স্নিগ্ধ গাংচিল পর্ব ৬

স্নিগ্ধ গাংচিল পর্ব ৬
নাজমুন বৃষ্টি

মাঝরাতে হঠাৎ করে মুনের ঘুম ভেঙে যাওয়াই পাশ ফিরে দেখলো ইরার জায়গা এখনো খালি। মুন হাতে মোবাইল নিয়ে সময় দেখে নিল একবার। রাত তিনটা বাজতে চলল আর ইরা এখনো আসেনি। হয়ত ইরা এখানে আগে থেকেই এসব করে আসছে। মুন আর না ঘুমিয়ে ইরার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। হঠাৎ নিচ থেকে গাড়ির হর্ণয়ের আওয়াজ শুনতেই সে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলো ইরা নামছে। ইরাকে কেমন জানি অগোছালো লাগছে মুনের কাছে।

ইরা রুমে ঢুকেই হ্যান্ড ব্যাগটা ছুড়ে মেরে অগোছালোভাবেই বিছানায় শুয়ে পড়লো। মুন কিছুসময় ইরার দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর এগিয়ে গিয়ে ইরাকে সোজা করে শুয়ে দিল। পা থেকে জুতো-জোড়া খুলে রাখল আর গায়ে লেপ টেনে দিল। এরপর নিজেও আবার শুয়ে পড়ল। সে ভাবেনি ম্যারিল্যান্ডে তার প্রথম রাত এতো তিক্ত-ভাবে কাটবে। তার সব ছেড়ে-ছুড়ে নিজের পরিবারের কাছে চলে যেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত থাকতে তো হবেই কারণ সবাইকে কথা দিয়ে আসছিল- এখানে থেকেই পড়াশোনা শেষ করে ফিরে যাবে আবারো নিজের মাতৃভূমিতে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রাতের নিস্তব্ধতা কেটে গিয়ে ধরণীর বুকে সূর্যের কিরণের ছড়াছড়ি ম্যারিল্যান্ডে। মুন আধো আধো চোখ খুলতেই সূর্যের তির্যক রশ্মি চোখে পড়তেই চোখ-মুখ কুঁচকে তাকাতেই দেখল ইরা জানালার পর্দা সরিয়ে মুনের সামনে কফির মগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইরাকে দেখতে একদম স্বাভাবিক লাগছে। মনে হচ্ছে যেন রাতের সবকিছু মুনের দেখা স্বপ্ন ছিল, যে স্বপ্নের ছিটে-ফোটার এক অংশও বাস্তবের সাথে মিল নেই।
মুনকে ইরার দিকে অবাক হওয়ার ভঙ্গিমায় তাকিয়ে থাকতে দেখে ইরা হাসলো,

-‘তোর মনে হচ্ছে রাতের সবকিছু স্বপ্ন দেখছিলি তাই না?’
মুন ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই ইরা মুনের দিকে কফির মগটা এগিয়ে দিয়ে তার পাশে বসল,
-‘আসলে এখানে থাকতে থাকতে এটাই আমার সংস্কৃতি মনে হয়। সবার দেখাদেখি আমিও এখন পার্টিতে যায়, ড্রিঙ্কস পান করি, রাত করে আসি। এগুলো ছাড়া এখানে একটি মেয়েও পাবি না। আমিও প্রথম প্রথম তোর মতোই ছিলাম। আর এখন দেখ! এসব ড্রিঙ্কস পান করতে করতে এমন পর্যায়ে এসে গেছি যে এখন আর এগুলো ছাড়া চলতে পারি না, আর প্রথম কয়েক ঘন্টা এগুলোর নেশা লেগে থাকলেও এখন সয়ে গেছি। পাপা এসবের কিছুই জানে না রে। তুইও সয়ে যাবি ফ্রেন্ডসদের সাথে চলতে চলতে।’
মুন এখনো ঘোরের মাঝে আছে। ইরা কী বলছে এসব!

মুনকে কিছু বলতে না দেখে ইরা কথার প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলে উঠলো,’ আচ্ছা যা ফ্রেশ হয়ে নেয়। আজ ভার্সিটিতে তোর প্রথম ক্লাস আর ম্যারিল্যান্ডের রাস্তাও দেখতে পারবি। দেরি হয়ে যাচ্ছে, উঠে পর।’
মুন মাথা নেড়ে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।
ফ্রেশ হয়ে দুইজনে একসাথে ভার্সিটি যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলো।
মুন গাড়ি থেকেই মাথা বের করে ম্যারিল্যান্ডের সৌন্দর্য উপভোগ করছিলো। সে বারে বারে মুগ্ধ হচ্ছে ম্যারিল্যান্ডের রাস্তাঘাট দেখে। তাদের গাড়ির পাশ দিয়েই চলে গেল আরেকটা গাড়ি। ইরা তাড়াতাড়ি মুনকে ডাক দিয়ে ভেতরে ঢুকতে বলল। আদ্রিনের গাড়িই গিয়েছিলো মুনের পাশ দিয়ে। আদ্রিন মুনদের গাড়ি পাস করে চলে যাওয়ার সময় পাশের গাড়ির মেয়েটির বাচ্চামো স্বভাব দেখে মুচকি হাসলো এরপর গাড়ি’র স্পিড বাড়িয়ে চলে যাওয়ার সময় ফ্রন্ট আয়নায় পিছনে মুনকে আরেকবার দেখে নিল।
পাশেই ইরা মুনের দিকে তাকিয়ে ওর বাচ্চামো স্বভাব দেখে হাসলো।

গাড়ি থামল একটি পার্কিং এরিয়াতে গিয়ে। ইরা মুনকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। কিছুসময় হাঁটার পরেই মুনের স্বপ্নের ভার্সিটি চোখে পড়ল। সে কিছুক্ষন নিস্পলক দৃষ্টিতে সাইনবোর্ডটির দিকে তাকিয়ে রইলো। বড়ো বড়ো অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা,’ইউনিভার্সিটি অফ ম্যারিল্যান্ড, বালটি’মোর,’। মুন বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো ভার্সিটির নামটা। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, আধো কী এটা সত্যি না-কি স্বপ্ন।
ইরা মুনের কান্ড দেখে হেসে দিল। তারপর এগিয়ে গিয়ে মুনের হাতে জোরে চিমটি দিল।
চিমটিটা বেশ জোরে পড়ায় মুন ব্যথায় চোখ-মুখ কুঁচকে চিৎকার দিয়ে উঠল। মুনের চিৎকার শুনে আশেপাশের কয়েকজন স্টুডেন্ট তার দিকে তাকালো। মুন চোখ খুলেই এমন পরিবেশ দেখে ‘ইরাকি বাচ্চি’ বলে বিড়বিড় করে ইরার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। ইরা মুনের চাহনি দেখে কেবলাকান্ত মার্কায় হাসি দিয়ে বলে উঠলো,
-‘তুই স্বপ্ন ভেবে এখানে ওই সাইনবোর্ডটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইছিস তাই আমি চিমটি দিয়ে বোঝাইলাম এটা স্বপ্ন নই, সত্যি। বাট চিমটিটা জোরে পড়ে গিয়েছে।’

মুন আশেপাশে তাকিয়ে আর কোনো কিছু বলল না শুধু ইরাকে রাগী দৃষ্টি নিঃক্ষেপ করে কিছু একটা বোঝালো যার অর্থ,’তোরে আমি পরে দেখে নিবো।’
ইরা তা বুঝেও না বুঝার ভান করে নিজের মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বলল,’ চল, ঐদিকটায় আমার ফ্রেন্ডসরা আছে। তোকে পরিচয় করিয়ে দিই।’ এই বলে ইরা ক্যাম্পাসের দিকে হাঁটা ধরলো। মুনও ইরাকে অনুসরণ করে হাঁটতে লাগলো।
ক্যাম্পাসের এক জায়গায় গিয়ে ইরা থামলো। সেখানে একটি ছেলে আর দুইটি মেয়ে বসে আছে। ইরা ওখানে গিয়ে ওদের পাশে বসে মুনকে ইশারা করলো বসতে। মুন বসতেই ওদের দৃষ্টি মুনের দিকে পড়লো। ওদের প্রশ্ন-বোধক চাহনি দেখে ইরা ওদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
-‘হেই গাইজ। শি ইজ মুন & শি নিউ হেয়ার। শি কাম’স ফ্রম বাংলাদেশ।’

ইরার কথা শুনে তিনজনই মুনকে উদ্দেশ্য করে ‘হাই’ জানালো।
ইরা মুনকে উদ্দেশ্য করে আবারো বলে উঠল,’মুন, ও হচ্ছে রিক, ও সিমি আর ও রিহি। ওরা সবাই এ দেশের।’
ওরা তিনজনই ইরার মতো ফর্সা। অবশ্য, সেই দেশের সবাই ফর্সা। ইরাও তাদের মতো ফর্সা। তবে মুন ওদের মতো অটো ফর্সা নয়।
এতক্ষন আড্ডার মাঝখানে বসে মুন বুঝতে পারলো রিক আর সিমি একজন আরেকজনের সাথে পড়ে না। তারা দুজনই কথায় কথায় ঝগড়া লেগে যায়। আর রিহি চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে। মুন আর রিহি সম্পূর্ণ আড্ডা-মহলে চুপচাপ ছিল।

এরপর ক্লাসে গিয়ে ঠিকঠাকভাবে সব শেষ করলো। সামনেই তাদের ভ্যাকেশন তাই ভার্সিটিতে একটা ট্যুর দিবে যেখানে সব স্টুডেন্টরাই থাকবে, কোনো একটা সুন্দর জায়গায় ট্যুর দিবে। ইরা তো ট্যুর নিয়ে অনেক এক্সসাইটেড। গল্পের মাঝখানে সে ট্যুরের কথা ফেলছেই না। ইরার বেশি খুশির কারণ হচ্ছে উপরের ক্লাসের স্টুডেন্টরাও যাচ্ছে আর ওখানে তার বয়ফ্রেন্ড রনও আছে। মুনের এসবের প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট নেই তাই সে চুপচাপ। এরপর ভার্সিটি শেষে তারা বাসার দিকে রওনা দিল। সব মিলিয়ে মুনের ম্যারিল্যান্ডের প্রথম দিন ভালোই কাটলো। মুন প্রথম দিন নিয়ে যতটা ভয়ে ছিল ততটা ভয় লাগেনি। রিক, সিমি, রিহি এরা খুব সহজেই মিশে গেল মুনের সাথে। এদের দেখে ভিনদেশের প্রতি থাকা ধারণাটা এক নিমিষেই হাওয়াই মিলে গেল মুনের।
মুনের মিশতে ততটা খারাপ লাগেনি কারণ ম্যারিল্যান্ডের কোনো দপ্তরিক ভাষা নেই। ইংরেজিতেই সবাই কথা বলে। যার কারণে মুনের ফ্রেন্ডশিপ করতে কষ্ট হয়নি।

স্নিগ্ধ গাংচিল পর্ব ৫

বিকেলে ইরা মুনকে সাথে নিয়ে বের হলো ম্যারিল্যান্ডের বিকেলের সৌন্দর্য উপভোগ করানোর জন্য। সবসময়ের মতো ইরা শর্ট কাপড়ই পড়লো আর মুন লং কুর্তি,গলায় একটা স্কার্ফ পড়লো আর চুলে বিনুনি করে সেটা সামনে এনে দিল। এরপর দুইজনেই বেরিয়ে পড়ল। ওরা মূলত হাঁটতে বেরিয়েছিল। ম্যারিল্যান্ডের বিকেলের রাস্তা সকালের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। মুনের পাশ দিয়ে দুইটা বাদামি চুলের ছেলে মেয়ে সাইকেল চালিয়ে চলে গেলো। মুন হেটে হেটে সব দেখতে লাগলো। রাস্তার এক পাশে এক ভদ্রলোককে গিটারের সাথে গান করতে দেখা গেল। মুন কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে গান শুনলো। লোকটি অসম্ভব সুন্দর করে গান গাইছে। ইরা বিকেলের নাস্তা করার জন্য মুনকে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। যেটি নদীর পাড়ে। মুন ম্যারিল্যান্ডের সৌন্দর্য প্রথমবারের মতো সবকিছু মুগ্ধ নয়নে উপভোগ করল।

স্নিগ্ধ গাংচিল পর্ব ৭