বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ১৪

বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ১৪
নিশাত জাহান নিশি

“অপেক্ষায় থাকব তোর। জানি নিরাশ করবিনা আমায়। আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কি জোঁ আছে তোর? মৃত্যুর দুয়ার থেকেও আমার কাছে তোর ফিরে আসতে হবে। যেমনটা আগের বার ফিরে এসেছিস। আমার সাথেই তোর নিয়তি লিখা আছে। উপর থেকেই আমাদের মিলন সেট করা।”

মিশালের হাতটি শক্তপোক্তভাবে আঁকড়ে ধরে চোখজোড়া বুজে ডুকরে কেঁদে ওঠল সামান্তা। বিনিময়ে মিশালকে কিচ্ছুটি বলার সুযোগও পেলনা সে। ইতোমধ্যেই তাকে অপারেশন থিয়েটারের ভেতর ঢুকিয়ে নেওয়া হলো। মিশালের মুখের ওপর অপারেশন থিয়েটারের দরোজাটি বন্ধ করে দেওয়া হলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ভেতর থেকে আকুতি ভরা কণ্ঠে সামান্তা মিশালের নাম ধরে ডাকতে লাগল। তৎক্ষনাৎ বুকটা ধক করে কেঁপে ওঠল মিশালের। এক সাংঘাতিক ভয় বাসা বাঁধতে লাগল তার মনে। সামান্তার ভয়ার্ত এই আহাজারি সহ্য করা যাচ্ছেনা আর। রক্তিম চোখ দুটিতে মিশালের ভাসা ভাসা জলের ছড়াছড়ি। ভেঙেচূড়ে যেন সে পরে যাচ্ছিল জায়গা থেকে। পাশ থেকে মিজানুর রহমান এসে মিশালকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। অশ্রুসিক্ত গলায় বললেন,

“শক্ত হ মিশাল। ভেঙে পরিসনা এত। আমার মন বলছে আমাদের সামান্তা সহিসালামতে আমাদের কাছে ফিরে আসবে। দোয়া ছাড়া এখন কিছুই করার নেই আমাদের। অনুরোধ করছি বাবা আমার মেয়েটার জন্য একটু দোয়া কর। এবার অন্তত আমার মেয়েটার সাথে একটু ভালো হোক।”
শক্ত হলো মিশাল। চোখের জল মুছল। মলিন হাসল সে। তার চাচার দিকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকালো। নাক টেনে বলল,

“তুমিও চিন্তা করোনা চাচা। ইন শা আল্লাহ্ এবার যা হবে ভালো হবে। পুরো ভরসা আছে আমার উপর ওয়ালার উপর৷ একমাত্র দোয়াই পারে আমাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চাচা। চলো আমরা সামান্তার জন্য দোয়া করি।”
অপারেশন থিয়েটার থেকে কিছুটা দূরত্বে থাকা পাতা চেয়ারগুলোতে মিশাল ও মিজানুর রহমান গিয়ে বসল। দুজনই মনে মনে সামান্তার জন্য প্রাণ ভরে ও শুদ্ধ মনে দোয়া দূরুদ পড়তে লাগল। এতে যেন দুজনের ভেতরটাই অনাবিল শান্তি এবং স্বস্তিতে ভরে যাচ্ছিল। উপর ওয়ালাই যেন ইশারা করে বলছিলেন তাদের দোয়া কবুল! ধীরে ধীরে চিন্তামুক্ত হতে লাগল মিশাল। ম্লান হাসতে লাগল সে।

ইতোমধ্যেই দেশ থেকে একটি সুসংবাদ এলো। জেনিয়া ছেলে সন্তানের জন্ম দিয়েছে! সাহিল তার খুশি ধরে রাখতে না পারে মিশালকে মাত্রই খবরটি জানালো। তবে মিশাল এখনি বাবুর মুখ দেখতে চাইলনা। সামান্তাকে নিয়ে একেবারে দেশে ফিরে এরপর বাবুর মুখ দেখবে বলে। ঐদিকে জেসমিন বেগমের ঘুম, নিদ্রা, খাওয়াদাওয়া সব বন্ধ হয়ে গেছে সামান্তার জন্য দুঃশ্চিন্তা করতে করতে। গতকাল থেকে এই অবধি নামাজের সিজদায় পরে রয়েছেন তিনি। সাইফা, সায়মা তারাও অবিরত দোয়া দরুদ পড়ছে। শাহনাজ বেগম ও রুমকি ও তাদের সাথে দোয়া দরুদ পড়তে ব্যস্ত। কারো চোখেই ঘুম নেই। ভেতরে শান্তিও নেই।

দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা অস্ত্র পাচারের পর অবশেষে শেষ হলো সামান্তার মুখের ক্রিটিক্যাল সার্জারি। ডক্টররা সব এক এক করে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হতে লাগলেন। মিশাল ও মিজানুর রহমান ছুটে গেলেন ডক্টর’সদের কাছে। ডক্টররা ইশারায় তাদের দুজনকে আশ্বস্ত করে বললেন যে অপারেশন ঠিকঠাক হয়েছে! তবে আজকের দিনটা তাকে অবজারভেশনে রাখা হবে। মিজানুর রহমান খুশিতে ফেটে পরলেন। আল্লাহ্’র কাছে শুকরিয়া আদায় করতে লাগলেন। চট জলদি দেশে ফোন লাগালেন তিনি। মিশাল তার উত্তেজনা ধরে রাখতে পারলনা। ঘামে জবজবে হয়ে গেল তার সর্বাঙ্গ। বুকের ভেতরটা অসম্ভব ভাবে কাঁপতে লাগল। ঘটনার আকস্মিকতায় সে মাথা ঘুরে ধপ করে ফ্লোরে ছিটকে পরল। জ্ঞান হারালো সে।

মিশালের যদিও খুব ইচ্ছে ছিল সামান্তাকে নিয়ে একদিন ইতালি ঘুরে দেখবার। তবে এখানকার সবকিছু এত কস্টলি যে তার পক্ষে সম্ভব ছিলনা এত এত খরচ বহন করার। অবশেষে টানা ছয়দিন পর আজ ইতালি ছাড়বে মিশাল, সামান্তা ও মিজানুর রহমান। তারা তিনজনই মোটামুটি তৈরি হয়ে নিচ্ছিল।
গোলাপী রঙের একটি কুর্তি পরে সামান্তা টিপটাপ ভাবে রেডি হয়ে গেল। মিজানুর রহমান কিছুক্ষণ আগেই ফ্ল্যাট ছেড়ে নিচে চলে গেছেন। চুল সেট করা বাকি শুধু মিশালের। বিছানার ওপর বসে সামান্তা বিরক্তি নিয়ে চকলেট চিবাচ্ছিল। একই সাথে মিশালকে উস্কানিমূলক গলায় বলছিল,

“ছেলে মানুষের বুঝি এত সময় লাগে রেডি হতে? কই আমিতো মেয়ে মানুষ হয়েও পাঁচ মিনিটে রেডি হয়ে গেলাম।”
ব্যস্ত গলায় মিশাল শুধালো,
“তুই রেডি?”
বিছানার উপর থেকে ওঠে এসে সামান্তা মিশালের ঠিক সামনের দিকটায় দাঁড়িয়ে নিজেকে জাহির করে বলল,
“কোনো সন্দেহ আছে?”

গত পাঁচদিনের ন্যায় সামান্তার মুখের দিকে ফিরেও তাকালোনা মিশাল! কেবল বুকের দিকটায় রক্তশূল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“ওড়না একপাশে এভাবে ঝুলিয়ে পরেছিস কেন? এসব চলাচল কিন্তু আমার পছন্দ নয়। ফরেন কান্ট্রি দেখে ভাবিসনা আমি তোকে ছাড় দিব।”

খিটখিটে মেজাজ নিয়ে মিশাল হেঁচকা টানে সামান্তার ওড়নাটি তার হাতে কেড়ে নিলো। ওড়নাটি পেচিয়ে সে বুকের পাশটা কভার করে সামান্তার মাথায় ঘোমটা পরিয়ে দিলো। প্যান প্যানিয়ে বলল,
“ওড়নাটা যেন এভাবেই থাকে। ঘোমটাটাও যেন মাথা থেকে না পরে। বি কেয়ারফুল ওকে?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল সামান্তা। নিরাশ গলায় মাথা নুইয়ে রাখা মিশালকে শুধালো,

“আর কতদিন আমার থেকে এভাবে মুখ ফিরিয়ে রাখবে মিশাল? আমার নতুন রূপ কি তোমার পছন্দ হয়নি? নতুন রূপ আবার কি আমিতো আবার আগের রূপেই ফিরে এসেছি। যে রূপে তুমি মজেছিলে, আমায় ভালোবেসেছিলে। কেন তুমি আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছ না কেন?”

“আমি আগেও তোর রূপে মজিনি। আর এখনও মজবনা! আমি এক সম্পূর্ণ তুইকে ভালোবেসে ছিলাম। তুই আমার কাছে ভালোবাসার একটি বিশাল প্যাকেজ। বিগত দুইবছর যাবত তোর ঐ মুখটিকে দেখতে দেখতে আমি এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে তোর এই রূপ ঐ মুখের কাছে ঠুনকো মনে হচ্ছে! শুধুমাত্র চাচা, চাচী ও আশেপাশের মানুষদের চাপে পরে আমি তোর সার্জারি করাতে বাধ্য হয়েছিলাম! তুই সব রূপেই আমার কাছে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু ঐ মুখটাকে ভুলতে আমার সময় লাগছে! কেন জানিনা সাহস করে তাকাতে পারছিনা তোর দিকে। ভয় হয় আমার অলক্ষুণে চোখের চাহনিতে যদি তোর আবারও কোনো মহা বিপদ হয়?”

আবেগ আপ্লুত হয়ে তৎক্ষণাৎ মিশালকে জড়িয়ে ধরল সামান্তা। যাকে বলে টাইট হাগ। কান্না বিজড়িত স্বরে সামান্তা মিশালকে বলল,
“তুমি ভুল ভাবছ মিশাল। তোমার লক্ষ্মী চোখ জোড়া সেদিন আমার দর্শন হয়নি বলেই আমার ওপর বিপদ নেমে এসেছিল। তুমি পাশে ছিলেনা বলেই আমি মরতে বসেছিলাম। দেখোনা? তুমি এবার পাশে ছিলে বলেই তো আমি সার্জারির মত ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশন থেকে চোখ বুজে বেঁচে ফিরতে পেরেছি। তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে মনের জোর খুঁজে পেয়েছি। সবসময় এত নেগেটিভ ভাবো কেন বলো তো? কখনও তো পজেটিভও ভাবতে পারো।”
কান্না মুখেও মৃদু হাসল মিশাল৷ সামান্তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“খুব চালাক হয়ে গেছিস তাইনা? আমাকে বুঝানোর ক্ষমতাও দেখছি রপ্ত করে ফেলেছিস।”
“মিশালকে বুঝানোর ক্ষমতা একমাত্র সামান্তারই রয়েছে। আর এটা ছোটোবেলা থেকেই হয়ে আসছে। মৃত্যুর আগ অবধি এর অন্যথায় হবেনা। তুমি মানো বা না মানো আমি তোমারই আজন্ম ভাগ্যরেখা।”

বেশ কিছুক্ষণ দুজন দুজনকে জড়িয়ে থেকে অবশেষে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। ফ্লাইট একঘণ্টা পর। যথাসময়ে তারা এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল। আর প্লেনে ওঠে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টার জার্নির পর অবশেষে তারা বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে পৌঁছালো। সাহিল এলো তাদের পিক করতে। সামান্তাকে আগের অবস্থায় দেখতে পেয়ে খুশিতে সাহিল চোখের জল ছেড়ে দিলো। জড়িয়ে ধরল সামান্তাকে। বলল,

“তোকে এভাবে দেখে খুব ভালো লাগছে।”
“আমিও খুব খুশি ভাইয়া। নিজেকে আগের অবস্থায় দেখে।”
গাড়িতে ওঠে সবাই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। তবে নিজেদের বাড়িতে না ফিরে তারা সোজা সাহিলদের বাসায় গেল। সাহিলের সদ্য জন্ম নেওয়া ছেলেকে দেখতে। সাহিলদের বাড়িতে পৌঁছে তারা সোজা সাহিলের বেডরুমে চলে গেল। জেনিয়া অবাক হয়ে সামান্তাকে দেখতে লাগল। খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে জেনিয়া জড়িয়ে ধরল সামান্তাকে। সাহিলের ছেলে তখন পিটপিট করে সামান্তাকে দেখছে! জেনিয়াকে ছেড়ে সামান্তা সাহিলের ছেলেকে কোলে তুলে নিলো। চুমু খেতে খেতে সে বাবুকে বলল,

“কি বাবা? শ্বাশুড়ি আম্মুকে খুব ভালোভাবে দেখে নিচ্ছ তাইনা? তোমার যেহেতু এখনও নাম রাখা হয়নি তবে তোমাকে আমি জামাই বলেই ডাকব। আমার ভবিষ্যৎ মেয়ের জামাই!”
সামান্তার কথায় উপস্থিত সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। জেনিয়া তো প্রশ্নই ছুড়ে দিলো,
“ভবিষ্যৎ মেয়ে জামাই মানে?”

“আরে বুঝতেছনা? মিশালের সাথে আমার বিয়ে হলে তো আমাদের প্রথম সন্তান মেয়েই হবে। তো আমি ভাবছি কি আমার মেয়ের সাথে তোমাদের ছেলের বিয়ে দিব। কি? ঠিক ভেবেছিনা আমি?”
সাহিল হু হা করে হেসে দিলো। বলল,
“হা হা হা। একদম ঠিক ভেবেছিস তুই। তাহলে আমাদের ছেলেমেয়ের বিয়ে ফিক্স ওকে?”
খরতর গলায় মিশাল বলল,

“তুমি হচ্ছ এক মাথামোটা। এই সামু হচ্ছে আরেক মাথামোটানি! আমাদের প্রথম সন্তান ছেলে হয় নাকি মেয়ে হয় এটা কি তোমরা জেনে বসে আছ?”
বিরক্তি প্রকাশ করল সামান্তা। মিশালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে সামান্তা কপাল কুঁচকে বলল,
“আচ্ছা প্রথমটা না হয় বাদ দিলাম। দ্বিতীয় সন্তান তো মেয়ে হবে তাইনা?”
“গাঁধির গাঁধিরে! দ্বিতীয় সন্তান যে মেয়ে হবে তার কোনো শিওরিটি আছে? যদি আমাদের কোনো মেয়ে সন্তানই না হয়?”

তৎক্ষনাৎ সামান্তার মন খারাপ হয়ে গেল। মুখ গোমড়া করে সাহিলের ছেলেকে সে জেনিয়ার কোলে তুলে দিয়ে মিশালকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমি বাড়ি যাব।”
রুম থেকে প্রস্থান নিলো সামান্তা। সাহিল ও জেনিয়া পেরেশান হয়ে গেল। মিশাল তাদের দুজনকে আশ্বস্ত করে বলল,
“আরে বাদ দাও। সামান্তাকে আমি বুঝাব।”

সাহিলের ছেলেকে কোলে নিয়ে মিশাল কিছুক্ষণ আদর করে তার হাতে এক হাজার টাকার একটি ধরিয়ে দিল! প্রথম যেহেতু দেখেছে কিছু না কিছু তো দিতেই হবে। সামান্তাকে দেখে নাজিয়া চৌধুরী ও কেঁদে ভাসিয়ে দিলেন। অনেক জোরাজোরির কারণে দুজন রাতের খাবার খেয়ে এরপর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। সাহিলের গাড়ি নিয়েই দুজন বাড়ি ফিরল। ড্রাইভ করছিল মিশাল। সামান্তা তার পাশের সিটে বসে। মুখ এখনও ভার তার। সাহস করে মিশাল এবার সামান্তার দিকে তাকালো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধালো,

বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ১৩

“কি ব্যাপার? সামান্য ব্যাপার নিয়ে তুমি এভাবে মুখ ফুলিয়ে রেখেছ কেন?”
এই প্রথমবার মিশালের মুখ থেকে ‘তুমি’ শব্দটি শুনে সামান্তা মনে মনে খুশিতে নেচে উঠছিল। তবে বাইরে তা বুঝালোনা! বেশ শক্তপোক্ত গলায় বলল,
“তুমি তুমি বলে আমার মন গলাতে চাইলেও আমার মন গলবেনা! তোমার কোনো ইচ্ছেই নেই আমাদের মেয়ে সন্তান হোক।”

বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ১৫