মেজর পর্ব ১৭

মেজর পর্ব ১৭
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

“ইয়েস মাই ডল।কাম।”
মিতু বিধস্ত দেহমন নিয়ে এগিয়ে আসে। আজকে সারাদিন বেশ ধকল গিয়েছে,মন বড়ই অশান্ত,শরীর ক্লান্ত।মুশফিকের বাড়িয়ে রাখা হাত,প্রসস্ত বুক যেনো তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

মুশফিককে সে যেনো আস্তে আস্তে সমীকরণের মতো বুজতে পারছে।মিতু মুশফিকের বুকে আস্তে করে হেলে পড়ে।মুশফিক পরম যত্নে পুতুলের মত বউটাকে বুকের খাঁচায় বন্দী করে নেয়।দুজনেই চুপচাপ, যেনো নিশ্চুপ থেকে একে অপরের হৃদস্পন্দন অনুভব করছে।মিতু পাথরকঠিন বুকে নাক ডুবিয়ে দেয়।মেজর শুধুমাত্র তার মেজর!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মুশফিকের গায়ে সারাদিনের ঘামে ভেজা ইউনিফর্ম।মিতু ঘামে ভেজা ইউনিফর্মেই নাক চেপে ধরে রাখে,এটাই তার ভালো লাগছে।মুশফিকের বুকে এত শান্তি লাগছে যে মিতু আবেশে চোখ বন্ধ করে রেখেছে।সারাদিনের অশান্তি যেনো এক নিমিষেই উধাও।মিতু খেয়াল করে তার পা মাটি ছুঁয়ে নেই বরং পা শূন্যতে।লম্বা মুশফিকের কড়াপড়া হাতগুলো শক্ত করে তাকে আগলে উপরে উঠিয়ে রেখেছে।যেনো মূল্যবান কিছু পেয়েছে।মিতুর মনে হলো সে আকাশে উড়ছে।বন্য সুভাস সুরসুরি দিয়ে বলে যায় প্রনয়…..

মুশফিকের বাড়িয়ে দেয়া হাতগুলো তিরতির করে কাঁপছে।মুশফিক হাতের দিকে তাকায়।যেই হাত দিয়ে পি,স্তল ভরা হাজারও বুলেট সাই সাই করে শ,ত্রুদের দিকে এগিয়ে যায় সেই হাত কিনা স্ত্রীর বুকে আসার অনুভূতির তোপে কাঁপছে!
‘পুরুষের হাজারও শক্তি,ক্ষমতা, নারীর আগমনের কাছে সব তুচ্ছ।নারী এগিয়ে আসলে পুরুষ লুটিয়ে পরে পরম ভালোবাসায়।’

মিতুর নরম দেহ মুশফিকের বুকে আছড়ে পড়াতে মুশফিক যেনো কাঠফাঁটা রোদে হঠাৎ হওয়া বৃষ্টির মত শান্তি পেলো।ছলছল,কলকল করে উঠে বুকের মধ্যিখান।মুশফিক তার বলিষ্ঠ হাত দ্বারা মিতুর শরীরটা বুকে মিশিয়ে উপরে উঠিয়ে নেয়।মুশফিক ভাবে মিতুলটা একটু চঞ্চল কিন্তু ভেতরটা একদম বাচ্চাদের মতো নরম।এই যে আজকে নয়নার এমন ব্যবহারের পরেও মুশফিক মিতুকে ঠিক মানিয়ে নিতে পেরেছে।

হ্যাঁ মিতু রাগ করেছিলো, একটু না বরং খুব বেশী রাগ করেছিলো কিন্তু বুদ্ধিমান মুশফিক ঠিকই মানিয়ে নিয়েছে,আ,গ্নেয়গিরিতে বরফগলা পানি ঢেলে ঠিক ঠান্ডা করে দিয়েছে।সে অতি ধুরন্ধর মানুষ,বিচক্ষনতার সাথে সব কিছু সামাল দিতে পারে।স্ত্রী-টাকেও ঠিক বুঝেছে।পা,গলরূপ শান্ত করেছে।এই যে এখন বিড়ালছানার মতো তার বুকে মিশে আছে।

মুশফিক জীবনে কখনো এই অনুভূতির সাথে পরিচিত না,তার জীবনটা অন্যরকম ছিলো,আজকে মিতুর সানিধ্যে এসে যেনো উন্মোচন হচ্ছে ভালোবাসার আরেক অধ্যায়,যদিও তার বয়স অনুযায়ী এসব অনুভূতির সাথে পরিচয় স্বাভাবিক। প্রিয় মানুষের শরীরটার তিরতির করে কাঁপন তাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে।এতো চিন্তা,টেনশনের মাঝেও পা,গলা অনুভূতি ভেতরটা তোলপাড় করে দিচ্ছে।মুশফিক তপ্ত শ্বাস ফেলে মিতুকে বললো,

“মিতু…”
মুশফিকের বুকে মিতু খুব শান্ত হয়ে ছিলো।মুশফিকের ডাকে মাথা উঠিয়ে তাকায়।মিতু মুশফিকের থেকে বেশ খাটো।মুশফিক তাকে মাটিতে নামিয়েছে সাথে নিজের উঁচু কাধ মিতুর দিকে ঝুকিয়ে এনেছে।মিতু সলোজ্জ দৃষ্টি মেলে তাকায়।মুশফিকের চোখে খেলা করছে অন্য ভাষা।মিতু মুশফিকের চোখের দিকে তাকাতেই বুকটা আবার মুচড়ে উঠে।এই মানুষটাকে সে বিশ্বাস করে কিন্তু কেউ উল্টাপাল্টা কথা বললে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়,এই যে এখন মুশফিকের গভীর চোখের দিকে তাকিয়ে নয়নার কথাগুলো মনে হয়ে যাচ্ছে।নিজের অগোচরেই চোখের পানি গাল বেয়ে যায়।মুশফিক বুঝে যায় মিতুর নিঃশব্দের কান্না।মিতু ফের ফুঁপিয়ে উঠলো।

“আপনি আমার।আমার মেজর।”
মিতুর সহয স্বীকারোক্তি মুশফিককে অপরিসীম সুখে দোলা দেয়।সে তাকে আসস্ত করে বললো,
“একদম,পুরোপুরি।”
“নয়না….”
মুসফিক তাকে থামিয়ে বললো,
“নয়নার কথা ভুলে যাও,আমি শুধুমাত্র তোমার আমাকে বুঝো,নয়নার ব্যবস্থা আগামীকাল নেবো।”
“হুহ।”

“হুহ!হুহ কি?”
“আপনি একজন মেজর হয়ে,সামান্য সৈনিকের কি করে এতো সাহস হয়?আপনার কটেজে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করেছে,বেডরুম অব্দি গিয়েছে আমাকে অপমান করেছে।ওর এতো সাহস?”
“আমি নয়নাকে এর যোগ্য জবাব দিয়েছি।মেয়ে বলে বেশী কিছু করিনি কিন্তু আগামীকাল এর একটা চূড়ান্ত কথা হবে।”

মিতু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।তারপর মুশফিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
“সেদিন রাতে নয়নাকে জিপে করে নিয়ে এসেছিলেন কেনো?”
মুশফিক মনে করে বললো,
“নয়নার নাকি অসুস্থ লাগছিলো তাই ওর আব্বু আমাকে পৌঁছে দিতে বলেছিলো।আমি জানতাম না এসব হবে জানলে কখনোই সাথে নিয়ে আসতাম না।”
“আপনি নয়নার সাথে আর কথা বলবেন না।”
মুশফিক হেসে বললো,

“ওকে।”
“তাকাবেনও না।”
“না।”
“সারাক্ষণ আমিই আপনার মনে থাকতে চাই।”
“আছোই তো।”
“কোনো মেয়ের সাথে কথা বলা যাবে না,আমি কষ্ট পাই।”
“বলবো না।”
“প্রমিস করেন।”
মুশফিক হেসে বললো,
“আমার প্রিটিডল প্রমিস।”
মিতু ভ্রু কুঁচকে বললো,
“প্রিটিডল কে?”

“আমার বউ।আমার তুলতুল।”
মিতু চুপ করে থাকে।মুশফিকের চোখের দৃষ্টি মিতুর র,ক্তেমাখা হাতের দিকে।সে আস্তে করে বললো,
“বাসায় চলো।”
মিতু সোজা জবাব দিলো।
“না।”
মুশফিক মিতুর নরম সরু হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
“বাসায় চলো হাতে ব্লি,ডিং হচ্ছে।”
“না।”

“প্লিজ।ই,নফেকশন হয়ে যাবে।জেদ করনা।”
মিতু মুশফিকের দিকে তাকিয়ে তার থেকে আলাদা হয়ে মিনমিন করে বললো,
“আপনি কিন্তু আমার। ”
মুশফিক শান্ত চোখে মিতুর দিকে তাকিয়ে আছে।আবারও সেই আকুতিভরা টলটলে আবদার।এই আবদারের উত্তর মেয়েটা জানে কিন্তু বারবার জবার শুনে কলিজা ঠান্ডা করতে চায়।মুশফিক তার প্রিয়তমার কলিজা ঠান্ডা করা উত্তরই দেয়।মিহি গলায়,

“হ্যাঁ তোমার,আমি সবটাই তোমার।”
মিতু অবুজ গলায় বললো,
“কিভাবে বুঝবো?”
মুশফিক বললো,
“এমনিতেই বুঝে যাবে।তুমি কাউকে আপন করে নিলে বুঝতে হয় না,প্রকাশ করতে হয় না, সবার আগে তোমার মন বুঝে যাবে।”
“কিন্তু কেউ তো জানে না।”

মুশফিক দু-পা এগিয়ে যায়।মিতু কিছু বুঝে উঠার আগেই চিৎকার করে বললো,
“শোন পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ,হাজারও পাখি,অসংখ্য গাছ,আকাশ ভরা তারা মিতুল আমার রানী।আমার জীবনসঙ্গী,মাই এভরিথিং।”
মুশফিকের মত মানুষের থেকে এমন পা,গলামি আশা করা যায় না কিন্তু মিতুর মুখে হাসি ফুটাতে সে এই পা,গলামি করলো।কথায় বলে না,

“নারীর মুখে হাসি ফুটাতে পুরুষ সব করতে পারে।”
মুশফিকও তেমন,সবার কাছে গম্ভীর, রাগী হলেও তার নিজস্ব নারীর কাছে সে কাদামাটি, মনটাকে যেমন খুশী তেমন করেই মিতু তাকে পেতে পারে
মিতু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
“পা,গল!”

মুশফিক মিতুর দিকে তাকায় তারপর তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললো,
“সবাইকে জানাবো।আমাকে বিশ্বাস করবে সবসময়।”
মিতু মাথা ঝাকায়।মুশফিক হাত ধরে বললো,
“চলো।”

মিতু হাটে।নির্জন রাত,গা ছমছমে পরিবেশে কপোত-কপোতী নিঃশব্দে একে অপরের হাত ধরে হাটছে।পাহাড় থেকে নেমে দুজনে কটেজে যায়।
মিতুকে বিছানায় বসিয়ে মুশফিক শার্ট খুলে নেয়।গায়ে গেঞ্জি,পেশীবহুল হাত,গায়ের শক্ত গঠন ফুটে আছে,মিতু সেদিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে।মুশফিক ফাস্ট এইড বক্স এনে ফ্লোরে বসে মিতুর হাত পরিষ্কার করে বললো,
“যত যাই হোক মিতু নিজের কোনোপ্রকার ক্ষ,তি করা যাবে না।দুনিয়া উলটে যাক কিন্তু নিজেকে ভালোবাসতে হবে।মনে থাকবে?”

মুশফিকের যত্নে মিতু আপ্লুত।সে লক্ষী মেয়ের মতো বললো,
“হ্যাঁ।”
মুশফিক মাথা উঠিয়ে মিতুর দিকে তাকায়।
“আর এমন কাজ করবে?”
মিতু মাথা নেড়ে বললো,
“না।”

“আজকে তোমাকে এই অবস্থায় দেখে আমি কষ্ট পেয়েছি।আশা করি আর আমাকে কষ্ট দেবেনা।”
মিতু মাথা নেড়ে না করে।
হাতটা অনেক কেটেছে,আয়না সাথে লেগে কেটেছে যেহেতু ক্ষত গভীর।মুশফিক আহত স্থানে পরম মমতায় হাত ভুলিয়ে দেয়।

মুশফিক খুব গোছানো স্বভাবের ছেলে।তার সব কাজ পরিপাটি।সে গোসল করে কিচেনে চলে গিয়েছে,মিতু তার কাপড় পালটে বিছানায় বসে আছে।মুশফিক মিনিট বিশেকের মাঝেই খাবার নিয়ে রুমে চলে আসে।মিতু কিছু বলার আগেই ভাত মাখিয়ে মিতুর সামনে ধরে।মিতু কিছু বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু মুশফিক তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“তোমাকে দুর্বল লাগছে,সারাদিন খাওনি আমি জানি।”

মিতু আসলেই ক্ষুধার্ত ছিলো।কোনো রা শব্দ না করে চুপচাপ প্লেটের অর্ধেক খাবার খেয়ে নিলো।তারপর মুশফিক মিতুর বাকি ভাতগুলো খেয়ে নিচে চলে যায়।মিতু চুপচাপ সব দেখে।মুশফিক সবটাই বুঝি ভালোবাসার প্যাকেজ।সে ভেবে পায় না এই প্যাকেজ তার কপালে কিভাবে এলো।
বিছানায় দুজন দুইপাশে ফিরে শুয়ে আছে।কেউ কোনো কথা বলছে না,না কাছে আসছে।সময় বয়ে যায় কিন্তু কেউ ঘুমায় না। মুশফিক মিতুর দিকে তাকায়।

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরে নিঃশব্দে মিতুর কাছে এগিয়ে যায়।লতানু মেয়েলী শরীরটা আস্তে করে নিজের হাত দিয়ে পেচিয়ে নেয়।মিতুর ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“ভালোবাসি।”

মেজর পর্ব ১৬

মিতুর মনে হচ্ছে সে এখনি ম,রে যাবে।সামান্য এইটুকু ছোঁয়া যে এতো অনুভূতি সম্পন্ন হতে পারে তা জানা ছিলো না।মুশফিক কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“তুমি আসলেই তুলতুলে।”

মেজর পর্ব ১৮