সুখতারার খোজে গল্পের লিংক || লেখক:আর আহমেদ

সুখতারার খোজে পর্ব ১
লেখক:আর আহমেদ

বেস্টফ্রেন্ডের বিয়েতে বরবেশে নিজের হবু স্বামীকে দেখে ভূমন্ডলে ভূমিকম্প অনুভব করলো তারা। তার জিবন যেন থমকে গেলো কিছু সময়ের জন্য। লাল কালোর পাইর দেওয়া শেরোয়ানিতে কবিতার পাশে বসে বেশ হাসি নিয়ে তাকিয়ে অভ্র। তারার শুষ্ক ত্বকে পানির ছোঁয়া। নোনাজলে গড়িয়ে পড়ে মূহুর্তে। বুকে ধুপধাপ শব্দ কর্নকুহরে হানা দেয়।দু পা পিছিয়ে বিস্ফোরিত ছোখে তাকায় তারা। যে ছেলেটা কাল রাতেই কত শত কথা বললো, বিয়ের সম্পর্কে নানান ব্যাবস্হার কথা বললো, আর আজ? তারার চোখের সামনে ভাসছে নিজের মায়ের প্রতিচ্ছবি। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি বুড়ি অসুস্থ মা ছাড়া কেউ নেই তারার। লতিফার মেয়ের বিয়ে হবে শুনে সে কতই না খুশি! আনন্দ দেখার মতন নয়। সে মেনেনিতে পারবে তো?

শ খানেক মানুষের মাঝ থেকে একপা একপা করে পিছিয়ে যায় তারা।চোখ বাধ ভেঙেছে। কিছুটা পেছোতেই সোফার এক কোনা খিচে শক্ত হয়ে দাড়ায় তারা। বুক ফেটে কান্না আসছে তারার। দাড়ানো অবস্থাতেই তার কানে আসলো কাজি সাহেবের কন্ঠ,
-মা, এবার তিনবার কবুল বলুন।
এত মানুষের মাঝে কবিতার ‘কবুল’ বলা স্বর কানে আসলো না তারার। তারার তো কলিজা পুড়ছে। তার মাকে কি বলবে ও?
-আরে তুমি এখানে কি করছো? বান্ধবীর বিয়েতে কেউ এরকম দূরে থাকে?
কবিতার মায়ের কন্ঠস্বর! তারা চট করে চোখের পানি মুছে নেয়। ওনার ূিকে তাকিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে তারা,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-আন্টি আসলে আমারএকটু বাড়ি যেতে হবে।
-আরে তুমি কি বলো? ওসব হবে না আসোতো..
একপ্রকার টেনে নিয়ে স্টেজের সামনে আনা হলো তারাকে। তারাকে দেখে অভ্রের কোন প্রতিক্রিয়া নেই। বরং সে খুশি! যেন পৃথিবীটা তার হাতে। অজানা কারনেই তারাকে কষ্ট দিতে প্রচুর ভালো লাগে অভ্রের। অভ্র গলা খাকড়ি দিয়ে তারাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-আরে শালি যে, আসেন! কই ছিলেন এতক্ষণ?

তারা অস্রুসিক্ত নয়নে তাকায়। ধনি পরিবারের ছেলে অভ্র। তারার সাথে অভ্রের আলাপ করায় তারার চাচা।তাদের তারাকে পছন্দ হয়। সব দিনক্ষন ও ঠিক করে।প্রতিদিন কথা হতো তারা আর অভ্রের মাঝে। অভ্র তাহলে মিথ্যে আশা দিতো? কেন এমন করলো অভ্র? কেন তাকে তার মায়ায় ফেললো? এটাকি উচিত ছিলো? তারার চোখে পানি জমে। সে ভালোবেসে ফেলেছে অভ্রকে। এতদিন যে ছেলেটা তার সাথে কথা বললো, তাকে কত সপ্ন দেখালো, নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে অন্যের পাশে দেখলে ঠিক কেমন লাগে তা সে হারে হারে টের পাচ্ছে। তারার কান্না সর্বপ্রথম কবিতার চোখে পড়ে। কবিতা উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করে তারাকে,

-কি রে? তুই কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে তোর?
তারা চোখ মুছে কবিতার পানে চোখ রাখে। ঠোঁট টেনে হেসে বলে,
-তোর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে শুনে কষ্ট হচ্ছে খুব। আমি আসি হ্যা? পড়ে কথা হবে ঠিক আছে?
তারা কোন দিকে না তাকিয়ে চলে যায় তৎক্ষনাৎ। পেছন থেকে কবিতা ডাক দেয় কয়েকবার। তারা শোনে না। চলে যায় সেখান থেকে।

বাড়িতে এসেই বিছানায় মুখ গুজে ডুকড়ে ওঠে তারা। বুকে এক বিশাল পাথর জমেছে। কবিতার বলা সারপ্রাইজটা এত বিরাট, বিকট হবে তা কল্পনাতেও আসেনি তারার।
পাশের রুম থেকে খক খক কাশির শব্দ কানে আসতেই চোখ মুছে বিছানা থেকে ওঠে তারা। চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে পাশের ঘরে যায় তারা। তারার মৃত্যুর পর থেকে তারার মা অসুস্থ। তারার এক চাচা আছে। এমনিতে কথা না বললেও, সাংসারিক ভাবে কোন অর্থ না দিলেও, তারার বিয়েতে তার প্রবল আগ্রহ। অজানা করনেই সে যেন খুব উদগ্রীব হয়ে থাকে এ ব্যাপারে। অভ্রের ব্যাপারটাও তিনিই বলেছেন।

তারা তার অসুস্থ মায়ের সামনে বসে। গর্তে তলিয়ে যাওয়া কুটি কুটি দুটি চোখ নিয়ে তাকান লতিফা। মা হয়ে মেয়ের মন বুজতে সময় লাগেনা লতিফার। তিনি আলতো হাতে মাথায় হাত রাখেন তারার। তারা চকিতে দৃষ্টি নিয়ে রয়েছে।
-কি হয়েছে মা?
তারা নিশ্চুপ! লতিফা ফের জিজ্ঞেস করেন,
-কি হয়েছে বলবি তো।
তারা বিষন্ন মুখটা উবু করতেই লতিফা বলে ওঠেন,
-বিয়েতে গিয়ে ফিরে আসলি যে?
-বিয়েটা হবেনা!
নির্লিপ্ত উত্তর তারার। তার বুকে চলছে করাতের ছোবল। ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে সব। লতিফা উৎগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-ভেঙে গেছে?
-হুম। কবিতার নয়, আমারটা!
লতিফা পাশ ফিরে শুয়ে পড়েন। অহরহ এমন ঘটছে! কিন্তু চোখে তার পানি জমেছিলো।
তারাউঠে নিজ ঘরে চলে যায়।

-তোমার বেস্টফ্রেন্ডকে একবার কল করলে না? সে পৌছায়ছে কি না শুনবে না একবার?
বাসররাতে স্বামী অভ্রের এমন কথা চমকে তোলে কবিতাকে। কবিতা অদ্ভুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অভ্রের দিকে। অভ্র ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার মতন তাকায়। আমতা আমতা করে বলে,
-না মানে একা একলা মেয়েকে পাঠিয়ে দিলে, একবার কল করা উচিত তোমার।
কবিতা প্রথম ধাক্কা খেয়ে উঠতে না উঠতেই আরেকটা! বাসররাতে কেউ এসব বলে? কবিতা সৌজন্য দেখাতে ফোন হাতে নেয়। ফের একবার অভ্রের দিকে তাকায়। অভ্র ফোনের দিকে ইসারা করতেই ফোন করে কবিতা। প্রথমবারেই ফোন রিসিভ করে তারা,

-কি রে? তুই এখন?
কবিতা একবার অভ্রের দিকে আরেকবার ফোনের দিকে তাকায়। সব গুলিয়ে আসছে তার। সে কি বলবে বুঝতেই পারছে না। অভ্র ভ্রু কুঁচকে ইসারা করতেই কবিতা বলে ওঠে,
-কেমন আছিস তুই?
কিছুক্ষণ নিরবতা কাটে। তারপর তারা জিজ্ঞেস করে,
-রাত ১১ টায় বলছিস কেমন আছিস?
অভ্র ফিসফিস করে বলে,
-আরে জিজ্ঞেস কর, সে পৌছায়ছে কিনা! ড্যাম ইট।
কবিতা একটা ঠোক গিলে বলে,
-পৌছায়ছিস তুই তারা?
-হ্যা কিন্তু..
-আচ্ছা রাখ তাহলে।
কবিতা বড় করে শ্বাস নিয়ে অভ্রের পানে ফের তাকায়। অভ্র পাশে শুয়ে পড়ে বলে,
-ঘুমাও এখন।

কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে তারা। সারাটা রাত তার ঘুম হয়নি! একটু ফ্রেসনেসের জন্য খুব সকালে উঠে তারা। মাকে একবার বলে বেড়িয়ে পড়ে তারা। চাচাকেও আর কিছু বলেনি তারা। বলতেও চায়না। সে একাই থাকতে চায়। নিজে আর নিজের মাকে নিয়ে।
পথ পেড়িয়ে হাইওয়ে রাস্তায় তারা। আজ কোন রিকশার দেখা নেই। অনেক্ষন দাড়িয়ে থেকেও একটা রিকসা পেলো না তারা। তার উপর সূর্যের প্রখড় রোধ! তারার রোদ সহ্য হয়না! একটুতেই চোখমুখ জ্বলে যেন।

হঠাৎ সামনে এসে কালো রঙা একটি কার এসে থামে। তারা বুঝে ওঠার আগেই গাড়ি থেকে নেমে আসে অভ্র। অভ্রকে দেখেই তারা সরে যায়। যে মানুষটা তার মুমুর্ষ মাকে কষ্ট দিয়েছে সে কেন আসেছে, আসবে? আর তারাই বা কেন তার সাথে কথা বলবে? ভালোবাসার মানুষটা সবথেকে চরম আঘাত দিয়েছে কালকে। তারার সামনে দাড়ায় অভ্র। তারা লক্ষ করতেই সরে যায়। অভ্র তারাকে টিটকারি দিয়ে বলে,
-পালাচ্ছো যে?

তারা চুপ থাকে। তার বুকে ছাইয়ে ডাকা আগুন আবারো জ্বলে উঠছে। বুকের পাথর ক্রমশ ভারি হয়ে আসছে তারার। ভালোবাসার মানুষটা, যে কিনা বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আজ শুধুই প্রাক্তন! যার ছবি মনে সবসময় আকঁতো তারা সে আজ তার প্রক্তন এটা মানতে যেমন কষ্ট হচ্ছে তার থেকেও বেশি কষ্ট হচ্ছে সেই তার সামনে দাড়িয়ে বাঁকা হাসছে। তারা কিছু বলে না। তার কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। দাড়ানো ভার হয়ে যাচ্ছে। অভ্রকি তারাকে কাঁদাতে এসেছে?
-কেন এসেছেন আপনি?
নিজেকে কঠোর করে বলে উঠলো তারা। অভ্রের বাঁকা হাসির মাত্রা দ্বিগুন হয়! অভ্র পাল্টা প্রশ্ন তুলে বলে,
-কলেজ?
ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করে অভ্র। তবুও চুপ তারা। সে এখন অপেক্ষা করছে একটা রিকশার। যা পেলেই সে স্থান ত্যাগ করবে।
-কথা বলবে না?

-কোন অধিকারে বলুন তো? বিয়ের পর কেন অন্য একটি মেয়ের কাছে এসেছেন আপনি? আপনার স্ত্রী হয়তো আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। প্লিজ যান এখান থেকে। একা থাকতে চাই আমি। কেন এসেছেন?
চিৎকার করে বলে উঠলো তারা। অথচ অভ্র হাসছে। যেন খুব মজার কথা বলেছে তারা।
-জানো তারা? আমাদের কাল রিসিপশন। আর কয়েকদিনের মধ্যেই হয়তো আমরা হানিমুনে যাবো। আমার না ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে যে শুধু আমি আর কবিতা, কবিতা আর আমি একা, একলা সেখানে! উফফ! হাউ রোমান্টিক না?
তারা ফুপিয়ে ওঠে! এমন আকিঁবুকিঁ তারাও করেছিলো ভালারবাসার মানুষটাকে নিয়ে। তার খুব কষ্ট হচ্ছে। গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। ক্রমশ অসর হয়ে আসছে হাত পা। বুক ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে অভ্রের প্রতিটা কথায়। অথচ, অভ্র হাসছে, সে তারাকে কাঁদাতে পেরে যেন বিশ্বজয় করেছে।

সুখতারার খোজে পর্ব ২