বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ১৫

বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ১৫
নিশাত জাহান নিশি

“তুমি তুমি বলে আমার মন গলাতে চাইলেও আমার মন গলবেনা! তোমার কোনো ইচ্ছেই নেই আমাদের মেয়ে সন্তান হোক।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মিশাল। সামান্তার অভিমানী মুখ থেকে দৃষ্টি জোড়া ফিরিয়ে নিলো। উল্টো পাশ ফিরে গম্ভীর সুরে বলল,

“লাইফে ফার্স্ট টাইম কাউকে সাহস করে তুমি করে বললাম। কোথায় সে তার জন্য খুশি উদযাপন করবে তা না ইললজিক্যাল বিষয় নিয়ে অযথা আমার সাথে ঝগড়াঝাটি করছে। হোয়াট দ্য লাক!”
মুখ গোমড়ো করে মিশাল গাড়ি স্টার্ট করে দিলো। সামান্তা মনে মনে বকবক করতে লাগল। বুকের ওপর দু’হাত গুজে সে বেশ রাগান্বিত গলায় বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“হ্যাঁ ইললজিক্যাল বিষয়। মেয়ে সন্তান চাওয়াটা তো ইললজিক্যাল বিষয়। চাইলেই তো আল্লাহ্ দিবে না কি? চাওয়ার মত করে চাইলে আল্লাহ্ অবশ্যই আমাদের মেয়ে সন্তান দিবেন। এই ইডিয়টটাকে এটাই বুঝানো যাচ্ছেনা। আল্লাহ্ আল্লাহ্ করে শুধু বিয়েটা হয়ে নিক জাস্ট। সব প্রতিশোধ আমি একসাথে নিব। সাহিল ভাই বিয়ের মজা এখন যেমন হারে হারে টের পাচ্ছে। এই লোকটাও সেই মজা টের পাবে। মাসে কয়দিন যায় তখন বুঝবে।”
হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে সামান্তা তার রাগ ঝাড়তে ব্যস্ত। মিশাল কেবল আড়চোখে তাকাচ্ছে সামান্তার দিকে। গলা ঝাঁকিয়ে সে ব্যগ্র হেসে শুধাল,

“কি ব্যাপার? মনে মনে আমাকে মারার প্ল্যানিং চলছে?”
নিরুত্তর সামান্তা। মিশালের দিকে ফিরেও তাকালো না সে। কেবল ভেতরে ভেতরে রাগ পুষতে লাগল। আচমকা মিশাল কেমন যেন ভারী গলায় বলে ওঠল,
“যদিও হাতে সময় বেশি নেই আমার! হয়ত আগামী মাসের মধ্যেই আমাকে ইতালি ব্যাক করতে হবে!”
মিশালের এই কথায় যেন সামান্তা থতমত খেয়ে ওঠল। করুণ দৃষ্টিতে সে পাশ ফিরে মিশালের দিকে তাকালো। ড্রাইভিংয়ে ব্যস্ত থাকা মিশালের দিকে সে কম্পিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“মামানে? এলেই তো কয়দিন হলো।”
“হুম। সাথে করে যে টাকাপয়সা নিয়ে এসেছিলাম সব শেষ! বাড়ির কাজ তো এখনও ধরিইনি। রুমকির বিয়েরও বাকি। কত দায়িত্ব আমার কাঁধে বল?”
“আমার সার্জারির জন্যই তোমার এই কাজগুলো বাকি রয়ে গেল তাইনা?”
“এভাবে বলছিস কেন? আর দেড়টা বছর সময় পেলেই ইন শা আল্লাহ্ সব ঠিক হয়ে যাবে। দিবি আমায় দেড়টা বছর সময়?”

সামান্তা তার উত্তর জানালোনা! চোখ ভরা জল ও বুকভরা ব্যথা নিয়ে সে অন্যপাশ ফিরে গেল। এই সবকিছুর জন্য সামান্তা নিজেকে দোষী সাবস্ত করতে লাগল! কত লাখ লাখ টাকা অনায়াসে সামান্তার পেছনে ব্যয় করেছে মিশাল। সব তার জেদের কারণেই হয়েছে। মিশাল ও তেমন কথা বাড়াতে চাইলনা। রুমকিকে বিয়ে দেওয়ার আগে মিশাল তার বিয়ের কথা ভাবতে পারছেনা! হুট করেই এই চিন্তাটা তার মাথায় এলো। সামান্তাকে বুঝালে অবশ্যই সামান্তা বুঝবে। তবে এখন ঘাঁটানো উচিত হবেনা।

আগামীকাল না হয় ঠান্ডা মাথায় এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাবে।
কিছুক্ষণ পর মিশাল ও সামান্তা তাদের বাড়ি এসে পৌঁছাল। সামান্তাকে পূর্বের ন্যায় ফিরে পেয়ে তার বাড়ির সবাই খুশি। আবেগে আপ্লুত তারা। এই রাতে কারো চোখে কোনো ঘুম নেই। সবাই সামান্তাকে নিয়ে হাসিখুশিতে মেতে ছিল। রুমকি ও শাহনাজ বেগমও সামান্তাদের বাড়িতে ছিল। তবে মিশাল তার বাড়ি ফিরে এলো। শরীর তার ক্লান্ত এবং দু-চোখ জুড়ে ঘুম। দুর্বল শরীর নিয়ে মিশাল ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে পরল। কিছু সময়ের মধ্যে তার চোখেও ঘুম লেগে এলো।

পরের দিন ঘুম ভাঙতেই মিশাল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সকাল প্রায় এগারোটা বাজতে চলছে ঘড়িতে। ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে সে বিছানা থেকে ওঠল। তবে অবাক হলো কেউ তাকে ডাকতে এলোনা! সেই চিন্তা মাথায় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে মিশাল রুম থেকে বের হতেই দেখল তাদের বাড়ির ড্রয়িংরুমে দুজন মুরুব্বি মহিলা বসে রয়েছেন। তাদের পাশে হাসিমুখে শাহনাজ বেগম বসে আছেন। তিনজন বেশ মনোযোগ দিয়ে নিজেদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়ে আলোচনা করছেন। কৌতূহল বশত মিশাল তাদের দিকে এগিয়ে যেতেই দুজন মুরুব্বি থেকে একজন মুরুব্বি হঠাৎ মৃদু হেসে মিশালের দিকে প্রশ্ন ছুড়লেন,

“তুমিই তো মেয়ের বড়ো ভাই?”
কপাল কুঁচকালো মিশাল। নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ঘুম থেকে ওঠার পর তার মাথা কাজ করছিলনা। কিছুই যেন বুঝতে পারছিলনা সে। ইতোমধ্যেই শাহনাজ বেগম বসা থেকে ওঠে মিশালের পাশে দাড়ালেন। জোরপূর্বক হেসে মহিলাটিকে বললেন,

“হ্যাঁ এটাই মেয়ের বড়ো ভাই। একমাস হলো ইতালি থেকে এসেছে। আচ্ছা আপনারা এখন আসুন। চলুন চলুন আমি আপনাদের এগিয়ে দিচ্ছি।”
বেশ তাড়াহুড়ো করে শাহনাজ বেগম মুরুব্বি দুজনকে বাড়ির বাইরে অবধি ছেড়ে এলেন। তারা যেতে চাচ্ছিলনা তবুও যেন শাহনাজ বেগম তাদের জোর করে বের করে দিচ্ছিলেন। বিষয়টায় মিশাল সন্দেহ প্রকাশ করল। শাহনাজ বেগম ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতেই মিশাল সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“কি ব্যাপার মা? তাঁরা কারা ছিলেন? আর আপনিই বা তাদের এভাবে জোর করে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছিলেন কেন?”
ব্যস্ততা দেখালেন শাহনাজ বেগম। রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হয়ে তিনি মিশালকে লক্ষ্য করে বললেন,
“এসব বাদ দে এখন। আগে নাশতা কর। কত বেলা হয়ে গেল বল? তুই ঘুমুচ্ছিলি বলে তোকে আর ডাকিনি আমি।”
শাহনাজ বেগমের পিছু পিছু মিশালও রান্নাঘরে গেল। প্রসঙ্গ পাল্টানো তার মোটেও পছন্দ হলোনা। নাছোড়বান্দা গলায় সে পুনরায় বলল,

“মা প্লিজ আমার প্রশ্নের উত্তর দিন আগে। কি লুকুচ্ছেন আমার কাছ থেকে বলুন?”
গ্যাসে চা গরম করতে বসিয়ে শাহনাজ বেগম পিছু ফিরে একরোঁখা মিশালের দিকে তাকালেন। বুকে হাত গুজে তিনি ধীর গলায় বললেন,

“রুমকির জন্য বিয়ে নিয়ে এসেছেন তারা। অনেক বড়োলোক বাড়ির ছেলে। কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি তাদের। ব্যবসা বানিজ্যের তো অভাবই নেই। এত বড়ো বাড়িতে কি আমাদের মত নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েকে বিয়ে দেওয়া ঠিক হবে? তাই তাড়িয়ে দিয়েছি তাদের।”

“ছেলের বায়োডাটা আছে আপনার কাছে?”
“আমার ফোনে আছে। কেন?”
“দেখান তো।”
“দেখে লাভ নেই মিশাল। আমরা এত বড়ো বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দিতে পারবনা। তাদের হয়ত চাহিদারও শেষ নেই। তাছাড়া এখন তো ভুলেও নয়। আমি জানি এখন তোর অবস্থান কি। হাত পুরো ফাঁকা। এই অবস্থায় কোনোকিছুতেই আগানো ঠিক হবেনা।”

“আপনাকে বলছি বায়োডাটাটা দিতে, দিন। আমার হাত ফাঁকা তো কি হয়েছে? এসবের জন্য আমার বোনের বিয়ে আটকে থাকবেনা। কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হবে। আগে আমি খোঁজ খবর নিয়ে দেখি ছেলে কেমন। এরপর বাকিটা পরে দেখা যাবে।”

মিশালের জেদের কাছে হার মেনে শাহনাজ বেগম বাধ্য হলেন ছেলের বায়োডাটাটি মিশালকে দেখাতে। সকালের নাশতা শেষে মিশাল বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল ছেলের খোঁজখবর নিতে। তার কাছের একজন বন্ধুকে সাথে করে নিয়ে গেল। বন্ধুর বাইকে করেই দুজন রওনা হলো। ঠিকানা অনুযায়ী মিশাল ছেলের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। ছয়তলা একটি বিশাল ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে মিশাল এবং তার বন্ধু।

এই বিশাল ভবনটি ছেলেদের। আশপাশ থেকে খোঁজখবর নিয়ে মিশাল জানতে পারল ছেলে এবং ছেলের পরিবার যেমন টাকা পয়সাওয়ালা তেমন নম্রভদ্র এবং দানশীল। কোনো ব্যাড রেকর্ড নেই তাদের। সাহস পেল মিশাল। তবে অভয়ে এই সম্বন্ধতে আগানোই যাই। ফুরফুরা মন নিয়ে মিশাল তার বন্ধুসহ আশেপাশের একটি রেস্টুরেন্টে গেল কফি খেতে। ঘাঁড় থেকে একটি দায়িত্ব বুঝি তার দূর হতে লাগল!

রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশ করে দুজন বাঁ পাশের একটি খালি টেবিলে বসল। আশেপাশে মিশালের চোখ না গেলেও মিশালের বন্ধু জুবিনের হঠাৎই ডান পাশের মাঝের সারির টেবিলটিতে চোখ গেল। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সে মিশালকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠল,

“মিশাল? এই দেখ সামান্তা ভাবি, ঐ ছেলেটার সাথে বসে। এইমাত্র আমরা যার খোঁজখবর নিয়ে এলাম!”
হকচকিয়ে ওঠে মিশাল জুবিনের দৃষ্টিকে লক্ষ্য করে ডান পাশের টেবিলটিতে তাকিয়ে দেখল সত্যিই সামান্তা ও রুমকির জন্য ঠিক করা ছেলেটি মুখোমুখি বসে হেসে হেসে কথা বলছে! মনে হচ্ছে যেন দুজন দুজনকে দীর্ঘদিন থেকেই চেনে। মাথায় রক্ত ওঠে গেল মিশালের। একে তো সামান্তার ওপর সে এমনিতেই ক্ষেপে আছে। কারণ সকালে ওঠে সামান্তার মুখটা অবধিও দেখতে পায়নি সে। তার সাথে একটিবার দেখা করতেও আসেনি সামান্তা। অথচ এদিকে সে সেজেগুজে অন্য একটা ছেলের সাথে দেখা করতে চলে এসেছে? তাও আবার সেই ছেলে যে ছেলেকে কিনা মিশাল তার বোনের জন্য পছন্দ করেছে!

মিশাল তার রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলনা। মাথায় যেন আগুন ধরে গেল তার। তরতরিয়ে হেঁটে সে সামান্তাদের টেবিলের কাছটিতে চলে এলো। টেবিলের ওপর সশব্দে হাত রেখে সে বিচলিত সামান্তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। চোয়াল উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,
“এই তুই এখানে কি করছিস? আর এই ছেলেটিই বা কে?”

শুকনো ঢোঁক গিলল সামান্তা। কোথা থেকে ওড়ে এলো এই মিশাল? যেখানে বাঘের ভয় তবে সেখানেই সন্ধ্যে হয়? এজন্যই মিশালকে কিছু না জানিয়ে সে এখানে আসতে চায়নি। তবে এক প্রকার বাধ্য হয়েই মিশালকে কিছু না জানিয়েই এখানে আসতে হলো তার। তৌহিদ অর্থাৎ রুমকির জন্য ঠিক করা ছেলেটি হঠাৎ মিশালের ওপর রেগে গেল! কড়া গলায় সে প্রশ্ন ছুড়ল,

“এই আপনি কে? আমাদের মাঝখানে এসে সিনক্রিয়েট করছেন কেন?”
মিশাল এবার রক্তশূল দৃষ্টিতে তৌহিদের দিকে ফিরে তাকালো। চড় দুটো দিয়ে ছেলেটিকে জায়গায় চুপ করিয়ে রাখতে মন চাইছে তার! মেজাজের বারোটা বেজে গেলে এখন সে হয়ত তাই করবে। বোনের জন্য এই ছেলেকে পছন্দ করেছে বলে মিশাল চুপচাপ রইল। সামান্তা বুঝতে পারল বিষয়টি। মিশালকে এখান থেকে না নিয়ে গেলে বিষয়টি আরও বিগড়ে যেতে পারে। বসা থেকে তৎক্ষণাৎ ওঠে গেল সামান্তা। হাত জোর করে তৌহিদকে বলল,

“আ’ম সো সরি তৌহিদ। রাতে আমি ফোন করে তোমাকে ব্যাপারটা খুলে বলব। এখন আমি ওঠছি কেমন?”
জিদ্দি মিশালকে কোনো রকমে টেনে হেঁছড়ে সামান্তা বাড়ি নিয়ে এলো। মিশালের শক্তির সাথে যেন পেরেই ওঠছিলনা সে। মিশালের রুমে প্রবেশ করে সামান্তা রুমের দরোজাটি ভেতর থেকে আটকে দিলো। বিষধর সাপের ন্যায় মিশাল ফোঁসফোঁস করে সামান্তার দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“তুই কিন্তু এখনও বলিসনি ছেলেটি কে? ছেলেটির সাথে তোর কিসের সম্পর্ক?”
স্থির হওয়ার চেষ্টা করল সামান্তা। মিশালের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে জবাবে শান্ত গলায় বলল,
“এত হাইপার হয়োনা প্লিজ। আমি বলছি ছেলেটি কে।”
“হ্যাঁ তো বল। তাড়াতাড়ি বল। মাথা কিন্তু গরম হয়ে যাচ্ছে আমার।”

“ছেলেটি হলো আমার অফিসের বসের ছেলে। আমি যে অফিসে আগে কাজ করতাম সেই অফিসের বসের ছেলে।”
“হ্যাঁ। তো? এখন তো জব ছেড়ে দিয়েছিস এখন আবার তার সাথে কিসের দেখা? কি চলছে তোদের মধ্যে আমাকে বল?”

বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ১৪

“আমি আমার জন্য তার সাথে দেখা করতে যাইনি মিশাল। গিয়েছিলাম অন্য কারণে।”
“কি কারণ বল? না হয় চড় থাপ্পড় খেয়ে ফেলবি অ্যানি টাইম।”
“কারণটা জানার পর তুমি রুমকিকে বকবেনা তো?”

বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ১৬