বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ১৩

বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ১৩
নিশাত জাহান নিশি

“উমমম্। আমি শ্রাবণ, তুমি অন্ধকার রাত। শ্রাবণ পেরিয়ে তোমার সেই অন্ধকার রাতে আমি এক টুকরো আলো হয়ে জ্বলব, তোমার একমাত্র দিশা হয়ে।”
আলতো হাসল মিশাল। ভেতরটাতে অসীম সুখ সুখ অনুভব হতে লাগল তার। বুকের বাঁ পাশে অদ্ভুত এক শিহরণের আভাস পেল। প্রেয়সীর মুখ থেকে এহেন ভালোবাসাময় অনুরক্তি শুনতে কোন প্রেমিকেরই বা ভালো না লাগে? এই সময়টা থমকে দাঁড়ালে ভালো হতো।

ইশ যদি.. যদি তা সম্ভব হতো! পেছন থেকে সামান্তা পূর্বের তুলনায় অধিক শক্তভাবে জাপটে ধরল মিশালকে। পৃথিবীর সব সুখ যেন মিশালকে ঘিরে থমকে দাঁড়াল। স্বস্তির শ্বাস ফেলল সামান্তা। বাইকের গতি খানিক বাড়িয়ে দিলো মিশাল। হাওয়ায় ভাসতে লাগল সে। নিজেকে সিনেমার হিরোদের চেয়ে কোনো অংশে কম মনে হচ্ছেনা তার। অপর পাশে, তাকে জাপটে ধরে যে মেয়েটি বসে আছে সে হলো তার হিরোইন। শুধু সিনেমার নয়, তার বাস্তব জীবনের হিরোইন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সেদিন রাতে পুরো শহর ঘুরল মিশাল ও সামান্তা। ব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে কাছ থেকে আকাশ দেখল, চাঁদ দেখল, আকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তাঁরাদের দেখল। নদী দেখল, সমুদ্র দেখল। কান পেতে সমুদ্রের গর্জন শুনল, মিশালের হাত ধরে খালি পায়ে সমুদ্রের পাড়ে হাঁটল। মিশাল কেবল নীরব হয়ে সামান্তার মিষ্টি হাসি ও অনাবিল খুশি দেখতে লাগল। প্রকৃতি উপভোগ করার চেয়ে মিশাল সামান্তার হাসিখুশি বেশি উপভোগ করল। সমুদ্রের পাড়ে হাঁটতে গিয়ে মিশাল এক পর্যায়ে সামান্তাকে কোলে তুলে নিলো। থমকালো সামান্তা। ঘটনার আকস্মিকতায় হাসিও থেমে গেল তার। মিশালের কাঁধে দু’হাত ঝুলিয়ে দিলো। অবাক করা গলায় বলল,

“কি হলো?”
মিশাল মুগ্ধ নয়নে সামান্তার দিকে তাকিয়ে রইল। অতঃপর বিভোর গলায় বলল,
“মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তোকে দেখতে অসুবিধা হচ্ছিল। তাই ভাবলাম কোলে তুলে নিই। এবার তোকে দেখতে আর কোনো অসুবিধা হচ্ছেনা। তোর কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে?”

লাজুক হাসল সামান্তা। মাথা নুইয়ে বলল,
“তুমি দিন দিন যাচ্ছে তাই হয়ে যাচ্ছ! আগে তো এমন ছিলেনা। মুখ থেকে কথাই বের হতোনা। অনেক খুঁচিয়েও কথা বের করা যেতোনা। আর এখন ফরফর করে মুখ দিয়ে যা আসে তাই বলে ফেলো, যা করতে মন চায় তাই করে বসো।”

“হুম। এবার বুঝ তুই আমাকে কি যাদু করেছিস! তোর চোখে কি কোনো তাবিজ লিখা আছে? যা পড়ে আমি তোর বশে চলে যাই? কেবল তোর দু-চোখেই হারিয়ে যাই। তোর মধ্যে হারিয়ে যাই। নিজেকে অবাধ্য করে তুলি। দিন দুনিয়া ভুলে তোর পেছনেই ছুটে বেড়াই। নেশার মত টানিস আমায়। নেশালো আফিমের মত। আকাশের চাঁদ দেখেও এত তৃপ্তি নেই, তোকে দেখে যতটা তৃপ্তি পাই! জাগতিক সব সৌন্দর্য তোর কাছেই এসে থমকে দাঁড়ায়। সৌন্দর্যের আঁধার তুই। আমি ভীষণ লাকি যে, তোকে আমার জীবনে পেয়েছি। অন্তত চোখের শান্তি কিংবা মনের শান্তির অভাবে ভুগতে হবেনা আমায়।”

কিঞ্চিৎ লজ্জা ও অস্থিরতা নিয়ে মিশালের বুকে মুখ লুকালো সামান্তা। মিশালের কথার বিপরীতে কিছু বলার যে ভাষা নেই তার। মিশাল যে তাকে পুরোপুরি বাকরুদ্ধ করে দিলো। অথচ সামান্তা তার দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি মিশাল তাকে নিয়ে এত গাঢ় গভীর ভালোবাসা অনুভব করে। কিংবা তাকে নিয়ে এত ভালোবাসাময় বন্দনা ভাবতে পারে। এবার তো মিশালকে হারাবার ভয় চেপে বসল তার মধ্যে। ভালোবাসা প্রকাশ না করা অবধিই ভালোবাসা সুন্দর! আবার সেই ভালোবাসাই প্রকাশ করে ফেললে হারানোর ভয়! সামান্তা তার ভয় মনের মধ্যেই চেপে রাখল। মিশালকে তার অবকাশও পেতে দিলোনা। সেদিনের মত সামান্তার ছোটো ছোটো ইচ্ছে ও আবাদারগুলো পূরণ করে দিলো মিশাল। ভোর হতেই দুজন বাড়ি ফিরে গেল। আরামচে যে যার রুমে গিয়ে শুয়ে পরল।

মাস ঘনিয়ে এলো। সামান্তারও সার্জারির সময় এগিয়ে এলো। এই একমাসে সামান্তা, মিশাল ও মিজানুর রহমানের ইতালির পাসপোর্ট ও ভিসা তৈরি হয়ে গেল। সামান্তার সাথে শুধু মিশাল ও মিজানুর রহমানই যাবেন। দূরদেশে এত লাখ লাখ টাকা খরচ করে সবার যাওয়ার প্রয়োজন নেই তাই। তাদের বিদায় দেওয়ার সময় কান্নায় ভেঙে পরলেন পরিবারের সবাই। বিশেষ করে জেসমিন বেগম। মেয়েকে ছাড়তে চাইছিলেন না তিনি। কিন্তু মেয়ের চিকিৎসার জন্য তাকে তো ছাড়তেই হবে।

ইতালিতে পৌঁছেই হসপিটালের কাছে এক রুম ও এডজাস্ট বাথরুমসহ একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিলো মিশাল। আগামীকালই যেহেতু সামান্তাকে হসপিটালে ভর্তি করে দেওয়া হবে তাই অযথা রুম বেশি নিয়ে টাকার অপচয় করতে চায়নি মিশাল। যতটা সম্ভব তাকে পারিপার্শ্বিক খরচের টাকা বাঁচিয়ে তা সামান্তার চিকিৎসার খরচে ব্যয় করতে হবে।

সেদিন রাতটা তিনজন একসাথে এডজাস্ট করে নিলো। যদিও রাত দুটোর পর সামান্তার আর ঘুম হয়নি! রুমের বারান্দায় পেতে রাখা সোফায় সে হাত-পা গুটিয়ে বসে ছিল। মিশাল বিষয়টি খেয়াল করে রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় গেল। গিয়ে দেখল সামান্তা হাঁটুতে মুখ ঠেকিয়ে কান্না করছে। পেরেশান হয়ে গেল মিশাল। ছুটে গিয়ে সামান্তার পাশে বসল। সামান্তাকে বুকের মাঝে চেপে ধরে উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত গলায় শুধালো,

“কি ব্যাপার? কাঁদছিস কেন?”
ভরসার স্থল পেয়ে সামান্তা তার কান্নার গতি দ্বিগুন বাড়িয়ে দিলো। হেঁচকি ওঠে গেল তার। নাক টেনে ভীতু গলায় বলল,
“আমার খুব ভয় করছে মিশাল। অনেক বেশি ভয় করছে। তোমাকে বুঝাতে পারবনা ঠিক কতটা ভয় হচ্ছে।”

“ভয় কিসের পাগলী? সামান্য সার্জারিই তো। তুই জাস্ট চোখ বন্ধ করবি, আবার চোখ খুলেই দেখবি তোর সার্জারি কমপ্লিট। তোর ফেসটা ঠিক আগের মত হয়ে গেছে। যেমনটা ম্যাজিকে হয়। তখন তো তুই আমাকে একদমই ভুলে যাবি! এলাকার ভেতরের ও বাইরের সব কোটিপতি ছেলেরা তোকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে যাবে। তখন কি এই নগণ্য ছেলেটাকে তোর মনে থাকবে? বল বল বল?”

“আমি দুষ্টুমি করার মোডে নেই মিশাল। আমি ভালো করেই জানি এসব বলে তুমি আমার মাইন্ড ঘুরানোর চেষ্টা করছ। এই সার্জারিটাকে তুমি যতটা সহজ মনে করছ, এটা অতটাও সহজ নয়। এখানে প্রাণ সংশয় হওয়ারও ঝুঁকি রয়েছে। কালকের পর যদি আমাদের আর দেখা না হয়?”

তৎক্ষনাৎ রেগেমেগে সামান্তাকে ছেড়ে মিশাল সোফার এক কোণায় জড়সড় হয়ে বসল। মাথা নুইয়ে সে হাত-পা কচলাতে লাগল। মাথার চুলগুলো ও টেনে ছিঁড়ে ফেলার উপক্রম। মিনিট কয়েক এভাবে সামান্তার সব রাগ নিজের ওপর ঝেড়ে মিশাল অগ্নি দৃষ্টিতে পাশ ফিরে হতভম্ব সামান্তার পানে তাকালো। চোয়াল উঁচিয়ে বলল,

“পৃথিবীর সব কাজেই রিস্ক থাকে সামান্তা। খাবার চিবাতে গেলেও কিন্তু জিহ্বায় কামড় পরার রিস্ক থাকে। তবুও তো মানুষ খাবার খায়। কারণ, এই খাবারটা খেয়েই তাকে বাঁচতে হবে। রিস্ক ছাড়া পৃথিবীতে কিছু হয়না সামান্তা। মনোবল শক্ত করতে হবে তোর। আবেগ কিংবা ভয় নিয়ে বসে থাকলে চলবেনা। আর মৃত্যু এত সহজ নয়, যে আমরা ডাকলাম আর মৃত্যু চলে এলো। এইযে বছরখানিক আগে এত বড়ো এক্সিডেন্টটা হলো তোর, তুই কি মরেছিস? বেঁচে ফিরিসনি? জীবন নাশ করে দেওয়া এত বড়ো এক্সিডেন্ট থেকে যদি তুই অনায়াসে বেঁচে ফিরতে পারিস, তাহলে এই সামান্য সার্জারি থেকে তুই কেন বেঁচে ফিরতে পারবিনা?”

কিছুসময় মৌন থেকে মিশালের কথাগুলো ভাবল সামান্তা। যদিও এখনও তার ভয় কাটেনি তবুও সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল। মিশালকে জাপটে ধরে মিথ্যে হাসির অভিনয় করে বলল,
“তুমি ঠিক বলেছ মিশাল। পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে রিস্ক তো নিতেই হবে। তুমি পাশে থাকলে পৃথিবীর সকল খারাপ পরিস্থিতিও পার হয়ে আসতে পারব আমি। সার্জারি আবার কি এমন বড়ো জিনিস।”
মিশালকে এসব বলে শান্তনা দিলেও সামান্তা ভেতরে ভেতরে ভয়ে কাতর৷ হরদমে চোখের জল ছেড়ে সে মনে মনে আওড়ে বলল,

“মৃত্যুর ভয় আমি পাইনা মিশাল। আমিতো ভয় পাই তোমাকে হারিয়ে ফেলার! তোমার কাছ থেকে পাওয়া সুখগুলো হারিয়ে ফেলার। আমার জেদের কারণে সেদিন এনগেজমেন্টটা হলোনা আমাদের। আল্লাহ্ না করুক যদি আমার কিছু হয়ে যায় তখন তো তোমাকে সামলানোর জন্য কাউকে প্রয়োজন। তাই তোমার জীবনে নতুন কেউ আসার সেই পথটা আমি খুলে দিয়ে গেলাম!”

সামান্তার সামনে মিশাল উপর থেকে নিজেকে শক্তপোক্ত দেখালেও ভেতরে ভেতরে সেও ভয় ও অস্থিরতায় কাবু! চোখের কোণে ভরোভরো জল তার। অনিশ্চয়তার ছাপ। সামান্তাকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে সে মনে মনে বলল,
“ভয় তো আমারও হচ্ছে সামান্তা। পৃথিবীর কোনো কিছুর মূল্যেই আমি তোকে হারাতে চাইনা। তোকে ছাড়া আমার এত মুহূর্তে কাটুক এমন কোনো দিন আমার জীবনে না আসুক। যদিও আসে সেদিন আমারও মৃত্যু হোক।”

মিশালের বুকে মাথা রেখে সেই রাতটা সামান্তা নির্ঘুম কাটিয়ে দিলো। মিশাল অনবরত সামান্তার মাথায় হাত বুলিয়ে সামান্তাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করল৷ মিশাল নিজেও নিদ্রাহীন রইল। দুজনের দুঃশ্চিন্তা এক জায়গায এসে থেমে গেল। রাত পেরিয়ে সকাল দশটা বাজতেই সামান্তাকে নিয়ে মিশাল ও মিজানুর রহমান হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। সেদিনই সামান্তাকে হসপিটালে ভর্তি করে দেওযা হয়। সিডিউল অনুযায়ী সার্জারির সময় নির্ধারিত হয় রাত দশটায়। এখন শুধু রাত দশটার অপেক্ষায়।

মিশাল ও মিজানুর রহমান সামান্তার কেবিনের বাইরে সকাল থেকে রাত অবধি টানা বসে রইল। শুধু দুপুরে গিয়ে খাবার খেয়ে এসেছিল। সামান্তাকে হসপিটাল থেকে টাইমে টাইমে খাবার দেওয়া হয়েছিল। অবশেষে রাত দশটায় সামান্তার সার্জারির সময় হয়ে এলো। বাড়ি থেকে একের পর এক ফোন আসতে লাগল।

সবাই সামান্তাকে দেখতে চাইল। অপারেশন থিয়েটারে সামান্তাকে প্রবেশ করানোর পূর্বে বাড়ির সবাই ভিডিও কলে সামান্তাকে দেখে নিলো৷ মিশালের কথা অনুযায়ী সবাই সামান্তার সাথে নরমাল থাকার চেষ্টা করল। হাসিখুশি ভাবে কথা বলল। এতে সামান্তাও স্বস্তি পেল। ভয় কাটতে লাগল তার। মিশালের হাত ধরে রইল সামান্তা। অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করানোর আগ অবধি মিশাল ও মিজানুর রহমানের হাতকে শক্ত করে ধরে রইল সামান্তা। চোখে জল নিয়ে মিজানুর রহমান মেয়ের কপালে চুমু এঁকে দিলেন। বললেন,

“যা। একদম ঘাবড়াবিনা। আল্লাহ্ ভরসা।”
সামান্তার হাত ছাড়ার আগে মিশাল ভেতর থেকে ফুঁপিয়ে ওঠে সামান্তার হাতে গভীর একটি চুমু এঁকে দিলো। মাথা নুইয়ে চোখে ভাসা ভাসা জল নিয়ে ভগ্ন গলায় বলল,

বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ১২

“অপেক্ষায় থাকব তোর। জানি নিরাশ করবিনা আমায়। আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কি জোঁ আছে তোর? মৃত্যুর দুয়ার থেকেও আমার কাছে তোর ফিরে আসতে হবে। যেমনটা আগের বার ফিরে এসেছিস। আমার সাথেই তোর নিয়তি লিখা। উপর থেকেই আমাদের মিলন সেট করা।”

বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ১৪