স্নিগ্ধ গাংচিল পর্ব ৪

স্নিগ্ধ গাংচিল পর্ব ৪
নাজমুন বৃষ্টি

সময় চলে যায় নিজস্ব গতিতে। দেখতে দেখতে মুনের যাওয়ার টাইম ঘনিয়ে আসছে। রিফাতের অনুপস্থিতিতে মুনের দিন এখন সবার সাথে ভালোই যাচ্ছে। কিন্তু আসলেই কী ভালো যাচ্ছে! রাত হলেই সব অতীত আবারো হানা দেয়।
আফজাল শেখ খুব তাড়াতাড়িই সবকিছু ঠিকঠাক করে ফেলেছেন। তিনি চান, মুন যেন অতি দ্রুত এসব ভুলে গিয়ে আবারো নতুন করে জীবন গঠন করতে পারে। আর দু’দিন পর মুনের ফ্লাইট।

গভীর রাত নেমে এসেছে, চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মুনের চোখে আজ ঘুম নেই। শুধু আছে চোখের জল। সে ব্যালকনিতে নিজের প্ৰিয় দোলনাতে বসে কাঁদতে রইল। আজ কাঁদবে, খুব করে কাঁদবে। শেষবারের মতো কেঁদে রিফাতের স্মৃতি এখানেই শেষ করে ফেলবে।
‘রিফাত ভাই কেন করলেন এমন! আপনি যদি ওই আপুকেই ভালোবাসতেন তাহলে আমার দুই বছর কেন নস্ট করলেন। আমার সুখের জীবনটাতে কেন একটা বিশ্রী অতীত দিলেন। আগে কেন বুঝতে পারিনি আমি! আমি যে নিঃস্ব হয়ে গেলাম রিফাত ভাই। আপনাকে চাইলেও ঘৃণা করতে পারছি না। সারাদিন মুখের উপর মিথ্যে হাসি ঝুলাতে ঝুলাতে আমি যে ক্রান্ত হয়ে গেলাম। আপনার জন্য আমার এতো সুন্দর পরিবার ছেড়ে ভিনদেশে যেতে হচ্ছে। তবুও মনে-প্রাণে দোয়া করি আপনি যেন সুখী হন।’ আপনমনে বিড়বিড় করে উঠল মুন। তার দু’চোখ বেয়ে আজ অজস্র ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে। মুন আজ তার চোখের জল মুছবে না। এই জলের সাথেই রিফাতের স্মৃতি বিসর্জন দিবে। আজকের পর থেকে আর ভাববে না, নিজের জীবনের দিকে ফোকাস করবে। তার মা, বড়ো বাবা যে তার সুন্দর জীবনের আশায় তাকিয়ে আছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মুন চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। বিছানায় শোবার পরও ঘুম আসছে না। এই দুই বছরের প্রতি রাতেই রিফাতের সাথে কথা শেষ করে ঘুমাতে যেত। অভ্যাসটা চাইলেও বদলানো যাচ্ছে না।
‘রাতে কারো সাথে কথা বলে নিয়ম করে প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার অভ্যাসটা সবচেয়ে বাজে অভ্যাস।’
মুনের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছে, মুন সেই জল আজ আর মুছবে না।
‘চোখের পানি হয়েই জড়তে থাকুক হৃদয়ের গহীন ব্যথাগুলো। ভালোবাসার মানুষটার জন্য যত হৃদয়ের গহীন ভালোবাসা আছে সব আজ মুছে যাক। মুছে যাক বেপরোয়া মনের লোকায়িত দীর্ঘশ্বাস।’
কাঁদতে কাঁদতে মুন একসময় ঘুমিয়ে গেল।

অন্যদিকে রিফাতের দিন যেন কাটছেই না। প্রীতির সাথে কথা না বলে তার দিন যেন কাটতেই চাইছে না। কোনো কাজেই মন বসাতে পারছে না। বাবাও কোনো যোগাযোগ করতে দিচ্ছে না। কেমন আছে মেয়েটা! সেই খবর পর্যন্ত জানতে পারছে না রিফাত। মুনের সাথে দুইবছর ভালোবাসার অভিনয়ের পরেই প্রীতিকে পেয়েছিল রিফাত।
দুইবছর আগে এক বন্ধুর আত্মীয়র বিয়েতে প্রীতিকে দেখেছিল রিফাত। প্রথম দেখাই ভালোবেসে ফেলেছিলো রিফাত। কিন্তু প্রীতিকে এরপর হাজার খুঁজেও পেলো না। রিফাতের যখন পাগল পাগল অবস্থা ঠিক তখনই বন্ধুরা তাকে একটি শর্ত জুড়ে দিছিলো যে প্রীতিকে পেতে হলে রিফাতের নিজের চাচাতো বোন মুনের সাথে দুইবছর প্রেমের নাটক করতে হবে, বিয়ের দিন সে প্রীতিকে পাবে। ওরা প্রীতিকে রিফাতের জন্য খুঁজে দিবে। রিফাত প্রথমে মুনের সাথে প্রেমের বিষয়টা মানতে না চাইলেও পরে প্রীতিকে পাওয়ার লোভে হিতায়িত জ্ঞানশূন্য হয়ে মুনের সাথে অভিনয় করেছিল। আর এছাড়াও মুনের প্রতি রিফাতের ছোটকাল থেকেই একটা সুপ্ত রাগ ছিল কারণ রিফাত শেখ পরিবারের বড়ো সন্তান হয়েও সবাই রিফাতের চেয়ে মুনকেই বেশি ভালোবাসতো, যার ফলে মুনের প্রতি রিফাতের চাপা ক্ষোভ ছিল। তাই তো বন্ধুদের কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলো – এক ঢিলে দুই দিকেই কাজ হয়ে যাবে ভেবে। রিফাত মুনের উপর ছোটকাল থেকে ক্ষোভটা এভাবেই মিটিয়ে ফেলতে চেয়েছিলো। মুনের সাথে এতো বড়ো অন্যায় করার পরেও রিফাতের একটুও অনুচোশনা হচ্ছে না। রিফাত এখন বুঝতে পারছে মুনের সাথে হয়ত একটু বেশিই অন্যায় করে ফেলেছে, ছোটবেলার রাগটা ভালোবাসার নাটক করে এভাবে মিটানো উচিত ছিল না। ভালোবাসার মানুষটাকে না পাওয়া যে কতটা যন্ত্রনার তা রিফাত হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। তবুও মুনের প্রতি অতটা অপরাধবোধ জেগে উঠছে না, শুধুমাত্র প্রীতির জন্য খারাপ লাগছে।

দেখতে দেখতে মুনের যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এলো। আজ রাত ১২টাই মুনের ফ্লাইট। কিছুসময় পর পরই মুনের চোখ ভিজে আসছে। মা- বোন, বড়ো বাবা, বড়ো মা এদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওই দূর দেশে পাড়ি কীভাবে থাকবে তা ভাবতেই মুনের চোখ ভরে উঠছে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো। মুন এক হাতে কাপড় গোছাচ্ছে আরেক হাত দিয়ে একটু পর পর চোখের জল মুছছে।
রাশিদা ইসলাম মুনের রুমে এসে মুনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল।
মুন নিজের হাতে পরম যত্নে মায়ের চোখের জল মুছে মুচকি হাসলো।
-‘মা, তুমি এভাবে কাঁদলে আমার তো যেতে ইচ্ছে করবে না। আর আমি তো একেবারের জন্য যাচ্ছি না, সবসময় ফোনে ভিডিও কলে আমাকে দেখতে পারবে। এখন হাসো, নাহলে আমার যেতে মন চাইবে না।’
রাশিদা ইসলাম মুনের কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বলল,’আচ্ছা আর কাঁদবো না। তুই সবসময় কল করবি তো আমাদের?’
-‘হ্যাঁ, ফাক্কা।’ মুন মায়ের পাশে বসে দুহাতে মা’কে জড়িয়ে ধরলো। কতদিন এই মা’কে কাছে পাবে না ভাবতেই কান্না পাচ্ছে কিন্তু মায়ের সামনে তাকে যে শক্ত থাকতে হবে।
রাশিদা ইসলাম ‘একটু আসছি’ বলে মুনের রুম থেকে বেরিয়ে গেল। এরপর সাথে সাথে হাতে কিছু একটা নিয়ে আবারো মুনের রুমে প্রবেশ করলো। তিনি তার হাতের শাড়িটা মুনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

-‘এই নেয় এটা তোর কাছে রাখ। মনে করবি, মায়ের আমানত। এটা দেখলেই তোর আমার কথা মনে পড়বে, সাথে সাথে কল দিবি। এই শাড়িটা তোর বাবা আমাকে শখের বশে কিনে দিয়েছিলো। তোর বাবার অনেক পছন্দের শাড়ি ছিল। সবসময় আমাকে বলতো,’তুমি এটা একদিন পড়িও’। অথচ পড়ার আগেই আমাকে একা রেখে চলে গেল। আজকে আমি এটা তোর হাতে তুলে দিলাম। ওই দেশে গিয়ে আমাদের সংস্কৃতিটা যাতে ভুলে না যাস।’
মুন শাড়িটা এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে শাড়ির উপর হাত বুলালো। এই শাড়িতেই তার বাবার ছোঁয়া আছে ভাবতেই এক অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে। সাদা পাড়ের নীল-রঙা শাড়ি। অসম্ভব সুন্দর শাড়ি। যতই শাড়িটার দিকে তাকাচ্ছে ততই বাবার কাছে যাচ্ছে অনুভূতি হচ্ছে। ক্ষনে ক্ষনে চোখ ভরে উঠছে শাড়িটার দিকে তাকালে কিন্তু এখন মায়ের সামনে কান্না করা যাবে না তাই মুন মুচকি হেসে শাড়িটা নিজের কাপড়ের সাথে গুছিয়ে ব্যাগে ঢুকালো।

মীরা এসে বড়ো বাবা নিচে অপেক্ষা করছে বলতেই মুন উঠে দাঁড়ালো। মীরাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো মুন। মীরা তো কেঁদে-কেটে অবস্থা খারাপ। এরপর একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বড়ো বাবার সাথে এয়ারপোর্ট-য়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো মুন। রাত হয়ে যাওয়াতে বড়ো বাবা একাই যাচ্ছে, কাওকে যেতে বারণ করেছে কারণ তিনি জানে ওখানে সবাই গেলে মুনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সবাই কান্না জুড়ে দিবে কিন্তু তিনি এটা চান না, তিনি চান মুন যেন শক্ত মন নিয়ে যায়।
এয়ারপোর্টে পৌঁছেই মুন বাকি সময়টুকু আফজাল শেখের বুকেই কাটিয়েছিল।

স্নিগ্ধ গাংচিল পর্ব ৩

মুন সিট্ বেল্ট বেঁধে বসে আছে। তার চোখ বারবার ভিজে আসছে। আফজাল শেখের চোখ মুনকে বিদায় দেওয়ার সময় বারবার ভিজে আসছিলো। মুন বুঝতে পেরেছে, লুকিয়ে লুকিয়ে আফজাল শেখ ঠিকই চোখের পানি মুছেছে। মুন এই মানুষটাকে বুঝতে পারে না, নিজের সন্তানদের চেয়ে মুনকেই বেশি ভালোবাসেন তিনি। তিনি মুনকে বিদায় দেওয়ার সময় বারবার করে বলেছিলেন মুন যাতে শক্ত থাকে, জীবনে যেন হেরে না যায়, মুন পারবে।
কিছুক্ষনের মধ্যে এয়ারহোস্টেস এসে সবাইকে দরকারি কথাগুলো বুঝিয়ে দিল। প্লেনটা বিরাট ঝাঁকুনি দিয়ে একটু একটু করে উড়া শুরু করলো। প্লেন যত চলছে মুনের মন ততো বিষন্নতায় ভরে যাচ্ছে। এতদিন নিজের মনকে সবার সামনে শক্ত রাখতে পারলেও এখন আর পারছে না। মনে হচ্ছে নিজের আপনজনদের ফেলে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে, কীভাবে চলবে পরিবার ছাড়া এমন একটা ভিনদেশে মুন!

স্নিগ্ধ গাংচিল পর্ব ৫