মেজর শেষ পর্ব 

মেজর শেষ পর্ব 
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

সারাদিন মিতুর এতো অশান্তি লেগেছে যে সে এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।বারবার মনে হয়েছে সে কোন আগুনের চুলায় জ্বলছে।দিনের মাঝে অনেকবার মুশফিককে ফোন দেওয়া হয়েছে কিন্তু ফোন সুইচড অফ বলছে।মিতু ভেবেছে মিশনে আছে তাই বোধহয় বন্ধ।বিকেলের দিকে মিতুর ফোনে অচেনা এক নাম্বার থেকে কল আসে।ধরবেনা ধরবেনা করেও মিতু ফোনটা ধরে,

“হ্যালো।”
“মিসেস মিতু আহসান বলছেন?”
“জ্বী।”
ওপাশ থেকে সস্থির নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ শোনা গেলো।
“আমি নয়না।”
“ভালো আছেন? ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“হ্যাঁ ভালো আছি।আপনার কাছে কোন ফোনকল যায়নি এখানের অবস্থা সম্পর্কে।”
মিতুর বুকটা কেঁপে উঠে।
“কেনো কি হয়েছে?মুশফিক কোথায়?ওর ফোন বন্ধ কেনো?ও ঠিক আছে?”
“আপনি আসলেই জানেন না?”
নয়নার ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথাগুলো যেনো মিতুর দম বন্ধ করে দিচ্ছে।

“কি হয়েছে আমাকে বলবেন প্লিজ।”
“মুশফিক স্যারের কাধে গু,লি লেগেছে।”
মিতু খুব জোড়ে বললো,
“কি?”
“জ্বি।”
মিতুর হাত-পা সমানতালে কাঁপছে।কথা বলার শক্তি ফুরিয়ে আসছে।

“এখন কি অবস্থা?”
“জ্ঞান ফিরেনি।”
“আপনি কি ওখানেই আছেন? ”
“না,কাউকে এলাউ করা হচ্ছে না,আমি বাবার কাছে আপডেট জেনেছি।”
মিতু সশব্দে ফুপিয়ে উঠে।
নয়না বললো,

“ভাবলাম আপনি জানেন কি না তাই ফোন দেওয়া।মুশফিক স্যারের নিষেধ ছিলো বাসার কাউকে জানানো,তাই জানানো হয়নি।”
কান্নায় মিতুর কথা আটকে যাচ্ছে।
“আপনাকে ধন্যবাদ।”

নয়না ফোন কেটে নিজেই ফুপিয়ে উঠে, পুরোপুরি অপরাধ না হলেও মুশফিকের এই পরিস্থিতির জন্য আংশিক হলেও সে দায়ী।এখন মুশফিকের এই অবস্থান তার ভালো লাগছে না।
সে তো ভালোবাসে,মানুষটার কোন ক্ষতি চায়নি কিন্তু শেষমেশ তারই ক্ষতি হলো।

সন্ধায় মিতু বাসে উঠে বসে।অতিরিক্ত কান্নার কারণে অস্বাভাবিকভাবে চোখ ফুলে আছে।মিতু বাসায় কাউকে কিছু জানিয়ে আসেনি,এতোটা টেনশনে ছিলো হাত ব্যাগটা নিয়ে সোজা বাস স্টেশনে চলে এসেছে।এখন মনে হচ্ছে বাসায় বলা উচিত ছিলো,এভাবে চলে যাওয়াটা নিতান্তই ছেলেমানুষী।মিতু নিজের ভুলটা বুঝতে পারছে কিন্তু মনটা যে পাগলপ্রায়।তাছাড়া মুশফিক কাউকে জানাতে নিষেধ করেছে।
কিছুক্ষণ পরেই তার শাশুড়ী ফোন দেয়,মিতু ফোন রিসিভ করে বললো,

“মা আমি খাগড়াছড়ি যাচ্ছি।”
মিতুর কথায় উনি বেশ অবাক হলেন।
“ওমা! কেনো?”
মিতু এবার কেঁদেই ফেলে।
“আপনার ছেলেকে খুব মিস করছি মা,এখানে থাকবো না।”
মিতুর কথায় উনি হাসে।

“পা,গল মেয়ে।আমাকে বললেই পারতে আমি বাসে উঠিয়ে দিয়ে আসতাম।এভাবে হুটহাট না বলে চলে যায়!”
“সরি মা। ”
ফোন রেখে মিতু নিঃশ্বাস ফেলে।মুশফিক তার অসুস্থতার কথা পরিবারকে জানাতে চায়নি,তাই মিতুও কাউকে বলবেনা।

সারা রাস্তা মিতু কান্না করতে করতে আসে,মুশফিকের বলা কথাগুলো, দুজনের একসাথে কাটানো সময়,সব যেনো সুচের মতো মিতুর বুকে ফুটছে।বাসে অনেক মানুষজন,মিতুর কান্নার শব্দ হচ্ছে,সে কাপড় দিয়ে মুখ চেপে ধরে।তার মনে হচ্ছে বুকটা ভেঙ্গে যাবে।অসহনীয় যন্ত্রনায় মুখ নীল হয়ে যায়।মুশফিকের বলা কথাটা মনে করে,
“তোমায় শক্ত হতে হবে মিতু,যেকোনো পরিস্থিতি মাথা ঠান্ডা রেখে সামলাতে হবে।”

মুশফিকের কথাটা মেনে মিতু নিজেকে,শান্ত, স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু প্রতিবারই সে ব্যর্থ হচ্ছে,চুপ থাকার চেষ্টা করলেই কান্নার চুটে দেহ ঢুকরে উঠে।
ভোর চারটায় মিতু ক্যান্টনমেন্ট হসপিটালে গিয়ে পৌছায়।হাত পায়ের কাঁপনের জন্য ঠিকঠাক হাটতে পারছেনা। তাকে দেখে কাইয়ুম হাসান চমকে যায়।

“আপনি?আপনার তো ঢাকায় থাকার কথা।”
মিতু বেশ স্বাভাবিক গলায় বললো,
“আমি মাত্র এসেছি।এখন কি অবস্থা?”
“জ্ঞান ফিরেছে ঘন্টা পাঁচেক আগে, ওষুধের কারণে ঘুমাচ্ছে।”
“ঝুকির বাহিরে এখন?”
“হ্যাঁ, আলহামদুলিল্লাহ।”

কাইয়ুম হাসান মেয়েটার অস্থিরতা অনুভব করেন।
“আমি কি একটু দেখা করতে পারি?”
কাইয়ুম হাসান খানিক ভাবলেন তারপর বললেন,
“হ্যাঁ যেতে পারেন কিন্তু মুশফিককে ডাকা যাবে না,কোন কান্নাকাটি করা যাবে না।”
“ঠিক আছে। ”

মিতু দরজা ঠেলে ঠান্ডা রুমটায় প্রবেশ করে।ধীর পায়ে ঘুমন্ত মানুষটার দিকে এগিয়ে যায়।সাদা বিছানায় খালি গায়ে শুয়ে আছে।কাধের দিকটা সবটাই ব্যান্ডেজ করা।মিতু মুশফিকের কপালে চুমু দেয়,গালে হাত ভুলিয়ে দেয়,কাঁদবেনা কাঁদবেনা করেও কেঁদে ফেলে।স্বামীর অসুস্থ চেহারার দিকে তাকিয়ে মিতুর চোখের পানি বাধভাঙ্গাভাবে ছুটে।এই মূহুর্তে মিতুর আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া মুশফিক সুস্থ হয়ে উঠুক,আগের মতো তার কাছে ফিরে আসুক।

মুশফিক চোখ খুলে তাকায়।এতোক্ষণ তার মনে হয়েছে বিশাল কোন সাগর পাড়ি দিয়ে এসেছে,তৃষ্ণায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে।হাত নাড়াতে গিয়ে লক্ষ করে হাতের কাছে কেউ আছে।ভালো করে পূর্ণদৃষ্টিমেলে তাকিয়ে দেখে এই মানুষটা তার অর্ধাঙ্গিনী।যাকে দেখলে শরীরের অর্ধেক অসুখ বিনা ওষুধে ভালো হয়ে যায়।মুশফিক একদৃষ্টিতে মিতুর দিকে তাকিয়ে আছে,মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে অথচ কান্নার দাগগুলো এখনো স্পষ্ট,মেয়েটা কি খুব কেঁদেছে? কখন এসেছে তার হরিণটা?আর খবরইবা কে দিলো,এতোটা রাস্তা একা এসেছে?

মুশফিক চুপচাপ মিতুর দিকে তাকিয়ে আছে।কিছুক্ষণ পরে মিতু চোখ খুলে তাকায় মুশফিককে তাকাতে দেখে সশব্দে কেঁদে দেয়,মুশফিকের ভালো হাতটা টেনে বুকে চেপে ধরে বুঝাতে চায় সে কতোটা মিস করেছে,ভয় পেয়েছে।ভিষণ অসুস্থ শরীর নিয়েও মুশফিক হাসার চেষ্টা করে।

“আমি ভালো আছি। ”
মিতু কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
“এটাকে ভালো থাকা বলে না।আপনি এমন কেনো?পরিবারকে জানাতে না করেছেন কেনো?যদি কিছু হয়ে যেতো?”
মুশফিকের চোখের কোনে পানি জমে,

“কিছু হয়নি তো।কেঁদো না।”
“তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠুন।”
“একা আসতে গেলে কেনো?”
“না আসলে আমিই ম,রে যেতাম।”
“পা,গল।”
মিতু মুশফিকের হাতে মুখে হাজারও চুমুর বর্ষণ এঁকে দেয়।পা,গল রমনী প্রিয় মানুষটাকে বুঝাতে চায় সে কতোটা উতলা,কতোটা উদগ্রীব।

মুশফিক চুপচাপ মিতুর পাগলামিগুলো দেখে।
নয়না নিঃশব্দে কাঁদছে।কাইয়ুম হাসান বজ্রপাতের মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।হাতের প্রমানগুলো কাটার মতো গায়ে বিধছে।মুশফিক চুপচাপ নয়নাকে পর্যবেক্ষণ করছে,এটাকে ভালোবাসা বলে?কোন ক্ষেত্রে?এমন নিন্দনীয় কাজ করে কিভাবে ভালোবাসার প্রমাণ দিতে আসে?নয়নার ভুলের জন্যই মিতু একবার ম,রতে ম,রতে বেঁচে গিয়েছে।মুশফিকের একরত্তিও ইচ্ছে করছে না নয়নার সাথে কথা বলতে কিংবা তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে।
জেনারেল অফিসার বললো,

“এমন দেশদ্রো,হীতা করার জন্য তোমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলো,আর এখন গ্রেফতার করা হবে।”
নয়না মাথা নিচু করে কাঁদছে।কাইয়ুম হাসান লজ্জিত।মেয়ের এমন কাজে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।জানা যায় মুশফিক আর মিতু ঘুরতে যাওয়ার সময় নয়না তাদের পিছু গিয়েছিলো,তখনই মতিনের সাথে পরিচয়।মিতু তাদের কটেজে ঢুকতে সাহায্য করেছিলো তারপরে যদিও আর কোন কথা শুনতে রাজী ছিলো না কিন্তু মতিন ব্লাকমেইল করে সব করতে বাধ্য করেছে।মেয়ের কথা শুনে কাইয়ুম হাসান খেকিয়ে উঠে,

“তোমায় ব্লাকমেইল করে আর তুমি আমাকে বলতে পারোনি?”
“ভয় পেয়েছিলাম।”
“ভয় পেয়েছিলে!ভয় পেলে কালো দলের সাথে হাত মেলানোর সাহস পেতে না।এখন তো পুরো জীবন শেষ,এখন ভয় পাচ্ছ না।”
নয়নাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

মিতু সেদিকে তাকিয়ে ভাবে,ভালোবাসা যেমন নরম হয় তেমনি ভ,য়ংকরও হয়।
পরে নয়নাকে টোপ হিসেবে দিয়ে মতিনকে ধরা হয়।ভুল পথে গিয়ে এভাবেই নয়নার জীবনটা নষ্ট হলো।আসল কথা হচ্ছে যে তোমাকে চায় না তুমি তাকে জোড় করে নিজের করে নেওয়ার চেষ্টা করোনা,কারণ তুমি ভালোবাসলেই হবে না অপরদিকের মানুষটাও তোমাকে ভালোবাসতে হবে তাহলেই ভালোবাসা সুন্দর।

সাপ্তাহ তিনেক পরে মুশফিক সুস্থ হয়।সাদা বিছানায় বুকে এক সাদা রমনীকে নিয়ে শুয়ে আছে।রমনীটা নিঃসন্দেহে মিতু,মুশফিকের মিতুল-তুলতুল।মিতু লজ্জামাখা দৃষ্টি মেলে মুশফিকের দিকে তাকায়।মানুষটার ছোঁয়াগুলো যেনো এখনো নতুন,গা কাঁপিয়ে দেয়ার মতো।এই যে এখনো মিতু লজ্জা পাচ্ছে,লজ্জায় গাল লাল হয়ে যাচ্ছে।মুশফিক মিতুর ঠোঁটে ছোট ছোট চুমু দিয়ে বললো,

“ভালোবাসি আমার ছোট হরিণ।”
মিতু চুপচাপ বুকে শুয়ে থাকে।মুশফিক বললো,
“মিতু ওওইদিনের মতো আমাদের জীবনে এমন ঝড় আরও অনেক আসতে পারে,বলেছিলাম না চাকরির প্রথম দিনই নিজের জীবনটা দেশের নামে উৎস্বর্গ করে দিয়েছি,কোন কিছুতেই আর পিছুপা হই না।”
“হুম।”

মেজর পর্ব ২৯

“তুমি শক্ত থাকবে।তুমি শক্ত থাকলে আমি আরও জোর পাই।”
মিতু জুলুজুলু চোখ নিয়ে মুশফিকের দিকে তাকিয়ে আছে।মুশফিক বিড়ালটাকে আদর করার লোভ সামলাতে পারলো না।পুরুষালী ঠোঁট দিয়ে আঁকড়ে ধরলো পেলব কোমল ঠোঁটজোড়া।ভালোবাসা তখনি সুন্দর যখন দুজনের সইচ্ছা,আগ্রহ,আর সম্মান সমান থাকে।