সবটাই তুমিময় পর্ব ৩৯ || লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা

সবটাই তুমিময় পর্ব ৩৯
লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা

বিয়ের সমাগম রিসেপশন অবদিই ছিলো।রিসেপশনে সাংবাদিকদের সব প্রশ্নের স্বচ্ছ জবাবে সবাইকে সন্তুষ্ট করেছেন অঙ্কুর।আজ সকালসকালই উনি ক্লাবে যাবেন বলে একদম রেডি হয়ে বেরিয়েছেন।ডাইনিং টেবিলে খাবার সার্ভ করছিলাম।মনিমা এখানেই বসে।অঙ্কুর বললেন,
-অদ্রি?কিচেনে যাও তুমি?
গাল ফুলিয়ে বললাম,
-না।নায়েব কাকা যেতে দেয়না।মনিমা তো আছেই!
-গুড।
উনি খাবার খেতে লাগলেন।আমি আর মনিমাও শুরু করলাম।অঙ্কুর খেতে খেতে বললেন,
-মা?একটা কথা বলার ছিলো।
-হুম বল।

-আমি চাই অদ্রি জার্নালিজম নিয়েই পড়াশোনাটা কন্টিনিউ করুক।
খাওয়া থামিয়ে বিস্ফোরিত চোখে তাকালাম অঙ্কুরের দিকে।এই বিষয়ে আমার সাথে কোনো কথাই হয়নি তার।মনিমার দিকে তাকালাম।সেও কিছুক্ষন তাকিয়ে ছিলো অঙ্কুরের দিকে।তারপর খাবার নাড়তে নাড়তে বললো,
-এই সাংবাদিকতাই ওকে অনাথ করে দিয়েছিলো অঙ্কুর!
-মা,ওটা পরিস্থিতি ছিলো।তা বলে তো আর জীবন থেমে থাকে না।আকাশ স্যার,অনিতা ম্যামের মৃত্যুর জন্য প্রদীপ সরকার দায়ী ছিলো।সাংবাদিকতা নয়।ওটা তো তাদের দায়িত্বই ছিলো।তাই সাংবাদিকতাকে দোষারোপ করলে,এই পেশাকে অসম্মান করা হবে না?তাছাড়া এসবের ভয়ে অদ্রির ইচ্ছা?ওর স্বপ্নগুলোই বা কেনো ধামাচাপা পরে যাবে বলতে পারো?কিছুই হবে না ওর।আমি কোনোদিন কিছু হতে দেবো না ওর!এটুকো বিশ্বাস নেই তোমার আমার উপরে?বলো মা?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বেশ কিছুক্ষন মনিমা চুপ রইলো।পাশের চেয়ারে বসে তার হাতে হাত রেখে শান্তভাবে অঙ্কুরকে বললাম,
-কি দরকার অঙ্কুর?থাক না এসব।আমি চাইনা মনিমার অমতে আর….
-তুমি জার্নালিজম পড়বে আহানিতা।
উৎফুল্লভাবে তাকালাম মনিমার দিকে।সে হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-আমারই ভুল ছিলো,তোকে সাপোর্ট না করে বেধে রাখা।ঠিকই বলেছে অঙ্কুর।যা হওয়ার,তা তো হয়েই গেছে।কিন্তু এখন তুই তোর স্বপ্নগুলো পুরন করবি।সাংবাদিকতা নিয়েই পড়াশোনা করবি তুই।তোকে আগলে রাখার জন্য এখন অঙ্কুর আছে যে!
আনন্দঅশ্রুতে চোখ ভরে উঠলো।আমার মতো অনাথের,এরকম একটা পরিবার পাওয়া,সত্যিই অনেক সৌভাগ্যের।খুশিতে জরিয়ে ধরলাম মনিমাকে।

দেখতে দেখতেই তিনমাস কেটে গেছে।বিয়ের পর এ তিনমাসে প্রতিদিন নতুন নতুন ভাবে অঙ্কুরের ভালোবাসার সাথে পরিচয় হয়েছে আমার।ছোটছোট বিষয়ে এতোটা কেয়ারিং উনি,যা প্রতিবার মুগ্ধ করে আমাকে।দাদুবাড়িতে ছিলাম আমরা বেশ কয়েকদিন।নানুবাসায়ও গিয়েছিলেন উনি।ওনার এই মিশুক ভাব যেনো আরো আকৃষ্ট করে সবাইকে।অনেকটা ব্রেক,মোটামুটি পনেরোদিন পর ভার্সিটির মাঠে বসেছি তিনজন।আস্থা,তানহা,আমি।আমার মাইগ্রেশনের বিষয়টা নিয়ে সবগুলো অমাবশ্যার চাদের মতো মুখ করে রেখেছে।মনটা আমারো ভালো নেই।গোমড়া মুখে বললাম,

-শুধু সাব্জেক্টটা পাল্টাচ্ছি।ভার্সিটি না তো!সবসময় তোদের সাথেই বসবো ইয়ার!এমন মুখ বানিয়েছিস কেনো তোরা?
আস্থা বললো,
-ক্লাস যে অন্যরুমে করবি!সেটা?
হতাশার শ্বাস ফেললাম।তানহা অন্যদিক তাকিয়ে।ওর চুল আঙুলে পেচিয়ে বললাম,
-তিহান কই রে?
-ও পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে।
-মানেহ্?
-মানে চারবার গোল্ডেন আর পাব্লিকের এতোভালো সাব্জেক্টের ফার্স্টক্লাস পাওয়া স্টুডেন্ট,এই এডুকেশনাল কোয়ালিফিকেশনস্ দিয়েই ওর ভালো বেতনের একটা জব হয়েছে।তাই পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে।
-কিন্তু….

-আমি বলেছিলাম।ওর এক কথা।আর পড়াশোনা করে কি হবে?চাকরিটা কোনোমতেই ছাড়বে না ও!
-আচ্ছা।কিন্তু তুই এভাবে কথা‌ বলছিস কেনো?
-ভালো লাগছে না আমার কিছু।শরীরটা ভালো নেই বেশ কয়েকদিন হলো।
-তো ডক্টর দ্…
আস্থার ফোন বেজে উঠলো।নাম্বারটা দেখেই ওর এক্সপ্রেশন পুরোই পাল্টে গেছে।বুঝলাম কার ফোন।ও কল রিসিভ করে দাত কেলিয়ে বললো,
-হ্যালো জানু?তুমি ফোন করেছো রোহান বেব?ওওলে!তা কেমন আছে আমাল বাবুতা?
ঠোট আটকে জোরে বেরোতে চাওয়া হাসিটা আটকে রেখেছি আমি আর তানহা।নিশ্চিত ও পাশে রোহান ভাইয়ার কান দিয়ে ধোয়া বেরোচ্ছে।ও বেচারার আম্মু তাকে বলে দিয়েছে আস্থার কল রিসিভ করতে।তিনমাসে আস্থাই জ্বালিয়েছে তাকে।আজ হঠাৎ সে ফোন করলো কেনো,এটাই বিস্ময়।ওনার কথা শুনে আস্থা বাকা হাসলো।পরে বিস্ময়ের মুখ করে বললো,

-কি বলো কি তুমি কলিজা?তোমার আম্মু আসতেছে আমার বাসায়?নাকফুল দেবে?নাকি আংটি?এই শুনো,আমি কিন্তু নাকফুল টাকফুল পরতে পারবো না।ও সোনা!বলোনা,তোমার আম্মুকে।আমাকে য্…
কান থেকে নামিয়ে নিলো ফোনটা।কেটে দিয়েছে হয়তো।ও চেচিয়ে বললো,
-বইনেরাআআআ!আজ আমার এনগেইজমেন্ট!রোহানের আম্মু আসতেছে আমার বাসায়।চল তোদের ট্রিট দিবো!
-বাসায় আসলেই এনগেইজমেন্ট?
-একবার বিয়ে করে তার তুই কি বুঝোস?আন্নু বোঝে।ওর তো দু দুবার বিয়ে হয়েছে!ঠিক কিনা বল আন্নু?
তানহাকে থামিয়ে দিয়ে আমাকে বলার সুযোগ না দিয়ে দুজনের হাত ধরে টানতে টানতে হাটা লাগালো আস্থা।কিছুটা এগোতেই আচমকাই জ্ঞান হারিয়ে মাঠের মাঝে লুটিয়ে পরলো তানহা।ঘটনার আকস্মিকতায় থম মেরে গেছি দুজনেই।আস্থা চেচিয়ে বলে উঠলো,

-কিরে?”আমি জ্ঞান হারাবো,মরেই যাবো”খুশিতে গানটা তো আমার গাওয়ার কথা!তুই কোন শোকে জ্ঞান হারালি?
অগ্নিদৃষ্টি ছুড়তেই আই ওয়াজ জোকিং বলে বিরবির করতে করতে আমার সাথে তানহাকে ধরলো।ওকে নিয়ে‌ সোজা কাছের হসপিটালেই চলে গেলাম আমরা।যেহেতু বলছিলো কিছুদিন হলোই শরীর ভালো নেই ওর।হসপিটালে ডক্টর চেক করে জানালেন ও প্রেগনেন্ট।কতোটা খুশি হয়েছিলাম কথাটা শুনে,তা বর্ননাতীত।তৎক্ষনাৎ তিহানকে ফোন করে জানিয়ে দিলো আস্থা।বেডের পাশে বসে তানহার সাথে কথা বলছিলাম।তিহান এসে সোজা জরিয়ে ধরলো ওকে।কাদছিলো।তিহানের কান্না!আজ প্রথমবারের মতো কাদতে দেখলাম ওকে।কাদতে কাদতেই তানহাকে ছেড়ে অজস্র চুমো দিলো ওর চোখেমুখে।দুগাল ধরে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,

-তুই জানিস না তুই কি দিয়েছিস আমাকে!তুই জানিস না তান্নু,আজ আমি কতোটা খুশি!আই লাভ ইউ!আই…আই লাভ ইউ ইয়ার!থ্যাংকস্!আমার এতোটা…এতোটা সুখের কারন হওয়ার জন্য।থ্যাংকস্!
তানহা কেদে দিয়ে ওর বুকে মাথা রাখলো।সুন্দর সে মুহুর্তের সাক্ষী হতে পেরে অসম্ভব সুখী মনে হচ্ছিলো আমারই।প্রথমবার তিহানকে ভালোবাসি বলতে শুনলাম।কে জানে,মুখ ফুটে এর আগে বলেছিলো কি না!বাসায় এসে অঙ্কুরকে জানালাম সবটা।উনি আগে তানহা‌ তিহানকে ফোন করে কনগ্রাটস্ জানালেন।ওনার চোখেমুখেও খুশির ঝলক।যা তাকিয়ে দেখার মাঝে অনেক তৃপ্তি।কল কেটে আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু ভ্রুকুচকে তাকালেন উনি।তারপর পেছন থেকে‌ জরিয়ে ধরে বললেন,

-ওভাবে কি দেখছো পর্বতশৃঙ্গ?
-তানহার বেবি হবে শুনে আপনি অনেক খুশি তাইনা?
উনি আমার কানে ঠোট ছুইয়ে‌ বললেন,
-হুম।তুমি জানো অদ্রি,এমন একটা মুহুর্ত যখন আমাদের লাইফেও আসবে,আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ হবো।কারন সেদিন কোনো অপুর্নতা থাকবে না আর আমার।হ্যাঁ,সে সবটার ক্রেডিট তোমার।একজনের জীবনে ছেলে,স্বামী,বাবা এই সম্পর্কগুলোই তো পুর্নতা এনে দেয়।তোমার জন্য,মাকে ফিরে পেয়েছিলাম আমি।ছেলে হয়ে উঠেছিলাম।তোমাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়ে,আমি স্বামী।আর যখন তোমার মাঝেই আসবে আমার সত্ত্বা,বাবা হবো আমি অদ্রি।তাই তুমিই আমার পুর্নতার কারন।হ্যাঁ,এজন্যই,আমার সবটাই তোমাতে।আমার *সবটাই তুমিময়*

ভালোবাসি অদ্রি!খুব ভালোবাসি তোমাকে!এভাবেই আজীবন‌ ভালোবাসতে চাই তোমাকে।সব পরিস্থিতিতে কাছে চাই তোমাকে।আর কিছু নাই হোক,কিন্তু বেচে থাকতে,আমার তোমাকে লাগবে।তোমাকেই!
চোখ বন্ধ করে রেখে হারিয়ে যেতে লাগলাম তার কথাগুলোয়।তার এ ভালোবাসাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া।হ্যাঁ,এভাবে আজীবন জরিয়ে থাকতে চাই আপনার ভালোবাসায় অঙ্কুর।আজীবন!

সময়ের স্রোতে আরো আটমাস পেরিয়ে গেলো।এরমধ্যে অঙ্কুরকে দু দুটো প্রিমিয়ার লিগ নিয়ে দেশের বাইরে থাকতে হয়েছে অনেকদিন।আমিও মাইগ্রেশনের ঝামেলায় ছিলাম।বিয়ের কয়েকমাস পরই অঙ্কুর সাব্জেক্ট চেন্জ করিয়ে জার্নালিজম নিয়ে পড়তে বলেছেন আমাকে।মনিমাও দ্বিমত রাখেনি।আমিও তাই খুশিমনে প্রচন্ড ব্যস্ত হয়ে পরেছিলাম পড়াশোনা নিয়ে।সময়ের হিসাব কষাটা হয়নি।আগের রাতে বাসায় দেরিতে ফিরেছেন অঙ্কুর।সকালে ফ্রেশ হয়ে মাথা মুছতে মুছতে প্রতিদিনের মতো তার ঘুমন্ত চেহরার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।মনে মনে প্রস্তুত করছি নিজেকে,এই বুঝি উঠে বসে প্রতিদিনের মতো তাকে চোখ দিয়ে খেয়ে নিচ্ছি বলে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।ফোনটা বেজে উঠলো।তিহানের নাম্বার।এতো সকালে ওর কল দেখে ভরকে গেলাম কিছুটা।তানহার বেবি হওয়ার সময় হয়েছে।ব্যস্তভাবে কল রিসিভ করে বললাম,

-হ্যাঁ বল তিহান!এতো সকালে?কি হয়েছে?তানহা কেমন আছে?সবাই ঠিক আছিস তো তোরা?
-তানহা ভালো আছে আন্নু।আর আমাদের বেবিও।
খুশিতে চকচক করে উঠলো আমার চোখ।ও বললো,
-ছেলে হয়েছে।কাল রাত দুটোয়।অতো রাত বলে জানাইনি।এএসএ কে নিয়ে চলে আসিস।ইউনাইটেড হসপিটাল।
ফোন রেখে লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম।চেচানো শুনে ধরফরিয়ে উঠে বসলেন অঙ্কুর।ওনার হাত ঝাকিয়ে বললাম,
-তান্নুর ছেলে হয়েছে অঙ্কুর!তান্নুর ছেলে বেবি হয়েছে!
একটু থেমে উনি হেসে দিলেন।আমাকে উল্টোদিকে ফিরিয়ে পেছন থেকে জরিয়ে ধরে বললেন,
-ওয়াও,কনগ্রাটস্ টু হার!

আড়চোখে ভ্রুকুচকে তাকালাম।শুধু এটুকোই?উনি বড়সর হেসে বললেন,
-ইয়াপ!আমি তোমার মতো অতো এক্সাইটেড নই!বরং জেলাস!কজ বিয়েটা আ‌মার আগে হয়েছিলো।বেবিও আমার আগে হওয়ার কথা ছিলো।এদিক দিয়ে তিহান আমার আগেই…সব দোষ তোমার!পড়াশোনা নিয়ে একটু বেশিই ব্যস্ত হয়ে পরলে,আমাকে ভুলে গেলে!আমাকে সময় দিয়েছো কম!তারজন্যই তো…
সরু চোখে তাকালাম।উনি থেমে গেলেন।নিজের দোষ স্বীকার করবে না!ব্যস্ততা কি তারও কম ছিলো কোনোঅংশে?দেশের বাইরেই থেকেছেন কয়েকমাস!তাছাড়া উনিই বলেছিলেন এসব নিয়ে পরে ভাববেন।খিচে উঠে বললাম,

-তা আপনাকে রোকেয়া সাখাওয়াতের বর হতে কি আমি বলেছিলাম?আমি বলেছিলাম আমার পড়াশোনা নিয়ে মাতামাতি করতে?
অঙ্কুর আরো শক্তভাবে জরিয়ে ধরে বললেন,
-ও।তাতে রাগ হয়েছে তোমার?তা বলো,কার বর হলে খুশি হবে?আইমিন কোন ক্যারেক্টারে ঢোকা উচিত আমার?রোমিও?জ্যাক?নাকি…
বালিশ হাতড়ে মারার জন্য উদ্যত হতেই একলাফে বিছানা ছেড়ে নেমে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলেন উনি।ভেতর থেকেই বলে উঠলেন,

-ওগো বউ!বরকে বালিশপেটা করার চেষ্টা করার জন্য তোমাকে পঞ্চাশটা চুমোদন্ডে দন্ডিত করা হলো।আমি কিন্তু গুনেগুনে এ সাজা উশুল করে নেবো!আর হ্যাঁ,আমার ক্লাবে যেতে হবে।তুমি রেডি হয়ে হসপিটাল চলে যাও।আমি ক্লাব থেকেই যাবো বেবি দেখতে।
মুচকি হেসে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম রুম থেকে।অঙ্কুরের ফোনের ম্যাসেজ টোন।পাশের‌ টেবিলে চোখ রাখতেই দেখলাম‌ ওটাতে হসপিটালের নাম লেখা।ওপেন না করেই যা বুঝলাম,ম্যাসেজে আমার রিপোর্ট কালেক্ট করতে যেতে বলা হয়েছে।দুদিন আগে কিচেনে আগুন দেখে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলাম।আর তা দেখে অঙ্কুর জোর করেই হসপিটাল নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে।টেস্ট করানো হয়েছে কিছু।ওগুলোরই রিপোর্ট।যাতে কিছুই পাওয়া যাবে না জানি আমি।কারন আমি পুরোপুরি সুস্থ্য আছি।ওটা নিতান্তই অঙ্কুরের আদিক্ষেতা ছাড়া কিছু নয়!তবুও কিছু না বলে বেরিয়ে আসলাম রুম থেকে।

সোজা তানহার কাছে পৌছালাম।বেডে শুয়ে আছে ও।পাশেই তিহান ওর হাত মুঠো করে নিয়ে বসে।ওর মাম্মী,পাপা দুজনেই বাচ্চা কোলে নিয়ে আদর করছে।এগিয়ে জরিয়ে ধরলাম তানহাকে।ওদের দুটোকে কনগ্রাটস্ জানিয়ে বেবিকে কোলে নিলাম।একদম তানহার মতোই দেখতে হয়েছে।তানহাকে বললাম,
-কিরে?কি নাম রেখেছিস বেবির?
ত্বোহা মাথায় হাত দিয়ে বললো,
-এইরে!নাম তো রাখা হয়নি।তুমিই বলে দাও আহানিতাপু।কি নামে ডাকবো ওকে?
একটু ভেবে হেসে বললাম,
-তানহা তিহানের ছেলে!তাহিয়ান আবনান!

নাম শুনে সবাই বেশ খুশি।এরমধ্যে আস্থা,রোহান ভাইয়াও আসলেন।অঙ্কুর এসে দেখেন বেবি ঘুমিয়ে গেছে।তবুও কোলে তুলে নিলেন ওকে।ছোটছোট গালগুলোয় আঙুল ছুইয়ে দিলেন।চুমোও দিলেন অনেকগুলো।মুগ্ধ চোখে দেখছিলাম শুধু ওনাকে।বাচ্চাটার সাথে পুরো অনুভুতি,নিজের সবটা দিয়ে মিশে যাচ্ছেন যেনো।বেবির হাতে আঙুল রাখতেই,ও মুঠো করে নিলো ওনার আঙুল।অঙ্কুর হেসে দিয়ে বললেন,
-হোয়াট আ ক্যাচ চ্যাম্প!ঘু‌‌মের ‌মধ্যেও,নট ব্যাড!
আরেকদফা আনন্দের কল্লোল কেবিনে।অঙ্কুর বেবিকে তানহার কোলে দিয়ে বললো,

-ওকে দেখো,এন্ড টেক কেয়ার।আমি আসছি।কিছু কাজ পরে গেছে।অদ্রি?তুমি বাসায় চলে যেও কেমন?
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম।উনি বেরিয়ে গেলেন।অনেকক্ষন ছিলাম তাহিয়ানের সাথে।তারপর বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে এলাম।কিন্তু মাঝরাস্তায় আমার রিপোর্টটার কথা মনে পরে গেলো।ভাবলাম একেবারে নিয়েই না হয় বাসায় ফিরি।যদি অঙ্কুর অন্যকাজে ব্যস্ত থেকে থাকেন,ওনাকে বাসায় ফিরে না হয় জানিয়ে দেবো,রিপোর্টটা নিয়ে এসেছি।যেমন ভাবা,তেমন কাজ।হসপিটালে পৌছে গেলাম।কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি পার্কিং এরিয়ায় অঙ্কুরের গাড়ি পার্ক করা।তারমানে উনি এসেছেন।

এই মানুষটা!সবদিকে খেয়াল এর।রিসেপশনিস্টকে জিজ্ঞাসা করতেই বললো উনি নাকি ডক্টর সারমিন নিপার কেবিনে।আমি যতোদুর জানি,ডক্টর নিপা অঙ্কুরের এক পরিচিত আন্টি।উনি একজন গাইনিকোলোজিস্ট।এসময় ওনার কেবিনে অঙ্কুরের যাওয়াটা একটু আজব লাগলো আমার।তবে আত্মীয়,দেখা করতেই পারে ভেবে এগোলাম।দরজার কাছাকাছি পৌছাতেই কানে আসলো,
-হরমোনাল আনএবিলিটিসহ এই হেল্থ ইস্যু নিয়ে….আহানিতা কান্ট কনসিভ অঙ্কুর!রাইট নাও,যেটা তুমি‌ বলছো,তা ইম্পসিবল!
দরজাতেই থেমে গেলাম আমি।কেমন যেনো পুরো পৃথিবী থমকে গেলো আমার।ভেতর থেকে নিপা আন্টি আবারো বলতে লাগলেন,

সবটাই তুমিময় পর্ব ৩৮

-দেখো অঙ্কুর,তুমি তো জানতেই,আহানিতার কিছু ফিজিক্যাল প্রবলেমস্ আছে।এই ইস্যুগুলোর জন্যই আগের ডক্টর তোমাকে ওর সেরোগেশন আটকে দিতে বলেছিলো।তুমি করেছিলেও তাই।নাও বি স্ট্র।এখন তুমি নিজেকে সামলাতে না পারলে,আহানিতাকে কি করে সামলাবে?আর এতে তোমার,আমার কারো কোনো হাত নেই অঙ্কুর।এখন আমাদের যা করনীয়,তাই করতে হবে।সেটাও অত্যন্ত স্ট্রং থেকে।আহানিতার মা হওয়াটা….

আর কিছুই শুনতে পাইনি।প্রথম থেকে প্রতিটা শব্দ শুনে টপটপ করে পানি পরছিলো চোখ দিয়ে।”আহানিতা কান্ট কনসিভ!”-কথাটা বারবার প্রতিধ্বনি হয়ে কানে বাজতে লাগলো যেনো।রোবটের মতো অনুভুতিশুন্য হয়ে উল্টোদিক পা বাড়ালাম।মাথা পুরোই ফাকাফাকা লাগছে।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে।দিশেহারার মতো আশেপাশে তাকালাম।জোরে কান্না করতে চাইছিলাম,গলা ধরে আসছে।পারছি না চিৎকার করে কাদতে।শুধু মনে হচ্ছে,মরে গেছি।আদৌও কি বেচে আছি আমি?নিজের কথা না হয় বাদই দিলাম।যে মানুষটার আমাকে ঘিরে সবটা,যে বারবার আমাকে স্বীকারোক্তি দিয়েছে,আমার সবটাই তুমিময়,তার জীবনের এতোবড় অপুর্নতার কারন আমি‌ নিজেই।কি করে মানবো এটা?মা হতে পারবো না আমি।আর আমার জন্য পিতৃত্ত্বের সুখলাভ‌ থেকে বঞ্চিত হবেন অঙ্কুর।ভাবতেই বুকফেটে কান্না আসছে আমার!এর থেকে হয়তো মৃত্যুযন্ত্রনাও শান্তির ছিলো।অন্তত কষ্টটা শুধু আমাতে সীমাবদ্ধ থাকতো।অঙ্কুরের নয়!

সবটাই তুমিময় শেষ পর্ব