মেজর পর্ব ১৬

মেজর পর্ব ১৬
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

উঁচু পাহাড়ের গায়ে নাম না জানা হাজার রকমের গাছ-গাছালি লেপ্টে আছে।মানুষ হাটার ফলে সরু চিকন রাস্তা হয়েছে মিতু সেই পথ ধরেই ছুটে যাচ্ছে।পেছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারছে যে মানুষটা তার পেছনে পেছনে আসছে,কয়েকবার গম্ভীর গলার ডাক শুনেছে কিন্তু মিতু দাঁড়ায়নি কিভাবে দাঁড়াবে তার অভিমান যে আকাশের চেয়েও বেশী হয়ে গেছে।

অবশেষে পাহাড়ের কিনারায় এসে দাঁড়ায়।উজ্জ্বল চন্দ্র আকাশ ছাপিয়ে মিষ্টি আলোয় ভুবন ঝকঝকে করে দিয়েছে,পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছে, দূরের কটেজে টিমটিমে আলো জ্ব,লছে।চাঁদের এমন অসহ্যরকম সুন্দর আলো সে আগে কখনো দেখেনি,নাকি নির্জন পাহাড় বলেই এত ভালো লাগছে।মিতু আড়চোখে পেছনে তাকায়,মুশফিক কিছুটা দূরূত্ব রেখে দাঁড়িয়েছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিতুর বুকটা অভিমানে ফুলেফেপে উঠে,মনে উঁকি দেয় হাজারও প্রশ্ন।সারাদিন যতো কষ্ট হয়েছে এই মানুষটাকে দেখে যেনো কষ্ট আরও বেড়েছে।তুষের আ,গুন যেমন দাউদাউ করে জ্বলে, মুশফিকের সানিধ্য পেয়ে যেনো মিতুর ভেতরটা এভাবেই জ্ব,লছে।কেনো!গম্ভীর, রাগী মানুষটার নরম,আবেশী,আদুরে কথা শোনার জন্য?
মুশফিক খুব ক্লান্ত।সারাদিন গাধার মতো পরিশ্রম করেছে এখন শরীরটা যেনো পাথরের মত ভারী লাগছে। বিছানায় শুয়ে যেতে পারলেই শান্তি লাগতো;

কিন্তু সব ক্লান্তি দূরে ঠেলে স্ত্রীর পেছনে ছুটে এসেছে।রা,গ যেহেতু তার কারণেই হয়েছে রা,গ ভাঙ্গানোর দায়িত্বও তার,তাছাড়া এমন কথা শোনার পরে রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক।সে আস্তে করে মিতুর পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়।
মিতু স্পষ্ট মুশফিকের কাছে আসাটা অনুভব করছে অথচ সে পেছনে ফিরে তাকায়নি। মুশফিক আস্তে করে বললো,
“এখান থেকে লাফ দেবে?”

মুশফিকের এমনতর কথায় মিতুর ভ্রুকুঞ্চন হয়ে আসে।মিতুকে এভাবে দাঁড়াতে দেখে মুশফিক বললো,
“অবশ্যই ম,রে যাবে।এত উঁচু থেকে লাফ দিলে বাঁচার সম্ভাবনা নেই।”
মিতুর ঠোঁট কেঁপে উঠে।নাক ফুলিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললো,
“আমি ম,রলে ওই মেয়েকে ঘরে আনবেন তাই না?”
মুশফিকের মুখভঙ্গি গম্ভীর।

“হুম ।তাড়াতাড়ি ম,রে যাও।”
মিতু মাথা নেড়ে বললো,
“আমি কেন ম,রতে যাবো?ম,রবে তো ওই অ,সভ্য মেয়েটা।”
“এক্সক্টলি,তুমি কেনো ম,রবে?কে কি বললো এসব ফালতু কথা শুনে এতো হ্যান্ডসাম হাজবেন্ড রেখে পাহাড় থেকে ঝা,পিয়ে পরা বুদ্ধিমানের কাজ না। ”
মিতু রা,গী চোখে মুশফিকের দিকে তাকায়। হরিণের মতো টানা চোখ থেকে টুপটুপ পানি পড়ছে।মুশফিক গম্ভীর, সুচালো দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে।

“এভাবে দৌড়ায় কেউ? এটা পাহাড়ী রাস্তা।”
রা,গ,অভিমান সব মিলিয়ে মিতু ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো,
“আপনি জানেন ওই মেয়ে আমাকে কত অপমান করেছে?বিয়ে করা স্ত্রী আমি অথচ বলে আমি নাকি… ”
“আর কি বলেছে?”

“আপনি শুনে কি করবেন?আমার ভিষণ কষ্ট হচ্ছে এখন একটুও কথা বলতে চাই না।”
মিতু নিঃশব্দে কাঁদে।মুশফিক এবার যত্ন সহকারে হাত দিয়ে কান্নাভেজা গাল মুছে, নরম কন্ঠে বললো,
“এবার বিস্তারিত বলো।এ টু জেড।”
মিতু আস্তে আস্তে সবকিছু বলে।সবকিছু শুনে মুশফিক বললো,

“সঙ্গীর ব্যাপারে কোনোকিছু শুনলে আগে তাকে জিজ্ঞেস করতে হয়।সত্য মিথ্যা যাচাই করতে হয়,এভাবে হাইপার হলে হবে?একবার আমাকে জিজ্ঞেস করবে না?একটুও বিশ্বাস নেই আমার উপর?”
মিতু মুশফিককে বিশ্বাস করে কিন্তু নয়না এমন করে বলাতে ঠিক থাকতে পারছিলো না।সে বললো,
“ও আপনার গালফ্রেন্ড?”

“নয়না আমাদের ব্যাটালিয়ন এ কর্নেল ফারুক আহম্মেদের মেয়ে।ও বোধহয় আমাকে পছন্দ করে কিন্তু আমি পাত্তা দেইনি ;আর গালফ্রেন্ড হওয়ার প্রশ্নই আসে না।আমি সবসময় সাধারণ সেনাই ভেবেছি। ”
“উনি বললো।”
“বললেই কেনো বিশ্বাস করবে?ওর কথা বেশী দামী না আমার কথা?”
মিতু মাথা নেড়ে বললো,

“আমি বিশ্বাস করিনি,আমিতো বুঝাচ্ছিলাম যে আমি আপনার স্ত্রী কিন্তু উনি বলে কিনা মুশফিক আমার,আমার মুশফিক থেকে দূরে থাকো।মুশফিক উনার হবে কেনো?মুশফিক তো আমার।”
শেষের কথাগুলো বলতে বলতে মিতু ফুপিয়ে কেঁদে ফেলে।
এত কষ্টের মাঝেও মুশফিকের ভিষণ হাসি পায়।মিতু কি সুন্দর করে বলছে মুশফিক তার,কি সুন্দর অধিকারবোধ,বুকে প্রশান্তি লাগে।সে বললো,

“তাহলে এই রা,গ কেনো?”
“আপনি নাকি ওকে ভালোবাসেন,আপনার কটেজে নাকি কত গিয়েছে আর…”
“আর কি?”
“রাত কাটিয়েছে আপনার সাথে।”
মুশফিকের চোয়াল শক্ত হয়।

“সব মিথ্যা কথা।চরিত্র এতটাও বা,জে হয়ে যায়নি যে এমন কাজ করবো।তুমি আমার বিবাহিতা স্ত্রী,তোমার সাথেই তো ইন্টিমেন্ট হইনি আর নয়না!এসব বিশ্বাস করেছো তুমি?”
“উনি এভাবে বলেছে আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো।”
মিতুর গড়িয়ে পরা চোখের পানি মুশফিক আবার মুছে দেয়।গালে লেপ্টে থাকা ভেজা চুল হাত দিয়ে সরিয়ে ; ভিষণ ভরসার গলায় বললো,

“আমার উপর বিশ্বাস রেখো।”
“আমাদের বিয়ের কথা কেউ জানে না কেনো?”
মুশফিক স্থির চোখে মিতুর দিকে তাকিয়ে আছে।দাঁত দিয়ে ঠোঁট কাঁমড়ে ধরে।মিতু আবার বললো,
“আমাদের সম্পর্ক কেনো গোপন?কেনো কেইউ জানে না?”
কিছুক্ষণ পরে মুশফিকের গম্ভীর গলায় বলে,

“গো,পন নয় মিতু কিন্তু কিছু সমস্যা আছে।আমি চাই আমার জীবনসঙ্গী সদা-সর্বদা নিরাপদ থাকুক,বিপদ যেনো তার ত্রী-সিমানায় না আসে,আর কিছুদিন পরেই সব সমস্যার সমাধান হলেই সবার সামনে তোমাকে নিয়ে যেতাম।”
মিতু মুশফিকের কথা বুঝে।সে এতটাও ইম্যাচুয়ার না যে হাজবেন্ডের কথা বুঝবেনা কিন্তু অভিমান করে চাঁদের দিকে ফিরে বললো,

“কারও সামনে নিতে হবে না।আমি কে!”
রমনীর রা,গের পারদ করেছে কিন্তু অভিমান এখনো বিদ্যমান।প্রত্যেক নারীই বোধহয় ব্যক্তিগত পুরুষের সাথে অভিমান করতে ভালোবাসে,মুখে না বললেও খুব চায় ব্যক্তিটা তার অভিমান ভাঙ্গাক। মিতুকে মুশফিক পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাধে থুতনি ঠেকিয়ে বললো,

“তুমি কে?তুমি আমার বউ,মিষ্টি বউ।”
মিতু চুপ করে থাকে কিন্তু মনের রঙ্গিন ফুল বাগিচায় ঠিকই ফুল ফুটে।মুশফিক কাধে তার খোঁচা দাড়ি যুক্ত গাল ছুঁয়িয়ে দেয়।ঠান্ডা হিম বাতসের চেয়েও মিতুর আরও বেশী ঠান্ডা অনুভব হয়,কেঁপে উঠে অন্তরাত্মা।মুশফিক আবার বললো,

“আর রা,গ করে থেকো না সোনা।বাসায় চল।”
হাজার কিলোমিটার দূরে থাকা চাঁদের দিকে তাকিয়ে মিতু বাচ্চাদের মত মাথা নেড়ে না করে।মুশফিক মিতুর চাঁদ দেখায় ব্যাঘাত ঘটায়।তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বুকে মিশিয়ে নেয়।বলিষ্ঠ হাত শক্তভাবে কোমড় আঁকড়ে ধরে রাখে।শান্ত কন্ঠে বললো,

“আমি সরি।সবাইকে বলা উচিত ছিলো আমার একটা তুলতুল আছে।”
মিতুর ছোটখাট কপালে মুশফিকের প্রসস্ত কপাল ঠেকানো।সে বললো,
“তুলতুল?”
“আমার বউ,মিতুল-তুলতুল।”
মিতু অন্যদিকে তাকাতে চায়।মুশফিক শক্ত করে ধরে বললো,

“তুমি কিন্তু আসলেই তুলতুলে,নরম আছো।”
মুশফিকের ঠোঁট টিপে হাসা দেখে মিতু বললো,
“ফ্লা,টিং করছেন?সিরয়াসলি!”
“ছিহ!আমার বউ তুলতুলে এটা বললে ফ্লা,টিং কেনো হবে?”
মিতু গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকায়।মুশফিক মিতুর নাকের ডগায় নাক ছুঁয়িয়ে বললো,

“আমরা দুজন আ,গুন আর পানির মত।আমি রেগে আ,গুন হলে তুমি পানির মতো আমাকে শীতল করবে,আর তুমি এখনের মতো আ,গ্নেয়গিরি হয়ে গেলে আমি পানির মতো তোমায় ঠান্ডা করবো।লাইক আদর করেও ঠান্ডা করতে পারি, ইটস ম্যাজিক।দুজন একসাথে রেগে গেলে পরিস্থিতি খারাপ হয়।মনে থাকবে।”
মিতু মুশফিকের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।লোকটা ভিষণ অন্যরকম।

“তুমি নাকি নয়নাকে মে,রেছো?”
মিতুর নরম চেহারা আবার শক্ত হয়ে উঠে।
“হ্যাঁ। চারটা থা,প্পড় দিয়েছি।আমার সাথে লাগতে আসে।চিনে আমি কে?”
মুশফিক মুচকি হেসে বললো,
“মেজরের বউ।”
মুশফিক থেমে আবার বললো,

“আমি নয়নাকে কথা শুনিয়ে দিয়েছি।কালকে ওর আব্বুর কাছে বলবো।এতোটা সাহস কি করে হলো?সামান্য সেনা হয়ে আমার কটেজে প্রবেশ করে কিভাবে।কর্ণেলের মেয়ে বলে নিশ্চয়ই ছেড়ে দেবো না।”
“আমি দেখেছি।”
মুশফিক ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
“কি?”
“নয়নাকে মে,রেছেন।”

মুশফিক অবাক হয়ে বললো,
“তুমি দেখেছো?তারপরও এতো রাগ,অভিমান?”
“হুহ।আমার মন শান্ত হচ্ছিলো না,অশান্তির দা,বানলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিলাম।”
মুশফিক ফের বুকের উপর মিতুকে টেনে নেয়।
“এখন দা,বানল ঠান্ডা?”
“হুহ।”

মিতু মুশফিকের দিকে ভালো করে তাকায়।সারাদিনের ইউনিফর্ম এখনো গায়ে।ইউনিফর্মে কি সুন্দর লাগছে।কিন্তু হঠাৎ কি হলো মিতুর চোখ বেয়ে আবার চোখের পানি পরতে শুরু হল,কন্ঠ হলো আরক্ত।
মুশফিক ব্যস্ত হয়ে বললো,
“আবার কি হলো?”
মিতু আমতা-আমতা করে বললো,
“আপনার আলমারিতে রাখা নাইট ড্রেসটা কার?”
মুশফিক মিতুর দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার প্রেমিকার,যে রাতে আমার সাথে থাকতো।”

মিতুর কান্না বাড়ে।সে জানে এই কথাগুলো মজা করে বলেছে কিন্তু তার কষ্ট হয়।মুশফিক বললো,
“আমার একটা বোকা বউ আছে।সে খুব চালাক আবার ভিষণ লজ্জাবতী। আমি তো পুরুষ মানুষ,বউকে একটু অন্যরকমভাবে কাছে চাচ্ছিলাম। ড্রেসটা এনে নিজে দিতে কেমন লাগছিলো তাই আলমারিতে রেখেছি যেনো কাপড় আনতে গেলে চোখে পরে আর নিজেকে সজ্জিত করে নেয় কিন্তু কিসের কি সে ভাবছে এটা কার।”
লজ্জায় মিতু বললো,

“এটা আমার জন্য ছিলো?”
“হ্যাঁ।”
মিতু মাথা নিচু করে নেয়।মুশফিক বুঝতে পারে মিতু আসলে চালাক হলেও একটু সোজা আছে,এই যে অভিমান করে,রা,গ করে।সে মিতুর হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে,
“তুমি রা,গ করোনা,এইটুকু ব্যাপারে ভেঙ্গে পড়না,মনে রেখো তোমার হাজবেন্ড একজন মেজর,যার জীবন দেশের জন উৎসর্গ করা।তুমি পাথরের মত শক্ত হতে হবে,যেকোনো কিছু শক্ত হাতে মোকাবিলা করার মনোবল থাকতে হবে।”

মেজর পর্ব ১৫

মুশফিকের এমন শক্ত শক্ত কথায় মিতুর বুকটা মুচড়ে উঠে সে বললো,
“আপনাকে একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরি?”
মুশফিক কয়েক কদম পিছু হটে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“ইয়েস,মাই ডল;কাম।”

মেজর পর্ব ১৭