সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৩৮
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
নির্জন,হাট খোলা দুপুর। জ্বলন্ত সূর্যটা গাড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছে। ড্রাইভিং-এ নাহিদ একেবারেই আনাড়ি। শিখে রাখা দরকার, তাই শিখেছিল। শেষ কবে হুইল ঘুরিয়েছে মনেও নেই।
তীব্রর ভারি জিপ সামলাতে বেশ কসরতে পড়ে গেছে বেচারা।
একেকটা ঢালে লেগে গাড়ির চাকায় হাওয়ায় ভেসে উঠছে। এতো সাবধানে চাল্লাছে নাহিদ! ভাগ্যিস মফস্বল। শহরের মেইন রোড হলে এতক্ষণে মর্গে থাকতে হোতো।
নাহিদের মুসিবতের ডগায় দাঁড়িয়ে আছে নূহা। পরীক্ষার জন্যে বেঁধে দেয়া সময়টা তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তার।
বারোটা পেরিয়েছে। হয়ত এত সময়ে হল ভর্তি করে বসে গেছে সবাই। পরীক্ষা কী শুরু হলো?
ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারবে তো সে? দেরি করলে ঢুকতে দেবে তো?
অথচ নূহার মাঝে এসব নিয়ে বিশেষ উদ্বেগ নেই। নাহিদের পাশের সিটে
কঠিন হয়ে বসে আছে মেয়েটা৷ বুকের ভেতর কিছু স্বশব্দের ধুকপুকানির রেশ। তারা মিছিল তুলছে,স্লোগান দিচ্ছে। একের পর এক দাবিতে নাভিশ্বাস দশায় ফেলছে কখনও।
এই যে ও নাহিদের প্রেমে পড়ল,এতে যে পুরো পৃথিবীই চট করে বদলে গেল আজ। এরপর থেকে সেও মরবে। পুষ্পিতার মতো জ্বালায়,যন্ত্রণায়,উদাসীনতায়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অবশ্য পুষ্পিতাকে তো তীব্র স্যার ভালোবাসেন। একটা আস্ত দুনিয়া ভেঙে গুড়িয়ে দিতে পারেন ওকে পাওয়ার জন্যে। কিন্তু নাহিদ! ঢেঁড়সটা কী ওকে ভালোবাসে?
নূহা আড়চোখে একবার দেখল তাকে। ছেলেটার হাবভাবে ব্যস্ততা। এক হাত হুইলে আটকে,অন্য হাতের ঘড়ি দেখছে বারবার। দু কাঁধে যে দায়িত্বের একটা বড়ো ভার,নূহাকে পরীক্ষার হলে পৌঁছে দেয়া! সেটা তার অক্ষরে অক্ষরে পালন করা চাই।
পাশে বসা মেয়েটির দিকে কী আদৌ কোনও খেয়াল আছে? যে মেয়ের
আড়াআড়ি দিগন্তের বিস্তৃতিতে এখন থেকে শুধুই একটা সূর্য উঠবে। আর তার নাম হবে ‘’ নাহিদ” এসব কি বুঝবে সে?
বুঝবে কেন? যার দেহ-মন-প্রাণ সব জুড়ে অন্য কেউ।
যার ছবি লোকটা এখনও ওয়ালেটে নিয়ে ঘোরেন। যার প্রসঙ্গ উঠলেই তার কণ্ঠ ভিজে আসে। সেই মানুষকে টপকে ওনার মনে কি আদৌ জায়গা পাবে নূহা?
নূহার উদ্ভট ভাবনার তল হতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ঠিকড়ে এলো বুকে৷ সেদিন পুষ্পিতাকে কত গর্ব করে বলেছিল,আমি কখনও প্রেমেই পড়ব না। অথচ কী হলো! পড়ল তো পড়ল এই মিনমিনে লোকের প্রেমেই?
ইস! এই ব্যথা, এই আফসোস কাকে দেখাবে নূহা? যে দেখবে সে নিশ্চয়ই অট্টহাসিতে ফেটে পড়বে ওর ওপর?
নূহার মন খারাপ বাড়ল৷ হতাশ চিত্তে সিটে মাথা এলিয়ে দিতেই নাহিদ ফিরল এদিকে। কণ্ঠে তার একইরকম উদ্বেগ,
“ আপনার কি এখনও মাথা ঘুরছে?”
নূহা ছোট্টো একটু ঢোক গিলল। দুপাশে মাথা নাড়ল নিশ্চুপ। নাহিদের স্বস্তি হলো না তাও।
মেয়েটা এতো কথা বলে! এতো চটপটে! হঠাৎ এমন চুপসে গেল কেন?
আচ্ছা,ওনার রাগ কি এখনও কমেনি?
কি ঠিক করেছে, সত্যি ওর সাথে কথা বলবে না?
নাহিদ কোমল কণ্ঠে ডাকল,
“ নূহা,মিস নূহা!”
গভীর ভাবনায় বুঁদ মেয়েটা উত্তর দিলো না। নাহিদের সন্দেহ প্রগাঢ় হয়। নূহার ডান হাতটা পাশেই ছিল ওর। ত্রস্ত তার ওপর হাত রাখল নাহিদ।
মেয়েটা চমকে ওঠে কিছু।
সিটে লেপটে থাকা মস্তক তৎপর সটান করে ফেলে।
নাহিদ শিশুর মতোন শুধাল,
“ রাগ কি ভাঙেনি? এখনও আমার ওপর ক্ষেপে আছেন?”
নূহা কী বলবে বুঝতে পারছে না। জ্বিভের ডগায়,কিংবা মনে? জবাব নেই তার। নাহিদের আশেপাশে থেকে মন হারানোর যে অদম্য ক্ষতি হয়ে গেল,সেটার ক্ষতিপূরণ কে দেবে এখন? এজন্যেই আগুন আর বরফ পাশাপাশি রাখতে নেই।
কিন্তু এখানে ওনারই বা কী দোষ? নূহা যেচে এই ক্ষতি ডেকেছে। প্রেমে পড়েছে আগ বাড়িয়ে। নাহিদ তো আর প্রেমে পড়তে বলেনি। তাহলে অহেতুক রাগ দেখিয়ে লাভ কী!
শক্ত মুখটা হঠাৎ নরম হলো নূহার। অল্প হেসে জানাল,
“ না।”
এতক্ষণে স্বস্তি পেলো নাহিদ। নূহার হাসি,তার ছোট্টো একটু উত্তরে বুক ফুলিয়ে লম্বা শ্বাস টানল।
“ যাক বাবা! বাঁচালেন। আপনি যখন বললেন না, আমার সাথে আর কখনও কথা বলবেন না? আমার যে কী খারাপ লাগছিল!”
নূহা আর কিছু বলেনি। কালচে পিচের রাস্তাটায় এক ভাবে চেয়ে রইল। দেখতে দেখতে তার ভার্সিটির চওড়া সাইনবোর্ড নৈকট্যে এলো। নাহিদ ব্রেক কষতেই
জড়ের মতো নেমে গেল নূহা। দু পা গিয়ে পিছু ফিরল আবার। নাহিদ প্রফুল্ল হেসে বলল,
“ অল দ্য বেস্ট!’’
নূহার নিশ্চুপতা,সৌজন্যবোধও কাটাতে পারেনি আজ। চুপচাপ হাঁটা ধরল সে। ক্ষুদ্র শরীরটা আস্তেধীরে ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকে যায়।
নাহিদ এতো-শত ভাবল না। ত্রস্ত চিত্তে গাড়ি ঘোরাল। একটা দায়িত্ব শেষ। এখন অফিসে ছোটার পালা। যদিও
চাকরি নেই কনফার্ম। তাও একবার দেখে আসবে না হয়!
রান্নাঘর ছেড়ে এক রকম ঝড়ের মতো ছুটে এসেছেন সালমা। খোরশেদও গায়ের ব্যথা নিয়ে বসে থাকতে পারেননি।
সব মিলিয়ে বসার ঘরে ছোটো-খাটো পরিবারটার বিস্তর এক মিলন মেলা বইল। মিথিলা শুধু কাঁদছে। চোখের মাঝেই যেন শতাব্দীর বন্যা। গলা, বুক, শাড়ির পাড় ভিজে চপচপে তাতে।
সালমা বেগম হাঁসফাঁস করছেন। মেয়ের কান্নায় আপনা-আপনি জল এসেছে চোখে। খোরশেদের ভেতরটাও একইরকম উত্তাল। উন্মুখ হয়ে মেয়েকে দেখছেন তিনি। দুজনের কেউ-ই কিচ্ছু বুঝতে পারছেন না। প্রশ্ন অনেক,উত্তর নেই। মিথিলা হঠাৎ কোত্থেকে এলো? কোনও রকম খবর না দিয়ে, না বলে! আর চেহারার কী অবস্থা!
ভদ্রলোক কাতর চোখে মেয়েটাকে ভালো করে দেখলেন। পরনে হাফসিল্কের সাদা-মাটা শাড়ি। কোনও মতে হাতখোপা করা চুল। একটা ভারি লাগেজ ছাড়া কিছু নেই সাথে। মুখখানা দ্যাখো! শুকিয়ে এইটুকুন। যেন কত কাল ঠিক করে খায়নি। চোখের নিচেও তো কালি পড়েছে।
হায় আল্লাহ! কী মেয়ে তার বিদেশ গিয়ে কী হয়ে এলো!
মিথিলা তখন মায়ের বুকে। দুহাতে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কাঁদছে। খোরশেদ কিছু জিজ্ঞেস করতে চেয়েও ঠোঁট নামিয়ে নিলেন। রাহাত শোবার ঘর হতে টেবিল ফ্যান টেনেটুনে আনল। বসার ঘরের সিলিং ফ্যানে বাতাস কম৷ মিথিলা এসেই ঘেমে কেমন চটচটে হয়ে গেছে। ফ্যানটাকে সেট করে বোনের দিকে ঘুরিয়ে রাখল সে।
কিছু যখন বলতে যাবে,সালমা বেগম চোখের ইশারায় চুপ বোঝালেন। উদ্যোগী রাহাত তৎপর থেমে গেল।
ভদ্রমহিলা মেয়ের পিঠে বিশ্রান্ত হাত বোলাচ্ছেন। কেঁদেকেটে তার হেচকি তোলার দশা। কোনও বড়ো সড় ঘটনা যে ঘটেছে সালমার বুঝতে বাকী নেই। ভেতরটাও কু ডাকছে কেমন। ইয়া আল্লাহ! আজকেই একটা বিপদ গেল! আবার কী অপেক্ষা করছে কে জানে!
মিথিলাকে হেচকি তুলতে দেখে আবার ভেতরের ঘরে ছুটে গেল রাহাত। এবার ফ্যান নয়,পানি নিয়ে এসেছে। সাথে রেখেছে এক বাক্স টিস্যু। বোনের টুকটাক যত্ন নেয়ার প্রসেস যথাসম্ভব শেষ করে তবেই দম নিলো ছেলেটা।
মিথিলা সময় নিয়ে সামলে উঠল নিজেকে। হেচকিটা যখন বন্ধ হলো একটু? সালমা খুব মোলায়েম কণ্ঠে ডাকলেন,
“ মিথিলা! আম্মু, ঠিক আছো তুমি?”
মেয়েটা মুখ তুলল বুক থেকে। নাক টেনে মাথা নাড়ল আস্তে।
রাহাত ত্রস্ত গ্লাস বাড়িয়ে ধরে,
“ পানি খাও আপু। গলা শুকিয়ে গেছে না!”
এইটুকু মানুষ! অথচ যত্নের বহরে মিথিলার বুকের কষ্টটা আবার দলা পাঁকিয়ে উঠল। এই ভাইটাকে ও কত অবহেলা করেছে এক সময়। কাছে ডেকে কখনও আদর করেছে কী না বলতে পারবে না। চোখদুটো তার আক্ষেপে ভিজে উঠল আবার।
খোরশেদ মুখ খুললেন এতক্ষণে। রয়ে সয়ে শুধালেন,
“ কী হয়েছে মা? তোমার এই অবস্থা কেন?”
মিথিলা চুপ করে মাথা নুইয়ে রইল। সালমা বললেন,
“ পলাশ আসেনি? ওই কি তোকে বাড়ির সামনে দিয়ে গেল? তাহলে ওপরে এলো না কেন!”
মিথিলা আনত থেকেই বলল,
“ আমি একাই এসেছি মা।”
সালমা-খোরশেদ মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। বুঝতে না পেরে বললেন,
“ একা কেন?”
মিথিলা বাবার পানে বিষণ্ণ মুখ তুলল। মনের ভেতর স্রোতের মতো বিষাদ উগলে দেয়ার প্রস্তুতি নিলো কেবল। হঠাৎই আর্ত নয়নে সতর্কতা এলো। খোরশেদের দিকে খেয়াল পড়তেই এক দফা বিস্ময়ে মুখ থুবড়ে পড়ল যেন।
উদ্বীগ্ন হয়ে বলল,
“ এ..একী! বাবা,তোমার কী হয়েছে? ব্যান্ডেজ কেন হাতে? মাথায় লাগল কী করে? আম্মু,কী হয়েছে বাবার?”
সালমা বলতে গেলে,খোরশেদ কথা কেড়ে নিলেন,
“ আরে শান্ত হও মা। তেমন কিছু হয়নি। সিঁড়ি থেকে পা পিছলে পড়ে গেছিলাম। সেজন্যেই হাতে-মাথায় চোট লেগেছে। সেড়ে যাবে।”
“ সিঁড়ি থেকে পড়েছ? কীভাবে পড়লে বাবা? একটু দেখে হাঁটবে তো! ইস,কী অবস্থা! অনেক ব্যথা লেগেছে তাই না? ডাক্তার কী বললেন,কবে ঠিক হবে হাত? মেজর ইঞ্জুরি না তো?”
মিথিলা নিজের কান্না ভুলে গেছে। সব চিন্তা তার বাবাকে নিয়ে। খোরশেদ অবাক না হয়ে পারলেন না। এই তো কিছু মাস আগে,যখন সালমা ওয়াশরুমে পড়ে গিয়ে একটা গোটা দিন হাসপাতালে ছিলেন! মেয়েটা একবার জিজ্ঞেসও করেনি। উলটে দাদির সাথে রান্না করা নিয়ে কত তর্ক করে গেল! আর আজ!
চোখমুখেই বাবার প্রতি তার কত শত বেদনা।
মেয়েটা কি সত্যিই এতো বদলে গেছে?
ক্ষণ নীরবতা ছিন্ন করে জবাব দিলেন ভদ্রলোক,
“ এতো ভেবো না। আমি ঠিক আছি। তুমি তোমার কথা বলো। কী অবস্থা করেছ নিজের? ওখানে খাওয়া দাওয়ায় কি খুব অসুবিধে হচ্ছিল?”
মিথিলার মুখ জুড়ে সেই মেঘটুকু ফেরত এলো আবার।
চুপ থেকে,সময় নিয়ে বলল,
“ আচ্ছা বাবা, আমি যদি আগের মতো তোমার কাছে থাকতে চাই,তোমার টাকায় খাই তাহলে কি তুমি আমাকে বোঝা মনে করবে?”
খোরশেদ কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,
“ এ আবার কেমন কথা মা! তুমি আমার বোঝা কেন হবে?”
কিন্তু ভয়ের পোকা বুকে কামড়ে উঠল সালমার।
চট করে মেয়ের থুতনি নিজের দিকে ফেরালেন। কণ্ঠ সচেতন,
“ পলাশের সাথে কিছু হয়েছে তোর?”
ঠিক জায়গায় ঘা পড়ায় মিথিলা কেঁদে ফেলল। ঠোঁট ভেঙে খুব আস্তে বলল,
“ পলাশ আমাকে তালাক দিয়েছে মা।”
পুষ্পিতার অবস্থা করুণ। সকাল থেকে পেটে দাঁনা না পড়লেও,পুরো এক জগ পানি সাবাড় করে ফেলেছে।
হাত-পায়ে ভূমিকম্প নিয়ে, গ্লাস তুলছে। ঢকঢক করে পানি খাচ্ছে। কখনও চোরা চোখে দেখছে হাত দুয়েক দূরে দাঁড়ানো পুরুষটিকে।
কিন্তু সে পুরুষের মাঝে ভ্রুক্ষেপের খবর নেই৷ তাড়াও নেই কোনও। নেই অধৈর্য হওয়ার সামান্যতম ছাপ।
পুষ্পিতা পুরো জগ খালি করে তবেই থামল। হাত তুলে মুখ মুছে দম ফেলল ঘনঘন। তীব্র তখনও বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে।
মেয়েটা ওদিকে ফিরতেও পারছে না।
স্যার তখন কী বলেছিল,ভাবলেও ঠোঁটের ডগায় জান চলে আসছে।
কী ইঙ্গিত দিলো ওকে? সামনে বাজে অবস্থায় থাকতে হবে মানে কী!
পুষ্পিতার সব এলোমেলো, অগোছালো। তীব্রর কথায়,কাজে আরো চুরমার হয় তা। স্যার যেভাবে কাছে আসেন,কথা বলেন এতে তো পুষ্পিতার অন্যরকম লাগে। মনে হয় স্যার ওকে পছন্দ করেন। তাহলে তনুজা!
স্যার কি ওর প্রেমের প্রস্তাব এ্যাক্সেপ্ট করেননি?
পুষ্পিতার হুট করেই মনে পড়ল তনুজার বলে যাওয়া কথাটা।
এম্মা, তনুজা যে বলেই গেছিল, দুদিন কলেজে আসবে না। বিয়ে খেতে যাবে। আর পুষ্পিতা কী না ওদের প্রেম দেখার ভয়ে কলেজে গেল না? ও এতো বোকা? নূহাই ওকে ঠিক নামে ডাকে। ও আসলেই একটা গাধি!
পুষ্পিতা ঝট করে তীব্রর দিকে ফিরল এবার। অমনি সে ভ্রু তুলল একটা,
“ শেষ?”
শুকনো মুখে মাথা নাড়ল পুষ্পিতা। তীব্র কাছে এগিয়ে আসে। খালি জগটায় একবার চোখ বুলিয়ে বলে,
“ থ্যাংক গড যে একটা জগের ওপর দিয়ে গেলে। আমি তো ভাবলাম ছাদ থেকে ট্যাংকটাও এনে দিতে হবে।”
পুষ্পিতা ঠোঁট ওল্টাল। তার গায়ে ওড়না আছে এখন। কিন্তু একটু আগের কথা ভাবলেই তো কুণ্ঠায় মাটির তলায় ঢুকে যাচ্ছে।
তীব্র স্যার স্যার ভাবটা টেনে আনল চেহারায়। তেমনই গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“ কলেজ যাওনি কেন?”
পুষ্পিতা মিনমিন করল,
“ শশরীর খাখারাপ।”
তীব্র কথা নেই, বার্তা নেই হুট করে কপালে হাত রাখল ওর। তারপর নিয়ে এলো গলায়।
শুধাল চিন্তিত স্বরে,
“ জ্বর তো নেই। কী হয়েছে?”
পুষ্পিতা তাড়াতাড়ি জবাব দিতে পারল না। চোখ দুটো বুজে মাথা নুইয়ে রাখল। স্যার যখন তখন ছোঁবেন,উদ্ভট কথা বলবেন তাতে কিছু না। আর ও এসবের ভার নিতে না পেরে পানি খেলেই দোষ?
তীব্র নিজেই বলল,
“ তোমারও কি মাথা ঘুরছে?”
পুষ্পিতা বুঝতে না পেরে বলল,
“ আমারও, আর কার মাথা ঘুরছে?”
“ বাইরে দেখলাম তোমার বন্ধুরও একই অবস্থা। নাহিদ মাথায় পানি দিয়ে দিচ্ছিল।”
“ সে কী!”
হাওয়ার বেগে ছুটতে নেয়া পুষ্পিতাকে কনুই চেপে আটকাল তীব্র।
“ যেতে হবে না। চলে গেছে ওরা।”
“ এখন কেমন আছে নূহা?”
“ সেসব তুমি নূহার থেকেই জেনে নিও। তোমার কী হয়েছে, আমি সেটা শুনতে এসেছি।”
পুষ্পিতা দুম করে বলে ফেলল,
“ আমার তো কিছু হয়নি।”
“ এই যে বললে শরীর খারাপ!”
মেয়েটা থতমত খায়। সব উত্তর কেমন জট পাঁকিয়ে গেল।
মুখের অবস্থা দেখেই তীব্র বুঝে ফেলল সব।
“ এর মানে মিথ্যে বলেছ! তুমি ইচ্ছে করে কলেজ যাওনি তাই না?
ওকে, মিথ্যে যখন বলেইছো,কারণ আর শুনতে চাইব না। তবে হ্যাঁ, এরপর থেকে আমি যেন তোমাকে ক্লাসে গিয়ে পাই। না পেলে…”
পুষ্পিতা চোখ তুলে চাইল। না পেলে কী, প্রশ্নের আগেই তীব্র জানিয়ে দিলো,
“ আর ভাবব না। সেদিন আমার ঘরে যা হয়নি, সেটাই হবে এবার। তখন তার দ্বায়ভার কিন্তু আমাকে দিতে এসো না।”
তারপর বেরিয়ে গেল তীব্র।
পুষ্পিতা মন খারাপ করে চেয়ারে বসে থাকে। আল্লাহ যে ওর মাথায় এতো গোবর দিলো কেন! একটুখানি বুদ্ধি দিলে কী এমন হোতো?
পরদিন ঠিকই কলেজে গেল পুষ্পিতা। তীব্রর হুমকিতে কী না কে জানে! তবে ভেতর ভেতর যে একটা অমোঘ টান,সেটার আর লাগাম টানা যায়নি।
আর ক্লাসের দরজার দাঁড়িয়েই পুষ্পিতা আবিষ্কার করল,তার ধারণা ভুল। দুদিনের কথা বলেছিল তনুজা। কিন্তু মেয়ে তো ক্লাসেই বসে আছে। তাহলে কি যায়নি?
পুষ্পিতা গাল ফুলিয়ে দম ছাড়ল। কিছুটা সহ্য শক্তি,আর সাহস টানল বুকে। তনুজা স্যারকে নিয়ে আজ যাই বলুক না কেন, ওর যেন কষ্ট না হয়! কিংবা হলেও যেন বোঝা না যায়!
তনুজা তখন মুঠোফোনে মগ্ন। পুষ্পিতা পাশে এসে বসল। জিজ্ঞেস করল আগ বাড়িয়ে, ,
“ কেমন আছো?”
তনুজা নড়ে ওঠে। পুষ্পিতাকে দেখেই বলল,
“ হেই কী অবস্থা তোমার? কেমন আছো?”
পুষ্পিতা মনে মনে বলল,
“ আর ভালো থাকা! কী যে হচ্ছে আমার সাথে কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। মাঝেমধ্যে মনে হয় আমি বেশি বেশি ভাবছি। টেকনাফ নিয়ে ভাবতে গেলে অটোমেটিক তেঁতুলিয়ায় চলে যাচ্ছি। আবার মনে হয় যা ভাবছি সবই ঠিক। প্রেমে তো তুমি আমি দুজনেই পড়েছিলাম,তাও একই মানুষের। তোমার হাসিটা কী সুন্দর, অথচ আমাকে দ্যাখো হাসতে গেলেও মনে হচ্ছে দাঁতে ব্যথা লাগছে। আমার বেলাতেই কেন,যত প্রেম তত জ্বালা!”
“ ওমা! একটা প্রশ্ন করলাম,আর এতো কী ভাবছো?”
“ হুঁ? না কিছু না তো। তোমার কথা বলো! বিয়ে খেতে যাওনি?”
“ হ্যাঁ গেছিলাম তো। আমাদের তো কাল ফেরার কথা ছিল। হুট করে ভাইয়ার এক্সাম রুটিন দিয়েছে, আর ব্যস! ফুল ফ্যামিলি ব্যাক টু গাজীপুর।”
“ ভালোই তো হয়েছে। একদিন আগে পেলাম তোমাকে।”
তনুজা হাসল। ওর দিক ফিরে উচ্ছ্বল কণ্ঠে বলে,
“ জানো, ওখানে কী হয়েছে? আমরা এত্ত মজা করেছি না! আর বরের একটা কাজিন আছে বুঝলে,কী যে হ্যান্ডসাম! আমিতো দেখেই মেল্ট হয়ে গিয়েছিলাম। এতো দারুণ ভাবে কথা বলে! একদিন আগে আসায় আমার খুব মন খারাপ হয়েছিল। তাই ওকে আমার নম্বর দিয়ে এ..”
পুষ্পিতা পথিমধ্যেই কথা কেড়ে নিলো,
“ এক মিনিট এক মিনিট! অন্য কারো প্রতি মেল্ট হয়েছ মানে,তুমি না তীব্র স্যারকে পছন্দ করো?”
ব্যস,তনুজার কথা বন্ধ। হুশ পেতেই জ্বিভ কামড়ে ধরল।
এতক্ষণের সবটা জ্বিভ ফস্কে বেরিয়ে গেছে। মুখবিবরের চোর চোর ভাবটা স্পষ্ট দেখল পুষ্পিতা। বলল সোজাসুজি,
“ কী হয়েছে বলোতো! আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছো তুমি?”
তনুজা আমতাআমতা করল,
“ না মানে ঐ…”
“ কী মানে মানে? যাওয়ার আগে স্যারের সাথে সব কিছু ঠিকঠাক করে গেলে। আর ফিরলে অন্য কাউকে নম্বর দিয়ে? ব্যাপারটা কেমন গোলমেলে না!”
তনুজা ঠোঁট উলটে বলল,
“ আমার কী দোষ? আমি তো সত্যিই স্যারের ওপর ক্রাশড ছিলাম। ফুলও নিয়ে গেলাম প্রপোজ করতে। দেখিয়েছিলাম তো তোমাকে! কিন্তু সে আমার ফুল নেয়া তো দূর,আমার মনের কথাও শোনেনি।”
পুষ্পিতা নড়েচড়ে বসল,
“ শোনেনি,শোনেনি মানে?
কী বলেছেন স্যার?”
তনুজা কণ্ঠ চাপে,
“ কাউকে বলবে না তো!”
“ না না। বলো প্লিজ!”
পুষ্পিতার ভেতরটা উত্তেজনায় ফাটছে। অথচ ওপর থেকে ঠান্ডা থাকতে চাইল।
তনুজা খুব দুঃখ নিয়ে বলে,
“ আসলে,ঐদিন স্যারের অফিসে গেলাম না? স্যার তখন ভেতরেই ছিলেন। আমি গেলাম,ভেতরে ঢুকলাম।
স্যার আমার দিক চেয়ে বললেন,
“ কিছু বলবেন?”
আমার তো তখন সারা শরীর কাঁপছে। কোনওরকম পিঠ থেকে লুকানো হাতটা সামনে বাড়িয়ে ধরেছি। যেই হাঁ করে বলতে যাব কিছু, স্যার এমন এক ধমক দিলো আমাকে! আমি ভালোবাসির ভ টাও আর মুখে আনতে পারিনি। ওখান থেকে এক দৌড়ে পালিয়ে এসেছি জানো। স্যার যে কেন করলেন এমন! আমি কি কম সুন্দর বলো তো!”
পুষ্পিতা হতবাক, স্তব্ধ। তনুজা নিজে নিজেই বলল,
“ কথাটা শুনে তোমার খারাপ লাগছে তাই না? আমারও লেগেছিল জানো। হ্যাঁ আমি একটু ঘনঘন এর-ওর ওপর ক্রাশ খাই। কিন্তু স্যার কে তো পার্মানেন্ট রাখতে চেয়েছিলাম। স্যার সেটা বুঝলেনই না।
নিষ্ঠুরের মতো আমাকে ধমক দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন।”
পুষ্পিতা বিমুঢ়তায়ও খেয়াল করল,তনুজার কথায় মন খারাপ। কিন্তু চেহারার ওর মতো কষ্ট পাওয়ার ছিঁটেফোঁটাও নেই। হলে আছি,না হলে নেই নেই ভাব।
ছটফটে গলায় শুধাল,
“ তাহলে এখন? এখন কী করবে তুমি? স্যারকে ভুলে যাবে?”
তনুজা কাঁধ উঁচাল,
“ আর কী করব? ওইদিন ওনার ধমক শুনেই তো বুঝেছি, এনাকে দিয়ে আমার পোষাবে না ভাই। আরে বাবা,কোন ছেলে মেয়েদের হাতে ফুল দেখলে অমন আগুন চোখে চায়? ‘আউট’ বলে চিৎকার করে ওঠে? আমি যদি ভয়ের চোটে ওখানে মরে যেতাম,তার দায়টা কে নিতো? হুঁ?”
“ কিন্তু স্যারকে না তুমি ভালোবাসো?”
“ উফঃ তুমিও না পুষ্পিতা! সব কিছু এতো সিরিয়াসলি ধরে বসে থাকো! গ্রো আপ ভাই। স্যারকে প্রথম দেখে শুধু আমার কেন,কলেজের অর্ধেক মেয়ের ভালো লেগে গেছিল। আমি তার মধ্যে প্রপোজ করতে গিয়ে একটা ধমক শুনে এসেছি। এখন কথা হলো,
একটা ছ্যাকা খেয়েছি বলে সারাজীবন কী সেই শোকে ব্যাঁকা হয়ে থাকব? মুভ অন করতে হবে না?
কতটুকু বয়স আমার? এখনও তো ঠিক করে জীবনটাকেই উপভোগ করতে পারিনি। আর তুমি সেদিন ঠিকই বলেছিলে বুঝলে। আমিও ভেবে দেখলাম,শিক্ষক আসলেই বাবা-মায়ের সমান।
তাই স্যারের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে আমি সামনে এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছি। ওইজন্যেই বিয়ে বাড়িতে একজনকে ভালো লাগায়,ভাবলাম স্যারকে নাহয় মনে মনেই দাফন দিয়ে দেব।”
পুষ্পিতা পাথর হয়ে থাকল। নড়ল না,চড়ল না। কিছু বললও না। তনুজার কথায়, তার মাথার ওপর আকাশ ভাঙার দশা। এই মেয়ে কথায় কথায় ক্রাশ খায়? স্যারের ওপর ক্রাশ থেকেই প্রপোজ করতে গিয়েছিল? ভালো টালো কিচ্ছু বাসে না! ওর মতো তো নয়ই। একটা ধমকেই যে অন্য ছেলের দিকে ইউটার্ন নেয়,তার পছন্দ-অপছন্দ নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ।
আর স্যার,স্যার তনুজার থেকে ফুলই নেয়নি। এ্যাক্সেপ্ট করা তো দূরের কথা। অথচ সে কী না এতকিছু ভেবে ফেলেছিল? কষ্টে-দুঃখে তনুজা আর স্যারের বাবু অবধি চলে গেছে! হে আল্লাহ! বোকার মাথায় গোবর থাকে। ওর মাথায় নিশ্চয়ই তাও নেই।
পুষ্পিতা পুতুলের মতো উঠে দাঁড়াল। তনুজা শুধায়,
“ কোথায় যাচ্ছো?”
উত্তরে পুষ্পিতা কিছু বলেনি। বিহ্বলতায় মুখে কথা আসছে না। চুপচাপ চলে এলো বাইরে।
লোকের চোখ এড়াতেই, নিজের গালে সপাটে একটা চড় বসাল তারপর।
বিড়বিড় করল রেগেমেগে
“ ছিঃ পুষ্পিতা! তোর তো গাধা হওয়ারও যোগ্যতা নেই।”
পুষ্পিতা কিছুক্ষণ নিজের ওপর ফুঁসল। কখনও রাগে,কখনও দুঃখে। একটা মিথ্যে মিথ্যে আন্দাজের জের ধরে কত কষ্টই না পাচ্ছিল এ কদিন! স্যারের থেকেও দূরে যাবে ভেবেছিল। ইস,ভালোবাসার জোরে ভাগ্যিস যেতে পারেনি। গেলে এই আফসোস, এই পরিতাপ কাকে দেখাতো পুষ্পিতা?
সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৩৭ (২)
মেয়েটার হঠাৎ চোখ পড়ল কলেজের ওপাড়ের দালানে। করিডোর দিয়ে কোথাও একটা হেঁটে যাচ্ছে তীব্র।
ক্লাসের ঘন্টাও পড়ল তখন৷ সবাই ভেতরে ঢুকল। কয়েকজন শিক্ষক বেরিয়ে এলেন ‘’ টিচার্স রুম’’ হতে! অথচ পুষ্পিতা ভুলে গেল সব। সব মানে সব। ইহকালের এই মুহুর্তকে তুচ্ছ করে তীব্রর উদ্দেশ্যে ছুটল সে৷