বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ১১

বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ১১
নিশাত জাহান নিশি

“ই’ডিয়’ট সাহিলের বা’চ্চা। কায়দা করে তোমার বৌয়ের জন্য ওসব আনিয়েছ তাইনা? একটুর জন্য সামুর কাছে ধরা খেয়ে যাচ্ছিলাম আমি! এখন তাকে আমি ড্রেস দেখাব কোথা থেকে? ইউ বি’চ তোমাকে আজ আমি ছাড়বনা।”

হন্তদন্ত হয়ে মিশাল ছুটে গেল সাহিল ও জেনিয়ার রুমের দিকে। দেখল রুমটির দরোজা খোলা। তবে রুমটির ভেতরে কারো সাড়া শব্দ নেই। মিশাল ভাবল রুমে হয়ত কেউ নেই। হতাশ হলো সে। বাড়ির কোথায় এখন খুঁজবে তাকে। ইতোমধ্যেই সাহিল হুড়োহুড়ি করে রুম থেকে বের হয়ে এলো। অফিস থেকে তার জরুরি কল এসেছে। এক্ষণি যেতে হবে তাকে। দুজন দুজনের মুখোমুখি হয়ে গেল। অমনি চোখ রাঙিয়ে ওঠল মিশাল। দাঁতে দাঁত চেপে নির্বোধ সাহিলের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“সেদিন কি বলেছিলে তুমি? তোমার থেকে টিপস চাওয়াতে কি বলেছিলে তুমি? ইনারের প্রোডাক্ট মেয়েরা পছন্দ করে? ড্রেস না এনে এসব আনতে সামান্তার জন্য?”
কুচুটে হেসে সাহিল বলল,
“তার মানে ইনারের প্রোডাক্টস এনেছিস তুই? কই? দেখি দেখি?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ দেখবেই তো। তোমার বউয়ের জন্যই তো এসব আনিয়েছ আমার হাত দিয়ে। আমাকে বোকা বানিয়ে! আমি আসলেই একটা ডা’ফার। তোমার দুষ্টু বুদ্ধি শুনেছি। তবে আমি তোমাকে আজ ছাড়বনা। আজ তোমার একদিন কি আমার একদিন।”
মিশালের হাত থেকে ব্যাগটি কেড়ে নিয়ে সাহিল হু হা করে হেসে দৌঁড়ে পালালো জায়গা থেকে। তার পেছনে ছুটতে থাকা মিশালকে কিঞ্চিৎ উচ্চশব্দে বলে গেল,

“মাথাটা একটু খাঁটা তাহলেই বুঝতে পারবি মেয়েরা কিসে খুশি হয়। আই থিংক সামান্তাকে খুশি করার জন্য তোর কারো কাছ থেকে কোনো টিপসের প্রয়োজন নেই। তোর একার চিন্তাভাবনাই যথেষ্ট।”
থেমে গেল মিশাল। সাহিল মন্দ কিছু বলেনি তাকে। ভাবতে লাগল সামান্তাকে কিভাবে খুশি করা যায়। ইতোমধ্যেই সামান্তা এসে মিশালের পেছনের দিকটায় দাঁড়ালো। পেছন থেকে কেমন যেন শুকনো গলায় বলল,

“আমি বুঝেছি মিশাল ভাইয়া। তুমি আমার জন্য কিছু আনোনি। কোনো প্রবলেম নেই এতে। আমি কিছু মনে করিনি। আমি যে মিশালকে দেড় বছর আগে নিজের ইচ্ছেতে আমার কাছ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে পাঠিয়েছিলাম সেই মিশাল পূর্বের ন্যায় আমার কাছে ফিরে এসেছে আমি এতেই সন্তুষ্ট। আমার আর কিছুর প্রয়োজন নেই। তুমিই আমার জন্য বেস্ট গিফট।”

ম্লান হেসে সামান্তা পেছন থেকে মিশালকে জড়িয়ে ধরল। মিশালের বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলোনা সামান্তা একটু হলেও দুঃখী। এনগেজমেন্টের জন্য মিশাল সামান্তার জন্য যে ডায়মন্ডের রিংটি এনেছে তা এখনি সে কাউকে দেখাতে বা বলতে চাচ্ছেনা সারপ্রাইজ হিসেবে রাখতে চাচ্ছে! তবে সামান্তার জন্য গিফট হিসেবে টুকটাক কিছু আনা উচিত ছিল তার। সবার জন্য কেনাকাটা করতে করতে মাথা থেকে এসব বের হয়ে গিয়েছিল তার। পিছু ঘুরল মিশাল। সামান্তাকে তার বুকের বাঁ পাশে ঠায় দিলো। প্রস্তাব রেখে বলল,

“আজ রাতে খাওয়াদাওয়ার পর ঘুমোবিনা ওকে?”
“মানে? কেন?”
“বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পরলে আমরা বের হবো।”
“কি বলো? এত রাতে?”
“হ্যাঁ তো কি হয়েছে? আমি থাকতে ভয় কিসের?”

“না বাবা এত রাতে বের হওয়াটা রিস্ক হয়ে যাবে। আমরা কোথাও বের হবোনা।”
“বললাম তো আমি থাকতে কোনো রিস্ক নেই। আমার ওপর ট্রাস্ট নেই তোর?”
“আছে। বাট এত রাতে বের হওয়াটা কি খুব প্রয়োজন বলো? তাছাড়া যাবেটা কোথায়?”
“যেদিকে দু-চোখ যায় সেদিকেই হারিয়ে যাব! তাছাড়া তোর তো বাইকে করে লং ড্রাইভে যাওয়ার অনেক ক্রেইজ ছিল। কখনও তো তোর কোনো ইচ্ছে পূরণ করতে পারিনি। এখন যেহেতু সময় সুযোগ এসে গেছে তাই ভাবলাম সার্জারির আগে তোর সব শখ পূরণ করে দিব।”

“কেন? সার্জারির পর কি আমাদের আর দেখা হব না? লাইফ রিস্ক আছে আমার?”
নীরব মিশাল! সামান্তাকে ছেড়ে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। মাথা নুইয়ে বাড়ির সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সোজা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। ফোন করে সাহিলের কাছ থেকে বাইকের চাবি চেয়ে নিলো। মিশালের যেহেতু এখনও বাইক কেনার সময় হয়ে ওঠেনি তাই সাহিলের বাইক দিয়েই কাজ চালাতে হবে তার।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সাহিলের বাড়ি থেকে বাইক নিয়ে মিশাল শপিং মলের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। সামান্তা ঐ সময় ভুল কোনো প্রশ্ন করেনি তাকে। সামান্তার সার্জারিতে রিস্ক রয়েছে বটে! তবে এই রিস্কের কথা সামান্তাকে বলা যাবেনা এক্ষণি। তবে যে সামান্তা ভেঙে পরবে। নীরবে জ্বলে পুড়ে খাঁক হচ্ছে মিশাল। উপর ওয়ালার কাছে শুধু একটিই ফরিয়াদ, জীবনের এই সুখের সময়টিতে যেন উপর ওয়ালা তার প্রতি আর কোনো অবিচার না করে!

পরিবারের সাথে রাতের খাবার সম্পন্ন করল মিশাল। খাবার শেষে সাহিলদের পরিবার ও সামান্তাদের পরিবার তাদের বাড়ি ফিরে গেল। জোর করেও তাদের রাখা গেলনা। সামান্তাও বাড়ি ফিরতে যাবে তবে সুযোগ বুঝে মিশাল সামান্তাকে তার রুমে টেনে নিয়ে এলো! ধুপধাপ করে রুমের দরোজা বন্ধ করে দিলো। ভড়কে ওঠল সামান্তা। বুকের হাত চেপে ধরে ভয়ার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল মিশালের দিকে। কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“পাগল হয়ে গেছ তুমি? এভাবে টেনেহেঁছড়ে রুমে আনার কি প্রয়োজন ছিল?”
অমনি সামান্তার হাতটি ছেড়ে মিশাল বিছানার ওপর থেকে বিশাল বড়ো একটি ডালা সামান্তার হাতে তুলে দিলো! একগাল হেসে বলল,

“এটা নিয়ে এখন বাড়ি যাবি। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পরলে সুযোগ বুঝে রেডি হয়ে আমাকে একটা মিসড কল দিবি। আমি বাইক নিয়ে তোদের মেইন গেইটে তোর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকব।”
সামান্তাকে কথা বাড়ানোর আর কোনো সুযোগ দিলোনা মিশাল। ঠেলেঠুলে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো। সামান্তা প্রস্থান নিতেই শাহনাজ বেগম মিশালের রুমে এসে প্রবেশ করলেন। মা-ছেলে পাশাপাশি বিছানার ওপর পা ঝুলিয়ে বসল। নিশ্চুপ মিশাল। গলা ঝেড়ে শাহনাজ বেগম মিশালের দিকে প্রশ্ন ছুড়লেন,

“আমি বলছিলাম কি বাড়ির কাজ ধরার আগে সামান্তার সার্জারিটা সেরে ফেললে বোধ হয় ভালো হবে। কি বলিস তুই?”
“আমিও তাই ভাবছি মা। তবে সার্জারির আগে এনগেজমেন্টটা জরুরি!”
“তোর যা ভালো মনে হয় কর। তা সার্জারির কথাবার্তা কতদূর এগুলে? টাকাপয়সার বন্দোবস্ত আছে তো?”
“টাকা-পয়সা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবেনা মা। আমি সেই ক্যাপাসিটি করেই দেশে এসেছি। আগামী একমাসের মধ্যেই সামান্তার সার্জারি হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ্।”

“বাহ্, বেশ ভালো খবর। খুশি হলাম শুনে। তোরা হয়ত আজ কোথাও যাওয়ার প্ল্যানিং করছিস তাই তো?”
জোরপূর্বক হাসল মিশাল। মাথা চুলকে বলল,
“ঐ আর কি।”
“ঘুরে আয়। মন ভালো হবে। আমি আসছি তবে। যাত্রা শুভ হোক তোদের।”

মিটিমিটি হেসে শাহনাজ বেগম রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। সামান্তার জন্য আনা কালো শাড়ির সাথে ম্যাচ করে মিশালও কালো রঙের একটি পাঞ্জাবি পরল। ঐদিকে সামান্তা বাড়ি ফিরে ডালাটি খুলে জাস্ট বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। কালো শাড়ি, ম্যাচিং করা অরনামেন্টস, চুড়ি, টিপের পাতা, গাজরা ফুল, আলতা, মেহেদির বক্স, চকলেটস, কারুকাজ করা ছোটো একটি আয়না। এসব দেখে সামান্তা থ হয়ে গেল।

এই কম সময়ের মধ্যে এতকিছু এরেঞ্জ করে ফেলেছে মিশাল? সাইফা ও সায়মা চকলেটস নিয়ে ঝগড়া লেগে গেল। সে কি তুমুল ঝগড়া। এদিকে মিশাল কল করে সামান্তাকে পাগল করে ফেলছিল রেডি হয়ে জলদি বের হতে। মিশালের আনা শাড়ি পরে সামান্তা চট করে রেডি হয়ে গেল। খোঁপায় গাজরা ফুলও গুজল, হাতে-পায়ে আলতা ও লাগাল। পরিপূর্ণভাবে সেজেগুজে সামান্তা পা টিপে টিপে বাড়ি থেকে বের হলো। বাইক নিয়ে মিশাল অপেক্ষমান। সামান্তাকে দেখামাত্রই মিশাল বাইক স্টার্ট করে দিলো। দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে সামান্তা মিশালের বাইকের পেছনে ওঠে বসল। বাইক ছেড়ে দিলো মিশাল উর্ধ্বগতিতে। পেছন থেকে মিশালকে দু-হাত দ্বারা আঁকড়ে ধরল সামান্তা। ভয়ে সিঁটিয়ে ওঠে বলল,

“বাইকটা আস্তে চালাও মিশাল। ভয় করছে আমার।”
“মৃত্যুকে নিয়ে এত ভয়?”
“সুখের এত কাছে এসে আমি সুখ না ছুঁয়ে মৃত্যু চাইনা! সো বি কেয়ারফুল।”
বাইকের গতি কমিয়ে দিলো মিশাল। স্মিত হাসল। কেমন যেন ভারি গলায় বলল,

বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ১১

“তুইতো আমার বুকের শ্রাবণ। দুঃখের শ্রাবণ। আঁধার রাতের বৃষ্টি ভেজা শ্রাবণ। ঘনকালো অন্ধকার হয়ে তুই ভারি বর্ষণ হয়ে আমার বুকে ঝুম বর্ষা হয়ে নামিস। বৃষ্টি বুঝি আল্লাহ্’র নেয়ামত? তুই আমার জীবনে আল্লাহ্’র দেওয়া শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। তাই সুখ হয়ে তোকে আমার ধরতে হবেনা। তুই নিজেই আমার ওপর বর্ষিত হবি।”
“উমমম্। আমি শ্রাবণ, তুমি অন্ধকার রাত। শ্রাবণ পেরিয়ে তোমার সেই অন্ধকার রাতে আমি এক টুকরো আলো হয়ে জ্বলব, তোমার একমাত্র দিশা হয়ে।”

বুকে যে শ্রাবণ তার সিজন ২ পর্ব ১২