আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পরিচ্ছেদ ২ শেষ পর্ব

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পরিচ্ছেদ ২ শেষ পর্ব
Raiha Zubair Ripte

পশ্চিমা আকাশে সূর্য ঢলে পড়তেই শহর জুড়ে আধার নেমে আসলো। খাঁন পরিবারের সবাই শপিংয়ে এসেছে তুলি সায়ানের বিয়ের শপিং করতে। যে যার মতো শপিং করছে। সায়ান তুলি কে আলাদা করে নিয়ে গেলো সাইডে। লেহেঙ্গার দোকানে ঢুকে বলল-

-“ বিয়েতে কি নিবেন বেনারসি নাকি লেহেঙ্গা?
তুলি লেহেঙ্গা গুলে উল্টেপাল্টে দেখলো। একটাও পছন্দ হলো না। বেনারসির দিকে চোখ পড়তেই মেরুন রঙের এক বেনারসি তে চোখ আটকে গেলো। সায়ান তুলির দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো বেনারসি গুলোর দিকে।
-“ কোন টা পছন্দ হয়?
-“ মেরুন রঙের শাড়ি টা।
সায়ান দোকানদার কে শাড়িটা বের করতে বলে। দোকানদার শাড়ি টা বের করে সামনে আনে। তুলি উল্টেপাল্টে দেখে। বেশ মনে ধরেছে শাড়ি টা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“ শুধু একটা দেখলেই হবে? আরো দেখুন।
-“ আর পছন্দ হচ্ছে না তো।
-“ এতো লেহেঙ্গা শাড়ির মধ্যে একটাও পছন্দ হচ্ছে না?
-“ না।
সায়ান শাড়ির পেমেন্ট করে তুলিকে নিয়ে অন্য দোকানে গেলো।
-“ এখানে এক্সক্লুসিভ ডিজাইনের শাড়ি লেহেঙ্গা, থ্রিপিস এভরিথিং আছে। এখন নিশ্চয়ই পছন্দ হবে। চয়েস করুন।
তুলি শাড়ি, লেহেঙ্গা, থ্রিপিস সব এক এক করে দেখলো। এতো সুন্দর যে কোনটা রেখে কোন টা নিবে বুঝতে পারলো না।

-“ পছন্দ হচ্ছে না?
-“ হচ্ছে বাট কোনটা রেখে কোনটা নিবো বুঝতে পারছি না। আপনি একটু সাহায্য করুন না।
-“ আমি!
-“ হু।
-“ ওকে।
সায়ান সব ঘেঁটে তিনটে শাড়ি,একটা লেহেঙ্গা, আর চারটে থ্রিপিস সিলেক্ট করে বলল-

-“ হবে এগুলো পছন্দ?
তুলি পোশাক গুলে দেখলো। কালার গুলো খুব সুন্দর। মাথা ঝাকিয়ে বলল-
-“ হ্যাঁ পছন্দ হয়েছে। আপনার চয়েস আছে বলতে হবে।
সায়ান পোশাক গুলো প্যাকেট করতে দিয়ে বলল-
-“ আজ জানলেন আমার চয়েসের খবর! যেখানে আস্ত আপনি টাকে চয়েস করে বসে আছি আমি। সেখানে এই পোশাক গুলো তো নগ্ন মাত্র।

তুলি আড়চোখে তাকালো। সায়ান পেমেন্ট করতে ব্যাস্ত। পেমেন্ট শেষে তুলি কে নিয়ে গয়নার দোকানে গেলো। ডায়মন্ডের কিছু গয়না কিনে জুতা কসমেটিক কিনে নিলো। তুলির শপিং শেষ এখন সায়ানের পালা৷ সায়ান নিজের জন্য মেরুন রঙের শেরওয়ানী কিনলো তুলির বেনারসির সাথে ম্যাচ করে৷ তারপর বউ ভাতের জন্য ব্লু কালারে স্যুট কিনলো। তুলি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সায়ানের কেনাকাটা দেখলো। ভালোই কেনাকাটা করতে পারে লোকটা।
চিত্রা নিজের জন্য শাড়ি কিনেছে। তুষার আসে নি। তুষারের জন্য পাঞ্জাবি কিনতে গিয়ে ব্লাক কালারের একটা পাঞ্জাবি তে চোখ আঁটকে যায় চিত্রার। লোকটা কালো রঙ ভীষণ পছন্দের। চিত্রা দোকান দার কে বলল পাঞ্জাবি টা প্যাক করে দিতে। প্রিয়তম পুরুষ কে কালো রঙে বেশ মানায়।

-“ তোর হলো তৃষ্ণা?
তৃষ্ণা শাড়ি উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে মনমরা হয়ে বলে-
-“ একটা কিছুও পছন্দ হচ্ছে না রে চিত্রা। তুই সিলেক্ট করে দে না।
চিত্রা তপ্ত শ্বাস ফেলে তৃষ্ণা কে শাড়ি সিলেক্ট করে দিলো।
সবার কেনাকাটা শেষ হলে রাতের ডিনার টা একেবারে রেস্টুরেন্টে খেয়ে তারপর বাসায় আসে।
দোলন বাসায় এসেই বিছানায় শুয়ে পড়ে। শপিংমলে ঘুরাঘুরি করতে করতে জীবন তার আধমরা হয়ে গেছে।
তন্ময় ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে দোলন কে বিছানায় দেখে বলে-

-“ ফ্রেশ হয়ে তারপর ঘুমাও দোলন।
দোলন চোখ বন্ধ রেখেই বলল-
-“ শরীর চলছে না আর। আজ আর না হই ফ্রেশ।
-“ শরীরে বাহিরের ধুলাবালি লেগে আছে দোলন। কুইক উঠো আর ফ্রেশ হয়ে আসো।
দোলন শোয়া থেকে উঠলো। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলো। তন্ময় বিছানা ঝাড়া দিলো। দোলন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল টাওয়াল দিয়ে মুছতে লাগলো। তন্ময় বিছানায় আধশোয়া হয়ে বলল-

-“ গোসল করলে এত রাতে।
-“ হ্যাঁ অস্বস্তি লাগছিলো যে।
-“ সকালেও তো গোসল করা লাগতে পারে। একেবারে সকালেই করতে।
দোলন ভ্রু কুঁচকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তন্ময়ের দিকে। তারপর ভেজা টাওয়াল তন্ময়ের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলে-
-“ ঘুম পাচ্ছে ভীষণ আমি ঘুমাবো। জ্বালাবেন না একদম রাতে।
তন্ময় টাওয়াল টা সাইডে রেখে মোবাইল ফোনে সময় দেখে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ায়। এলোমেলো বিন্যাসে দোলনের দিকে এগিয়ে এসে বলে-

-“ এগারো টা বেজে গেছে অলরেডি দোলন। ঘুম পাচ্ছে।
-“ আমি কি ধরে রেখেছি নাকি। ঘুমান না গিয়ে।
-“ তোমাকে জড়িয়ে না ধরলে আমার ঘুম আসে না মেয়ে।
-“ তো আমার করণীয় কি?

-“ এই তো বেশি কিছু না। ঝটপট বিছানায় এসে আমার বুকে মাথা রাখবে। আর আমি জাপ্টে জড়িয়ে ধরবো।
দোলন গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। তন্ময় লাইট নিভিয়ে বিছানায় এসে দোলন কে টেনে দোলনের মাথা বুকে রাখলো। দোলন এক হাত দিয়ে তন্ময় কে জড়িয়ে ধরলো। তন্ময় দোলনের কপালে চুমু খেয়ে বলল-
-“ নাও ঘুমিয়ে পড়ো এখন। কাল থেকে কাজে লেগে পড়তে হবে তো। তোমার ননদের বিয়ে বলে কথা।
দোলন আর কিছু বললো না। ঘাপটি মেরে তন্ময়ের সাথে লেপ্টে ঘুমিয়ে পড়লো।

সকাল হতেই খাঁন বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান তেমন ঘটা করে হবে না। তুলি সায়ানের এক সাথেই গায়ে হলুদ হবে। সায়ানের ফ্যামিলি বলতে তো কেউ নেই রাতুল ছাড়া।
তো সক্কাল সক্কাল রাতুল সায়ানের বাসায় গিয়ে সায়ান কে নিয়ে এসেছে। তুষার নিজেই বলেছিল সায়ান কে গিয়ে আনতে।
সায়ান সহ বাড়ির সকল পুরুষ ব্রেকফাস্ট করছে। দোলন, চিত্রা খাবার বেড়ে দিচ্ছে। বাহিরে প্যান্ডেলের কাজকর্ম রাফি দেখছে।

পুরুষগণ দের খাওয়া শেষ হলে মেয়েরা খেতে বসে। তুলির গলা দিয়ে খাবার যাচ্ছে না। আজ তার গায়ে হলুদ কাল বিয়ে৷ মা বাবা কে পেয়েও অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই আবার অচেনা পরিবেশে গিয়ে থাকতে হবে। চিত্রা মেয়ের পানে তাকালো৷ মেয়ে কে মনমরা হয়ে খাবার প্লেটে নাড়াচাড়া করতে দেখে তুলির কাঁধে হাত রেখে মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করে-

-“ কি হয়েছে মা খাচ্ছিস না কেনো?
তুলি চকিতে ঘুরে তাকালো মায়ের দিকে। চোখজোড়া টইটম্বুর করে উঠলো। গলা ধরা কন্ঠে বলল-
-“ খাইয়ে দিবে আমায় মা?
চিত্রা মুচকি হাসলো।

-“ আমার হাতে খাবি?
তুলি উপর নিচ মাথা ঝাকালো। চিত্রা হাত ধুয়ে মেয়েকে খাইয়ে দিতে লাগলো। তুলি তৃপ্তি নিয়ে খাবার খেলো। খাওয়া শেষে তুলিকে নিজের রুমে গিয়ে গোসল করে নিতে বললো। দুপুরের দিকে পার্লারের মেয়েরা চলে আসবে যে।
তুলি মায়ের কথা মতো রুমে এসে গোসল করে নিলো। দুপুর হতেই পার্লারের লোকেরা এসে সাজিয়ে দিয়ে গেলো তুলি কে।

চিত্রা তুলির রুমে এসে মেয়েকে গায়ে হলুদের সাজে দেখে তার নিজের বিয়ের গায়ে হলুদের কথা মনে পড়ে গেলো। মনে হলো এই তো সেদিন তার এমপি সাহেবের সাথে বিয়ে হলো। চোখের পলক ফেললেই মনে হয় দিনটা খুব দূরে নয়। কিন্তু কত বছর পেড়িয়ে গেছে তাদের বিয়ের গুনতে গেলে কয়েক সংখ্যা পাড়ি দিতে হয়।
চিত্রা কল্পনা থেকে বেরিয়ে মেয়ের কাছে এসে দু গালে হাত রেখে বলে-

-“ মাশা-আল্লাহ আমার মেয়েটাকে অনেক মিষ্টি লাগছে দেখতে।
তুলি মায়ের দিকে নজর দিলো৷ তার মা ব্লাক কালারের শাড়ি পড়েছে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে তার মা কে। বয়সের ছাপ এখনও পড়ে নি মুখে।
-“ আমার থেকেও তোমাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে মা। কেউ বলবেই না আমি তোমার মেয়ে। বলবে দু বোন।
চিত্রা খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। মেয়ের ডান হাত ধরে বলল-

-“ চল সবাই অপেক্ষা করছে তোর জন্য।
চিত্রা মায়ের সাথে হাঁটা ধরলো স্টেজের দিকে। সায়ান স্টেজে বসে ছিলো। তুলি কে স্টেজে আসতে দেখে হাত বাড়িয়ে দেয়। তুলি সায়ানের হাত টা ধরে সায়ানের পাশে বসে। তুলির শরীর কাচা হলুদ রঙের শাড়ি। শরীর জুড়ে কাঁচা ফুলের গহনা। সেই গহনা গুলো থেকে ভেসে আসছে এক মিষ্টি গন্ধ। সায়ান যতবার নিঃশ্বাস নিচ্ছে ততবারই ফুলের গহনার সুগন্ধ নাকে আসছে। সায়ান তুলির কানের কাছে মুখ টা নিলো। ফিসফিস করে বলল-

-“ ফুলের সুগন্ধের জন্য আপনার শরীরের নিজস্ব সুগন্ধী বিলিন হয়ে গেছে তুলি। যা আমাকে শান্তি দিচ্ছে না।
তুলি ফট করে সায়ানের দিকে তাকালো।
-“ খুলে ফেলি তাহলে গহনা গুলো।
-“ হলুদের শেষে খুলে আমার সামনে কিয়ৎ ক্ষন দাঁড়িয়ে থাকবেন কেমন?
-“ আচ্ছা।
তুষার চিত্রার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তুষারের শরীরে ব্লাক কালারের পাঞ্জাবি। চিত্রা তুষারের সাথে ম্যাচ করেই শাড়ি টা পড়েছে।

-“ কিভাবে সময় গুলো কত তাড়াতাড়ি চলে গেলো তাই না চিত্রা?
চিত্রা তুষারের বাহু জড়িয়ে মাথা ঠেকিয়ে দিলো।
-“ এই তো সেদিন রেস্টুরেন্টে আপনার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হলো। আপনার সাথে বিয়ে ভাঙার জন্য কত কিছুই না করেছি। সেগুলো ভাবলেই এখন হাসি পায়।
-“ একদিক দিয়ে বিয়ে ভাঙতে চেয়েছো আর অন্য দিক দিয়ে বিয়ে করতে চেয়েছো না দেখেই। বিষয় টা বেশ হাসির ছিলো।

-“ আমি জানতাম নাকি আপনার পরিচয়। কত বছর হলো জানেন আমাদের এক সাথে পথ চলার?
-“ আটাশ বছর তিন মাস ১২ দিন ম্যাডাম।
-“ বাহ গুনে রেখেছেন।
-“ তা তো রাখতে হবেই মিসেস খাঁন। এবার চলুন মেয়ে টা কে হলুদ লাগাতে হবে তো।
চিত্রা তুষার এক সাথে স্টেজের দিকে এগিয়ে গেলো। তুলি সায়ানের মুখে হলুদ ছুঁইয়ে দিলো।
এরপর একে একে দোলন,তন্ময়, রাফি,তৃষ্ণা সহ সকলে হলুদ ছুঁইয়ে দিলো।
হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হতেই যে যার রুমে চলে গেলো। তুলি নিজের রুমে এসে ফুলের গহনা গুলো খুলতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। একেবারে গোসল করে তারপর ঘুম দিবে৷ এরমধ্যে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ ভেসে আসে। তুলি দরজার কাছে গিয়ে বলে-.

-“ কে?
ওপাশ থেকে সায়ান বলে-
-“ আমি। দরজাটা খুলুন।
-“ কেনো?
-“ আহ খুলুনই না। দরকার আছে।
তুলি দরজা খুলে দিলো৷ সায়ান হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকলো। তুলি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো-
-“ কি হয়েছে?
সায়ান পাঞ্জাবির পকেট থেকে কিছু একটা বের করলো। তারপর তুলির দিকে মেলে ধরলো৷ স্বর্ণের বালা।

-“ স্বর্ণের বালা এটা।
-“ হুমম। এটা আমার মায়ের তুলি। এতোদিন আমার কাছে ছিলো। আজ থেকে এটার ভাগিদার আপনি।
-“ আমি কেনো?
-“ কারন এই বালা টা ছিলো আমার দাদির৷ সে আমার মা কে দিয়েছে বাড়ির বউ হবার পর। এখন আপনি আমার বউ হতে চলছেন। সেক্ষেত্রে এটা আপনারই প্রাপ্য। তাই আপনার টা আপনাকে দিতে এসেছি।
-“ ওহ্ আচ্ছা তাহলে পড়িয়ে দিন।
তুলি তার দু হাত বাড়িয়ে দিলো। সায়ান যত্নসহকারে বালা দুটো পড়িয়ে দিলো তুলির হাতে। তারপর তুলির হাতে চুমু খেয়ে বলল-

-“ মাশা-আল্লাহ মানিয়েছে বেশ।
তুলি হাত নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখলো।
সায়ান অপলকভাবে তুলির দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু স্বরে বলল-.
-“ আসি তাহলে । সকালে দেখা হবে ইনশাআল্লাহ বধূ বেশে।
তুলি নৈঃশব্দ্যে হাসলো। সায়ান চলে গেলো। তুলি দরজা আটকিয়ে হাত দুটো বুকে জড়িয়ে ধরলো।
সকাল হতেই চিত্রা তুলি কে ডেকে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে ওয়াশরুমে পাঠায় গোসল করতে। তুলি ওয়াশরুম থেকে আসতেই দেখে দোলন তার বিছানায়, বেনারসি গয়না সাজিয়ে বসে আছে। তুলি ভেজা টাওয়াল দিয়ে চুল মুছে সেটা বেলকনিতে মেলে দিয়ে বলে-

-“ কখন আসলে ভাবি?
-“ এই তো কেবলই আসলাম। তা শুনো আপু পার্লারের মেয়ে গুলো একটু পরই চলে আসবে। তুমি বরং রুমের মধ্যেই থাকো। তারা আসলে আমি পাঠিয়ে দিব।
তুলি মাথা নাড়ালো। দোলন চলে গেলো। এগারো টা বাজতেই পার্লারের মেয়ে গুলো তুলি কে সাজাতে শুরু করলো। খুবই সিম্পল সাজ দিয়েছে তুলি। সায়ানের গর্জিয়াছ সাজ পছন্দ না বলে। পুরো সাজ কমপ্লিট হতেই তুলি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে নেয়। নাহ্ সাজটা ভালোই হয়েছে। হাল্কা গহনা হাল্কা সাজ পারফেক্ট লাগছে।
সায়ান খাঁন বাড়িতেই রাতুলের রুমে শেরওয়ানি পড়ে রেডি হয়ে বসে আছে। রাতুল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল গুলো জেল দিয়ে ফিটফাট করছে। আবির সোফায় পা তুলে বসে আছে। সায়ান হাত ঘড়ি তে সময় দেখে বলে-

-“ আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকবো মামু?
রাতুল চকিতে ফিরে তাকালো।
-“ এই তো এখনই নিয়ে যাব তোকে উঠ।
সায়ান উঠে দাঁড়ালো। রাতুল এগিয়ে এসে সায়ানের পাগড়ী টা ঠিকঠাক করে বের হলো রুম থেকে।
সায়ান আর তুলি কে বসানো হয়েছে এক সাথে। সামনেই কাজি সাহেব বসে আছেন। তুলির উদ্দেশ্যে বললেন তুলি কে কবুল বলতে। তুলি বেনারসি টা খামচে ধরলো। গলার ভেতর থেকে শব্দ বের হতে চাচ্ছে না। চিত্রা মেয়ে কে এখনও কবুল বলতে না দেখে মেয়ের পাশে গিয়ে মেয়ের কাঁধে হাত রাখে। মৃদু কন্ঠে বলে-

-“ কবুল বলছো না কেনো মা? কাজি সাহেব তো অপেক্ষা করছেন।
সায়ান তুলির দিকে তাকালো। সবার অগোচরে তুলির বা হাত শক্ত করে চেপে ধরে চোখের ইশারায় সাহস যোগালো কবুল বলার জন্য। তুলি লম্বা একটা শ্বাস টেনে কবুল বলে দিলো। এবার সায়ান কে কবুল বলতে বললে সায়ান তুলির দিকে চেয়ে কবুল বলে দেয়।
সকলে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠে।

তুলি সায়ানের ফুলসজ্জা টা সায়ানের বাড়িতেই করার ব্যাস্থা করা হলো। রাতুল সাব্বির,লারা,রাহাত দের দিয়ে সায়ানের রুম টা সাজিয়ে রেখেছেন। সায়ান তুলি কে নিয়ে সোজা নিজের বাড়িতে চলে আসে। আসার পথে সে কি কান্না তুলি চিত্রা কে জড়িয়ে ধরে। এক ঘন্টা ধরে কান্নার পর্ব চললো। গাড়িতে বসেও নাক টানলো তুলি। সায়ান অবশ্য তুলি কে জড়িয়ে ধরে বারবার কান্না থামাতে বলছিলো কিন্তু তুলির কান্না থামছিলো না।
এখন এই ফাঁকা ফুলে সজ্জিত রুমে বসে আছে তুলি। একটু আগেই ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ওজু করে এসেছে। এখন সায়ান গেছে ফ্রেশ হয়ে ওজু করতে। সায়ান বের হতেই দু’জন দু রাকাআত নামাজ পড়ে নেয়।
তুলির শরীরে পেঁয়াজ কালারের শাড়ি। সায়ান মিষ্টি কালারের টিশার্ট পড়েছে।

আকাশে আজ থালার মতো ইয়া বড় চাঁদ উঠেছে। চাঁদ তার সম্পূর্ণ জ্যোৎস্না যেনো এই ধরণীর বুকে ঢেলে দিয়েছে। সায়ান তুলি কে নিয়ে বেলকনিতে আসলো৷ বেলকনিতে থাকা দোলনাটায় তুলি কে নিয়ে বসলো। দু’জনের ই দৃষ্টি আকাশে৷ সায়ান টাউজারের পকেট থেকে একটা ছোট্ট বক্স বের করলো। বক্স টা খুলে একটা ডায়মন্ডের রিং বের করে তুলির সামনে মেলে ধরলো। তুলি তাকালো। সায়ান ইশারায় বা হাত টা বাড়িয়ে দিতে বললো। তুলি নিঃশব্দে হাত টা বাড়িয়ে দিলো। সায়ান তুলির অনামিকা আঙুলে আংটি টা পড়িয়ে চুমু খেয়ে বলল-

-❝ চাঁদ তুমি দেখে নাও। আমার ঘরণী আজ তোমার সম্মুখে একান্ত আমারই হয়ে। তোমার জ্যোৎস্নার আলো আমার ঘরণীর কাছে ফিকে।❞
তুলি খিলখিল করে হেসে উঠলো। সায়ান তাকিয়ে দেখলো তার ঘরণীর হাসি মাখা মুখ। তুলি কে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরে বলে-

-“ ভালোবাসি আপনাকে ঘরণী । ধন্যবাদ আপনাকে আমার ঘরে একান্তই আমার হয়ে আসার জন্য। চেষ্টা করবো সব সুখ আপনার পায়ের কাছে এনে দেওয়ার। বিনিময়ে আপনি জাস্ট আমার পাশে থাকবেন মৃত্যুর আগ অব্দি কেমন?
তুলি সায়ানের বুকে মাথা রাখলো। কন্ঠে মাদকতা এনে বলল-

-❝ আকাশে থাকা চন্দ্র সাক্ষী।
তুলি হচ্ছে সায়ানের জীবনসঙ্গী।
মৃত্যুর আগ অব্দি পাশে থাকবে
আপনার এই ঘরওয়ালী।❞
সায়ান মুচকি হাসলো। এবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলো। আজ থেকে তাদের নতুন জীবনের সূচনা। কোনো দূর্ঘটনা না আসুক তার এই নতুন জীবনে।
চিত্রা ঘুমাতে পারছে না। এখনও নাক টেনেই চলছে। তুষারের এবার রাগ হলো। বিয়ে হয়েছে মেয়ের আর কেঁদেকেটে হয়রান হচ্ছে তার বউ। তুষার চিত্রা কে টেনে নিজের দিকে ঘুরালো।

-“ আর কত কাঁদবে চিত্রা? তুলির বিয়ে হয়েছে তোমার না। তোমার বিয়েতেও তুমি এতো কাঁদো নি জান। তাহলে এই বয়সে এসে এতো কাঁদছো কেনো? মেয়েকে তো দূরে বিয়ে দেই নি। এই তো কাছেই। যখন খুশি তখন দেখতে পারবে।
চিত্রা নাক টানলো। কান্নারত অবস্থায় বলল-

-“ আপনি বুঝবেন কি করে একটা মায়ের অবস্থা। আমার কান্না পেলে আমি কাঁদবো না?
-“ না আমার সামনে তোমার কোনো কান্না কাটি নেই। চুপচাপ বুকে আসো। ঘুম দিবে।
-“ কান্না করতেছি আমি। কোথায় আপনি টিস্যুর বক্স এগিয়ে দিবেন তা না করে বলছেন ঘুমাতে!
-” তো কি করবো বলো। বসে বসে তোমার কান্না দেখবো? ট্রাস্ট মি তোমার কান্না দেখার একটু ও ইচ্ছে নেই আমার।
-“ হ্যাঁ তা কেনো থাকবে। পুরানো হয়ে গেছি তো সেজন্য।
তুষার চিত্রা কে বিছানায় টেনে শুইয়ে জড়িয়ে ধরে বলে-

-“ তোমার এই অশ্রু মাখা চোখ দেখলে বুকের বা পাশ টায় ধারাম ধারাম করে কেউ যেনো হাতুড়ি দিয়ে পি’টায়। ব্যাথা অনুভব হয়। নিজেকে পিড়া দিয়ে সরি তোমার কান্না দেখতে পারবো না। আগে নিজের ভালো টা পরে অন্যের ভালো।
-“ হ্যাঁ সেলফিশ হয়ে যাচ্ছেন যে।
-“ সেল ফিশ হ্যাঁ কথাটা মন্দ বলো নি। আমি তোমার কাছে এক বিক্রিত মাছ৷ যার মালিক তুমি।
চিত্রা তুষার কে জড়িয়ে ধরলো। বুকে মুখ গুঁজে বলল-

-“ ঘুমাবো আমি।
তুষার মুচকি হেঁসে চিত্রার মাথায় হাত বুলাতে থাকে। জীবন টা এখন পরিপূর্ণ তার। নজর না লাগুক কারো আর।
সবাই যখন ঘুমে ব্যাস্ত তখন একদল ছাঁদে বসে গল্পগুজব করতে ব্যাস্ত।, দোলন তন্ময়,রাহাত রাহা,মিথিলা সাব্বির,লারা আবির।
ছাঁদে মাদুর পেতে বসে আছে তারা। জ্যোৎস্নার আলো আলোকিত করে রেখেছে ছাঁদ টাকে। মাদুরের ঠিক মধ্যি খান টায় কোল্ড ড্রিংকস, চানাচুর, স্ন্যাকস।
খাচ্ছে আর গল্প করছে। দোলনের ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। বারবার হাই তুলছে। তন্ময় ড্রিংকস এর গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলে-

-“ ঘুম পাচ্ছে?
দোলন উপর নিচ মাথা ঝাকালো। তন্ময় গ্লাস টা মাদুরের উপর রেখে সকলের উদ্দেশ্যে বলে-
-“ এটেনশন গায়েস,আমার পক্ষে আর থাকা সম্ভব না এখানে। প্রচুর ঘুম পাচ্ছে। আই নিড ঘুম।
রাহাত ও তন্ময়ের কথায় তাল মিলালো। তারও ঘুম পাচ্ছে। রাহাত তন্ময় বউ নিয়ে চলে গেলো ছাঁদ থেকে। ছাঁদে রয়ে গেলো দুই জুটি। সাব্বির মিথিলার দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ এই ছোট প্যাকেট ঘুমাবে না তুমি?
মিথিলা রাগী চোখে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল-

-“ কথায় কথায় ছোট প্যাকেট বলেন কেনো? নাম আছে আমার একটা। সেটা বলে ডাকবে।
সাব্বির চুল গুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে বলে-
-“ তোমার নাম থাকতেই পারে। বাট আই লাভ ছোট প্যাকেট নাম টা।
-“ আপনাকে তাহলে আমি আজ থেকে বুইড়া প্যাকেট বলে ডাকবো। কজ আই লাভ বুইড়া প্যাকেট নাম।
সাব্বির মুখ বাঁকালো।

-“ একদম এই নামে ডাকবে না। কল মি জান,বাবু, শোনা।
-“ ওরে আসছে আমার বাবি,শোনা,জান। গুড নাইট ঘুমাতে গেলাম ঘুম পাচ্ছে।
-” আমাকেও নিয়ে যাও।
-“ আসেন কোলে করে নিয়ে যাই।
-“ তুমি বললে কাজ টা আমিই করতে পারি। ট্রাস্ট মি মন্দ লাগবে না।
মিথিলা বসা থেকে উঠে চলপ আসলো। সাব্বিরও মিথিলার পেছন পেছন আসলো। তাদের বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়ে গেছে। মিথিলার এক্সাম শেষ হলেই সাব্বির তাকে তার ঘরে তুলে নিয়ে আসবে। আর মাত্র তিন মাস বাকি।
মাদুরে বসে রইলো লারা আবির। আবির হাসফাস করছে বেশ অনেকক্ষণ ধরে। লারার চোখে পড়লো বিষয় টা। গম্ভীর কন্ঠে বলল-

-“ আপনি কি কিছু বলতে চান?
আবির হকচকিয়ে গেলো। আমতা-আমতা করে বলল-
-“ হ্যাঁ না মানে হ্যাঁ কিছু বলতে চাই।
-“ কি বলেন।
-“ আপনি অনুমতি দিলে আপনার কাছে কিছু চাইবো।
-“ কি চান?
-“ উমমম। আপাতত আপনাকে চাইছি।
-“ মানে?

-“ মানে টা হচ্ছে জীবন কে কি আর আপনি দ্বিতীয় বার সুযোগ দিবেন না?
-“ ভাবি নি এখনও এটা নিয়ে।
-“ কবে থেকে তাহলে ভাবা শুরু করবেন?
-“ জানা নেই।
-“ আমি ততদিনের অপেক্ষায় থাকবো।
-“ আপনি অপেক্ষায় থাকবেন কেনো?
-“ কারন আপনার জীবন টাকে দ্বিতীয় বারের মতো আমি গুছিয়ে নিতে চাই।
-“ সরি ঠিক বুঝলাম না।
-“ সোজাসাপ্টা বলি তাহলে?
-“ হু বলুন

-“ আপনি দ্বিতীয় বার কাউকে ভালোবাসলে প্লিজ আমাকে বাসার চেষ্টা করবেন কেমন?
-“ আপনাকে কেনো বাসার চেষ্টা করবো?
-“ কজ আপনাকে আমার ভালো লেগেছে৷ তবে জোর করছি না। আপনার মুভ অন করতে যত সময় লাগে নিন সমস্যা নেই। তবে মুভ অন করার পর প্লিজ আপনার হাত টা আমাকে ধরতে দিয়েন।
লারা বসা থেকে উঠলো। ছাঁদ থেকে নেমে যেতে যেতে বলল-

-“ ভেবে দেখবো।
আবির পেছন থেকে বলে উঠল-
-“ শিউরিটি দিয়ে যান।
-“ তকদির এ বিশ্বাস করেন?
-“ জ্বি করি।
-“ তাহলে আপনি আমার তকদির এ থাকলে আপনাকে আমার শিউরিটি দেওয়ার দরকার পড়বে না। কথায় আছে যদি থাকে নসিবে আপনা-আপনি আসিবে। তাই অপেক্ষা করুন। অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়।
লারা চলে গেলো। আবির মুচকি হাসলো।মনে মনে বলল-
-“ আমি অপেক্ষায় থাকবো মিস লারা আপনার। অপেক্ষার ফল যেহেতু মিষ্টি হয় বললেন সেই মিষ্টি পাবার লোভ এসে গেছে হৃদয়ে।

বেলকনির ইজি চেয়ারে বসে আছে রাতুল। হাতে তার অধরা নামক রমণীর ছবি। পাশেই মোমের এক খন্ড আলো জ্বলছে। রাতুলের দৃষ্টি সেই জ্বলন্ত আলোর দিকে। ছবি গুলো জ্বলন্ত আগুনের উপর ধরতেই আগুন ছেয়ে গেলো। চোখের নিমিষে ছবি গুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। রাতুল ছাই গুলো হাতে তুলে নিলো। আকাশের বুকে ফু দিয়ে ছাই গুলো উড়িয়ে দিয়ে বলল-

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পরিচ্ছেদ ২ পর্ব ৩১

-❝ পৃথিবী তারে বলে দিয়ো। তাকে ছাড়াই আমি আছি বেশ ভালো। ❞ ❝সে জেনে রাখুক রাতুল তাকে ছাড়াও নিঃস্ব হয়ে বাঁচতে জানে। পৃথিবী চিনে রাখুক রাতুল নামক প্রেমিক পুরুষ কে। যে এক নারীতে আসক্ত হয়ে ঠকে গেছে। পরিশেষে সে ভালো থাকুক শিকলের ওপারে৷ পরকালে দেখা না হোক এই আমাদের। না হলে তখনও তার সকল বিশ্বাসঘাতকতা কে ভুলে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হবে। অতঃপর আমাদের আর ইহকাল পরকাল, কোনো কালেই দেখা না হোক আর।❞

সমাপ্ত