হামিংবার্ড পর্ব ১৫

হামিংবার্ড পর্ব ১৫
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া

সময়টা বিকেলবেলা। হালকা কমলা রঙের আভা যেন নেমে এসেছে চারপাশে। গাড়ির ভেতর পাশাপাশি বসে আছে অরা আর আরিশ। আরিশ মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে, আর অরার দৃষ্টি জানালার কাচ পেরিয়ে হারিয়ে গেছে অজানা কোনো গন্তব্যে। তার পরনে সাদা থ্রিপিস, খোলা চুলগুলো কাঁধে এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে, কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ, চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে কোমল লিপস্টিকের ছোঁয়া।

আরিশের পরনে বরাবরের মতোই কালো রঙের শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট! অরার হালচাল সুবিধার ঠেকছে না আরিশের। কিছু একটা ভাবছে মেয়েটা। বাড়িতে কেউ কিছু বলছে? না-কি অন্য কিছু? আরিশের ভাবনা ডালপালা মেলতে শুরু করেছে। অরাকে নিয়ে তার ভাবনার শেষ নেই। সকালবেলা ঘুম ভেঙে সামনে তাকালেই এতটুকু একটা মেয়েকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পায় আরিশ। কী স্নিগ্ধ, সুন্দর, মায়াময় লাগে তখন অরাকে, সেটা শুধু আরিশই জানে। অরার এই স্নিগ্ধ মুখখানাই আরিশের ভালোলাগার কারণ হয়ে উঠছে আজকাল। কিন্তু আরিশ সে বিষয় মনকে মোটেও প্রস্রয় দেয় না। বরং মনকে কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” আর কতদূর? ”
নিচু স্বরে জানতে চায় অরা। আরিশ মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে অরার এলোমেলো চুলগুলো আলতোভাবে গুছিয়ে দেয়। তারপর বলে,
” আর পাঁচ মিনিট। ”
” আচ্ছা। ”
আরিশ তাকায় তার দিকে, চোখে আধো মজা, আধো কৌতূহল।
” ঘটনা কী, হামিংবার্ড? শপিং করা নিয়ে আজ এতো আগ্রহ! জামাকাপড় নিয়ে তো তোমার মাথাব্যথা নেই। তাহলে?

অরা শুকনো ঢোক গিলল। অরা যে আজ পালিয়ে যাওয়ার মতলব করেছে, লোকটা কি কোনোভাবে সেটা বুঝতে পেরে গেলো? অরার অস্বস্তি হচ্ছে। কিছুতেই ধরা পড়া যাবে না, হুহ্।
” সাবিহা আপুর কথায় খারাপ লেগেছিল অনেক। সেজন্য তাড়াতাড়ি দামী শাড়ি পরতে হবে, সেজেগুজে বাড়িতে ঘুরতে হবে। সবাই দেখবে আর লুচির মতো ফুলবে। ”
অরার ভঙ্গিমা, কণ্ঠের ভেতরে ছেলেমানুষি অভিমানের ছায়া দেখে আরিশ হেসে ফেলল। এই চঞ্চল, কথার ফুলঝুরি মেয়েটা এতদিন ধরে চুপ করে ছিল? কেন? ভয় পায় সে? হয়তো।
গাড়িটা ধীরে থামিয়ে আরিশ বলে,
” ওকে, মাই লিটল বার্ড। লেটস গো ফর শপিং। আমরা পৌঁছে গেছি। ”
অরা আশেপাশে তাকিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলো শপিংমলের সামনেই আছে কি-না । তারপর খুশিমনে বলল,
” চলুন, চলুন। ”
” ওয়েট!”

হঠাৎ আরিশ অরার হাত টেনে ধরল। অরার চোখে প্রশ্ন। আরিশ কিছু না বলে, তার ঠোঁটে আলতো করে কিস করলো একটা । অরার মেজাজ খারাপ লাগছে।
‘বাড়ির বাইরে, গাড়ির ভেতর এসেও এসব! আর মাত্র কিছুক্ষণ। তারপর আর নাগালেই পাবেন না। ‘
মনে মনে কত কথা ঘুরপাক খাচ্ছে, তবুও চুপচাপ রইলো অরা। নিজের চিন্তার গহ্বরে হারিয়ে গিয়েছে যেন। আরিশ গাড়ি থেকে নেমে অরার দিকে এগিয়ে এল। গা ঝাঁকিয়ে হালকা হাসি ছুঁড়ে সে গাড়ির দরজা খুলে অরার সামনে নিজের হাত বাড়িয়ে দিল— রাজকীয় কুর্নিশের ভঙ্গিতে।
” এসো হামিংবার্ড। ”

অরা স্বাভাবিকভাবেই আরিশের হাত ধরে গাড়ি থেকে নেমে আসে। শপিংমলের কাঁচের দরজা ঠেলে একসাথে ভিতরে ঢুকে পড়ে তারা। আলো ঝলমলে পরিবেশ, হালকা এসির ঠান্ডা হাওয়া আর মানুষের কোলাহল—সব কিছুতেই যেন একটা বর্ণিল জীবন্ততা।
প্রথমেই থ্রিপিসের দোকানে ঢোকে তারা। দোকানের দেয়ালে সারি সারি ঝুলছে রঙিন, জমকালো থ্রিপিস—আরিশ একটু বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বলে না। বাজারে এখন পাকিস্তানি থ্রিপিসের চল বেশ। দোকানদারও সেই মোতাবেক একের পর এক পাকিস্তানি থ্রিপিস বের করে দেখাতে শুরু করে।
অরা মনোযোগ দিয়ে একেকটা দেখে যাচ্ছে। কাপড়ের কাজ, রঙের সুর, কাঁথির সূক্ষ্মতা—সবকিছুর মাঝে যেন কোথাও নিজের গা ঢাকা ইচ্ছে লুকিয়ে রেখেছে সে। তার চোখে কোনো উত্তেজনা নেই, কিন্তু অদ্ভুত এক স্থিরতা আছে। আরিশ অরার মনের ভাবনা বুঝতে চেষ্টা করছে। হঠাৎ অরা বলে ওঠে,

“আমার এত দামী পোশাক লাগবে না,”
নরম স্বরে বলে অরা।
“চুপ। ভালো ভালো ড্রেস নাও।”
আরিশর গলা শক্ত হয়ে ওঠে,
“তাজরিন খান আরিশের স্ত্রীর দিকে যেন কেউ আঙুল তুলতে সাহস না করে।”
অরার চোখের কোণে কিছু নরম আলোর ঝলক খেলে যায়, কিন্তু সে চুপ থাকে।
দোকানী আবুল হাসান, বয়স চল্লিশ কি পঁইতাল্লিশ, ভদ্রলোকের চেহারায় আন্তরিকতা। হাতে মেরুন রঙা একটা থ্রিপিস তুলে এনে বললেন,

“আপা, এইডা নেন। এই থ্রিপিসডায় আফনেরে দারুণ লাগবে—একেবারে পরীর মতন।”
আরিশের কপালে তৎক্ষণাৎ ভাঁজ পড়ে। মুখ না ঘোরালেও, ভেতরে রক্ত ধীরে ধীরে টগবগ করে উঠল। সে অরার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল।
“চলো,” গলার স্বর কড়াতালের মতো।
“কিন্তু কোথায়? ড্রেস তো কিনিনি এখনো…”
অরার চোখে বিস্ময়।
“হ্যাঁ, কিনবে। কিন্তু অন্য শপিংমলে।”
আর কোনো কথা বলেনি আরিশ। হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো অরার হাত ধরে।
বেচারা আবুল হাসান থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার মাথায় কিছুই ঢুকলো না। সে তো শুধু বলেছিল—পরীর মতন লাগবে…তাতেই এমন বিদায়?
শপিংমলের কাচের দরজা আবার স্লাইড করে বন্ধ হয়ে গেলো। তার পেছনে রয়ে গেল কিছু বিস্ময়, আরিশের চোখে লুকিয়ে থাকা একরাশ ঈর্ষা।

সারা বিকেল কেটে গেলো এক শপিংমল থেকে আরেকটায় ঘুরতে ঘুরতে। তিনটে, পাঁচটা, সাতটা দোকান… কিন্তু শেষমেশ জামাকাপড় কেনা তো দূরের কথা, কোথাও এক জায়গায় মন বসলো না আরিশের।
প্রতিটা দোকানের সেলারের মুখে একই কথা—
“এইডা পরলে আপারে একেবারে অপ্সরীর মতন লাগবে!”
“মাশা-আল্লাহ, আপা দেখতে এমনিতেই সুন্দর।”
এই কথাগুলোকেই যেন তীক্ষ্ণ বর্শার মতো মনে হয় আরিশের কাছে। এই চটকদার প্রশংসা, অপরিচিত কারও চোখে অরাকে পরীর সাথে তুলনা করা—এসবই যথেষ্ট তার মেজাজ বিগড়ে দেওয়ার জন্য।
সে কিছু বলেনি। কেবল মুখে ঠান্ডা এক অভিব্যক্তি, চোখে অনাহুত কুয়াশা।
গাড়ি চলছে। জানালার বাইরের আলো আধার একটানা পিছিয়ে যাচ্ছে। অরা পাশের সিটে চুপ করে বসে আছে। মাথার ভেতর এক রাশ অস্থিরতা।
সে ভেবেছিল, যেভাবেই হোক, আজই পালাবে। কিন্তু লোকটা কোথাও কিছু কিনলো কই? জামা-কাপড়, ব্যাগ, কিছুই তো নয়।

“মন খারাপ করতে হবে না, বাসায় ফিরে অনলাইনে সব ড্রেস অর্ডার করে দেবো। তুমিও পছন্দ করে নিবে।”
অরা কিছু বলল না। জানালার কাচের ওপারে সূর্যটা একটু একটু করে গলে যাচ্ছে। পোশাক নিয়ে তার কোনো ভাবনা নেই, কোনো আগ্রহও নয়।
এই মুহূর্তে সে যেন একদম অন্য জগতে। হঠাৎ মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার, চোখে শিশুসুলভ উচ্ছ্বাস—
“আইসক্রিম!”
আরিশ চমকে তাকায়। রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা আইসক্রিমের গাড়ি দাঁড়িয়ে, রঙিন ছাতার নিচে এক বুড়ো লোক ঠাণ্ডা মিষ্টির গন্ধ ছড়াচ্ছে। আর ঠিক তখনই, হুট করে আরিশের মনে পড়ে যায় তার ছোটোবেলার একটা সন্ধ্যা।

“মা, আমাকে একটা আইসক্রিম কিনে দেবে?”
ছোটো আরিশ গাড়ির জানালা দিয়ে আইসক্রিমওয়ালার দিকে তাকিয়ে অনুরোধ করে চলেছে বারবার। কাঁচের ওপারে লাল-সবুজ রঙের আইসক্রিম গাড়ি, আরেকটু পরেই তা দৃষ্টিসীমা পেরিয়ে যাবে। তবুও মা ব্যস্ত, ফোনে কথা বলছেন। হাসছেন, কারো সঙ্গে খুব আনন্দে গল্প চলছে।
আরিশ মায়ের হাতটা টেনে ধরে। চোখে পানি টলমল করে বলে,
“ও মা, দাও না কিনে? গাড়ি তো চলেই গেলো… দোকানটা পেছনে পড়ে গেলো মা…”
মা বিরক্ত হয়ে একবার তাকান, ঠোঁটে বিরক্তি মেশানো স্বর:
“সারাক্ষণ শুধু খাই খাই করিস! দেখছিস না কলে কথা বলছি?”
তারপর আবার ফোনে মনোযোগ।
হাসি, গল্প—আরিশ যেন তার জীবনের বাইরের কেউ।
আরিশ তখন চুপ করে যায়। ভেতরে কোথাও যেন একটা ছোট্ট কিছুর মৃত্যু হয়। সেদিনের পর, সে আর কখনো আইসক্রিম চায়নি। না কারো কাছে, না নিজের কাছে।

” আইসক্রিম খাবে, হামিংবার্ড?”
” হ্যাঁ। ”
” তুমি বসো, আমি গিয়ে নিয়ে আসছি। ”
অরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মুচকি হেসে বলল,
” ঠিক আছে। ”
আরিশ গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলো।কিন্তু পরক্ষণেই আবার দাঁড়াল। গলা উঁচিয়ে শুধালো,
“কোন ফ্লেভারের?”
আরিশ জিজ্ঞেস করতেই অরা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর নিচু স্বরে বলে,
“ভ্যানিলা একটা… আর চকলেট একটা।”
বলেই নিজেই থমকে যায় অরা। এই কথাটা তো আইসক্রিম খাওয়ার জন্য বলা হয়নি তার।
ওর মুখ থেকে এই কথাগুলো বেরিয়ে এল কেবল—কারণ ওর পালানোর একটা পথ দরকার।
একটা সুযোগ। একটু সময়।

আরিশ লক্ষ্য করছে অরার মুখ। সেই চঞ্চল মেয়েটা এখন যেন অদ্ভুত রকম শান্ত। চোখে অদ্ভুত এক ছায়া। এই মেয়ে কিছু লুকোচ্ছে। আরিশ সেটা বুঝতে পারছে, কিন্তু ঠিক ধরে ফেলতে পারছে না।
” ওকে। বসো, আসছি। ”
আরিশ চলে যেতেই,অরা আর দেরি করলো না। খুব সাবধানে গাড়ি থেকে নেমে গেলো।
ক্লান্ত শরীরে স্কুলব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাসার দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে নয়না। লোকটা কি চলে গেছে? না-কি আছে? মকবুলের মুখোমুখিও হতে চায় না নয়না। কিন্তু কী আর করার! দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নয়না। পরপর দু’বার কলিংবেল বাজালো। খানিকক্ষণ বাদে দরজা খুলে দিল মকবুল। নয়না চমকাল। উনি কেন দরজা খুললেন? কিন্তু কিছু বলতে পারলোনা। হয়তো মা রান্নাঘরে সেজন্যই!
” আসো মামুনি। সারাদিন স্কুলে অনেক ধকল গিয়েছে নিশ্চয়ই। ”
নয়না মকবুলকে পাশ কাটিয়ে বাসার ভিতর প্রবেশ করে, নিজের রুমের দিকে এগোতে এগোতে বলে,
” তেমন কিছু না। ”

মকবুল দরজা আঁটকে দিলো। ঠোঁটের কোণে তার বিশ্রী হাসির ঝিলিক। রোকসানা মল্লিক গিয়েছেন বাজারে, কিছু কেনাকাটা করতে। বাড়িতে মকবুল একা, অথচ নয়না সেটা জানে না।
রুমে ঢুকে কাঁধের ব্যাগটা টেবিলের ওপর রাখল নয়না। মাঝে মধ্যে ইচ্ছে করে মায়ের কাছে সবকিছু বলে দিতে। কিন্তু নয়নার সাহস হয় না। ভয়, লজ্জা, আত্মগ্লানি সবকিছু ঘিরে ধরে তাকে। এসব ভাবতে ভাবতে ওড়না খুলে বিছানায় ছুড়ে ফেলল নয়না। মাথাটা ভীষণ ধরে আছে নয়নার। গোসল করলে যদি ভালো লাগে সেজন্য ওয়াশরুমের দিকে এগোল সে। কিন্তু আচমকা পেছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরাতে চমকাল নয়না। পুরুষালি স্পর্শ! আঁতকে উঠল নয়না।

” কে! কে?”
চিৎকার করে উঠতেই মকবুল বিশ্রীভাবে হেসে বলল,
” মামুনি আমি, তোমার মকবুল চাচ্চু। ”
ভয়ে, ঘৃণায়, রাগে থরথর করে কাঁপছে নয়নার শরীর। মকবুলের নোংরা স্পর্শে কান্না পাচ্ছে।
” ছাড় বলছি! শয়তানের বাচ্চা! তুই এখনও শয়তানই আছিস। মা কোথায়? মা! মা! মা আআ…..”
মকবুল নয়নাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে শক্ত করে থুতনি চেপে ধরে, অন্য হাতে নয়নার গলা চেপে ধরে বলে,
” বাসায় কেউ নেই মামুনি। আর এভাবে বলছ কেন? শয়তানি বলে না এটাকে। চুপচাপ মেনে নাও সব। নয়তো…..

নয়না মকবুলের পায়ে লাথি মারে, ধস্তাধস্তি করতে শুরু করে। মকবুলও নয়নাকে জোর করতে থাকে।
” আমার কিছু হলে আমার বাবা-মা তোকে খুন করে ফেলবে হারামির বাচ্চা। ছাড়……..”
মকবুল নয়নার কোনো কথা শোনে না। সে এখন জানোয়ারে পরিণত হয়েছে। কিশোরী নয়নার শরীরে তার স্পর্শ গাঢ় হতে থাকে। নয়নাও নিজেকে ছাড়ানোর জন্য প্রাণপণ লড়াই করতে থাকে।
এতক্ষণ পাগলের মতো ড্রাইভ করছিল আরিশ। অরাদের বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়েছে সে। আইসক্রিম কেনা শেষে গাড়ির কাছে আসতেই দেখে, অরা নেই! অরাকে খুঁজে পাচ্ছিল না। সবকিছু এলোমেলো লাগছে তার। কিছুটা সময় লাগলেও আরিশের বুঝতে অসুবিধা হয় না অরা কোথায় যেতে পারে। তাই দেরি না করে তখুনি অরাদের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হয়েছিল আরিশ। সময় নষ্ট না করে গেট পেরিয়ে সোজা বাড়ির দরজায় পৌঁছে গেলো আরিশ। কলিংবেল বাজাল কয়েকবার কিন্তু দরজা খুলছে না কেউ। মেজাজ হারাচ্ছে আরিশ। অরা না হয় দরজা খুলবে না, কিন্তু রোকসানা মল্লিক?

আশেপাশে তাকাতেই হঠাৎ অরার দিকে নজর গেলো আরিশের। অরাকে দেখা মাত্রই আরিশ তার দিকে তেড়েমেড়ে গেলো।
” এই মেয়ে! তোমার সাহস তো কম না! তুমি আমাকে বোকা বানিয়ে পালিয়ে এসেছ!”
অরার দুই কাঁধে আরিশের হাতের চাপ, ব্যথায় চোখ সংকুচিত হয়ে আসছে অরার। কিন্তু অরা সেদিকে খেয়াল না করে বলল,
” আপনি প্লিজ দরজাটা ভেঙে ফেলুন। আমার মনে হচ্ছে বাসায় কিছু ঠিক নেই। আমি এসেছি মিনিট পাঁচেক হবে, কলিংবেল বাজালাম কেউ দরজা খুলল না। মা’কে কল দিলাম বলল, বাসায় নেই উনি। মকবুল চাচা আছে বাসায়। নয়না! ওর এতক্ষণে বাসায় ফেরার কথা। চাচা সুবিধার না…. নয়না! আরিশ… নয়না!”
অরা কিছু বলতে পারছে না আর। ভয়ে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে তার। আরিশ আপাতত সবকিছু ভুলে অরাকে বুকে জড়িয়ে ধরল।
” শান্ত হও। আমি দেখছি। ”

ওদের কথা শেষ হতেই ঘরের ভেতর থেকে জোরেশোরে শব্দ হলো। মনে হলো বাসনকোসন ফ্লোরে পড়েছে। অরার চোখ বড় হয়ে গেছে। আরিশ ইশারায় তাকে আস্বস্ত করলো। অরাকে একপাশে দাঁড় করিয়ে দরজায় লাথি মারতে লাগলো। পরপর কয়েকবার লাথি মারার পরেও দরজা ভাঙল না। অরা কাঁদছে। আরিশ ওর মুখের দিকে তাকাল। তারপর আরেকটা লাথি। দরজা ভেঙে গেলো। আরিশ দ্রুত পায়ে বাসার ভিতর প্রবেশ করলো, অরা পিছুপিছু।
“বাঁচাও! কে এসেছ? বাঁচাও প্লিজ!”
ভাঙা গলায় চিৎকার করে উঠলো নয়না।
অরা শব্দের উৎস খুঁজতে রান্নাঘরের দিকে দৌড়ে গেলো, আর পেছন পেছন আরিশও।
শরীরের পোশাক ছেঁড়া , হাতে একটা ছুরি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নয়না। ওর চোখে আতঙ্কের ছায়া। সামনে দাঁড়িয়ে আছে মকবুল—অসুস্থ, লোলুপ চেহারায়। অরা এক দৌড়ে গিয়ে নয়নার সামনে আড়াল হয়ে দাঁড়াল। আরিশ এগিয়ে গিয়ে মকবুলকে ধরে মারতে শুরু করল।

“নয়না! কিচ্ছু হয়নি বোন, কিছু না… শান্ত হ, আমি আছি তোর পাশে, কিছুই হবে না তোর…”
নয়না জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ওর নিঃশ্বাসের ভারে ঘরটা যেন গুমোট হয়ে উঠেছে। ভয়ে, দুঃসহ যন্ত্রণায় অরাকে জড়িয়ে ধরে আছে সে। অরা নিজের ওড়না খুলে নয়নার গায়ে জড়িয়ে দেয়, স্নেহে, শীতে কম্বলের মতো।
ওদিকে আরিশ মকবুলকে টেনে বসার ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। মুখে তার আগুন, রাগ, ঘৃণা।
“এই বয়সে এসে একটা বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে এসব করার সাহস হয় তোর? তোকে আজ জন্মের শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো, হারামজাদা! আই উইল কিল ইউ। ”
আরিশের ঘুষি, লাথিতে দেহটা কেঁপে ওঠে মকবুলের।
এরমধ্যে রোকসানা মল্লিক ফিরলেন বাজার থেকে। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই থমকে দাঁড়ালেন। ঘরের ভেতর অস্বাভাবিক এক উত্তেজনা। নয়নার চোখে পানি, গায়ে অরার ওড়না জড়ানো, আরিশ তেতে আছে রাগে। মকবুল ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে কাতরাচ্ছে।

“কি হচ্ছে এখানে? আরিশ, তুমি কেন মারছো ওকে?”
রোকসানা আঁতকে উঠলেন।
“তোমার এই দেবর কী করেছে দেখো আগে, তারপর কথা বলবে!”
অরা গর্জে উঠল। শান্তশিষ্ট অরা যেন বাঘিনী হয়ে গেছে।
রোকসানার মুখ শুকিয়ে গেল। এমনকিছু ঘটতে পারে দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি তিনি। নয়নার বিধস্ত মুখ, ভেজা চোখ রোকসানার বুকে অসহ্য যন্ত্রণার সুচ ফুটিয়ে দিচ্ছে।

হামিংবার্ড পর্ব ১৪

“তুই কী করেছিস, মকবুল? তুই কী করেছিস আমার মেয়ের সাথে?”
রাগে কাঁপছেন রোকসানা, তেজী গলায় বললেন রোকসানা।
মকবুল কিছু বলার চেষ্টা করে, কিন্তু মুখ খুললেই আরিশের লাথি।

হামিংবার্ড পর্ব ১৬