স্নিগ্ধ গাংচিল পর্ব ৫

স্নিগ্ধ গাংচিল পর্ব ৫
নাজমুন বৃষ্টি

পাড়ি জমালো এক ভিনদেশে মুন। যে দেশে তার কোনো চেনা-পরিচিত মানুষ নেই শুধুমাত্র ছোটবেলার একটা বান্ধবী ছাড়া। সেও এখন এখানের স্থানীয়।
প্লেন একটা বিরাট ঝাঁকুনি দিয়ে ল্যান্ড করতেই মুন অন্যদের দেখাদেখি নিজেও নেমে পড়লো। প্লেন থেকে নামার পরে ভিনদেশে প্রথমবারের মতো পা দিতেই তার এক অন্যরকম অনুভূতি অনুভব হলো।ম্যারিল্যান্ড শহরের ছোঁয়া এই প্রথমবারের মতো গায়ে মাখাচ্ছে মুন।

প্লেন থেকে নেমে এদিক সেদিক ঘুরে তাকিয়ে সামনে যেতেই দেখলো অনেকে তাদের আপনজনের নামে সাইনবোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুনের নার্ভাস লাগছে, সে আশেপাশে তাকিয়ে ইরাকে না দেখে হতাশ হলো। ইরা তো আগে থেকেই এসে যাবে বলেছিলো কিন্তু এখনো তার আসা হচ্ছে না। মুনের প্লেন থেকে নামা প্রায় মানুষ আস্তে আস্তে আপনজনদের সাথে এয়ারপোর্ট থেকে বিদায় নিচ্ছে। তার হঠাৎ করেই কান্না পাচ্ছে, এর দূর দেশে ইরা ছাড়া আর কেউই নেই ; এই ভিনদেশে সে একা যাবেই বা কোথায়! সে এগিয়ে একটা জায়গায় বসলো। এই সকাল সকাল এয়ারপোর্টটা জনশূন্য একদম। যে কয়েকজন আছে তারা ভিনদেশি মুনের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। এসব দেখে মুনের চোখ বেয়ে আপনা-আপনি অশ্রু নির্গত হতে লাগলো। সে ঠোঁট চেপে কান্না আটকে মাথা নিচু করে বসে রইল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

হঠাৎ মুনের পাশে তার থেকে কিছু দুরুত্ব বজায় রেখে কেউ বসতেই সে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখতে পেল ট্রাউজারের সাথে গেঞ্জি আর মুখে মাক্স পরিহিত কেউ একজন সামনের দিকে তাকিয়ে বসলো। বোঝায় যাচ্ছে, সকালের জগিং করছে। মুখমন্ডল দেখার উপায় নেই। সকালের সূর্যের তির্যক রশ্মী ছেলেটার মুখে পড়তেই চোখমুখ কুঁচকে ফেলল। ছেলেটা মুনের দিকে তাকাতেই মুনকে কান্নারত অবস্থায় দেখে কিছু বলতে নিল। মুনের হঠাৎ করেই জনশূন্য এলাকায় এমন মুখমন্ডল ঢাকা একজনকে দেখে ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। কারণ কেউ জগিং করতে বের হলে মাক্স পড়ে তা মুনের জানা নেই। সে টিভিতে এমন কিডন্যাপের খবর অনেক দেখেছে। হয়ত মুনকে ভিনদেশের মনে হওয়ায় ছেলেটা নিজের মুখমন্ডল ঢেকে নিজের কার্যসাধন করতে এসেছে। মুনের ভাবনায় এটা আসতেই সে দ্রুত ব্যাগ-পত্র নিয়ে বসা থেকে কোনোমতেই উঠে পড়ল।

পাশের মেয়েটাকে কিছু নিয়ে ভীতিগ্রস্থ হয়ে ব্যাগ নিয়ে অতি-দ্রুতর সহিত উঠে দাঁড়াতে দেখে আদ্রিন ব্রু কুচকালো। সে বুঝতে পারছে না, মেয়েটি কী তাকে দেখে ভয় পেয়েছে! সে একবার নিজের দিকে তাকালো। না তো! তাকে তো সাধারণ মানুষের মতোই লাগছে। সে জগিং করে এই রোড দিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েটিকে মাথা নিচু করে চোখ মুছতে দেখা গেল। দেখে মনে হচ্ছিলো মেয়েটি এখানকার নই। তাই তো কী হয়েছে জিজ্ঞেস করার জন্য এখানে এসে দুরুত্ব বজায় রেখে বসছে। কিছু জিজ্ঞেস করবে সেই মুহূর্তে মেয়েটি ভয় ভয় দৃষ্টিতে উঠে দাঁড়ালো। সে মেয়েটিকে পিছন থেকে ডেকে উঠতেই মেয়েটি ভয়ে দৌড় দিল। আদ্রিন মেয়েটির কান্ড দেখে হেসে দিল। আদ্রিনকে দেখে আজ পর্যন্ত কোনো মেয়েই দূরে সরে যায়নি উল্টো তার পাশে বসতে চায়তো, সে সবসময় মেয়েদের থেকে দুরুত্ব বজায় রেখে চলে। তাই তো মাক্স পড়েই বের হয়েছিল। অথচ এই প্রথম একটা মেয়ে এরকম দেখলো! এরপর সে উঠে দাঁড়াতেই একটা কানের দুল দেখতে পেল। সে দুলটা নিয়ে মুনকে ডাকতে নিতেই সেদিকে আর মুনকে দেখা গেল না। সে বুঝতে পারছে মেয়েটি তাকে ভালোই ভয় পেয়েছে। সে মুচকি হেসে দুলটা ট্রাউজারের পকেটে গুঁজে পার্কিং এরিয়াতে গাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।

মুন উঠে দৌড়ে ওখানে থেকে একটু দূরে এসেই বুকে হাত দিয়ে হাঁফাতে লাগলো। ঠিক তখনই দৌড়তে দৌড়তে ইরা মুনের সামনে এসে হাঁটুর উপর দুহাত রেখে দাঁড়ালো। এরপর উঠে মুনকে জড়িয়ে ধরতে নিলে মুন মুখ ফিরিয়ে নেয়।
-‘আ’ম এক্সট্রিমলি সরি মুন। ঘুম থেকে উঠতে লেট্ হয়ে গিয়েছিলো। তুই তো জানিস, সেই ছোট কাল থেকেই আমার ঘুম ভীষণ ভারী। অ্যালার্ময়ের আওয়াজেও ঘুম ভাঙলো না, অবশেষে পাপা উঠে ডাকার পর মনে পড়লো তুই আসবি যে এটা। এবারের মতো মাফ করে দেয় মুন।’ ইরা বাচ্চা বাচ্চা ভাব করে কানে ধরতেই মুন হেসে দিলো। এরপর ইরা গিয়ে জড়িয়ে ধরতে মুনও এতদিন পর বান্ধবীকে পেয়ে জড়িয়ে ধরলো।
পিছন থেকে আদ্রিন গাড়ি বের করে চলে যাওয়ার সময় ওদের কথোপকথন শুনে মুচকি হাসলো।
‘মুন’ ‘চাঁদ’ বলেই আপনমনে বিড়বিড় করে বাঁকা হেসে নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে গাড়ি স্টার্ট দিল।

ইরার সাথে গাড়িতে উঠে বসে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। ক্রান্তিতে ম্যারিল্যান্ডের রাস্তা ভালোভাবে উপভোগ করতে পারলো না মুন। ইরাদের বাসাটা হচ্ছে মূলত ডুপ্লেক্স বাড়ি। ম্যারিল্যান্ডয়ের প্রায় বাড়িই এমন সুন্দর সুন্দর। ইরাদের বাড়ির সামনে একটা ছোট বাগান আছে। ইরা আর ইরার বাবা-ই থাকে এই বাড়িতে। মুন বাসায় ঢুকে আশেপাশে না তাকিয়ে ইরার কাছ থেকে রুম জেনে নিল। এরপর মোবাইল রেখে লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

কারো ধাক্কা ধাক্কিতে আধো আধো চোখ খুলে ইরাকে দাঁত বের করে হাসতে দেখে মুনের রাগ চরম পর্যায়ে উঠে গেল।
-‘এভাবে ডাকছিস ক্যান? ঘুমাচ্ছি না?’
-‘আর কত ঘুমাবি? একটু বিছানা ছেড়ে উঠে দেখ?’
মুন চারদিকে তাকিয়ে দেখলো সন্ধ্যা নেমেছে। তার মানে, সেই সকালে এসে শুয়েছিল! সে এতক্ষন ঘুমিয়েছে!
-‘আমি পুরোদিন ঘুমাইলাম!’
-‘না, আমাদের এখানে সকাল না হতেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। এখন উঠ। পাপা আসছে। আর কিছুই তো খেলি না। আয় খেতে আই। তুই ফ্রেস হয়ে আয় আমি অপেক্ষা করছি।’

মুন উঠে ফ্রেস হয়ে ইরার সাথে নিচে নামল। ইরার বাবার সাথে পরিচয় হয়ে খেয়ে নিলো একসাথে। তিনি জানাল, এখানকার একটা নামকরা ভার্সিটিতে ইরা পড়ে। মুন আসবে ইরা জানিয়েছিল তখনই তিনি মুনের জন্য সব রেডী করে ফেলেছেন। এখন শুধু ইরার সাথে গিয়ে ক্লাস করার পালা। মুনের বড়ো বাবা আফজাল শেখের সাথে তার কথা হয়েছে। এখানে মুনকে নিশ্চিন্তে থাকতে বলেছেন, কিছু লাগলে ইরার সাথে গিয়ে নিয়ে আসতে বলেছেন।এসব শুনে মুন চিন্তামুক্ত হলো। যাক অন্তত একজন সঙ্গী ওর সাথে আছে তাই চিন্তা হচ্ছে না আর। ইরার বাবার সাথে কথা বলে বোঝা গেল, মানুষটা বড্ড ভালো। কী সহজে মুনকে নিজের মেয়ের মতো কথা দিয়ে আপন করে ফেলল। ইরার বাবা সবসময় বাড়ি থাকে না, ব্যবসার কাজে একেক সময় একেক জায়গায় যেতে হয়, এসময় ইরা এতো বড়ো বাড়িতে একাই থাকে, মুন আসাতে তিনি চিন্তামুক্ত হলেন।
রাতে খেয়েদেয়ে মুন রুমে এসে বসলো। ইরাও এসে সাথে বসলো।

-‘আজকের দিন তো ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিলি। কিছুই তো দেখলি না ম্যারিল্যান্ডের!’
-‘সমস্যা নেই। কাল দেখবো।’
-‘প্রতিদিন ক্লাস আছে রে। তুই কী কাল থেকে যাবি ক্লাসে? না কি আর কয়দিন রেস্ট নিবি?’
-‘না রে, আমি বাসায় একা একা কী করবো। আর কীই বা রেস্ট নিবো। আমিও কালকে থেকে ক্লাসে যাবো। তুই তো আছিসই।’
-‘হ্যাঁ,’ ইরার মোবাইলে কল আসাতে সে এদিক ওদিক তাকিয়ে মুনের দিকে তাকালো। ইরার ভাব ভঙ্গিমা দেখে মুন যা বোঝার বুঝে ফেলল। সে মুচকি হেসে বলল,’ যা কথা বল।’
মুনের কথা শুনে ইরা আমতা আমতা করে বলে উঠল,’আমি পার্টিতে যাবো।’
ইরার কথা শুনে মুন অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল। এতো রাতে পার্টি!

-‘তুইও চল, ইনজয় করবি আমার ফ্রেন্ডসদের সাথে।’ ইরা মুনের উত্তরের অপেক্ষা না করে বলে উঠলো।
-‘ইরা তোর মাথা ঠিক আছে? এতো রাতে পার্টিতে যাচ্ছিস! আঙ্কেল জানলে কী হবে ভাবতে পারছিস?’
-‘এগুলো এখানে স্বাভাবিক। তুই এখানে প্রথম তাই তোর অবাক লাগছে। কয়েকদিন যেতেই সব বুঝে যাবি। আর পাপা এখন ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাবে, সকালে পাপা উঠার আগেই আমি চলে আসবো।’
-‘সকালে উঠার আগে বলতে! তুই কী সারারাত ওখানেই কাটাবি!’
-‘ওহ হো, মুন। এগুলো এখানে সবাই করে। তুই গেলে আই।’
-‘না, আমি যাবো না। তুই যা।’

স্নিগ্ধ গাংচিল পর্ব ৪

-‘আচ্ছা আমি যায়। তুই ঘুমা।’ এই বলে ইরা জামা চেঞ্জ করে বেরিয়ে গেল। মুন ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলো ইরা একটি ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ছেলেটির সাথে গাড়িতে করে চলে যাচ্ছে। মুনের খারাপ লাগলো। এসবই কী এদেশের সংস্কৃতি! ইরার পরনে হাটু উপর বরাবর একটা জামা। মুন ভেবেছিল অন্তত ইরা এদেশের সংস্কৃতির সাথে তাল মিলিয়ে এতটা খারাপ হবে না কিন্তু এখানে এসে তার ধারণা পাল্টে গেল। তার এখন ভীষণ আফসোস হচ্ছে। কেন যে এখানে আসতে গেল! সে কী এদেশের এমন সংস্কৃতিকে ইগনোর করে চলতে পারবে! ইরা এখানে এসে নিজের সুন্দর সংস্কৃতিটাকে পায়ে ঠেলে এই দেশেরটা গ্রহণ করেছে। সে জানতো, এখানকার মানুষরা এমন কিন্তু ইরাও যে এমন হবে তা তার ধারণার বাইরে ছিল।

স্নিগ্ধ গাংচিল পর্ব ৬