সন্ধ্যাতারা পর্ব ৫

সন্ধ্যাতারা পর্ব ৫
ফারহানা কবীর মানাল

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো আলভির কোনো খোঁজ নেই। যতবার ও-কে কল দিয়ছি ততোবারই এক পরিচিত গলা জবাব দেয়, ” আপনার কাঙ্ক্ষিত নম্বরের সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না! ” কোথায় যেতে পারে আলভি কিছু বুঝতে পারছি না। ও-র সকল বন্ধু, অফিসের কলিগ আত্মীয় স্বজন সবার কাছে ও-র খোঁজ নিয়েছি কিন্তু কেউ-ই বলতে পারছে না আলভি কোথায় গেছে। এদিকে আমার শরীরও আস্তে আস্তে খারাপের দিকে যাচ্ছে। প্রচন্ড জ্বর সে-ই সাথে এতো টেনশন, সবকিছু মিলিয়ে খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে আছি। নীলিমা সর্বক্ষণ আমার সাথে আছে। আমাকে নানান কথা বলছে, এসব দেখে আমার শাশুড়ি মা ভিষণ বিরক্ত! নিজের মতো কিসব বকবক করছে আবার চুপ করে টিভি দেখছে। দুপুরের দিকে নীলিমা সামান্য পরিমাণ ভাত লেবু দিয়ে চটকে জোর করে আমাকে খাইয়ে দিয়েছে। খাওয়ার পর একটা প্যারাসিটামল ঔষধও খেতে দিয়েছিলো। ওষুধের প্রভাবে শরীর সময়ের সাথে কিছুটা ঠান্ডা হচ্ছে কিন্তু মনের মাঝে অস্থিরতা বেড়েই চলেছে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এলো এখনও আলভির কোনো খবর নেই। কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার শরীর এখন মোটামুটি, জ্বর নেই কিন্তু প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে। সন্ধ্যার দিকে শাশুড়ি মা আমার কাছে এসে প্রশ্ন করলেন, ” তানিয়া আলভি কোথায় গেছে বলতে পারো? ছেলেটা সেই সকালে বের হয়ে চলে গেলো এখনও আসার নাম গন্ধ নেই। ”
শাশুড়ি মা’য়ের কথার কও জবাব দিবো বুঝতে পারলাম না। শুধু চোখ মুছে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। শাশুড়ি মা আমার দিকে কিছুসময় তাকিয়ে থাকলেন তারপর ইশারায় তার ঘরে যেতে বলে নিজের ঘরে চলে গেলেন। আল্লাহ জানে এখন কি বলবেন সে!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

গুটিগুটি পায়ে হেঁটে শাশুড়ির ঘরে গেলাম। শাশুড়ি মা আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন, ” এখানে বসো। কিছু কথা বলি। ”
আমার ভিতরের অস্থিরতা ক্রমশ বাড়তে লাগলো। শাশুড়ি মা যদি জানতে পারেন আমার কথায় কষ্ট পেয়ে আলভি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে তাহলে আমাকে খুন করতেও তার হাত কাঁপবে না। চুপচাপ গিয়ে খাটের পাশে রাখা চেয়ারে বসে পড়লাম।

শাশুড়ি মা শান্ত গলায় বললো, ” মা আমাকে তুমি মাফ করে দিও। সকালে আলভির ব্যবহার দেখে আমার মনে হয়েছে আলভি তোমার সাথেই সব থেকে বেশি খুশি। অন্য কাউকে পেলে হয়তো ছেলেটা এতো খুশি থাকতো না। ”
আমি অবাক দৃষ্টিতে শাশুড়ি মা’য়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। শাশুড়ি মা হয়তো বুঝতে পেরেছে আমি তার কথা বুঝতে পারিনি। তাই আবারও বলে উঠলো, ” সকালে আমি আলভি আর নীলিমাকে নিয়ে এক জায়গাতে বসে কথা বলেছিলাম। তুমি হয়তো জানো না। কারণ আমি আলভিকে বলেছিলাম দরজা আটকে দিতে। ”

শাশুড়ি মা’য়ের কথা শোনার পর আমার চোখের সামনে সকালের দৃশ্য ভেসে উঠলো। আলভি নীলিমাকে ডাকতে ডাকতে বাড়িতে ঢুকছে। নীলিমা আলভির ডাক শুনে ঘর থেকে বের হয়ে এলো তারপর আবার আলভির সাথে ঘরে চলে গেলো। তারপর আলভি দরজা আটকে দিয়েছিলো। আমি মনে করে ছিলাম আলভি আর নীলিমা একান্ত সময় কাটানোর জন্য এক ঘরে আটকা পড়েছে। কিন্তু ঘরে যে শাশুড়ি মা ছিলো তা একবারও বুঝতে পারিনি।

–” সকালে আপনি আলভি আর নীলিমার সাথে কথা বলেছিলেন মা?”
–” হ্যাঁ রে মা। আমি আর নীলিমা বসে কথা বলছিলাম। পরে আমি আলভিকে কল দিয়ে বলি নীলিমা আমাকে বলেছে যে ও তানিয়াকে এই বাড়িতে দেখতে চায় না। আলভির সাথে ভালো ভাবে সংসার করতে চায়। ‘ এ কথা শোনার পর আলভি কল কেটে দেয়। তারপর বাড়ি চলে আসে। আলভি সদর দরজা দিয়েই নীলিমার নাম ধরে ডাকতে থাকে। তারপর ওরা আমার কাছে যায়। আমি আলভিকে বলি দরজাটা আটকে দিতে, আলভি রাগ করে দরজা আটকে দেয়। তারপর কড়া গলায় নীলিমার কাছে জানতে চায়, নীলিমা এমন কেন বলেছে! কিন্তু নীলিমা তো এমন কথা বলেনি তাই অস্বীকার করে। ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। ”

আমি হতভম্ব হয়ে শাশুড়ি মা’য়ের কথা শুনছি। এ তো সিরিয়ালের শাশুড়ির মতো তালবাহানা করছে। শাশুড়ি মা কিছু সময় চুপ করে থেকে আবারও বলে ওঠে, ” মা রে সারাদিন সংসারের এসব কুট কাঁচালি দেখতে দেখতে আমিও কবে অমানুষ হয়ে গেছি নিজেও বুঝতে পারিনি। নিজের পছন্দ অপছন্দের থেকে বড় ব্যাপার হলো সন্তানের ভালো থাকা। সন্তান যার সাথে ভালো থাকে তাঁকেই মেনে নেওয়া উচিত। তুই আমাকে মাফ করে দে মা। যে করে পারিস আলভিকে আমার কাছে এনে দে। ও ছাড়া তো দুনিয়ার কেউ নেই আমার। ”

শাশুড়ি মা কথাগুলো বলে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। আমিও উনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। না জেনে বারবার আলভিকে ভুল বুঝেছি। আসলে আমাদের চিন্তা ধারণা এখন নেগেটিভ হয়ে গেছে। আমরা ভালো কোনো জিনিসকেও ভালো মনে করতে পারি না। সন্ধ্যার প্রহর শেষ হয়ে রাত শুরু হলো। আলভি এখনও বাড়িতে আসেনি। বারবার সদর দরজার কাছে গিয়ে দেখতে লাগলাম আলভি এসেছে কিনা কিন্তু আলভির কোনো খোঁজ পেলাম না।
সারারাত নির্ঘুম কেটে গেলো। ফজরের নামাজ পড়ে আল্লাহ কাছে সাহায্য চাইলাম।

–” হে আল্লাহ আপনি ছাড়া আমাকে সাহায্য করার আর কেউ নেই। আপনিই তো বলেছেন আপনার রহমত থেকে নিরাশ না হতে, আমি আপনার রহমত ভিক্ষা চাচ্ছি। ”
নামাজ শেষ করে বাগানে চলে এলাম। প্রায় দিন সকালে আলভির সাথে এখানে আসতাম। আজ আলভি আমাকে ভুল বুঝে আমার থেকে কত দূরে চলে গেছে। আমিও আলভিকে ভুল বুঝে কত দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম। কোথায় যেতে পারে ছেলেটা। আচ্ছা নদীর পাড়ে যায়নি তো? আমাকে নিয়ে প্রায়ই নদীর পাড়ে ঘুরতে যেতো। হয়তো সেখানে গিয়ে বসে আছে।

পরমুহূর্তেই মনে হলো একটা মানুষ সারারাত কি নদীর পাড়ে বসে থাকবে নাকি! এ কি নাটক সিনেমা যে প্রেমিকার জন্য সারারাত দিন সেই জায়গায় অপেক্ষা করবে যেখানে তারা আগে সুন্দর সময় কাটাতো। আবার যেতেও তো পারে, এসব নাটক সিনেমা আমাদের মস্তিষ্কের উপর অনেক প্রভাব ফেলে, আমরা নাটক সিনেমার মতো চলতে চেষ্টা করি। গিয়ে দেখতে তো দোষ নেই। পেলে তো আলহামদুলিল্লাহ না পেলে কি আর করবো। কিন্তু আমার শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালো না। একা যেতেও সাহস হচ্ছে না। নাহ্ এখন নিজের কথা ভাবলে হবে না আলভিকে খুঁজে বের করতে হবে। শাশুড়ি মা মনে করছে আলভি তার কথায় কষ্ট পেয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, গতকাল রাত থেকে একদম মুষড়ে পড়েছে।

ঘরে গিয়ে বোরকা হিজাব পরে নিলাম। ব্যাগে টাকা আছে কিনা চেক করে, ব্যাগটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে ঘর থেকে বের হতেই নীলিমা প্রশ্ন করলো, ” আপু কোথায় যাচ্ছেন?”
–” আলভিকে খুঁজতে, এভাবে বসে থাকলে ও-কে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আলভি অনেক জেদি একটা ছেলে। মা বাবার উপর রাগ করে বাড়ি ছাড়ার রেকর্ডও তার আছে। ”

নীলিমা আমার কথায় মুচকি হাসলো। তারপর বললো, ” আপনার শরীর তো ভালো না। আপনার একা যেতে হবে না। আপনি বরং কয়েক মিনিট অপেক্ষা করেন। আমি বোরকা হিজাব পরে আসি। আমিও আপনার সাথে যাবো। ”
আমি মুখে কিছু বললাম না। শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। নীলিমা দৌড়ে গিয়ে বোরকা হিজাব পরে আসলো। তারপর দুইজন শাশুড়িকে বলে বের হয়ে আসলাম। জীবনে প্রথমবার শাশুড়ি মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। তারপর চোখের পানি মুছে ঘরের ভিতর চলে গেলেন। একটা রিকশা ডেকে আমরা দুইজন রিকশায় উঠে গেলাম। নদীর পাড়ে যাবো। আল্লাহ চাইলে আমি আলভিকে পেয়েও যেতে পারি। চেষ্টা করতে ক্ষতি কি! আল্লাহ কুরআন শরীফে বলেছেন,

–‘ মানুষ যা চায়, তাই কি সে পায়?’ ( সূরা নাজম, আয়াত -২৪)
–” মানুষ তাই পায় যা সে চেষ্টা করে। ( সূরা নাজম, আয়াত -৩৯)
রিকশার হুট খোলা, বাতাসে কাপড় উঠে যাচ্ছে। খুব সুন্দর অনুভূতি। কিন্তু তাও কিছু ভালো লাগছে না। চোখের সামনে শুধু আলভির আর আমার সুন্দর মুহূর্তগুলে ভেসে উঠছে। আলভির সাথে রিকশায় বসলে সবার চোখের আড়ালে আমার হাতটা ধরে থাকতো।

–” মামা রিকশাটা থামান প্লিজ। দয়া করে আমার কথাটা শোনেন একটু।”
নীলিমার চিৎকার শুনে রিকশাওয়ালা মামা গাড়ি দাঁড় করালেন। নীলিমা কিছু না বলে রিকশা থেকে নেমে ছুট লাগালো। আমি কিছু বুঝতে না পেরে ও-র পিছন পিছন দৌড় দিলাম। রিকশাওয়ালা মামা হতভম্ব হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কয়েকবার ডাক দিলেন কিন্তু আমি ফিরলাম না। নীলিমা দৌড়ে একটা ছেলের কাছে গেলো। ছেলেটা রাস্তার পাশের ডাস্টবিন থেকে ময়লা ভেনে তুলছে।

সন্ধ্যাতারা পর্ব ৪

–” নীলয়!”
নীলিমার গলা শুনে ছেলেটা ও-র দিকে তাকলো তারপর দুইজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলো। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না, এটা নীলিমার স্বামী। ও কত সহজেই ও-র বরকে খুঁজে পেয়ে গেলো আমিও যদি আলভিকে এমন করে খুঁজে পেতাম। এমন সুন্দর মুহুর্তেও আমার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

সন্ধ্যাতারা পর্ব ৬