সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ৩২

সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ৩২
লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা

মানস্পটে বিষাদ ছুঁয়েছে। সহস্র সহস্র তাহাদের পরিমাণ। শূণ্যতায় খাঁ খাঁ করছে অন্তকরণ। কবে আসবে বর্ষণ? জলধারার শীতল আলিঙ্গনে হিম হবে ভিতর কোন ক্ষণে?আষাঢ়ে জল আদৌ কি স্পর্শ করবে ভূমিকে?প্রচন্ড তাপদাহে তারা যে ফেটে চৌচির কিন্তু শ্রেয়ার ন্যায় নয়। ওর শূন্য,তৃষ্ণার্ত অন্তরের উত্তাপ নিভানোর কাজ টা কখনও আকাশ ভেঙে নেমে আসা বৃষ্টির দ্বারা সম্ভব নয়। এ অগ্নিতেজের শীতলীকরণ হবে কেবল, কেবল তূর্য নামক শ্রাবণ মাধ্যমে।

মানুষ টা সেই যে গত সপ্তাহে গেল আর একটা খোঁজ খবরও নেই। এ বাড়িতে তূর্য বিহীন কেটে গেল শ্রেয়ার সাতটা দিন। তন্মধ্যে বেশ ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাগুলোও শ্রেয়াকে এতটা আঘা-ত করে নি,যতটা করছে প্রিয় সেই পুরুষের অনুপস্থিতি। হলদে দ্যুতিতে খোলা বারান্দায় হলুদ পাখি সেজে চেয়ারে বসে আছে শ্রেয়া। চেহারায় প্রিয়র মোহে অমানিশা ও মলিন ভাব।
তূর্য প্রিয়ুদের বাড়ি থেকে পরের দিন সকালে বিদায় নিয়ে সোজা চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়। একটা শব্দও বলে যায় নি শ্রেয়াকে যাওয়ার আগে। শুধু আয়ুশকে জানিয়েছে শ্রেয়াকে যেন বাড়িতে নিয়ে যায় সাথে। হঠাৎ সাথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। শ্রেয়া তখনও গভীর ঘুমে মগ্ন ছিল। উঠে প্রিয়ুর কাছ থেকে এসব শুনে অত্যন্ত বিস্মিত হয়। মনে ভয় জমে। তূর্য কি তাহলে রাত্রির অর্ধভাগে ঘটে যাওয়া ঘটনার রেশ ধরে অকস্মাৎ চলে গেল!কেন যে ও অমন করতে গেল! যাওয়ার পরের দু দিন বাদে শ্রেয়া চৌধুরী বাড়িতে ফিরে আসে। ওকে দেখেই মেহরিমা সকলের সামনে তেঁতে উঠলেন। সুযোগ পেয়ে কথা শুনালেন,’ কি এমন হলো ভাইয়ের শশুর বাড়ি থেকে আমার ছেলেকে সকাল সকাল চট্টগ্রাম চলে যেতে হলো?আগেও শান্তি দিলে না,এখনও না। ‘

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কথাগুলো শুনিয়ে চলে যান তিনি।
তূর্যর খালা বার কতক জিজ্ঞেস করে তার হঠাৎ চলে যাওয়ার কারণ কিন্তু বরাবরই প্রতুত্তরে পরাজয় মেনে নেয় শ্রেয়া। তারপর! তৎপরে গুণে গুণে আরো কয়েকটা দিন কেটে গেল। অনেক বার মোবাইল হাতে নিয়েও কল দিতে গিয়ে ফিরে আসে শ্রেয়া। প্রচন্ড দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে ও। এত জেদ,রাগ!তাহলে রাগই কি করেছে? নয়ত কেন এতদিনে একটা বারও কল,মেসেজ কিছুই করলো না?

বারান্দার রেলিংয়ে শ্রেয়া মাথা ঠেকিয়ে রইল। মোবাইলটা পড়ে আছে চেয়ারের একপাশে। চোখ দুটো অশ্রুতে টলমল অবস্থা। তূর্যর দেহের কড়া পারফিউমের ঘ্রাণ, হেয়ালিপনা, ত্যাড়া বাঁকা শব্দ মিলে একেকটা বাক্য,গম্ভীর,তেজী ভাব সবকিছু ওকে বড্ড পোড়াচ্ছে। মনস্পৃহা জাগছে এখনই বাস ধরে ছুটে যেতে চট্টগ্রাম। আয়ুশও অনেকবার কল দিয়েছিল কোনো হদিস নেই তার। কোথায় গেল?এক সপ্তাহ সহ্য করেছে, আর পারছে না শ্রেয়া। পাশ থেকে হাতড়ে ফোনটা হাতে নেয়। তূর্যর নাম্বারে ছোট্ট একটা বার্তা পাঠায় বহু সাহস জুগিয়ে, ‘ আসসালামু আলাইকুম স্যার। ‘
মিনিট পেরোয় কিন্তু অপর দিক হতে কোনো উত্তর মিলে না। এ যাত্রায় নিজেকে দমিয়ে রাখা কঠিন হতে কঠিনতম হয়ে পড়ে। অতি সন্তর্পণে গড়ায় জল। ভিজায় শ্বেত কপোল যুগল। ঠিক সেই মুহুর্তে পিছন থেকে চেনা একটা স্বর ডেকে ওঠে,
‘ নতুন বধূ নিচে চলো খাইবা। ‘

শ্রেয়া ফিরে না। এ অবাধ্য জলের সাক্ষী করতে চায় না ও কাউকে। কাঁদলে কাঁদবে শক্তপোক্ত সেই বক্ষে মাথা এলিয়ে। তবুও কান্নাগুলোও তার নামে হোক,দেখুক সে। সেও জানুক শ্রেয়া আজ সম্পূর্ণভাবে জ্ঞাত হয়েছে তার তার ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে জটিলভাবে প্রকাশ করা অনুভূতিদের সম্পর্কে। কিছু কিছু জিনিস কখনো ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভবপর হয় না,তার মধ্যে একটা হলো মানব কন্ঠনালি গলিয়ে উন্মুক্ত হওয়া শব্দাংশ। শতাধিক বার চাওয়া সত্ত্বেও শ্রেয়া ফিরিয়ে নিতে পারছে না। যার দরুন মিলছে বিচ্ছেদের অসুখ। সে এক নিদারুণ অসুখ। শ্রেয়ার নরম মনে অঢেলভাবে বিস্তার লাভ করছে তা। কর্ণবিবরে আবারও প্রবেশ করে রহিমার তড়তড়ে স্বর,

‘ ও নতুন বধূ!খাইবা না?’
‘ খাবো না খালা। ‘–ভাঙা ভাঙা কন্ঠে তৎক্ষনাৎ জবাব শ্রেয়ার।
রহিমা পিছন থেকে চুলে হাত বুলিয়ে বললো,
‘ মন খারাপ তোমার?কথা হয় নাই তূর্য বাবার লগে?’
শ্রেয়ার অভিমান বেড়ে গেল। ঠান্ডা গলায় বললো,’ না। লেকচারার সাহেবের সময় আছে নাকি?কাউকেই তো ফোন দিচ্ছেন না?’
‘ কে কইল কাউরে দেয় না?তুমি যেদিন বাবা রে পুরোপুরি চিনে যাইবা সেদিন কইবা খালা এমন একটা জামাই আমারই হোক। ‘

শ্রেয়া বিস্ময়াহত। ব্যগ্র কন্ঠে সরব করে বলে,
‘ ফোন দিয়েছেন তিনি?’
রহিমা খালা যেন প্রশ্নটা উপেক্ষা করলো। বললো,
‘ এহন আইয়ো আমার লগে। মেলা রাত হইছে। তোমারে খাওয়াইয়া আমি ঘুম দিমু। ‘
শ্রেয়া খেয়াল করেছে তূর্য যাওয়ার পর থেকে প্রিয়ু ও খালা ওর খেয়াল রাখছে। বিশেষ করে রহিমা খালা। এ বাড়িতে একমাত্র ওর জন্য যদি কারো অতিরিক্ত দরদ থাকে তাহলে সেটা নিঃসন্দেহে রহিমা খালাই প্রকাশ করছে। মায়ের মতোন আচরণ ওনার। শ্রেয়ার বড্ড আনচান করে আজকাল মনটা মা’কে দেখবার। কিন্তু সেটা তো কোনো কালেই সম্ভব না। রহিমা খালাকে দেখেই ও তৃপ্তি মেটায়। মেহরিমা ও ফাতেমা চৌধুরী হাঁটতে বসতে কথা শুনিয়ে যায় ওকে। ক্ষণে ক্ষণে উপলব্ধি করেছে ও স্বামী বিহীন শশুর বাড়িটা মেয়েদের জন্য কখনও শান্তির স্থান না। মনের সন্দেহ ব্যক্ত করে প্রশ্ন করে শ্রেয়া,
‘ আপনি আমার জন্য এত চিন্তা করছেন কেন খালা?’

‘ তোমার দায়িত্ব জানি কেউ একজন আমারে দিয়ে গেছে। এ বাড়িতে তার ভরসার জায়গা টা আমি। এইডা আমার কত বড় পাওয়া তুমি বুঝবা না নতুন বধূ। সবসময় আমার জীবনডা দিয়া হইলেও তোমার খেয়াল রাখমু। ‘
শ্রেয়া হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। অবাক হলেও কথা বাড়ালো না। দু হাতে চোখ মুছে ওষ্ঠদ্বয়ে হাসি মাখে। মিছে হাসি। বলে,
‘ আম্মা,বাবা,প্রিয়ু সবাই খেয়ে নিয়েছে?’
‘ হু। তুমিই বাকি। বড় স্যার তোমারে ডাকতাছিল। আমি কইছি তুমি পরে খাইবা। কিন্তু প্রিয়ু রইছে। কইল তোমার লগে নাকি খাইব।’

‘ আচ্ছা। চলুন। ‘
শ্রেয়া আগে আগে বারান্দা ছেড়ে চলে গেল। রহিমা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে হাতের মোবাইল টা কানে নিয়ে বলে উঠলো ফিসফিস করে,চুপিসারে,
‘ সুস্থ হইছো নি কিছুটা?মাইয়াডা তোমারে ছাড়া দুঃখ পাইতাছে। ‘
অপরপাশ থেকে তাৎক্ষণিক কর্ণধার হয়,’ মা কি ওকে বেশি কথা শোনাচ্ছে?’
মোক্ষম সময় পেয়ে রহিমা গড়গড় করে বললো,’ শুধু তোমার মা?আম্মাও ছাড় দিতাছে না। এহন যদি তোমার কথা শুনে তাইলে তো নতুন বধূরে একদম ছাড়ব না। তোমার মা’র মায়া দয়া যে কই পালাইছে। আগে কত ভালা আছিল। ‘
‘ আচ্ছা ওর খেয়াল রাখবেন। ‘
কথাটা বলতে দেরি তবে কলটা কাটতে বিলম্ব করে নি মানুষ টা। রহিমা হতাশামিশ্রিত নিঃশ্বাস ফেলে দ্রুত গতিতে নিচে যায়।

তন্দ্রা নিয়ে গায়েব হয়েছে তূর্য। শ্রেয়ার ঘুম পায় না। নিশীথিনী তে হাটতে বের হলো বাগানের দিক টায়। বাড়ির সব মেহমান এক দু দিন থেকেই চলে গিয়েছে। রুনা খালা এই ক’দিন ছিলেন কিন্তু তিনিও নিজের বাড়িতে চলে গিয়েছেন। একটা মাস বাংলাদেশে কাটিয়ে আবার কানাডায় চলে যাবেন। গুড়ি গুড়ি বর্ষণ হচ্ছে। একটু একটু করে দেহ স্পর্শ করছে। এটা অত্যন্ত উপভোগ করছে শ্রেয়া। কিছুদূর হেঁটে আসতেই চক্ষে বিঁধে নুরুল চৌধুরী বাগানে পাতানো বেঞ্চিতে বসে আছেন মাথা নত করে। অবলীলায় ঠাহর করলো সে আধবয়স্ক এই মানুষ টা কোনো কারণে ভীষণ ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন। ঘরে ফিরে যাওয়ার মত পোষণ করে ও। তথাপি পাও বাড়ায়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে থেমে যেতে হয়। নুরুল চৌধুরী হাসিমুখে ডাকে ওকে। শ্রেয়া আজ একটা জিনিস খেয়াল করলো ওনার কন্ঠে গম্ভীরতা নেই নিত্য দিনের মতোন,এ মুহুর্তে উপস্থিত শুধু শুধুই বিষাদ। মাথায় ঘোমটা সমেত ও বেঞ্চির কাছে এসে দাঁড়ায়। নম্রতার সহিত বললো,’ জি বাবা!’

‘ এত রাতে বাহিরে কেন তুমি?’
শ্রেয়া মৌনতা পালন করলো। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। নুরুল চৌধুরী নিজ থেকেই বললেন,
‘ বুড়ো শশুরের পাশে একটু বসবি মা?কিছু কথা বলতে চাই তোকে। ‘
অপ্রস্তুত হলো শ্রেয়া। দূরত্ব রেখে এক কোণে বসলো। কখনো তো বাবার সান্নিধ্যে যাওয়া হয় নি,বাবার আদর কেমন হয় সেটাও ওর জানা নেই। ছোট্ট করে বলে উঠলো,
‘ বলুন বাবা। ‘

‘ তূর্যর সাথে কথা হয় নি তোর তাই না?ছেলেটা আমারও ফোন তুলছে না। যাই হোক, প্রিয়ুর কাছ থেকে শুনলাম সামনের সপ্তাহে তোদের পরীক্ষা। তিন দিন পর পাঠিয়ে দিব তোদের। তখন আমাকে গিয়ে জানাস তো আমার ছেলেটা কেমন আছে। ওদের মন মতোন বাবা আমি হতে পারলাম না। না পারলাম পরিবারের ভালো কর্তা হতে। তোর শাশুড়ী এ কদিন তোকে অনেক কথা শুনিয়েছে,আমি খেয়াল করেছি। আসলে ওর দো’ষ নেই। আমরা সবাই পরিস্থিতির শিকার। মনের একটা ভয় থেকেই এমন করে। তোহাশের মতো তূর্যকে হারিয়ে ফেলার ভয়। ‘
‘ কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করি বাবা?’— খুঁত খুঁত স্বরে অনুমতি চাইল শ্রেয়া। নুরুল চৌধুরী নির্দ্বিধায় বললেন,
‘ আমি জানি তুই কি প্রশ্ন করবি। সম্পর্কে তোর শশুড় হতে পারি কিন্তু তুই আমার মেয়ে। তোকে প্রথম দিন থেকে নিজের মেয়ে ভেবে আসছি আমি। বাবার জীবনের কয়েকটা কথা জানার অধিকার মেয়ের রয়েছে। আমিও আমার মেয়েকে শেয়ার করতে চাই।

তোহাশ আমার প্রথম স্ত্রীর সন্তান। আমার বড় ছেলে। তোহাশের মা মায়া ছিল আম্মার বান্ধবীর মেয়ে। গ্রামের মেয়ে ছিল। বড্ড পড়ালেখার ঝোঁক ছিল মেয়েটার। তখন সবে সে মেট্রিক দিয়েছে। ওর ক্লাসের সকল মেয়েদের প্রায় বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার মাথায় ভূত চাপে সে ইন্টার পাস করবে। ওদের গ্রামে তখন কোনো কলেজ করা হয় নি। আম্মা এটা শুনে তার বান্ধবীকে বুঝিয়ে মায়া কে এখানে নিয়ে আসে। ‘
এটুকু বলে শব্দ করে হেসে উঠলেন নুরুল চৌধুরী। পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে মুখ মুছলেন। শ্রেয়া যেন ঘোরে আছে। নুরুল চৌধুরী সামনের দিকে তাকিয়েই বলে উঠলেন,

সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ৩১

‘ অবাক হচ্ছিস?জানিস তোর মধ্যে ঠিক মায়ার স্বভাব। চুপ করে সব সহ্য করা,জবাব না দেওয়া কথায় কথায়। ও একদম এমন ছিল। তোর প্রথম শাশুড়ী থাকলে তোকে কলিজায় ঢুকিয়ে রাখত। তুই তো ওরই প্রতিচ্ছবি মা। মায়ার চুপচাপ স্বভাবে আমি সবথেকে বেশি মুগ্ধ হয়েছিলাম। এত শান্ত মেয়ে আমি কখনও দেখি নি। এই যে পেয়ারা গাছ টা দেখছিস না?এটা ওর জন্যই লাগানো। অনেক পছন্দ ছিল ওর পেয়ারা। অবশ্য এটা আমি আগে লাগাই নি। ওর মৃ*ত্যুর পর লাগিয়েছি। অনেক পর। তোহাশ তখন ভার্সিটিতে পড়ে।’

সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ৩৩