সুখতারার খোজে পর্ব ২

সুখতারার খোজে পর্ব ২
লেখক:আর আহমেদ

ভালোবসার মানুষটার রিপশনেও যেতে হবে তা কল্পনায়েও ভাবতে পারেনি তারা। আবার ঘটা করে নিমন্ত্রণ করা হচ্ছে। পাথারচাপা বুক ক্রমশ ভারি হয়ে আসছে। ফোনের ওপারে কবিতা উত্তরের অপেক্ষায়। তারার গলায় দলা পাকাচ্ছে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে খুব! কিন্তু কার জন্য? একজন প্রতারক? তার জন্য?
-তারা তুই কথা বলছিস না কেন? কি রে?তুই লাইনে আছিস?
তারার ধ্যান ভাঙে। সে একটা শুকনো ডোক গিলে নিজেকে সামলানোর ব্যার্থ চেষ্টা করে। অত সহজ কাউকে ভোলা? পারে কেউ? পারে হয়তো, কিন্তু তারা পারছে না। বাধ ভাঙা নদীর মতন চিৎকার ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। বুকের কোথাও কাটা বিধছে, মাত্রাতিবিষাক্ত সে কাটা!

তারা ফোনটা ঠিক করে নেয়। তার হাত কাঁপছে। যেখানে কবিতা নিজেই ফোন করে বলছে সেখানে কি করে না করতে পারে তারা? তারা এক বিন্দু অস্ত্রু ফেলে উত্তর দেয়,
-আরে..যাবো না কেন? নি..ষ্চই যাবো। নিষ্চই। কাল দেখা হবে কেমন?
ফোনটা কাটার আগেই ওপাড় থেকে কবিতা বলে ওঠে,
-বন্ধুবী দাড়া! তোর দুলাভাই কথা বলবে।
তারা স্তব্ধ! না করবে? এটাতো খারাপ দেখায়। ওপাড়ে কবিতা অভ্রকে ফোন দেয়। অভ্র ফোন হাতে নিয়েই বলে,
-শালির তাড়াহুড়ো খুব দেখছি। একটি মাত্র শালি আমার। তোমায় চটজলদি আসতে হবে কিন্তু। আর হ্যা, আমাদের গিফটটা নিয়ে আসিও কেমন?
ঠেস দিয়ে কথাটা বলে উঠলো অভ্র! বরংবার শালি বলে কি সে বোঝাতে চায় অভ্র? সে সুখি? নাকি কষ্ট দিতে চায়?,ভাবে তারা। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে খুব। ওপারে অভ্র ব্যাস্ততার সহিত বলে,
-কি হলো? কথা বলেনা কেন? এ তোমার কেমন বন্ধু কবিতা?
তারা নিজেকে সামলে বলে,
-নিশ্চই যাবো। তাহলে বিকেলে দেখা হচ্ছে।
-আরে বিকেলে মানে? এত এত কাজ! তুমি তাড়াতাড়ি আসো। শালিকা হিসেবে একটু খাটবে না? কাল দুপুরের দিকেই চলে এসো কেমন?
-জ্বি

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বলেই ফোন কেটে দেয় তারা।বুক ফেটে আসছে। কেন তাকে একলা করে গেলো তার বাবা? কেন এত বড় বড় কঠিন পরিক্ষা দিতে হচ্ছে তাকে? অন্য সবার মত তার জিবনটা হতে পারতো না? খুব খারাপ হতো? তারার মনে অভিযোগ জাগে। নিম্ন মধ্যবিত্য পরিবারের তারা। গত বছর করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান আমিন আহমেদ। তার ছোট্ট সাক-সবজির দোকান ছিলো। তা দিয়েই সংসার চলতো। কিন্তু উনার মৃত্যুর পর লতিফা ব্যারামে আক্রান্ত হন! কঠোর রোগের বাসা বাঁধান শরীরে। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি খাওয়া নাওয়া ছেড়েই দিয়েছেন। ফলে রোগ অতি তারাতাড়ি জায়গা করে নেয় শরীরে লতিফার। সয্যাসাহী হয়ে পড়েন লতিফা। নবমে পড়ুয়া তারা তখন কেবল পৃথিবী জানতে লেগেছে! কিন্তু যখন তার পড়াশোনা, হাসি মজার দিন ছিলো তখনি তাকে ধরতে হয় সংসারের হাল। তারার একটিমাত্র চাচা যে কিনা আমিনের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তারাদের খোজ খবর প্রায় দিনেই নিতো সে তখন মুখ ফিরিয়ে নেয়। পথ একটিই তখন খোলা ছিলো তারার কাছে। টিউশনি! সেটাই করিয়ে সংসার, নিজের পড়াশোনা চালায়, চালিয়েছে! তবে এখন একটা কোচিং সেন্টারে পড়ায় তারা। একজন প্রাইভেজ টিচার হয়ে। চাকরির জন্য আবেদনও করেছে তারা।
তারা রান্নাঘরে চলে যায়। উনুনে ভাত, সবজি বসিয়ে নিজের বইগুলো নিয়ে বসে। সামনে তার অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের এক্সাম। তার সব ওলট পালট করে দিয়েছে অভ্র নামক মানুষটা! ঠকিয়েছে তাকে।

সকালের সুভ্র আলো ফুটেছে!
পাখিদের কিচিরমিচিরের আওয়াজ ভেসে আসে কানে। তারা চোখ মেলে তাকায়। সূর্যের আলো ফুটতে আর মাত্র কয়েক মুহুর্ত বাকি। তারার মুখ শুকনো। পুরো রাত তাকে কাদিয়েছে অভ্রের কিছু প্রাক্ত মেসেজ, কল! তারা বড্ড মিস করছে অভ্রকে। সে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। ফোনটা একবার হাতে নেয় এই আশায় হয়তো তার একটি মেসেজ পাবে! পরক্ষণেই ভাবে, সে এখন বিবাহিত! এসব কি ভাবছিস তুই তারা? কবিতা, যে কি না তোর বেস্টফ্রেন্ড…
তারার মনে পড়ে কালকে রাতের কথা। রিসিপশনে গেলে তো কিছু না কিছু নিয়ে যেতে হবে! তারা কি নেবে? মাস তো প্রায় শেষের পথে। টাকা বলতে মাত্র দুটো পাচঁশত টাকার নোট! তারা ছুটে উইখাওয়া কাঠের টেবিলের কাছে যায়। টেবিলে পাতানো ওড়না তুলতেই দেখতে পায় দুটো নোট। টাকাগুলো হাতে নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে চোখের নোনাজল আড়াল করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে তারা। এখনো তার মায়ের ঔষধ কেনা বাকি! কোন কিছু আর ভাবতে পারেনা তারা। টাকাগুলো নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে।

মিষ্টি কালারের সালোয়ার কামিজ পড়েছে তারা।চোখে দিয়েছে একটু কাজল! তার লম্বা কালো কেশগুলো একপানে রেখে গাঁথুনি বিনি দিয়েছে। অদ্ভুত ব্যাপার এতটুকুতেই অপ্সরি লাগছে তারাকে। তার রেশমি কালো চুল তার প্রখড়ভাবে দ্বিগুণ করে তুলেছে। টেবিল থেকে গিফট বক্সটা হাতে নিয়ে তার মায়ের কাছে চলে যায়। বুড়ি মা দিনদিন বেশি অসুস্থ হচ্ছে। উল্টোদিক ফিরে শুয়ে আছেন লতিফা। তারা ডাক দেয়,
-মা..
লতিফা ওভাবেই উত্তর দিলেন,
-বল তারা।
-আমি একটু বেরোচ্ছি। আজ কোচিং বিকেলবেলা। তোমার পাশে সবই দেয়া আছে। কিছু লাগলে পাশ থেকে নিও।
-আচ্ছা।
তারা একপাএগিয়েই আবারো পেছন ফিরে বলে,
-তোমার পাশে দুধ রাখা আছে। খেয়ে নিও।
কথাটা কর্নকুহরে যেতেই ঘুরে শোন লতিফা। জিজ্ঞেস করেন,
-দুধ? কই পেলি?
-তোমার শরীরের দিনদিন যা অবনতি হচ্ছে..কাল নিয়েছি এক পোয়া তুলি বুবুর থেকে নিয়েছি। খেয়ে নিও।
তারা বেড়িয়ে যায়। লতিফার কোথাও গর্ব হচ্ছে।
হাইওয়েতে উঠে রিকশা করে রওনা হয় তারা। রিকসা অভ্র মঞ্জিলের সামনে থামে। ভারা মিটিয়ে ভেতরে যেতেই কিংকর্তব্যবিমুঢ। গাধা ফুল, রজনীগন্ধার মালা গেথে সাজানো হয়েছে পুরো বাড়ি, চিকচিকে আলোয় চকচক করছে সন্ধ্যার পুরো গার্ডেন। মানুষও কম নয়। শ’খানেক মানুষ এরিমধ্য উপস্থিত। তারা গার্ডেন পেড়িয়ে ভিতরে যায়। কবিতার সাথে দেখা করার জন্য। বাড়িতে পা রাখতেই তার উদ্ভট এক শিহরণ হয়। এটা হয়তো হতে পারতো তার শশুরবাড়ি! দরজা পেরোতেই ড্রইংরুমে চোখে পরে পলক ইরাকে। উনি অভ্রের মা। তারাকে দেখেই উনি চলে আসলেন। বললেন,

সুখতারার খোজে পর্ব ১

-এত দেড়ি কেন করলে?
-দেড়ি হয়ে গেল। কবিতা কই আন্টি?
-উপরে। রুমেই আছে। যাও, দেখ হয়তো তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছে।
তারা মুচকি হেঁসে পাশ কেটে উপরের দিকে হাটা দেয়। বিশাল এক বাড়ি অভ্র মঞ্জিল। রুমের অভাব নেই। তারা হেটে চলে। অভ্রের রুম অচেনা তারার কাছে। তবুও হেঁটে চলে তারা। একটি রুম থেকে কবিতার আর একটি মহিলার হাসাহাসির আওয়াজ আসছে। তারা সেদিক পানে এগোয়। কিন্তু রুমে ডোকার আগেই কেউ হেঁচকা টান দিয়ে দেয়ালে মিশিয়ে নেয়। আচমকা এমন হওয়ায় হকচকিয়ে ওঠে তারা। জান যেন উড়ে যাচ্ছিলো। চোখ খিচে বন্ধ করে জোড়ে জোড়ে শ্বাস ফেলে তারা। সামনের লোকটা হাতদ্বয় দেয়ালে খিচে ধরে। তারা তৎক্ষনাৎ চোখ খুলে। কালো পাঞ্জাবি পড়নে অভ্র বাকা হাসছে। তারার মেজাজ গরম হয়ে যায় অভ্রকে দেখে। চেয়াল খিচে বলে,
-এসব কিরকম অসভ্যতা আপনার?
অভ্র মুখ তারার কানের কাছে এনে বলে,

-অসভ্যতা? তুমিতো এমনই কিছু চাও তাইনা?
তারার ঘৃনা দৃষ্টিতে তাকায় অভ্রের দিকে। একজন মানুষ আর কতটা নিচ হতে পারে? তারার নিজেকে ধিক্কার দেয়,’তার লজ্জা হয় এরকম কুৎসিত মনের একজনকে সে ভালোবেসেছে। তারা বলে ওঠে,
-আমার লাগছে ছাড়ুন। আমি কিন্তু চিৎকার করবো।
-তো করো না! ভাঙুক তোমার বেস্টফ্রেন্ডের সংসার। করো চিৎকার। আমায় আর তোমায় এভাবে দেখলে তো যে কেউই মেনে নেবে যে আমাদের মাঝে কিছু আছে। নাও স্টার্ট প্লিজ।
তারা মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকায়। অভ্রের মুখটা তার কাছে এখন বিষ মনে হচ্ছে। অভ্র চেয়াল খিচে শক্তহাতে তারার হাত গাল টিপে ধরে। তারা কেঁদে ফেলে। অনুনয়ের ন্যায় বলে,
-ছাড়ুন আমায়। যেতে দিন। বিশ্বাস করুন, আমি আর কোনদিন আসবো না।
চেয়াল শক্ত করে তারাকে বলে অভ্র,
-এতটুকুতেই? যা করতে পারবি না তা বলিস কেন হু?
‘হুহ্’ শব্দটি ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো অভ্র।
-অভ্র!
তৃতীয় কারো স্বর পেতেই তারাকে ছেড়ে দেয় অভ্র। কবিতাকে দেখেই থমকে যায় তারা, অভ্র। তারার ভূমন্ডলে দ্বিতীয়বারের মতন ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়।

সুখতারার খোজে পর্ব ৩