সন্ধ্যাতারা গল্পের লিংক || ফারহানা কবীর মানাল

সন্ধ্যাতারা পর্ব ১
ফারহানা কবীর মানাল

সবেমাত্র রাতের রান্না শেষ করলাম, গোসল করার জন্য বাথরুমে যাবো। এমন সময় রহিমা কাকি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ” মা রে তোর কপাল পুড়েছে। আলভি নাকি পার্কে কোন মেয়ের সাথে খারাপ অবস্থায় ধরা পড়েছে। পুলিশ নাকি ওদের বিয়েও দিয়ে দিয়েছে। ”

কাকির এসব কথা আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না। হতবাক হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। হয়তো কাকি কিছু ভুল শুনেছে। আলভি কখনো এ কাজ করতে পারে না। কিন্তু আমার বিশ্বাসকে মিথ্যা প্রমাণ করে আলভি তার সদ্য বিবাহিত বউ নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো। মেয়েটাকে দেখতে বেশ সুন্দরী। একটা সাধারণ থ্রি-পিচ পরে আছে। হঠাৎ করে বিয়ে হয়েছে বলেই হয়তো কোনো সাজগোজ করতে পারেনি। আলভি বাড়িতে আসার কয়েক মিনিট পর শাশুড়ি মা হন্তদন্ত হয়ে ও-র কাছে ছুটে আসলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–” আলভি এসব কি শুনছি বাবা? পুকুর ঘাটে বসে কাপড় ধুচ্ছিলাম এমন সময় আবেদা আপা এসে খবরটা দিলো। তুই কি সত্যি বিয়ে করেছিস নাকি?”
আলভি চোরের মতো মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। এতো সময় হয়তো মনের কোথাও সামান্য বিশ্বাস বেঁচে ছিলো যে আলভি বলবে এটা ওর বউ নয়। ও বিয়ে করেনি কিন্তু এখন আর কোনো আশা নেই। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হতে লাগলো। শাশুড়ি মা নতুন বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ” তোর পছন্দ তো বেশ। মাশাল্লাহ সুন্দর আছে। তা বাবা এইভাবে বিয়ে করতে গেলি কেন? আমাকে বললেই তো আমি তোর বিয়ে দিয়ে দিতাম। ”

এতো সময় গ্রামের সকলের কানে খবর পৌঁছে গেছে আলভি আবার বিয়ে করছে। বাড়ির সামনে লোকের ভিড় জমছে। কেউ কেউ আমার পোড়া কপাল বলে আফসোস করছে কেউবা নতুন বউয়ের রূপের প্রশংসা করছে। কেউ আলভি কেন বিয়ে করেছে তা জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি পৃথিবীতে নেই। কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছি। ভয়ংকর একটা স্বপ্ন। আমার সারা শরীর অবস হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে এখান থেকে ছুটে চলে যাই কিন্তু পা নড়ছে না। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শাশুড়ি মা হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন, ”

কি রে মুখ পুড়ি এখনো নির্লজ্জের মতো এখানে দাঁড়িয়ে আসিস কেন? আমার ছেলেটাকে তো ধরে রাখতে পারিসনি। এখন কি ছেলেটা সুখ দেখে অভিশাপ দিচ্ছিস? ”
শাশুড়ি মা’য়ের কথায় কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না। সত্যি তো আমি আলভিকে ধরে রাখতে পারিনি। যদি পারতাম তাহলে হয়তো এইদিন দেখতে হতো না। আর এক মুহুর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে ঘরে চলে এলাম। আলমারি থেকে শাড়ি বের করে এলোমেলো পায়ে বাথরুম গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলাম। ঝর্নার শীতল পানির নিচে দাঁড়িয়ে নিজেকে কিছুটা শান্ত করার চেষ্টা করত লাগলাম। কিন্তু মনের ভিতরের আগুন কি বাইরের পানিতে নিয়ে নেভানো সম্ভব!

আলভির সাথে আমার বিয়ে হয়েছে প্রায় চার বছর। আলভি বাবার আর আমার বাবা ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই সুবাদে উনার আমাদের বাড়িতে যাতায়াত ছিলো। আলভিও কখনো সখনো বাবার সাথে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে যেতো। কিন্তু বিয়ের আগে আলভির সাথে আমার কোনো প্রকার সম্পর্ক ছিলো না। আলভির বাবা মানে আমার শশুর আব্বুই আমাকে পছন্দ করে আলভির বউ করে নিয়ে আসে। কিন্তু আমার শাশুড়ি মা’য়ের কোনো কালেই আমাকে পছন্দ ছিলো না। বিয়ের এতো বছর পরেও উনি আমাকে ছেলের বউ হিসাবে মেনে নিতে পারেননি। শাশুড়ি মা চেয়েছিলো তার ভাইয়ের মেয়েকে আলভির বউ করে আনতে কিন্তু শশুর আব্বু রাজি ছিলেন না। তাই শাশুড়ি মা-ও আর কিছু করতে পারেননি।

বিয়ের পরে জানতে পারি আলভি নাকি আমাকে বিয়ের আগে থেকেই ভালোবাসতো। সে কারণেই মাঝে মধ্যে আমাদের বাড়িতে যেতো আমাকে দেখতে। এসব কথা আমার আলভির মুখ থেকেই শোনা। বিয়ের পরে বেশ সুখেই দিন কাটছিলো আমাদের। কখনো স্বপ্নেও এমনটা ভাবতে পারিনি। বুকে প্রচন্ড ব্যাথা করছে, দম আটকে আসছে বারবার। চোখের পানিগুলো ঝর্ণার পানিতে মিলিয়ে যাচ্ছে।

ঘন্টাখানেক গোসল করার পর কোনো রকম ভাবে শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলাম। এক ঘন্টার মধ্যে বাড়ির পরিবেশ বদলে গেছে। আমার চির পরিচিত ঘরটা ফুল আর রঙিন কাগজ দিয়ে সেজে উঠেছে। সারা বাড়িতে খুশির আমেজ। বুঝতে বাকি রইলো না এটা শাশুড়ি মা’য়ের করা। কোনো কালেই তিনি আমাকে পছন্দ করতেন না। আমার জন্য শেষ বয়সে স্বামী সাথে তার তিক্ততার সম্পর্ক ছিলো। এ বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর থেকে শাশুড়ি মা আর শশুর আব্বু কখনো মিলেমিশে থাকতে পারেনি। রোজই তাদের ভিতর ঝামেলা হতো। আর কারণটা ছিলাম আমি। শাশুড়ি মা প্রায়ই আমাকে নানান কথা শোনাতেন, শশুর আব্বু তার প্রতিবাদ করতে গেলেই দুইজনের ঝগড়া লাগতো। আমার বিয়ের একবছরে মাথায় শশুর আব্বু মারা গেলেন। সে-ই থেকেই আমি শাশুড়ির দুই চোখের বিষ। কখনো আমাকে সহ্য করতে পারে না। একমাত্র ছেলে যদি বউ নিয়ে আলাদা হয়ে যায় সেই ভয়ে আলভির সামনে তেমন কিছু বলতো না।

নিজের চির পরিচিত ঘরটা আজ অন্যকারো জন্য সেজে উঠেছে। সব থেকে কাজের মানুষটাকে কেড়ে নিতে, ঘর থেকে বের হয়ে দেখলাম আলভির নতুন বউকে খুব সুন্দর করে সাজানো হচ্ছে। শাশুড়ি মা নিজে হাতে সাজিয়ে দিচ্ছেন। অথচ এই মানুষটা আমাকে কখনো ভালোবাসেনি। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম আলভি কোথাও নেই। বুকের ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো। এখানে দাঁড়িয়ে এসব দেখা মৃত্যু যন্ত্রণার সমান তাই গুটিগুটি পায়ে হেঁটে ছাঁদে চলে এলাম। কিছুসময় আগে সূর্য ডুবে গেছে। পশ্চিম আকাশে সন্ধ্যাতারা জ্বলজ্বল করছে। দিন আলো সরে গিয়ে রাতের অন্ধকার হানা দিচ্ছে পৃথিবীতে। ঠিক যেন আমার জীবনের মতো। কি থেকে কি হয়ে গেলো এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। তবে আলভির জীবনে আমি আর মাত্র কয়েকদিনের অতিথি এটা খুব ভালো করে বুঝে গেলাম। আচ্ছা বউ থাকতেও কেন অন্য নারীর প্রয়োজন হয়? একজনের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকা কি বড্ড কষ্টের কাজ?

চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। চিৎকার করে কাঁদতে পারলে হয়তো কষ্ট কিছু কম হতো। ছাঁদের এক কোণে বসে আকাশ দেখতে লাগলাম। যদিও চোখ বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে তবুও আকাশ দেখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। এই ঘন কালো আকাশের সাথে নিজের জীবনের বড্ড মিল পাচ্ছি আজ। আস্তে আস্তে রাত বাড়তে থাকলো। অন্ধকার গভীর থেকে আরো গভীর হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম। আল্লাহ কুরআন শরীফ বলেছেন,

‘নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি।’ [সুরা ইনশিরাহ : ৬]
হঠাৎ চির পরিচিত সেই কন্ঠস্বর কানে ভেসে এলো।
–” আমাকে বাসরঘরে যাওয়ার অনুমতি দেবে না? ”
এতো কষ্টের মাঝেও হাসতে ইচ্ছে করলো খুব। বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে এসেছে এখন নাটক সিনেমার মতো আমার কাছে অনুমতি চাচ্ছে। মানুষ কত অভিনয় করতে পারে! ইচ্ছে হলো আলভিকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করি, কেন এমনটা করলে তুমি? এই ছিলো তোমার ভালোবাসা? ভালোই যদি না বাসতে তাহলে দিনের পর দিন কেন ভালোবাসি বলেছো?”
কিন্তু কোনো প্রশ্নই করলাম না। নিজের মতো বসে রইলাম।

–” কি হলো আমার সাথে কথা বলবে না তুমি?”
–” নিজের নতুন বউ অপেক্ষারত রেখে প্রাক্তন বউয়ের সাথে কিসের কথা আপনার?”
–” তুমি কিন্তু আমার প্রাক্তন স্ত্রী না। তোমার সাথে আমার ভির্ভোস হয়নি। আর না তো কোনো বিচ্ছেদ! তুমি এখনও আমার বউ।”
–” প্রাক্তন হতে গেলে বিচ্ছেদ বা ভির্ভোসের দরকার হয় না। মৃত মানুষের সাথে কিন্তু কারো সম্পর্ক থাকে না। ”
–” আমি তোমার কাছে মরে গেছি?”

আলভির কথার কোনো জবাব দিলাম না। ইচ্ছে করছিলো চিৎকার করে বলি হ্যাঁ আপনি মৃত আমার কাছে কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারলাম না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।
আলভি পিছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, ” কি হলো বলো আমি মরে গেছি তোমার কাছে?”

আমি ও-র কথার জবাব না দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। কখনো ভাবিনি আলভির বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে হবে। যে মানুষটার প্রতিটা স্পর্শে ভালোবাসা খুঁজে পেতাম আর তার স্পর্শতেই যেন সমস্ত ঘৃণা লুকিয়ে আছে।

আলভি আমাকে শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরে বললো, ” কি হলো বলো? আমি আমার প্রশ্নের উত্তর চাই।”
আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, ” আপনার কথার উত্তর দিতে আমি বাধ্য না। নিজেকে সদ্য বিয়ে করা বউয়ের কাছে গিয়ে এসব করুন। আমাকে দয়া করে ছেড়ে দিন। ”
আলভি কর্কশ গলায় বললো, ” তাহলে কার কথার জবাব দিতে বাধ্য তুমি?”
আমি কিছু একটা বলতে চাইলাম কিন্তু তার আগেই জ্ঞান হারিয়ে আলভির হাতের উপর ঢলে পড়লাম। তারপর কি হয়েছে মনে নেই।

চোখ খুলে দেখলাম আমি ফুল দিয়ে সাজানো খাটে শুয়ে আছি। হ্যাঁ এটা আমারই ঘর যা অন্যকারো জন্য সেজে উঠেছিলো। কিন্তু আমি এখানে কেন! চারদিকে খেয়াল করে দেখলাম সকলে আমাকে নিয়ে বসে আছে। শাশুড়ি মা অগ্নি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমার জ্ঞান ফিরেছে দেখে ঝাঁঝালো গলায় বললেন, ” আমার ছেলেটাকে কি তাবিজ পড়া খাইয়েছিস তুই? ”
শাশুড়ি মা’য়ের কথায় অর্থ আমার বোধগম্য হলো না। আমার সাথে কি হয়েছে বুঝতে চেষ্টা করতে লাগলাম। আমার অবাধ্য চোখজোড়া আলভিকে খুঁজে চললো। কি হবে আমার সাথে!

সন্ধ্যাতারা পর্ব ২