সন্ধ্যাতারা পর্ব ৬

সন্ধ্যাতারা পর্ব ৬
ফারহানা কবীর মানাল

এমন সুন্দর মুহুর্তেও আমার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আমিও যদি আলভিকে খুঁজে পেতাম আজ। আমি ওদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইলাম। এই সময়ে ওদের বিরক্ত করা উচিত হবে না। আমি চুপচাপ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম। নীলিমা নীলয়ের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে ওকে প্রশ্ন করলো, ” তুমি ঠিক আছো? আমি সেদিন তোমাকে খুঁজে পাইনি। জানো কত কিছু হয়ে গেছে!”

নীলয়ের চোখে পানি টলমল করছে। একহাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বললো, ” আমার পা ভেঙে গেছে রে নীলিমা। এই দেখো ব্যান্ডেজ করা। ”
নীলিমা নীলয়ের পায়ের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল। সত্যিই ওর ডান পায়োর বেশ খানিকটা জায়গা ব্যান্ডেজ করা। নীলিমা ব্যস্ত হয়ে বললো, ” কি হয়েছো তোমার? আর এ অবস্থায় কাজ কেন করছো?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নীলয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ” তোমাকে যেদিন বাসস্ট্যান্ডে আনতে যাবো সেদিন যাওয়ার পথে আমার এক্সিডেন্ট হয়। মোবাইলটাও হারিয়ে যায়। তুমি তো জানো আমি সামান্য ব্যাথাও সহ্য করতে পারি না। এক্সিডেন্টের পরে আমার চোখ খোলে হাসপাতালে কিন্তু এই অবস্থায়! জ্ঞান ফেরার পর মনে পড়ে তোমাকে আনতে যাওয়ার কথা। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসি। কিন্তু বাসস্ট্যান্ডে তোমাকে আর খুঁজে পাইনি। এদিকে আমার কাছে মোবাইলও নেই, মানিব্যাগটাও হারিয়ে গেছে। তোমাকে নিয়ে সব জায়গায় ঘুরবো বলে সব টাকা নিয়ে বেরিয়ে ছিলাম। আমার কাছে কোনো টাকাও নেই, মোবাইলটাও নেই যে তোমাকে কল দিবো। কি করবো কিছু বুঝতে পারছিলাম না। এদিকে একটু হাঁটার কারণে পায়েও অনেক ব্যাথা হয়। সারারাত ব্যাথার জ্বালায় কেঁদেছি। আজ সকালে তোমাকে একটা নম্বর থেকে কলও দিছিলাম কিন্তু রিসিভ করোনি। হয়তো নম্বর চেনো না তাই। সকালে কাজে এসেছি টাকা পেলে সীম কার্ড তুলে তোমাকে কল দিবো তাই। ”

নীলিমার চোখেও পানি টলমল করছে। এরা দুইজন দু’জনকে কত ভালোবাসে। নীলিমার এতো সময় পর আমার দিকে খেয়াল এলো। নীলয়কে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।
–‘ নীলিমা তুমি নীলয়কে নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলো। ”
–” কিন্তু কাজ কে করবে?”
নীলয়ের প্রশ্নের জবাবে বললাম, ‘ কাজ করতে হবে না। মালিককে কাজটা ফিরিয়ে দেও আর তোমার নীলিমাকে তো পেয়ে গিয়েছো এখন আর টাকা লাগবে না। ‘

নীলয় পাশে দোকানে বসা একটা লোকের সাথে কথা বলতে গেলো। হঠাৎ মনে পড়লো। নীলিমা যেদিন এসেছিলো সেদিন থ্রি পিচ পরে ছিলো। আজ হঠাৎ বোরকা হিজাব কোথায় পেলো! প্রশ্নটা মনে আসতেই নীলিমাকে বললাম, ” আচ্ছা নীলিমা তুমি বোরকা হিজাব কোথায় পেলে? তুমি তো সেদিন থ্রি-পিস পরে এসেছিলে। ”

–” আপনার শাশুড়ি মা দিয়েছে আমাকে। প্রথমদিন উনি আমাকে এই বোরকা আর হিজাব দিয়ে বলেছিলেন এখন থেকে জানি আমি বোরকা হিজাব পরি। মেয়েদের উপর আল্লাহ পর্দা করা ফরজ করেছেন। এখন যদি অবহেলা করে এসব মেনে না চলি আর যদি আল্লাহ পরকালে এর জন্য শাস্তি দেন তখন কি করবো। তাছাড়া একজন মুসলিম হিসাবে তো আমার এসব বিধান মেনে চলা উচিত। আপনার শাশুড়ি কেমন মানুষ আমি জানি না। তবে উনি কথাগুলো আমার ভালোর জন্যই বলেছেন, তা-ই ভাবলাম এখন থেকে বোরকা হিজাব পরে চলবো। বোরকা হিজাব পরলেই ভালো হয় না এটা ঠিক। কিন্তু নিজের ধর্মের ফরজ বিধান লঙ্ঘন করে কি কেউ ভালো হতে পারে বলেন? এটা আমি এতোদিন বুঝতে পারিনি। আপনার শাশুড়ি মা’ই আমাকে বুঝিয়ে বলেছে। ”

নীলিমার কথায় মুচকি হাসলাম। শাশুড়ি মা সকলের সাথেই কত ভালো ব্যবহার করে। শুধু আমাকে-ই কেন দেখতে পারে না কে জানে। নীলয় ও-ই লোকটার সাথে কথা বলে চলে আসলো। তারপর আমাদের কাছে এসে বললো, ” উনার থেকে কাজটা নিয়েছিলাম। সব কাজ করে দিলে ২০০ টাকা দিবে বলেছিলো। চলেন এখন কোনো কাজ নেই।
নীলিমা আর নীলয় এক রিকশায় উঠলো। আর আমি অন্য এক রিকশায়। অনেকদিন পর দেখা হয়েছে ওদের, একসাথে একটু সময় কাটালে ভালো লাগবে ওদের। রিকশায় বসে আলভির কথা ভাবতে লাগলাম। নদীর পাড়ে কি আমি সত্যি ও-কে পাবো?

কিন্তু না আমার ইচ্ছে পূরণ হয়নি। আলভিকে কোথাও পেলাম না। এক বুক হতাশা নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসলাম। কিছু ভালো লাগছে না। গেস্ট রুমে নীলয় আর নীলিমাকে থাকতে বলে আমি ঘরে চলে আসলাম। শাশুড়ি মা তখন নিজে ঘরে শুয়ে ছিলেন। তাঁকে আর কিছু বলা হলো না। ঘরে ঢুকে বোরকা হিজাব খুলে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলাম। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। জ্বর হয়তো আবারও আসবে। চোখ বুঁজে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে গেলাম নিজেও জানি না। চোখ খুলে দেখলাম কেউ একটা আমার কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

পার্ট ৫ এ একটা কুরআনের আয়াত ছিলো, ‘ মানুষ যা চেষ্টা করে তাই পায়।’ এটা সূরা নাজমের ৩৪ না ৩৯ নম্বর আয়াত। আমার এমন ভুলের জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। কুরআনের আয়াত লেখার সময় আমার আরো সর্তক হওয়া উচিত ছিলো। আমার এই ভুলটা একজন পাঠক ধরিয়ে দিয়েছেন। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আমার ভুলটা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য।

বাইরে সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ আগে। ঘরের ভিতরও অন্ধকার। লোকটার মুখটা দেখতে না পারলেও এই স্পর্শের সাথে আমি অনেক পরিচিত আর এই মানুষটাও আমার চিরচেনা। খাটের উপর উঠে বসলাম। আলভি আমার দিকে ঘুরে তাকালো। ও কিছু বলবে এর আগে আমি ও-কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। আলভি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, ” কাঁদছো কেন শুনি? এই তো আমি। ”
–” আপনি অনেক খারাপ। আমাকে রেখে চলে গেছিলেন। কেউ নতুন বউ নিয়ে আসলে কি আগের বউটা ঠিক থাকতে পারে নাকি?”

আলভি আমার কথায় মুচকি হাসলো। তারপর এক হাত দিয়ে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে আমাকে ও-র কাছে নিয়ে গেলো। কিন্তু আমার এই প্রেম একদম ভালো লাগছে না। খুব রাগ হচ্ছে। প্রিয় মানুষের উপর কখন কখন যে অভিমান হয় আমরা নিজেরাও ঠিক বলতে পারি না। আমি ও-র থেকে সরে আসতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে আমাকে আরো শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরলো।
আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, ” আমার উপর অভিমান করো না প্রিয়, আমি বুঝতে পারিনি তুমি জানতে না এসব কিছু। আমি তো ভেবেছি তুমি সব জানো। ”

আমি অবাক হয়ে আলভিকে প্রশ্ন করলাম, ” আপনাকে এসব কে বলেছে?”
আলভি মুচকি হেসে বললো, ” আমার শাশুড়ি মা। ”
আমার মা আলভিকে এসব কি করে বললো। আলভির মোবাইল তো বন্ধ ছিলো।
–” আপনাকে মা কোথায় পেলো শুনি?”

–” মেয়েরা তো রাগ করে বাপের বাড়ি যায়। কিন্তু ছেলেরা তো বাপের বাড়িতে থাকে, তারা আর কই যাবে বলো, শশুর বাড়ি গিয়েছিলাম। তুমি বুঝতেই পারতে না আমি কোথায়! ”
কথাগুলো বলেই আলভি হো হো করে হাসতে লাগলো। আমার এখন আরো বেশি রাগ হচ্ছে। আমি আলভির হাতের কাছের শার্ট খামছে ধরে বললাম, ” গেছিলেন তো ভালো কথা, আবার ফিরে এসেছেন কেন হুহ?”
আলভি শয়তানি হাসি দিয়ে বললো, ” বউয়ের কথা মনে পড়েছে, এই বর্ষায় রোমান্টিক আবহাওয়ায় কি বউ ছাড়া বেশিদিন ভালো লাগে নাকি?’

–” দেখেন মজা ভালো লাগছে না। আর আপনি মা’য়ের কাছ থেকে এসব জানলেন কি করে মা’কে তো আমি কিছু বলিনি। ”
–” তুমি বলনি। মা নাকি বিকালে কল দিয়ে অনেক কান্না করেছে, তুমি নাকি আমাকে খুঁজতে গেছো, এসব শুনেই এসেছি। বাড়িতে আসার পরে নীলিমার কাছেই সব শুনলাম। আমি কি করে জানবো কেউ এসএমএস সিন করে কিন্তু ভয়েস রেকর্ড শোনে না। ”

–” ওহ! ভালো হইছে আমি না হয় শুনিনি। তবে আপনি বাসরঘরে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন কেন?”
–” ওরে্ ভাই একটু নাটক সিরিয়ালের মতো ঢং করতে গেছিলাম। কে জানতো সে আপনি জানেন পারেননি কিছু। ”
–” আপনার এতো ঢং করা লাগে কেন শুনি?”
–” বউয়ের সাথেই ঢং করতে হয়। আমার কি আর বউ আছে নাকি যে তার সাথে ঢং করবো?”
আমি রাগী গলায় বললাম, “আরো বউয়ের শখ আছে নাকি?”

আলভি কিছু না বলে আমার কপালে চুমু এঁকে দিলো। তারপর ও-র দুই হাত দিয়ে আমার মুখ ধরে বললো,” না এই একটাকে নিয়েই জান্নাতে যাওয়ার ইচ্ছে আছে৷ আর কাউকে চাই না। ”
আমি উত্তরে কিছুই বললাম না। শুধু আলভিকে জড়িয়ে ধরলাম। আলভিও আমাকে ওর বুকের মাঝে আগলে নিলো। সব বাঁধা বিপদ শেষ করে আমরা আবার এক হয়ে গেছি। স্বামী স্ত্রী সম্পর্কে ঝগড়া ঝামেলা থাকবেই তা-ই বলে জেদ করে আলাদা হয়ে যাওয়া কোনো সমাধান না।

সন্ধ্যাতারা পর্ব ৫

আর এই ঘটনায় আলভির যেমন দোষ ছিলো আমিও খুব একটা নির্দোষ ছিলাম না। এসএমএস সিন করা দেখলে তো যে কেউ ভাবতো আমি সব জানি। এমন কি আমিও তাই ভাবতাম। সব ভুলবোঝাবুঝি মিটে আমরা আবারও এক হতে পেরেছি এটাই আলহামদুলিল্লাহ। প্রিয় মানুষটাকে নিজের কাছে রাখার থেকে বড় আনন্দের কিছুই হতে পারে না।

সন্ধ্যাতারা শেষ পর্ব