সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ২৯

সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ২৯
লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা

সড়কপথে নেমে এসেছে তূর্য। পেশিবহুল দু’হাতের এক হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে রাখা। সেই লোমশপূর্ণ হাত খানাতে কালো বেল্টের একটা ঘড়ি নিজের স্থান দখল করে আনন্দে কেমন ঝলমল করে চলেছে,আলো আঁধারির খেলায় তা শ্রেয়ার দৃষ্টির অগোচরে যায় নি। মাথার উপর কালো বাদলে ঢেকে থাকা এক বিশাল মনমরা আকাশ ও সামনে একজন কালো টি শার্টে আবৃত পুরুষ। যিনি হেঁটে চলেছে আপনমনে, নিরলসভাবে। ভাবভঙ্গিমায় পরিস্ফুটনভাবে প্রকাশিত তাঁর পিছনে হোচট খেয়ে খেয়ে চলা মেয়েটার জন্য কোনো চিন্তা কিংবা গুরুত্ব নেই।

মলিন মুখশ্রী সমেত শ্রেয়া পিছু পিছু হাঁটায় মনোযোগী। হয়ত!হয়ত কোনো এক সময় তূর্য ফিরে তাকাবে সে আশায়। যদি না হেঁটে দাঁড়িয়ে পড়ে তাহলে আবার না মোবাইল থেকে কিসিং পিক ব্যতীত অন্য কোনো পিক ডাউনলোড করে দেখিয়ে বলবে চলো এটা করি। ভাবতেই শরমে ম’রণ হবার উপক্রম ওর। কি নির্দ্বিধায় তখন ছবি টা দেখিয়ে ফটাফট মুখের উপর করার কথা বলে দিল!স্পষ্টত দু’টো মানুষের ওষ্ঠাধর এক হবার ছবি ভাসছিল কুচকুচে কালো মণিতে,চক্ষু আয়নায়। মনে হলেই তাপে শরীর গরম হয়ে উঠে ওর। রগে রগে এক অনিষিদ্ধ অনুভূতি খেলে যায়। বারংবার ঠোঁট যুগল কেঁপে উঠে তিরতির করে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শ্রেয়া তূর্যর কদমে নিজের কদম ফেলছে। ঘোমটা সরে গিয়ে আঁচল পিচ ঢালা পথ ছুঁই ছুঁই। চুলগুলো হাত খোঁপা করা। তা হতে আবার অবাধ্য দশ-তেরো টা চুল ললাটে স্পর্শ করছে,বেরিয়ে আসছে কর্ণ পশ্চাৎ থেকে,ছুঁয়ে দিচ্ছে নেত্র পল্লব। হাত তুলে চুল সরাতে উদ্যত হয় বিষন্ন আকাশ পানে দৃষ্টি তাক করে। তখুনি নিস্তব্ধ পরিবেশে ঝংকার তুললো কয়েকটা চুড়ি। ভেঙে দিল সকল নিরবতার ঘর। অকস্মাৎ এহেন কাজে ও নিজেই হতবাক, বিস্মিত!
চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ বেশ ভয়ংকর ঠেকল শ্রেয়ার নিকট। দাঁড়িয়ে পড়ল মাঝ রাস্তার এক কোণে। গাড়ি চলাচল নেই তেমন একটা। সামনে চেয়ে দেখে এক জোড়া চক্ষুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ওর দিকে। মানুষ টার মুখে বিরক্তি ভাব। কাছে এসে ভারী গলায় কৌতূক করে বললো,

‘ দাঁড়িয়ে পড়লে কেন?চুড়ির আওয়াজও তুলছো?আমার এটেনশন পাচ্ছিলে না তাই?’
হতভম্ব শ্রেয়া। বিস্ময়াবিষ্ট কন্ঠে প্রতুত্তর করে,
‘তেমন কিছু না। চুল ঠিক করছিলাম। ‘
তূর্য ভ্রুঁ কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল–‘ চুলে কি হয়েছে?’
মিনমিনে স্বর হতে আওয়াজ বের হয়ে আসল–‘ কিছু না। চলুন আমরা থেমে না থেকে হাঁটা শুরু করি।’

অগ্নিময় চাউনিতে কাঁপিয়ে তুললো তূর্যর শ্রেয়ার দুর্বল দেহ খানি। এমনিতেই প্রচন্ড, অতিশয় তপ্ততা চতুর্দিকে। ধরণীতলে ত্রিযামা বিরাজ করলেও লাভ হচ্ছে না বিশেষ, গুমোট আবহাওয়া। তার উপর সামনের ব্যক্তির রক্তিম চাহনি। সব মিলিয়ে নিজেকে টাটকা টাটকা লাগছে শ্রেয়ার। কাঁপতে হলে বিষাদমিশ্রিত পরিবেশ, শৈত্যের প্রয়োজন নেই, কারো দৃষ্টিই যথেষ্ট তা আজ অনুভব করলো ও। কিন্তু মাথায় ধরে না ভালো,নরম-সরম কথা বললেও এই ছেলে রেগে যায় কেন?
তূর্য একটু রেগেমেগে ওঠে। গম্ভীর কন্ঠে বলে,’ তুমি একটু বেশি পাকনি মেয়ে। হাঁটার দরকার হলে আমি হাঁটতে বলবো না?তোমাকে কোলে নিব নাকি?শুধু শুধু শক্তি ক্ষয় করার ইচ্ছে নেই। সেদিনই করবো যেদিন ওজনে পঞ্চাশের গন্ডি পেরোতে পারবে। আগে ষাট কেজি হও তারপর জামাইর কোলে উঠে রোমান্স করার চিন্তা ভাবনা করো। তবেই না শক্তি খরচ হলেও আফসোস থাকবে না। ‘

তৎপরে বড় বড় পা ফেলে শ্রেয়ার পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। মাথায় চুলগুলো একসঙ্গে করে রাখা কাটা টা ঢিলে হয়ে আছে। অনতিবিলম্বে তা খুলে নেয় সে। ছড়িয়ে পড়ে কেশ। ঢাকা পড়ে যায় অনাবৃত এক অঙ্গ, পিঠের একাংশ। শিরশিরে ভাব জমে শ্রেয়ার মন পাঁজরে। তূর্য কন্ঠস্বর নরম করে। অধর কোণ বাঁকায় ঈষৎ, মৃদু। প্রশ্ন করে,
‘ কেন আফসোস থাকবে না জানো?’

‘ কেন?’– আনমনে,অজান্তে অস্ফুটস্বরে কন্ঠনালি গলিয়ে আসে ছোট্ট এই প্রশ্নটা। খেই হারিয়ে ফেলেছে শ্রেয়া। মাদকতা মেশানো কন্ঠ শুনে অশনী সংকেত বাজছে হৃদয়স্থলে। নিমিষেই তূর্য জবাব দেয়,
‘ তুমি হাড্ডিমন্ত্রী থেকে গুলুমুলু মন্ত্রী হবে তাই!দ্বিতীয়ত্ব রোমান্স মাধ্যমে সকল ক্লান্তি,শক্তি সবকিছু পুষে যাবে। ‘
লজ্জায় নত বদনে হাসে শ্রেয়া। এমন মানুষ ও ওর এত বছরের জীবনে,কোনোকালেই দেখে নি। রাত্রি প্রহরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিসব বলছে। দেখবেই বা এমন করে!ওর অপূর্ণতার জীবনের প্রথম পুরুষ যে এই লেকচারার সাহেব। মুখ টা বড্ড লাগামহীন। আজ বহুরুপী গগণ দেখে ওর একটা কথা-ই মনে হচ্ছে আকাশের সাথে তূর্যর অত্যধিক মিল রয়েছে। তেজী,গম্ভীরতা, উত্তাপ, ফিচলেমি, মাদকতা সবকিছু, সব বিদ্যমান এই মানুষ টার ভিতর। হঠাৎ বুঝলো তূর্য খোঁপা করে ওর চুলগুলো বেশ গুছিয়ে ক্লিপ দ্বারা আঁটকে দিয়েছে। এক দু’টো চিকন চুল অত্যন্ত অসভ্য, চিপকানো টাইপ তাই কোনোরকমেই গম্ভীর লেকচারার নিকটস্থে হার মানে নি। সুন্দর এবং সাবলীল ভাবে দখল করে রাখলো কপাল।

এখন আর পিছনে নয়,তূর্যর পাশাপাশি হাঁটছে শ্রেয়া তার কড়া আদেশে। পাশাপাশি চলছে দু’টো মানবদেহ। আকাশ দেখে মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে কিন্তু পরিবেশে গরমের বিচরণ। উষ্ণতা সহ্য করেই হাঁটাহাটি। আকস্মিক হিমশীতল সমীর আসলো। আলিঙ্গন করলো শ্রেয়ার সমস্ত কায়া। তীব্র গতিতে স্পন্দিত হতে লাগে বক্ষস্থল। নিজের হাতের দিকে তাকালো ও,যা বন্দী কারো হাতের মুষ্টিমেয়। চমকিত নয়নজোড়া মেলে আঁড়চোখে চাইল। তূর্য সামনের দিকে নজর রেখে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,

‘ চকমকানোর কিছু নেই। ইচ্ছে ছিল বউকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটবো হাতে হাত ধরে। দুর্ভাগ্য যে তুমি বউ হয়ে গেলে। তাই তোমাকে দিয়েই কাম চালানো। ‘
তূর্য হাত টা আরো শক্ত করে ধরলো। শ্রেয়ার মনে বিষন্নতা নেমে আসে। সত্যিই কি তূর্যর দুর্ভাগ্য? ওকে বউ হিসেবে পেয়ে কত স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে মানুষ টার। হয়ত স্বপ্নগুলো সাজিয়েছিল অহমিকার সঙ্গে,তাকে কল্পনা করে। পরমুহূর্তেই মন বললো,যাকে নিয়ে সাজানো হোক না কেন!পূর্ণতা তো তোর সাথেই পাচ্ছে। ইতস্তত করে মিহি কন্ঠে বলে,
‘ একটা কথা বলি?’
পাশ হতে প্রতি উত্তর আসে কর্ণকুহরে, ‘ বলো। ‘

শ্রেয়া সাহস জুগিয়ে বললো,’ আপনি অহমিকা আপুকে আরেকটা সুযোগ দিতে পারতেন। ‘
মুহুর্তেই হাতে প্রবল টান অনুভব করে ও। তূর্য ওর দেহ টা নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়েছে। হুট করে এমন হওয়াতে শরীর কাঁপছে থরথর করে। গলা শুকিয়ে আসে। খোলা কোমরে তূর্যর বলিষ্ঠ এক হাতের শক্ত আলিঙ্গন। শিউরে ওঠে শ্রেয়া। তাকায় ভয় ভয় দৃষ্টিতে। কাজলদিঘী আঁখিদ্বয়ে ভাসমান হয় তূর্যর ক্রুদ্ধ দৃষ্টি, লালচে চোখ। দূরের ঐ খুঁটিতে লাগানো নিয়ন বাতির দীপ্তির ছটা এসে আরো জ্বালিয়ে তুলছে যেন চাহনি। শ্রেয়া ঠাহর করলো,ভুল কথা বলে বসেছে। অন্যায় করেছে ভীষণ বড়। মুখ খুলে কিছু বলতে যাবে তখনই তূর্য চাপা গর্জন করে ওঠে। ঝাঁঝালো কন্ঠে হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,
‘ তোমরা মেয়ে জাত বড্ড ভেজাল টাইপের। সঠিক তো বুঝোই না। উল্টো স্বামীর প্রাক্তন থাকলে সেটা নিয়ে হিংসে করো,খোঁচা মা’রো। এমন ধাক্কা মা’রবো উড়ে গিয়ে মাঝ রাস্তায় পড়বে। তখন তোমার এই ছোট্ট চিকনচাকন দেহ গাড়ির নিচে পিষে যাবে। নেহাৎ আমি দুই বিয়ে করতে চাই না,তাই বেঁচে গেলে। গাধা কোথাকার! ‘

শ্রেয়া তব্দা খেয়ে চেয়ে আছে। দৃষ্টিতে একরাশ ভয়। তূর্য কোমর ছেড়ে এক হাঁটু গেড়ে ঝুঁকে বসল বালু মিশ্রিত ইট পাথরের তৈরি রাস্তায়। গভীর দৃষ্টি রাখলো শ্রেয়ার উন্মুক্ত কোমরে। ফ্যালফ্যাল নয়নে চেয়ে রইল শ্রেয়া। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তূর্য ঠান্ডা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
‘ ব্যাথা পেয়েছো?’
শ্রেয়া মাথা নাড়ালো। কিন্তু সত্য এটাই কিঞ্চিৎ হলেও ব্যাথা অনুভব করেছে ও। তূর্য দাঁড়িয়ে ফিচেল হাসে। বললো,
‘ মিথ্যাবাদী। কোমর লাল হয়ে আছে তোমার। সমস্যা নেই বাসায় গিয়ে হট মালিশ করে দিব। ‘
‘ মালিশ?’
‘ হু। হট মানে গরম মালিশ বুঝো না? আরাম পাবে নরম গড়নের গাধা মেয়ে। ‘
কান থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে শ্রেয়ার। অদৃশ্য, চক্ষু এড়ানো ধোঁয়া। তাড়াতাড়ি পা চালাতে লাগলে তূর্য কাঠ কাঠ গলায় ডাকে,
‘ শ্রেয়সী। ‘
এবার যেন তার কথার আঁচে বুঝা যাচ্ছে সিরিয়াস কিছু বলবে। তাই নম্র গলায় সায় দিয়ে বলে,
‘ জি। ‘

তূর্য ওর শাড়ির আঁচলের কিছু অংশ করপুট আগলে নেয়। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলতে লাগলো,
‘ তুমি বয়সে বড় হলে তবে মানুষ চিনতে,অনুভূতি বুঝতে এখনও অপরিপক্ক। আজ, এক্ষুণি আমি তোমাকে আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা বাক্য শুনাবো। এই বাক্যের শব্দের উৎপত্তি আমার জীবন থেকে। যেই ঘটনা আমার সাথে আগে কখনও হয় নি। তুমি কথাগুলোর পিছনে লুকিয়ে থাকা বিশেষ কিছু আজ বুঝবে কিনা জানিনা,তবে আশা করি যেদিন বুঝবে খুশিতে তোমার হৃদস্পন্দন ক্ষণিকের জন্য হলেও থমকে যাবে। একটু চালাক হও শ্রেয়সী,এ পৃথিবীতে বোকা মানুষ ঠকে যায় বার বার, প্রতা-রণার শিকার হয়,ভেঙে পড়ে,খুব সহজেই তাকে অন্য কেউ এসে দুমড়েমুচড়ে যায়। ‘

পরক্ষনে তূর্য একটা প্রশ্ন নিক্ষেপ করে,’ সন্ধি অর্থ কি?’
প্রথমত শ্রেয়া হকচকালো। ধিমে যাওয়া স্বরে উত্তর দিল,’ মিলন। ‘
‘ কখনও হৃদয়ের সন্ধি দেখেছো কিংবা অনুভব করেছো?’
‘ হৃদয়ের সন্ধি দেখা বা অনুভব কি করা যায়?’— অপ্রস্তুত কন্ঠে পাল্টা প্রশ্ন করলো শ্রেয়া।

‘ না। হৃদয়ের সন্ধি কখনও দেখা অথবা অনুভব করা যায় না। এই ধরো,একই পথে দু’টো ছেলে মেয়ে মুখোমুখি হলো। চোখের দেখায় সমানতালে ধ্বক করে উঠলো দু’জনের হৃদযন্ত্র। তখনই কিন্তু দুই মানবের দু’টো হৃদয়ে মিলন ঘটে যায় তাহাদের অজান্তেই। সন্ধি হয় হৃদয়ে হৃদয়ে। কিন্তু একে অপর সেটা বুঝতে পারে না প্রকাশ করা না অব্দি। সকল মিলন প্রকাশ্যে হয় না। দুই দেহ প্রকাশ্যে মিলেমিশে একাকার হলেও, দু’টো হৃদয় অচেনা থেকেও হঠাৎ করে মিলিত হয়ে যায়। ‘
তূর্য কথাগুলো বলে শাড়ির আঁচলের দিকে চেয়ে মুষ্টি খুলে দলে মুচড়ে যাওয়া অংশটা মুক্ত করে দিল।

ছেড়ে দিল। দু’জনে এসে থামলো একটা ভ্যান গাড়ির সন্নিকটে। শ্রেয়া ঘোরে ডুবে গেল। কথাগুলো শ্রবণগ্রন্থি মাধ্যমে সোজা গিয়ে বুকের বা পাশে তোলপাড় সৃষ্ট করলো। ঠিকি তো বললো গুণে গুণান্বিত এই মানুষ টা। হৃদয়স্থলে মিলনমেলা কখনও নোটিশ দিয়ে বসে না,অজান্তেই হয়ে যায় কিন্তু যাকে আমরা মন দিয়ে বসি তার প্রকাশ করা ছাড়া বুঝতেই পারি না সেই মানুষ টা আমাদের ভালোবাসে কিনা!ঠিক যেমনটা হচ্ছে ওর বেলায়। ও তো ভালোবাসে তবে তূর্য বাসে কিনা জানেনা,কখনও বাসবে কিনা তাও জানে না।

মানুষের ভিড় জমে আছে মোটামুটি। ক্লান্ত পথিকরা তৃষ্ণা মেটাতে জড়ো হয়েছে গাড়িটার সামনে লেবুর শরবত খাওয়ার উদ্দেশ্যে। একটু একটু করে পা ফেলে কখন এতখানি পথ পাড়ি দিল খেয়ালই করে নি শ্রেয়া। তূর্য হাত বাড়িয়ে ওর আঁচল টা পিঠে জড়িয়ে দাঁড় করিয়ে দেয় একপাশে। যেখানে মানুষ ঘেঁষবে না ওর শরীরের ধারে। কারো একটুখানি স্পর্শও পড়বে না ওর কোমল গায়ে। হাতে এক গ্লাস শরবত নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় তূর্য। শ্রেয়া হাতে একটা গ্লাস দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তাক করে। সেকেন্ডের ব্যবধানে ভেসে আসে নিরলস কন্ঠস্বর,

‘ আমি এসব পান করি না। শুনলাম তোমার নাকি অনেক পছন্দ তাই ভাবলাম বউয়ের চাওয়াকে একটু গুরুত্ব দেই। এতে যদি বউয়ের বুদ্ধি বাড়ে আর আমার মন শান্ত হয়। নাও। ‘
শ্রেয়া স্মিত হাসে। ছোট ছোট চুমুক দেয় গ্লাসে। অর্ধ গ্লাস শেষ করে বলে,’ আর খাবো না। আপনাকে প্রিয়ু বলেছে এটার কথা তাই না? ‘
তূর্য গ্লাস টা হাতে নিয়ে ঠোঁটের কোণে সুপ্ত হাসি আঁকে।
‘ খেতে হবে না আর। ‘

বলেই বাকি অর্ধেক শরবত নিজের গলায় ঢালে। চোখ বড়সড় হয়ে যায় শ্রেয়ার। এই তো বললো লোকটা তিনি শরবত খান না। আর এখন?শরীর টা ঝক্কি দিয়ে উঠলো। দেখল,তূর্য টাকা মিটিয়ে খালি গ্লাস টা নিয়ে ফিরে আসলো। শ্রেয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ়!তূর্য ভাবলেশহীন কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ অন্য কেউ আমার খাওয়া গ্লাসে চুমুক দিবে তা সহ্য হবে না৷ তাই গ্লাসসহ কিনে নিয়ে আসলাম। তবে একটা লাভ হলো আজ। তোমার খাওয়া দেখে লোভ করে শরবত টা খেয়ে অনেক তৃপ্তি পেলাম। অনেস্টলি একটা কথা বলি তোমাকে?’

‘ বলুন। ‘–শ্রেয়ার নিচু গলা
তূর্যও নিচু গলায় গাঢ় স্বরে বললো, ‘ শরবতের লোভে নয়,তোমার খাওয়ার ধরনের লোভে পড়ে গিয়েছিলাম। ‘
শ্রেয়ার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অস্থিরতা বেড়ে গেল। একটু হলেও সে আন্দাজ করতে পেরেছে তূর্যর কথার মানে। পরিস্থিতি, পরিবেশ লজ্জামুক্ত করতে আওড়ায়,’ স্যার!’
তূর্য ধমকে ওঠে, ‘ হুঁশ! একদম স্যার ডাকবে না। পাবলিক শুনলে ভাববে ছাত্রী নিয়ে রাতের আঁধারে পালিয়ে এসেছি। ‘

ফুলে ফুলে ভরপুর চৌধুরী বাড়ি। বাগান থেকেও মৌ মৌ করে ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। প্রিয়ু লাল লেহেঙ্গা টা পড়ে খুশিতে খিলখিল করে হাসতে ব্যস্ত। পাশেই বসা আয়ুশ কালো পাঞ্জাবিতে। প্রিয়ু হাসির কারণ ওর বাবা মা। তাদের দেখেই সকল হাসি উপচে পড়ছে। হরেক রকমের কথা জুড়ে বসেছে। যেন কত কাল দেখা হয় না। নুরুল চৌধুরী ও মেহরিমা, ত্রিহা সবাই কুশলাদি বিনিময় করে মেহমানদের আপ্যায়নে নিমগ্ন। রাশেদা প্রিয়ুর কাঁধে হাত রেখে বললো,
‘ কি রে শ্রেয়া কোথায়?তূর্য কে দেখলাম বাহিরে। আমাদের সাথে কথা বলে চলে গেল। কিন্তু ওকে দেখলাম না। ‘

প্রিয়ু হাসি থামিয়ে বললো,’ আর বলো না,ও একবার আমার মতোন লাল লেহেঙ্গা পড়েছিল। পরে স্যার কোথা থেকে একটা সাদা লেহেঙ্গা এনে বললো এটা পড়তে। তাই চেঞ্জ করতে গিয়েছে। চলে আসবে এক্ষুনি। ‘
রাশেদা মনে মনে খুশি হলেন বেশ। ক’জন স্বামী বউয়ের প্রতি এত খেয়াল করে!অন্যদিকে ফাতেমা চৌধুরী হা-হুতাশ করতে আরম্ভ করলেন শ্রেয়াকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখে। পড়নে সাদা লেহেঙ্গা,মাথার দোপাট্টাও শুভ্র রঙের। ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙে নামতেই কর্ণধার হয় ফাতেমা চৌধুরীর কন্ঠস্বর,
‘ জনমেও দেখছি না বউভাতে সাদা পড়তে। বিধবার মতোন। তূর্যর ভাগ্য আবার পুড়ছে। না জানি পোলাডার কি হয়!আমি জানি এই মাইয়াই এরুম লেহেঙ্গা আনাইছে। ‘

শ্রেয়া চক্ষু কোলে অশ্রু কণা ভিড় জমালো। আয়ুশী ওর হাত টা ধরে নিম্ন স্বরে বলে, ‘ দাদির কথায় কান দিও না ভাবী। ‘
রাশেদা ও প্রিয়ুর মনোক্ষুণ্ণ হলো। এত অতিথিদের সামনে এভাবে মেয়েটাকে কথা শুনানো। অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো প্রিয়ুর আখিঁদ্বয়। আয়ুশ সর্বদা নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে আসছে ছোট বেলা হতে। কিন্তু প্রিয়ুর নয়ন জোড়ার আকুতি ফেলতে পারলো না। ফাতেমা চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বললো,

সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ২৮

‘ যার যা মন চায় পড়বে দাদি। এতে এমন উদ্ভট কথা কেন বলছো?এটা তূর্য এনে দিয়েছে। শ্রেয়ার ইচ্ছে থাকলে তো ও আগে অন্য কালারের পড়ত না। তাই অযথা চিল্লানোর কোনো মানে হয় না। ‘

সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ৩০