমিটি হাসতে লাগলো। কেউ ঠোঁট কামড়ে, কেউ মুখ চেপে তো কেউ বা প্রকাশ্যে হেসে উঠলো। মেহতাব কে এই প্রথম তারা এভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করতে দেখেছে। সবার বেশ ভালো লেগেছে!

গাঁয়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু করা হয়েছে প্রায় দুই ঘণ্টা আগে। এতক্ষন গান বাজনা চালালেও। এখন পরিবেশ টা বেশ শান্ত। মিথিলাকে হলুদ মাখিয়ে সবাই ভূত করে দিয়েছে। মিথিলা চেঞ্জ করে রুমের ভিতর সৌরভের সাথে কথা বলছে। সব মেহমানরা বাসায় চলে গেছে। কাছের কয়েকজন গেস্ট উপরের খালি রুমে গুলোতে শুয়েছে। সবাই ভীষণ ক্লান্ত থাকায় নিজেদের মতো যার যার রুমে ঘুমাচ্ছে। এখন শুধু মেহতাব আর মেঘ জেগে রয়েছে। মেঘ টুকিটাকি কাজ করে নিচ্ছে। মেহতাব সোফায় বসে তার দিকেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বেগুনি রঙের শাড়ি পরে আঁচল কোমরে গুঁজে সে এক ধ্যাঁনে কাজ করছে। মেহতাব চুপি চুপি মেঘকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। মেঘের কাধে থুতনি রেখে নেশালো কন্ঠে বলে উঠলো,

মেহতাব : চলো না উপরের রুমে একটু আলাদা টাইম স্পেন্ড করি।
মেঘ মেহতাববের হাত সরিয়ে বলে উঠলো,
মেঘ : ছাড়ুন অনেক কাজ।
মেহতাব : স্টাফরা করে নিবে।
মেঘ : স্টাফদের জন্য এতো কাজ ফেলে রাখা মোটেও উচিত নয়।
মেহতাব : হুশ যাবে কি যাবে না?
মেঘ : যাবো না।

মেহতাব : এখন যদি আমার সঙ্গে না যাও তুলে নিয়ে যাবো। ওয়ার্নিং দিচ্ছি।
মেঘ : আপনার যা ইচ্ছে করুন। আমি যেতে পারব না।
মেঘের কথায় মেহতাব কান না দিয়ে মেঘকে কলে তুলে নিয়ে হাঁটা শুরু করে দিল। মেঘ ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করেও পারছে না সুঠাম দেহীর লোকটার সঙ্গে। মেহতাব যেই ড্রয়িংরুম পেরোবে। মারজা বেগম হাজির হলেন পিছু পিছু হুল্লোড় পার্টির সদস্যরা ও। মারজা বেগম হেসে বলে উঠলেন,

মারজা বেগম : পুতির মুখ কবে দেখাইবা?
মারজা বেগমের কথায় লজ্জা পেয়ে মেহতাব মেঘকে ওখানেই দাড় করিয়ে রেখে কেটে পড়লো। সবাই সমস্বরে হেসে বলে উঠলো,
“দাদী তুসি গ্রেট হো”
মারজা বেগম মেঘের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে চলে গেলেন নিজের রুমে। সবাই সোফাতে বসে পড়লো। শাম্মী বলে উঠলো,

শাম্মী : ভাইয়ার মুখটা দেখার মতো ছিলো।
সিমরান : একদম।
সিয়াম মেঘের দিকে তাকিয়ে নেকা কান্না কেঁদে বলে উঠলো,
সিয়াম : মেঘ আমার নিষ্পাপ দোস্ত টাকে দেখে রেখো।
রৌফ সিয়ামের সঙ্গে যোগ দিয়ে বলে উঠলো,
রৌফ : যারে হাতে ধইরা বড় করছি সে আজ অন্য মেয়ের জামাই।
মেহসান : ওভারএকটিং বন্ধ করো ফর গড সেইক।
সামির অভার লোডেড হয়ে বলে উঠলো,

সামির : অতো আমার কোলে ১ নাম্বার কতো করছে। আজও আমার সেই ভেজা পেন্ট স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছি এখনো শুকোয় নি।
সৌম বলে উঠলো,
সৌম : চাপা মারার লিমিট কার্ড এখনও দেয়নি নাকি তোমাদের।
শাম্মী পা দুটো সোফায় উঠিয়ে বলে উঠলো,
শাম্মী : আজাইরা কথা। ভাইয়া যখন ছোট তুমি কি তখন দামড়া ছিলা‍।

সবাই হেসে উঠলো। সবাই সবার মতো কথা বলে যাচ্ছে। কেউ কারো পিছু লাগতে ছাড়েনি। মেঘ সোফায় বসে ওদের খুনসুটি গুলো দেখছিল। সবাই একসাথে থাকলে কতো হাসি-খুশি থাকে! বাড়িটাও প্রাণ ফিরে পায় যেনো।
সবাই কথা বলে রুমে ঘুমাতে চলে গেছে। ঘড়ির কাঁটায় এখন ৩ টা বাজতে ২০ মিনিট দেখাচ্ছে। মেঘ তপ্ত শ্বাস ফেলে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে যাবে তখনি গাড়ির হর্নের শব্দ ভেসে এলো। মেঘ কৌতূহল বশত সদর দরজা খুলতেই মেহতাব কে জিপে বসে থাকতে দেখতে পেলো। পড়নে ব্ল্যাক জ্যাকেট আর ব্ল্যাক পেন্ট। মেঘ অবাকের সহিত প্রশ্ন ছুড়ে বলে উঠলো,

মেঘ : এখানে কী করছেন?
মেহতাব : পেত্নীদের থেকে বউ পটানোর কৌশল অবলম্বন করার চেষ্টা করছি।
মেঘ : ফালতু কথা বলবেন না। বলুন কি করছেন?
মেহতাব : বউয়ের জন্য অপেক্ষা করছি। বউ বড্ড আনরোমান্টিক তাই একটু লং ড্রাইভে নিয়ে যেতে চাই যাতে বাইরের প্রকৃতিতে ভিতরের ফিলিংসের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

মেঘ : ঠিকাছে আপনি বউয়ের জন্য অপেক্ষা করুন আমি ঘুমাতে গেলাম।
মেঘ এই বলে যেতেই মেহতাব জোড়ে জোড়ে হর্ন বাজানো শুরু করলো। মেঘ রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। মেহতাব ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে এখনও বসে আছে। নিরবতা ভেঙে বলে উঠলো,
মেহতাব : জান আসো প্লিজ। নাহলে আমি হর্ন বাজিয়ে সকলের ঘুমের ৩ টা বাজিয়ে দিবো। তিনটা বাজতে এখনো ১৫ মিনিট আছে, যাও রেডি হয়ে এসো।

মেঘ : ব্ল্যাকমেল করছেন।
মেহতাব কোমল সুরে বললো,
মেহতাব : এই প্রথম কোন কিছুর জন্য অনুরোধ করছি। আশা করবো এই প্রেমিক পুরুষকে নিরাশ করবে না।
মেহতাবের এই অনুরোধ কে ফিরিয়ে দেওয়ার মতো সাধ্য মেঘের নেই। মেঘ কিছু না বলে চলে গেলো। মেঘ রেডি হতে গেছে এটা মেহতাব জানে। এই বুদ্ধি কাজে লেগেছে, বুদ্ধিটা অবশ্য সৌরভের ক্রেডিট তাকেই দেওয়া যায়।
৫ মিনিট বাকি ৩ টা বাজতে, মেহতাব একই ভাবে বসে আছে। মেঘের আসার অপেক্ষা শুধু। আজ পূর্ণিমার রাত চাঁদের আলোয় চারিদিক আলোকিত হয়ে আছে। নিস্তব্ধ পরিবেশ এতো রাতে কারো জেগে থাকার কথাও নয়।

ফেব্রুয়ারি মাসে শীত খুব বেশি না পড়লেও আজ শীত অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশি। হঠাৎ মেঘের আবির্ভাব ঘটলো । মেহতাব কাভার্ডে একটা কালো শাড়ী কিনে লুকিয়ে রেখেছিল। মেঘ সেটাই পড়েছে। কোনো কৃত্রিম প্রসাধনী ব্যবহার করে নি। তবুও বড্ড মায়াবী লাগছে! মেহতাব চাইলেও চোখ সরাতে পারছে না। মেঘের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো মেহতাব। মেঘ মুচকি হেসে উঠে পড়লো। মেহতাব চাঁদের আলো মিশ্রিত হাসি দিয়ে মৃদু স্বরে বলে উঠলো,

মেহতাব : ❝ভালোবাসি❞
মেঘ এক দৃষ্টিতে মেহতাবের দিকে তাকিয়ে রইলো। মেহতাবের গভীর দৃষ্টি দেখে মেঘের হৃদ স্পন্দন যেনো শতগুন বেড়ে গেলো!

মেহতাব জিপ চালাচ্ছে। মাঝেমধ্যে আড়ালে মেঘের দিকে দুই একবার তাকাচ্ছে। মেঘ এক দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে। শীতল শিরশিরে বাতাস তার মধ্যে এই নির্জনতা বেশ ভালো লাগছে! মেহতাব হঠাৎ জিপ কোথাও একটা দাড় করালো। নিজে নেমে মেঘের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। মেঘও নেমে পড়লো। পূর্ণিমার রাত হওয়ায় চারিদিক আলোকিত। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এটা কোনো দীঘি। মেহতাব এগিয়ে যেতে লাগলো মেঘও তাকে অনুসরণ করে এক স্থানে বসলো। মেহতাব ফিসফিসিয়ে বললো,

মেহতাব : ভালো লাগছে?
মেঘ মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। মেহতাব মেঘের কপালে ওষ্ঠ ছুঁয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
মেহতাব : তোমাকে শেষ নিশ্বাস অব্দি আগলে রাখবো, ভালোবেসে যাবো অবিরাম।
মেঘ মুচকি হাসলো। মেহতাবের ঘাড়ে মাথা রেখে হাত বাড়িয়ে বললো,

তুমি এসেছিলে বলে পর্ব ৩০

মেঘ : আমায় ছুঁয়ে বলুন।
মেহতাব স্মিত হেসে মেঘের হাতে হাত রাখলো।

তুমি এসেছিলে বলে পর্ব ৩২