তুমি এসেছিলে বলে পর্ব ২৮

তুমি এসেছিলে বলে পর্ব ২৮
নাদিয়া আক্তার সিয়া 

নতুন বছরের দিনগুলো প্রতিদিনের মতো ব্যাস্ততায় কেটেছে মেঘের। গভীর রাত প্রায় ৪ টা ছুঁই ছুঁই। মেঘ গভীর ঘুমে মগ্ন। জানালার পর্দার ফাঁকফোকর দিয়ে চাঁদের আলো ঘরে ঠাঁই পেয়েছে। হঠাৎ ঘাড়ে কারো গরম নিশ্বাস টের পাচ্ছে মেঘ। কারো বাহুডোরে আবদ্ধ সে। তড়িঘড়ি করে উঠে হনহনিয়ে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে ধরাম করে নিচে পড়ে গেল মেঘ। মেঘের পড়ে যাওয়ার শব্দ পেয়ে লোকটি ঘুম মগ্ন অবস্থায় পিটপিট করে তাকালো। মেহতাবকে দেখে মেঘ চিৎকার করতে যাবে। মেহতাব এসে মুখ চেপে ধরলো।

— করছো কী? শাট আপ। এটা আমি মেহতাব কোনো ভূত নই।
মেঘ মুখ থেকে মেহতাবের হাত সরিয়ে কোমরে হাত দিয়ে উঠে দাড়াতে গিয়ে আবার ধপাশ করে পড়ে গেলো। মেহতাব মেঘকে হাত ধরে উঠিয়ে দিলো। মেঘ মেহতাবকে পা থেকে মাথা অব্দি স্ক্যান করলো। পাশের টেবিল ল্যাম্প জ্বালালো। টেবিল ল্যাম্পের আলোতে ঘরে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে সবকিছু। মেহতাবের দিকে দৃষ্টি যেতেই মেহতাবের গভীর দৃষ্টি আর মুখে শয়তানি হাসি দেখে বুঝতে বাকি রইল না সে অপ্রস্তুতকর পরিস্থিতিতে আছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এপাশ ওপাশ না তাকিয়ে বিনাবাক্যে নিচে পড়া থাকা ওড়না নিয়ে দৌড় দিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করতে গিয়ে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিলো। মেহতাব স্মিত হেসে আবার শুয়ে পড়লো । একে তো জার্নি করে এসেছে আবার বউ তাকে ভুলে গেছে। মনে করাতে হবে একটু রোমান্টিকভাবে। এই ভেবে বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় বসে পড়লো।
মেঘ ফ্রেশ হয়ে এসেছে। মেহতাব কে বসে থাকতে দেখে বলে উঠলো ,

— আপনি হঠাৎ না বলে হুট করে চলে এলেন?
— কেনো সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম, খুশি হও নি?
— না তেমন কিছু না, তাহলে রান্না করে রাখতাম।
আপনি কি খাবেন?
— এনিথিং ভালোবেসে যা বানিয়ে দিবে।

মেঘের বেশ সন্দেহ হচ্ছে মেহতাবের মধুর বাণী শুনে । এটা মেহতাব নাকি কোনো ভূত প্রেত । যাই হোক রোমান্টিক বটে!আপাদত এইসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে গাঁয়ে শাল জড়িয়ে নিচে কিচেনের উদ্দেশ্যে চলে গেলো।
কিচেনে রান্না করছে মেঘ। সামির ঘরের দরজা খোলা দেখে কিছু না ভেবে ঢুকে পড়লো। এমনিতেও আজকে সৌরভের সম্মন্ধ নিয়ে আসবে মিথিলার জন্য। তাই বাকিরা সৌরভের বাড়িতেই বর পক্ষ হিসেবে আসবে। এই বাড়িতেই মেয়ে দেখবে। একে তো সৌরভ তাদের সম্পর্ক গোপনে রেখেছে কিন্তু যাই হোক বিয়েতে খাবারের দিকের দায়িত্ত্ব সে নেবে সে বলে দিয়েছে। তাই সে কনের বাড়িতেই থাকবে। মুচকি হেসে মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে বলে উঠলো ,

— খাবার মানে সামির। সামির মানে খাবার। খাদ্যসৃঙ্খল ভঙ্গ করা কার সাদ্ধি আমি খাবার খেয়ে তা রক্ষা করবে। দুনিয়া বিলুপ্ত হয়ে যাক, খাবার তুই আমার থাক।
এইসব ভাবতে ভাবতে কিচেনে তাকিয়ে থমকে যায় সে। অন্ধকারে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না কে? সাদা চাদর টা শুধু চোখে পড়েছে। কিন্তু রাতে তো ডাইনি, পেত্নীরা সুন্দর ছেলেদের ধরে ব্রেকফাস্ট সাড়ে ।
— আমি তো একদম দেখতে নাদুস-নুদুস দুই বেলার জন্য পারফেক্ট।

নিজের কথার মানে নিজে বুঝতে পেরে, ওখানেই অজ্ঞান হয়ে ধপ করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো সামির।
সকাল হয়ে গেছে। সবাই বাড়িতে বেশ হাসিখুশি মেহতাব ফিরে এসেছে তাই। অরিন বেগম আর বাকিরাও সকল ব্যাস্ততা ছেড়ে এক হয়েছে। শুধু অহনা আসতে পারেনি আহতাব অহনার কাছে গিয়েছে তার সাথে কয়েকদিন থাকার জন্য। ব্রেকফাস্ট টেবিলে সবাই একসাথে বসে নাস্তা করছে। মিনহাজ সাহেবের জরুরি কল আসায় বসা থেকে উঠে চলে গেলেন। সামির চুপচাপ নড়াচড়া বিহীন বসে আছে । টেবিলে এতো খাবার সাজানো সামিরের তার প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সবাই বেশ লক্ষ্য করেছে মিটিমিটি হাসছে।

— খাচ্ছ না কেন বাবা?
অরিন বেগমের স্নেহময়ী গলা শুনে সামির কথা না বাড়িয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে খাওয়া শুরু করলো। মেহসান তা দেখে বলে উঠলো,

— ভাইয়া তো সেই পেত্নীর সাথে আলাপ- সালাপ কেমন হলো? কবে খাবে তোমায়? কোনো ডেট ফিক্সড করেছে?
মেহসানের কথা শুনে সবাই মুখ টিপে মিটিমিটি হাসলো। মেহসানের দিকে অরিন বেগম রাগী দৃষ্টিতে নিক্ষেপ করলেন। মেহসান আর কিছু বললো না। সবাই ব্রেকফাস্ট শেষে সোফায় বসে পড়লো। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো। মেঘ গিয়ে দরজা খুলতেই মিথিলা , সিমরান , শাম্মী আর সিমু বেগম প্রবেশ করলেন সঙ্গে মেহতাবের মামী ইতি বেগম আর সৌমও এসেছে। ইতি বেগম আর শিমু বেগম মেঘকে জড়িয়ে ধরলেন। অরিন বেগম এগিয়ে এসে শিমু বেগম আর ইতি বেগম কে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলেন। সিমরান,শাম্মী,মিথিলা মেঘের দিকে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো একসাথে। সৌম হাই টেনে বলে উঠলো,

— সরো তোমরা। ভাবীকে আমার সাথে কথা বলার সুযোগ দেও। তিনজন এতো ফ্যাট রাখো কোথায়?
সৌমের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভিতরে প্রবেশ করে সবাই সোফায় বসে পড়লো। সবাই বসে বসে আলাপ আলোচনা করছে। মেহতাবের মুখোমুখি মেঘ বসেছে। মেঘের পাশে মিথিলারা আর মেহতাববের পাশে সামির প্লেট থেকে মিষ্টি খাচ্ছে। মেহতাব গালে হাত দিয়ে একদৃষ্টিতে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে মেঘের বেশ লজ্জা লাগছে। সিমরান আর বাকিরাও বেশ লক্ষ্য করেছে। হঠাৎ মেঘের ফোনে টুং করে আওয়াজ হলো। মেঘ ফোনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই মেহতাব এর মেসেজ দেখতে পেলো। সবার চোখের আড়ালে মেসেজ টা পড়ে নিল।

— উপরে এসো আ’ম ওয়েটিং।
মেঘ সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো মেহতাব সিড়ি দিয়ে উপরে যাচ্ছে। মেঘের ভীষণ রাগ হলো। একেই তো বাড়িতে এতো মানুষ। তাদের চোখের আড়ালে কিভাবে যাবে? মেঘ হঠাৎ দাড়িয়ে বলে উঠলো,

— মা আমার ফোন টা ঘরে রেখে এসেছি। অহনা আপুকে জানিয়ে দিয়ে আসি বিকেলে এই জায়গায় চলে আসতে।
অরিন বেগম মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে আবার গল্প করতে লাগলেন। মেঘ তড়িঘড়ি করে উপরে চলে গেলো। সিমরান, শাম্মী, মিথিলা, মেহসান আর সৌম এতক্ষন বেশ মনোযোগ দিয়ে মেঘকে পর্যবেক্ষণ করেছে। মেঘ এক নিশ্বাসে কথা গুলো বললো যেনো অনেক তাড়া। বেশ অদ্ভুত! অন্যদিকে সামির খেয়েই চলেছে যেনো কতো দিন না খেয়ে ছিলো। সামির কে পাত্তা না দিয়ে তারা মেঘের উপর গোয়েন্দা গিরি করতে উপরে চলে গেলো।
মেঘ ঘরে প্রবেশ করতেই মেহতাবকে দেখতে পেলো না। না কোথাও নেই? ভিতরে ঢুকতেই কেউ পিছন থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো। দরজা আটকানোর শব্দ পেতেই মেঘ পিছনে ফিরে তাকালো। মেহতাব কে দেখে বলে উঠলো,

— কেনো ডেকেছেন?
— কেনো ডাকা বারণ?
— না আজকে মিথিলাকে দেখতে আসবে। কাজ তো কম নয় বলুন?
— হুম বেশী সময় নিবো না ,জাস্ট ফাইভ মিনিট।
এই বলে মেহতাব পিছন থেকে কিছু একটা বের করলো। মেঘ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
— কি এটা?
— তোমার গিফট’স।
— আমার?
— না আমার আরো বউ আছে তাদের জন্য এনেছি।

মেহতাবের কথা শুনে মেঘ প্যাকেটটা বিছানায় রেখে দিলো। মুখটা শুঁকনো করে বলে উঠলো,
— তাহলে আমায় কেনো দিচ্ছেন?আমি গেলাম।
এই বলে মেঘ দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে সবাই এক জনের উপর অন্যজন পড়ে গেলো।
মেহতাব ওদের উপর স্থির দৃষ্টি রেখে বলে উঠলো,
— তোরা?
সবাই একসাথে কিঞ্চিৎ হেসে বলে উঠলো,

— আমরা আমরাই তো।
পিছন থেকে সামির বলে উঠলো,
— আমি কী তাইলে গাঙের জল থেইকা ভাইসা আইছি।
সামিরের কথা শুনে মেহতাব আফসোসের সুরে বলে উঠলো,

তুমি এসেছিলে বলে পর্ব ২৭

— যে আসুক না আসুক। আমার প্রজন্ম আসার কোনো চান্স নেই।
মেঘ মেহতাবের কথার মানে বুঝতে পারলো না। সবাই আহাম্মকের মতো অদ্ভুত ভঙ্গিতে মেহতাববের মুখের পানে চেয়ে রইলো।

তুমি এসেছিলে বলে পর্ব ২৯