সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ৪১

সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ৪১
লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা

নুরুল চৌধুরী কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে আসলেন। অবস্থা তেমন ভালো না ওনার। বুকের ব্যথা প্রায়শই অসহনীয় হয়ে ওঠে। আয়ুশের সাহায্যে ড্রইং রুমে আসলেন তিনি,তোহাশ আসার খবর পেয়ে। বসার ঘরে পা রাখতেই দীর্ঘ দিনের পুরোনো চশমা টা অস্পষ্ট, ঝাপসা হয়ে আসে। অন্তর্দেশ টায় দমকা সমীরণ বয়ে যায়। সাথে জমানো অভিমানের পাল্লাটা আরও অনেকখানি ভারী হয়ে উঠলো। চেহারায় গম্ভীরভাব ধরে রেখে মাঝ বরাবর এসে দাঁড়ান।
বাবাকে দেখে বাচ্চাদের মতোন ছুটে আসলো তোহাশ। দু হাতে ঝাপটে জড়িয়ে ধরতে চায়,কিন্তু পারে না৷ তার আগেই হাত তুলে বাঁধা দিলেন নুরুল চৌধুরী। গমগমে সুরে বলে উঠলেন,’ বসো। ‘

সোফায় বসে তোহাশ কে বসার জন্য বললেন পুনশ্চঃ। অসহায়, দুর্বল নেত্রে তাকিয়ে তোহাশ তূর্যর পাশে বসলো। টলমলে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো বাবার দিকে। কখনও তাকে ‘ তুমি ‘ বলে সম্বোধন করেন নি নুরুল চৌধুরী। বাবা ছেলের সম্পর্কটা ছিল একেবারে বন্ধুর ন্যায়। সেই বাবা আজ ওর দিকে তাকাচ্ছে না,ঠিক করে কথা বলছে না। কতগুলো বছর কেটে গেল অনুতপ্ততায়,অনুশোচনায়। হ্যাঁ প্রতিনিয়ত জ্বলছে ওর ভিতরটা। কতশত অভিযোগ নিজের প্রতি জমে আছে হৃদয় কুঠুরিতে। বিলাসিতার প্রাচুর্যে,মায়া মমতায় ভরপুর এই চৌধুরী বাড়ির আঙিনা পার হয়ে একটা মুহুর্তও স্বস্তি মিলে নি তার। নিজের অপরাধের শাস্তি থেকেও রেহাই পায় নি সে। কঠিন শাস্তি ভোগ করেছে, মা’কে অপমান করার ফলস্বরূপ। নিষ্প্রভ কন্ঠে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ বাবা,কেমন আছো?মা’কে দেখতে পাচ্ছি না যে?’
মুহুর্তেই সকলের কর্ণে কর্ণে প্রতিধ্বনিত হয় তাচ্ছিল্য কন্ঠস্বর,
‘ তোমার মা আছে?সে তো তোমাকে জন্ম দেওয়ার সময়েই এ দুনিয়া ছেড়েছে। হয়ত বুঝে গিয়েছিল মা’কে সম্মান করতে অক্ষম তুমি। কুলাঙ্গার সন্তান। ‘

স্তব্ধ পরিবেশ। ফাতেমা চৌধুরী বাঁকা হাসলেন। নিশ্চুপে,লুকিয়ে,নিঃশব্দে। মনে মনে বেশ আনন্দ পেয়েছেন। তূর্যর নজর সাদা,ফকফকা মেঝেতে। তোহাশের কন্ঠনালি ভেদ করে এলো,’ তুমি ঠিক বলেছো বাবা। ‘
তৎক্ষণাৎ আরিয়ানার চোখের কার্নিশ ছুঁইয়ে এক ফোঁটা জল গড়ালো। স্বামীর দুঃখের পরিমাণ নিতে পারে না ও। নিমীলিত চক্ষু পত্রে টুপ টুপ অশ্রু পড়তেই অত্যধিক জোরে চিল্লাতে শুরু করে তিতিসা। ওর চিৎকারের শব্দে শ্রেয়া অস্থির হয়ে ওঠে। ব্যগ্র গলায় প্রশ্ন করে,

‘ আপু ও কাঁদছে কেন?’
আরিয়ানা জবাব না দিয়ে তিতিসাকে থামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শ্রেয়ার নিশ্চল দৃষ্টি ছোট্ট তিতিসার পানে। ঠোঁট ভেঙে কান্না করছে মেয়েটা। ওষ্ঠাধর কেমন লালচে রঙের। হাত মুঠো করে রেখেছে। কান্নার তালে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে এতটুকুন মেয়ের রাগ, জেদ। শ্রেয়ার অভ্যন্তরে শীতল শীতল ভাব। বাচ্চারা অদ্ভুত মায়ায় মাখে মানুষকে। পাষাণ হৃদয়ও গলে মোম হয়ে যায় তাদের সান্নিধ্যে।
তূর্যর ডাকে ভাবনা ছিঁড়ে ফিরে তাকায় ও। আদেশের স্বরে বলে তূর্য, ‘ মিসেস আরিয়ানাকে রুমে নিয়ে যাও। তিতিসার এখানে ভালো লাগছে না হয়ত। ‘

আরিয়ানা না চাইতেও শ্রেয়ার সঙ্গে ড্রইং রুম ছাড়তে হলো। ওদের গমনের পথে তাকিয়ে তূর্য কন্ঠে গাম্ভীর্য রেখে বললো,’ আপনার সিদ্ধান্ত টা ভাইকে জানিয়ে দিন বাবা৷ ‘
তোহাশের কন্ঠে চমক,’ কিসের সিদ্ধান্ত?’

দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস মুক্ত করলেন নুরুল চৌধুরী। বললেন,’ তুমি এই বাড়িতেই থেকো। সন্ধ্যার পর উকিল আসবে৷ সম্পত্তির বন্টন হবে। আর কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তোমার ও তোমার বউয়ের কথামতো আমরা তোমাদের প্রাপ্য সম্মানই দিব। এই বাড়িতে তোমার অধিকার আছে,নিজের পাওনা কেন ছাড়বে?সেই যে বলে গেলে তোমার হক তূর্য মে’রে দিবে,আজ পর্যন্ত আমার ছেলে তোমার ভাগের এক রত্তিও ভোগ করে নি। বুকে পাথর চেপে ভালোবেসে,সম্মান দেখিয়ে তোমার সাথে যোগাযোগ রেখেছে।

ওর মা খারাপ না সেটা প্রমাণ করেছে। যদি খারাপ হতো তাহলে নিশ্চয়ই তোমার বিরুদ্ধে ফুসলিয়ে বড় করত ওকে। ছোট থেকেই এটাই শিখাত তোমাকে দূরে রাখলে সব সম্পত্তি পাবে। এমন কিছু কি করেছে? করে নি। ওর মায়ের দেওয়া ভালো শিক্ষায় ভুল অভিযোগের ফলেও সে তোমাকে সম্মানের সাথে এ বাড়িতে এনেছে। বড় হলেই বিবেকে উচ্চ হওয়া যায় না। দুধ দিয়ে কালসাপ পুষলে দিনশেষে ছোবলই খেতে হয়। যার ভুক্তভোগী মেহরিমা। কোনোদিন ওকে বলি নি সতীনের ছেলেকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে হবে ওর৷ না বলা সত্ত্বেও সে সেটা করেছে। এতকিছুর বিনিময়ে তুমি কি দিয়েছো ওকে?অপমান, মিথ্যে অপবাদ। সত্য মিথ্যা যাচাই ছাড়া কষ্ট দিলে।

এত বছরের ভালোবাসা প্রত্যাখান করেছো দুদিনের ভালোবাসার মোহে। আাশা করি সুখেই ছিলে। বুড়ো বয়সে অনুরোধ করবো পারলে থেকে যাও। তোমার মা’কে খুব ভালোবাসতাম, তোমাকে দেখলে যেন আমি তাকেই অনুভব করতে পারি। অভিমানের দেয়াল টা আর তুলে রাখতে পারলাম না। থেকে যাও। আমি কথা দিচ্ছি আরিয়ানার কোনো ক্ষতি হবে না। দরকার পড়লে আমি চট্টগ্রাম চলে যাবো মেহরিমাকে নিয়ে। অন্তত এই সমাজ বলতে তো পারবে আমার খাটিয়া ধরা থেকে কোনো ছেলে বঞ্চিত হয় নি। ‘

কথাগুলো শেষ হতেই তোহাশ ঢলে পড়লো নুরুল চৌধুরীর পায়ের সমীপে। ওনার হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে ওঠে। পুরুষ নাকি শত কঠিন পরিস্থিতিতেও ভাঙ্গে না?অথচ প্রিয়ুসহ সবাই দেখলো কতটা সহজে বাবার পা ছুঁয়ে কাঁদছে তোহাশ। কই ছিল এত কাল? প্রিয়ু বুঝে পায় না মানুষ কেন সবসময় সময় খুইয়ে নিজের ভুল বুঝে?নুরুল সাহেব অটল। টু শব্দটুকু করলেন না তোহাশের উদ্দেশ্যে।তূর্যর দিকে নজর ফেলে স্রেফ বললেন,’ সন্ধ্যার পর থাকিস। ‘

তৎপরে সোফায় ঘাড় এলিয়ে চুপ করে রইলেন। তোহাশও পা আঁকড়ে ধরে রাখলো। মুখ দিয়ে কথা আসছে না। আয়ুশ ওর কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় আওড়ালো,’ উঠুন ভাই। বড় আব্বুর জন্য স্ট্রেস ঝুঁকিপূর্ণ। ‘

সকালেই রুম টা গোছগাছ করে রেখেছিল শ্রেয়া। আরিয়ানাকে নিয়ে আবছা অন্ধকার কক্ষে ঢুকে ও। নিজ হাতে রুমের কালো পর্দাগুলো সরিয়ে দিয়ে সূর্যের রশ্মি ঘরে আসার সুযোগ করে দেয়। তিতিসার কান্না থমকে গিয়েছে ততক্ষণে। ভাসা ভাসা আখিঁদ্বয়ে সে দেখছে কালো একটা তাতের কাপড় পরিহিতা মেয়েকে। ওর চাহনিতে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় পা ফেলে অভিমুখে এসে উপস্থিত হয় শ্রেয়া। বিমুগ্ধ নয়নে চেয়ে দু হাত বাড়ায়,উদ্দেশ্য কোলে নিবে৷ তিতিসা ঠোঁট ছড়িয়ে ওর বুকে ঝাপিয়ে পড়বে পড়বে অবস্থা তখনই আরিয়ানা নিজের সঙ্গে চেপে ধরে ওকে। শ্রেয়ার মন আহত হয়। মনোক্ষুণ্ণ হয়। বুকটা কেঁপে ওঠে। আরিয়ানা ক্রোধান্বিত চাহনি নিবদ্ধ করে। মুখ থেকে বেরিয়ে আসা একেকটা ধ্বনিতে রাগের মিশ্রণ, ‘ আমার মেয়েকে ধরবে না। ‘

মলিন ভাব কাটিয়ে শ্রেয়া হাসে। অত্যন্ত মৃদু হাসি। ধাতস্থ হয়ে বলে, ‘ আমি কি তিতিসার ক্ষতি আপনার চোখের সামনে করে ফেলব?আর কেনই বা করবো?আমার হাত এতটাই শক্ত না যে তিতিসার শরীর থেকে চামড়া খসে পড়ে যাবে। কিংবা আমার মন কুৎসিত না যে একটা বাচ্চার ক্ষতি করবো। আমার এমন কোনো ইচ্ছেও নেই। আপনার আচরণের ব্যাপারে শুনেছিলাম, আজ দেখেও নিলাম। আমার মনে হয় কি জানেন?আপনি ওভার পজেসিভ। নিজের জিনিস একান্তে নিজের করে রাখতে চান। কারো সান্নিধ্য সহ্য হয় না আপনার। আপনার জন্য সংসারে ফাটল ধরেছে।

শুনেছি আপনিও আমার মতো এতিম। কোনোদিন আপনজনের অভাব ফিল করেন নি?একবারও মনে হয় নি আপনজনের কাছে থাকাটা কতটা শান্তি দেয়?জানেন আপু আমি আপন মানুষের স্পর্শ পাওয়ার জন্য কত ব্যকুল ছিলাম। আল্লাহ আমার সেই চাওয়া এই পরিবারের মাধ্যমে পূর্ণ করে দিয়েছেন। আশা করি আপনিও একদিন বুঝবেন। তিতিসাকে এমন করে বড় করবেন যেন আপনাদের সম্মান করে। ভুল বললে ক্ষমা করে দিবেন আমাকে। আজও সময় আছে নিজেকে শুধরানোর। আমি আপনাকে আপু বলেই ডাকি?আমার কেউ নেই। বড় বোনের অভাব বোধ করি। আপনি বললেও ডাকবো,না বললেও ডাকবো। ‘

হাসি বজায় রেখে তিতিসাকে এক প্রকার কেঁড়ে নিল শ্রেয়া। সাথে সাথেই তিতিসা ওর বুকে মিশে গেল। ওর মাথায় চুমু খেয়ে প্রশান্তির শ্বাস টেনে নেয় শ্রেয়া। আরিয়ানার কন্ঠ নিভে গেল। অকস্মাৎ কি হয়েছে কে জানে!বললো,’ ওকে বেশি চেপে ধরো না। নয়ত গরমে কষ্ট হয় ওর। ‘
শ্রেয়া মিষ্টি হাসি উপহার দেয়। বলে,’ আচ্ছা। ‘

কিন্তু সেই হাসি বেশিক্ষণ টিকল না। মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল আরিয়ানার উচ্চারিত দু বাক্যে,’ তোমার আপন শাশুড়ি তো তাই এমন পক্ষপাতীত্ব করো। আমার মতো সৎ ঘরের হতে তাহলে এক দন্ডও মনের স্বস্তি পেতে না। ‘
থেমে থাকলো না শ্রেয়া। চট করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, ‘ মনের স্বস্তির জন্য নিচে নেমেছেন?আপন না বলে?মানুষ হোন। আপন পর দিয়ে নয়। মানবতা, মন দিয়ে যাচাই করুন। আপনি মেন্টালি সিক সেটা বুঝতে পারছেন আপু?ছিহ!’
সমস্ত গা ঘৃ-ণায় রি রি করে উঠলো তার। তিতিসা কে রেখে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। নারী মন নাকি দুর্বল হয়,মায়ায় ভরা থাকে। কিন্তু আরিয়ানা ক্ষেত্রে মতামত সম্পূর্ণ পাল্টে গেল শ্রেয়ার।

সম্ভবত অপরাহ্নেই বাড়ি ফেরছে পাখির দল। হতে পারে ভীষণ তাড়া তাদের। সন্ধ্যা নামলো না ধরণীতে,এখনই যাওয়ার কত অস্থিরতা। শ্রেয়া নীলাম্বর থেকে চক্ষু সরিয়ে এনে জিজ্ঞেস করলো,
‘ হঠাৎ কোথায় যাচ্ছি আমরা?’

সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ৪০

তূর্য একমনে ড্রাইভ করতে মগ্ন। কোমল কন্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই বলে উঠলো, ‘ খালা শাশুড়ির বাড়িতে দাওয়াত খেতে। ‘
শ্রেয়া বিষম খেলো। খালা শাশুড়ি মানে তো ওর খালা।

সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ৪২