আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পরিচ্ছেদ ২ পর্ব ৪

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পরিচ্ছেদ ২ পর্ব ৪
Raiha Zubair Ripte

সকাল থেকেই মেঘেদের শব্দে উথাল পাথাল ধরণী। সূর্য লুকিয়েছে ছাই রঙা মেঘের আড়ালে। বৃষ্টি হচ্ছে ঝুম বৃষ্টি সেই সাথে যোগ হয়েছে আকাশে গুমুর গুমুর শব্দটা। শেষ রাতের দিকে এসেছিল ভারী বর্ষন, তবে এখন কিছুটা কমেছে বৃষ্টির মাত্রা। এই ভরা ঝুম বৃষ্টি তে গাড়িতে বসে জ্যামে আঁটকে বসে আছে সায়ান মাহবুব। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে আছে। আজ এই নতুন জায়গায় প্রথম কাজের দিনেই এই ভোগান্তি মোটেও পছন্দ হলো না। রাস্তার ড্রেন উপচে রাস্তায় পানি এসেছে। হঠাৎ আকস্মিক এমন ভারি বৃষ্টিতে বেশ অবাক শহরবাসী। কোনো পূর্বাভাস ই দেওয়া হয় নি।

সামনেই ট্রাফিক পুলিশ দেখতে পেয়ে একবার হাত ঘড়িটার দিকে চোখ বুলিয়ে গম্ভীর গলায় ডাক দিলো। ট্রাফিক পুলিশ ছাতা মাথায় করে এগিয়ে এলো। সায়ানের শরীরে ইউনিফর্ম দেখে হাত কপালে ঠেকিয়ে স্যালুট জানালো।
-“ আর কতক্ষণ লাগবে?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ট্রাফিক পুলিশ রাস্তার সামনের মাথার দিকে তাকিয়ে বলে- এই তো স্যার আর আধঘন্টার মতো লাগবে। আসলে পানি ড্রেন উপচে রাস্তায় এসে পড়েছে,পানি সরানোর কাজ চলছে।
সায়ান বিরক্তির শেষ পর্যায়ে চলে গেলো। রাগ মিশ্রিত কন্ঠে শুধালো-
-“ তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করুন।
ট্রাফিক পুলিশ মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো।

সায়ান ড্রাইভিং সিটে মাথা এলিয়ে দিলো। সোজা সিলেট থেকে যাচ্ছে অফিসে সারা রাত জেগে ড্রাইভিং করে এসেছে। এখন এখানে এসে এমন ভোগান্তি বেশ খারাপ লাগলো। চোখ বন্ধ করতেই ঘুম পেলো। কিন্তু হঠাৎ চোখ মুখে ঠান্ডা কিছু এসে পড়তেই ঠাস করে চোখ মেলে তাকায়। শরীরে ইউনিফর্ম টা প্রায় অনেক টাই ভিজে গেছে। মুহূর্তে চোখ মুখ রাগে জ্বলে উঠলো। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাতেই দেখলো এই ভরা বৃষ্টি তে এক মেয়ে দৌড়ে চলে যাচ্ছে। পড়নে মেরুন কালারের কুর্তি। হয়তো গাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওড়না থেকেই পানি টা এসেছে। কেননা মেয়েটা ওড়নার দু প্রান্ত দু হাতে নিয়ে দৌড়াচ্ছে।

বিরবির করে ইস্টুপিট বলে আখ্যায়িত করলো ঐ রমণী কে। জ্যাম ছাড়তেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলতে লাগলো নিজ গন্তব্যে।
খাঁন বাড়িতে আর আসে নি তন্ময় সন্ধ্যায়,যার দরুন দোলন কে এ বাড়িতেই রাতে থাকতে হয়েছে। রাত টা রাহার সাথেই কাটিয়েছে দোলন। দোলনের এক ব্যাচ উপরে পড়ে রাহা। দোলন এইচএসসি এক্সাম দিয়েছে মাস এক আগে। রেজাল্ট বের হয় নি এখনও। রাহা কে আপু বলে ডাকে। তবে বন্ডিং তেমন না। রাহা হয়েছে একদম অধরার মতো সারাদিন বই গুঁজে থাকে।

মাঝে মাঝে তৃষ্ণা বেশ অবাক হয়,রাহা তার মেয়ে নাকি অধরার? অধরার মতো ঘরকুনো, অধরার মতো বই পড়ুয়া আবার অধরার মতোই চাপা স্বভাবের। অথচ অধরাকে সামনা-সামনি রাহা খুব ছোট থাকতেই দেখেছে যখন রাহা ক্লাস টু তে পড়ে। কারন তারপর ই অধরা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। সেই থেকে এখনও অব্দি বিদেশেই আছে। এবার নাকি আসবে শুনেছে তৃষ্ণা। বড্ড খুশি খুশি লাগছে।
দোলন চুপচাপ বসে আছে খাটে। আর পড়ার টেবিলে বসে বইয়ের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে বসে আছে রাহা। হঠাৎ আকস্মিক রাহা বই থেকে মুখ সরিয়ে দোলনের দিকে তাকিয়ে বলে-

-“ আচ্ছা দোলন একটা কথা জিজ্ঞেস করি তোমায়?
দোলন হকচকিয়ে গেলো। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল-
-“ হ্যাঁ আপু বলো না কি জিজ্ঞেস করবে?
-“ প্রেমের ডেফিনিশন কি তোমার কাছে?
দোলন মুচকি হাসলো। চোখ বন্ধ করতেই কল্পনা করলো এক সুদর্শন পুরুষ কে। মুহূর্তে ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।

-“ প্রেম তো কেবল এক অনুভূতি মাত্র। এই প্রেমের তো কোনো ডেফিশন হয় না। মানুষ নিজের অনুভূতি গুলো কে কেবল মাত্র প্রকাশ করার জন্য বলে প্রেমে পড়েছে সে,বা কারো সাথে প্রণয়ের সূত্রপাত সৃষ্টি করেছে। বিজ্ঞদের মতে, প্রেম বলতে দুনিয়াতে কোনো শব্দই নেই। একটা অদ্ভুত অনুভূতি আছে। বোঝানোর প্রেক্ষিতে বলা হয়, ‘আই অ্যাম ইন লাভ!
রাহা চুপচাপ শুনলো। দোলনের কথার প্রেক্ষিতে আর কিছু বলতে পারলো না। আবার নিশ্চুপে বইয়ের মধ্যে ডুবে গেলো।

তন্ময় গতকাল রাতে বেশ রাত করে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে। অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে না খেয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। যার দরুন এই সকালে তার বেশ ক্ষিধে পেয়ে গেলো। আলসেমিকে এক পাশে ঠেলে দিয়ে বিছানা থেকে উঠে রান্না ঘরে গিয়ে চুলায় গরম পানি বসিয়ে দেয়, তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। টেবিলে বসে কফিতে চুমুক দিয়ে ব্রেডে কামড় বসাতেই দোলনের কথা মনে পড়ে গেলো। ও বাড়ি থেকে আসার পর আর যোগাযোগ করা হয় নি। পকেট থেকে ফোন টা বের করে রাহার নম্বরে কল করলো। রাহা নিজের ফোনে ভাইয়ের ফোন আসায় ভ্রু কুঁচকালো। খুব সহজে এই নম্বর থেকে ফোন আসে না। মাসে দু একবার আসে। আর কিছু না ভেবে ফোন টা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই তন্ময় বলে উঠলো-

-“ কেমন আছিস?
-“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি?
-“ হুমম আছি ভালো। দোলন আছে পাশে?
-“ হ্যাঁ আছে,দিব ফোন টা ওর কাছে?
-“ না থাক। বলিস সন্ধ্যায় আসবো নিতে। রেডি হয়ে থাকতে বলিস।
তন্ময় ফোন কে’টে দিলো। রাহা ফোনের দিকে তাকিয়ে ফোন উল্টো করে রেখে দিলো।

ভারি বৃষ্টি তে ছাতা মাথায় করে হেঁটে চলছে সাব্বির। পড়নে তার থ্রি কোয়াটার প্যান্ট আর ব্লু কালারের টি-শার্ট। গন্তব্য তার দোকানে। ডিম ফুরিয়ে গেছে। সকাল সকাল ডিম না খেলে তার চলে না। দোকানের কাছে আসতেই ফোন বেজে উঠে। সাব্বির ফোন টা পকেট থেকে বের করে সামনে ধরতেই দেখে তার মায়ের ফোন। সচারাচর তার মা ফোন দেয় না প্রয়োজন ব্যাতিত।

আজ ও হয়তো কোনো প্রয়োজন মনে করে ফোন দিয়েছে। সাব্বির দীর্ঘ এক শ্বাস ছাড়লো। সবার মা আর তার মায়ের মধ্যে কত আকাশপাতাল তফাৎ। এই তো চিত্রা আর তন্ময় কে দিয়েই তো উদাহরণ দেওয়া যায়। দিনে কয়েক বার তাদের কাছে ফোন দিয়ে তন্ময়ের খোঁজ। আর সাব্বিরের মা মাসে প্রয়োজন পড়লে দু একবার ফোন দিবে। এ নিয়ে বেশ মনোক্ষুণ্ণ হয়ে থাকে সাব্বিরের।

সাব্বির মনে মনে ভেবে নেয় তার মা হয়তো তাকে ভালোইবাসে না। তার যথাযথ কারন ও আছে। কিছু অতীত ভীষণ তিক্ত। তার রেশ বয়ে বেড়াতে হয় বর্তমান ও সামনের দিনগুলো।
সব কিছু কে এক সাইডে রেখে ফোন টা রিসিভ করলো সাব্বির। সালাম জানালে ওপাশ থেকে সালামের জবাব দিয়ে সালমা বেগম বলে উঠে –

-“ কোথায় এখন তুমি?
-“ দোকানে এসেছি ডিম কিনতে।
-“ ওহ্। বাড়ি আসবে কবে?
-“ ঈদ ছাড়া সম্ভব নয়। কোনো জরুরি কাজের জন্য ফোন দিয়েছেন?
-“ নাহ তেমন জরুরি নয়। তোমার চাচি তোমার জন্য মেয়ে দেখছে। বাসায় আসার জন্য বলছে তোমায়।
-“ চাচি কে মেয়ে দেখতে মানা করুন আম্মা। সে নাইন টেনের পড়ুয়া মেয়ে ধরে ধরে নিয়ে আসে। আমি একজন প্রাপ্ত বয়সের হয়ে নিশ্চয়ই এমন পিচ্চি মেয়ে বিয়ে করতে চাইবো না।

-“ এবারের মেয়েটা নাইন টেনে পড়ে না। মেয়েটা কলেজে পড়ে। একবার এসে দেখে গেলে ক্ষতি কি।
সাব্বির বিরক্তির চরম পর্যায়ে চলে গেলো। রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলল-
-“ এখন রাখি আম্মা,অফিসে যেতে হবে। এ নিয়ে পরে কথা হবে।
ফোন টা পকেটে ঢুকিয়ে দোকান থেকে এক খাচি ডিম নিয়ে হাঁটা ধরলো।

পিচঢালা রাস্তা, বৃষ্টি থেমে গিয়ে এখন ঝিরিঝিরি পড়ছে। কাঁদায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে রাস্তা টা। খুব সতর্কতার সাথে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে সাদা কলেজ ড্রেস পড়ুয়া মেয়ে। কিন্তু এতো সতর্কতা অবলম্বন করেও লাভের লাভ কিচ্ছু হলো না। সেই কাঁদা এসেই লাগলো সাদা ড্রেস টায়। রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো। পাশে দিয়ে চলে যাওয়া লোকটার দিকে ফিরে চেঁচিয়ে উঠলো-

-“ দিলেন তো আমার ড্রেসে কাঁদা মাখিয়ে। অসভ্যর মতো কাঁদা ছুঁড়তে ছুঁড়তে হেঁটে যাচ্ছেন কেনো।
সাব্বির পেছন ফিরলো। দেখলো কলেজ ড্রেস পড়া এক মেয়ের রণমুর্তি চেহারা। কপালে ছোট ছোট চুল এসে আছে, বাচ্চাদের মতো দুই পাশে বেণীগাঁথা। বেশ বাচ্চা বাচ্চা।
-“ দুঃখিত বাচ্চা, এক্সিডেন্টলি কাঁদা লেগে গেছে।
মিথিলা ক্ষেপে গেলো বাচ্চা ডাকে। সে কি বাচ্চা? কলেজে পড়ুয়া মেয়ে এখন ও বাচ্চা থাকে? মিথিলা এক হাতে ছাতা সামলিয়ে ডান হাতের তর্জনী উঁচু করে বলে-

-“ এই মিস্টার অভদ্র, আমাকে বাচ্চা বলছেন কেনো? আমাকে কোন এঙ্গেল থেকে বাচ্চা মনে হয়?
সাব্বির ভেবাচেকা খেয়ে গেলো হঠাৎ মেয়েটাকে আরো রেগে যেতে। আশেপাশে তাকালো। লোকজন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন আর আড়চোখে তাদের দেখছে। মিথিলা কে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো। তারপর মিথিলার দিকে এগিয়ে এসে বলল-

-“ সব এঙ্গেলেই তোমায় বাচ্চা বাচ্চা লাগে বাচ্চা মেয়ে। আর বাচ্চাদের এতো রাগ মানায় না। রাগ কমিয়ো। অভদ্র বলেছো। অভদ্রের কিছুই আমি করি নি তবে এখন করবো। শুধু শুধু তো আর একটা মিথ্যা অভিযোগ বয়ে বেড়াতে পারি না তাই না?

কথা বলা শেষে মিথিলার গাল টেনে দিয়ে হাঁটা ধরলো। মিথিলা বরফের মতে জমে গেলো। একটা অচেনা পুরুষ তার গাল টেনে দিয়ে গেলো? সাহস কত ঐ পুরুষের! চোখের নিমিষে লোকটা দৃষ্টি সীমারেখার বাহিরে চলে গেলো। হুঁশ আসলো মিথিলার। টেনে ধরা গালে হাত রেখে বলল-
-“ অসভ্য ই’তর খ’বিশ লোক। আমার গাল টেনে ধরছিস এই মিথিলার! সাহস কত্তোবড়। তোর বউয়ের গাল টানার জন্য গাল থাকবে না দেখিস।

এমন হাজার খানেক সাব্বির কে বকতে বকতে চলে গেলো মিথিলা।
রাহাত, তন্ময়, লিখন, সাব্বির এসেছে অফিসে,সাথে লারা ও৷ লারা কে মাঝ রাস্তা থেকে ড্রপ করে এনেছে তন্ময়৷ লারা ও একজন সিআইডি। অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু আগেই এসেছে। কিন্তু তাদের থেকে আগে এসে অফিসে হাজির সায়ান মাহবুব। নিজের কেবিনে বসে অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য।
লিখন কেবিনের দরজায় নক করে বলে-

-“ মে আই কামিং?
সায়ান দরজায় এক নজর তাকিয়ে বলে-
-“ ইয়েস।
লিখন,রাহাত,তন্ময়, সাব্বির লারা কেবিনে ঢুকলো। সায়ান ইশারায় সবাই কে বসতে বললো চেয়ারে। লারা জাস্ট হা হয়ে গেছে সায়ান কে দেখে। এর আগেও একবার দেখেছে সিলেটে। সেই থেকেই পছন্দ করে বসে আছে লারা সায়ান কে। লারা ঘুণাক্ষরেও যদি আগে টের পেত এই নতুন অফিসার টা সায়ান তাহলে সেজেগুজে আসতো। কি সুদর্শন দেখতে এই পুরুষ। মনের ভেতর শীতল ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেলো। সাব্বির লারা কে হা হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে টেনে বসালো। লারা চেয়ারে বসে ফিসফিস করে বলল-

-“ সাব্বির দেখ উনি কি হ্যান্ডসাম। তোর দুলু হিসেবে বেশ মানাবে তাই না?
সাব্বির কিছু বলতে নিবে তার আগেই সায়ান বলে উঠে।
-“ আপনাদের সাথে এটা নিয়ে আমার দ্বিতীয় সাক্ষাৎ এ্যাম আই রাইট?
রাহাত মাথা ঝাকালো।

-“ পরিচয় পর্ব টা আর নতুন করে করার প্রয়োজন নেই তাহলে। আসল কথায় আসি বরং। আপনাদের উপর যেই কেসটা এসে পড়েছে,সেটা মুলত আমার আন্ডারে এখন থেকে লিড হবে। আই হোপ আপনারা সহযোগিতা করবেন।
-“ আমরা দেশের জন্য কাজ করি। সেখানে আপনি আলাদা ভাবে প্রত্যাশা না রাখলেও আমরা এই কেসটায় নিজেদের সর্বত্র দিয়ে চেষ্টা চালাবো অপরাধী কে ধরতে।
সায়ান তাকালো তন্ময়ের দিকে। তন্ময় বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলল-
-“ এখন আসছি তাহলে।

তন্ময় চলে গেলো। তন্ময়ের চলে যাওয়া দেখে সবাই এক এক করে চলে গেলো। গেলো না শুধু লারা। লারা কে নিজের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অস্বস্তিতে পড়ে যায়। দৃষ্টি সরিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে-
-“ আপনি এবার আসতে পারেন মিস লারা।

লারার মনোক্ষুণ্ণ হলো। ইশ এভাবে মুখের উপর না করে দিলো লোকটা! কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো লারা। সায়ান সেদিকে একবার তাকিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো।
আবছা অন্ধকার পুরো রুম জুড়ে। একের পর এক ফোন বেজে চলছে৷ ফোনের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো ফারাহ্-র। চোখ মুখ কুঁচকে ফোন তুললো রিসিভ করে কানে নিয়ে ঘুমঘুম কন্ঠে বলল- হ্যালো।
ফোনের ওপাশ থেকে কিছু কথা ভেসে আসলো আর তাতেই ঘুমের রেশ উবে গেলো। চোখ মুখ জুড়ে হানা দিলো ভয় আতঙ্কের। সহসা শোয়া থেকে উঠে বসলো।

-“ সত্যি তন্ময় বিয়ে করে নিয়েছে? কিন্তু কবে করলো? আমি জানতে পারলাম না কেনো?
ওপাশ থেকে কিছু বললো কথার প্রেক্ষিতে। ফারাহ্ রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল-
-“ আমি অফিস থেকে দু দিনের ছুটি নিয়েছিলাম,কিন্তু তুমি জানা শর্তেও বলো নি কেনো? আমি ড্রিংক করে নে’শায় বুদ হয়ে থাকি আর না মাতাল হয়ে থাকি তুমি আগে কেনে জানাও নি? আবার আমার উপর চওড়া হচ্ছো! এ্যান্সার মি ড্যাম্ ইট!

কথাটা বলে ফারাহ্ ফোন টা ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। রাগে শরীর কাঁপছে। তন্ময় কে সে পাগলের মতো ভালোবাসে৷ আর সে বিয়ের দুদিনের মাথায় এসে জানতে পারলো তার ভালোবাসা আর তার নেই। অন্য কারো হয়ে গেছে! তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে নেমে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ইউনিফর্ম পড়ে বের হলো বাসা থেকে।
তুলি আজ বৃষ্টি তে ভিজে এতিমখানায় ফিরেছে। ছাতা নিয়ে যেতে মনে ছিলো না। যার দরুন তাকে ভিজে ভিজে এতিমখানায় ফিরতে হয়েছে। এখন একের পর এক হাঁচি দিচ্ছে। হাফিজা বেগম বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো মেয়েটাকে নিয়ে। সামান্য ভিজলেই মেয়েটার সর্দি জ্বর চলে আসে,আর আজ তো পুরো ভিজে জবুথবু হয়ে এসেছে। খুব ভালো ভাবেই যে এবার জ্বর সর্দি আসবে তা ঢের বুঝে গেলেন।

অথচ মেয়েটা কি সুন্দর এতিম বাচ্চা গুলো কে নিয়ে মেতে আছে। হাতে থাকা খাবারের প্লেট টা টেবিলের উপর রেখে তুলির দিকে এগিয়ে গেলো। তুলির কাঁধে হাত রেখে বলল-
-“ খাবার এনেছি তো খেয়ে নে না।
তুলি মাথা ঘুরিয়ে তাকালো হাফিজা বেগমের দিকে।
মুখে হাসি এঁটে বলে-

-“ আম্মাজান আমার কপালে একটা পাপ্পি দেন তো। কপাল টা বড্ড ব্যাথা করছে যে।
হাফিজা বেগম বড় প্রশান্তি পায় যখন তুলি তাকে আম্মা বলে ডাকে। সেই পাঁচ বছরের মেয়েটা কে গড়ে পিঠে এতোদিন মানুষ করেছে। তুলি ছোট থেকেই হাফিজা বেগম কে আম্মা বলে ডাকেন। হাফিজা স্বামী সন্তান নেই। বাইশ বছর আগে এক্সিডেন্টে তিন বছরের ছেলে আর স্বামী মারা যান। বাচ্চা স্বামী হারিয়ে পাগল প্রায় হয়ে গিয়েছিল হাফিজা বেগম।

কাজের দায়ে পথে পথে ঘুরেছে। আর তখনই এতিমখানায় লোক লাগবে বলে বিজ্ঞাপন দেখতে পায়। তারপর ঠিকানা বের করে আসে এই এতিমখানায় কাজের সন্ধানে। তারপর থেকে আজ অব্দি দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে লম্বা সময় অতিবাহিত করেছে এই এতিমখানায়। পিচ্চি পিচ্চি বাচ্চারাও তাকে আম্মা বলে ডাকে।
-“ কি হলো আম্মা একটা পাপ্পি দাও না।
হাফিজা বেগম নিচু হলেন। তুলির কপালে গাঢ করে চুমু এঁকে দিয়ে বলল-

-“ তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে নে আমি ঔষধ আনছি। এখন ঔষধ না খেলে সারা রাত জ্বরে ছটফট করতে হবে।
তুলি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। শরীরে তাপমাত্রা ক্রমশ বেড়ে চলছে। কোনো রকমে খাবার টা খেয়ে রুম থেকে বের হলো। দুতলা বিশিষ্ট এই এতিমখানা। এতিমখানার চারিপাশ পাঁচিল দিয়ে ঘেরাও করা। সামনেই বড় ঘাসযুক্ত মাঠ,মূলত বাচ্চাদের খেলার জন্য ই এই মাঠ।

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পরিচ্ছেদ ২ পর্ব ৩

তুলি গিয়ে দূরে আমা গাছের নিচে বসলো। পনেরো বছর ধরে আছে এই এতিমখানায়। কত আবেগ,অনুভূতি, কষ্ট ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই এতিমখানার সর্বত্রে। বড্ড ভালোবাসে এই এতিমখানার মানুষ গুলো কে তুলি। নিজের মায়ের চেহারা প্রায় ভুলেই গেছে তুলি। এখন মা বলতে চিনে শুধু হাফিজা বেগম আর চিত্রা কে। একজন আম্মা আরেকজন মা।

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পরিচ্ছেদ ২ পর্ব ৫