হামিংবার্ড পর্ব ৩৪

হামিংবার্ড পর্ব ৩৪
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া

তোমাকে ছাড়া এ আকাশ সাজে না
সহজে তো বাঁশি বাজে না,
চলনা আজ এ রূপকথা
তোমাকে শোনাই ।
সারাটা দিন
ঘিরে আছো তুমি এত রঙ্গিন
হয়নি কখনো মন,
সারাটা রাত
আসছে না ঘুম ধরেছি হাত
থাকবো সারাজীবন ।
আকাশ হারায় যেখানে
ও.. তোমায় ছোঁবো সেখানে,
ও.. ভালোবাসো এখনি
হো.. পরে কি হয় কে জানে ।
সারাটা দিন
ঘিরে আছো তুমি এত রঙ্গিন
হয়নি কখনো মন,
সারাটা রাত
আসছে না ঘুম ধরেছি হাত
থাকবো সারাজীবন ।
ভালো লাগা সারাক্ষণ
ও.. জানিনা তার কি কারণ,
হা.. ভেসেছি স্বপ্নে আমি
ও…তোমাকে পেয়েছে মন ।
তোমাকে ছাড়া এ আকাশ সাজে না
সহজে তো বাঁশি বাজে না,
চলনা আজ এ রূপকথা
তোমাকে শোনাই ।

গান শেষ হতেই উচ্ছ্বসিত তামান্না জোরে তালি দিতে লাগল। চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। তালহা গিটারটা ফ্লোরে রেখে হেসে জিজ্ঞেস করল,
“কেমন লাগল গানটা?”
তামান্না মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল,
“অসাধারণ! আপনার গলার সুরটা একেবারে মন ছুঁয়ে গেল, ভাইয়া।”
“আস্তাগফিরুল্লাহ!”
তালহার হঠাৎ এমন প্রতিক্রিয়ায় চমকে উঠল তামান্না। চারপাশে তাকিয়ে কিছু ঘটেছে কি না বোঝার চেষ্টা করল। কিন্তু কোথাও কিছু অস্বাভাবিক দেখল না।
“কি হয়েছে?”
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল সে।
তালহা গম্ভীর গলায় বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তুমি আমাকে ভাইয়া বলো কেন? আমার অলরেডি একটা বোন আছে। একাধিক বোনের দরকার নেই আমার।”
মুচকি হাসল তামান্না। বিদ্যুতের ক্ষীণ ঝলকানি আকাশ চিরে আলো ফেলছে মাঝে মাঝে। অল্প অল্প শীতল হাওয়া বইছে। আকাশজুড়ে ঘন মেঘ, যেন কোনো এক দুরন্ত ঝড় ঠিক প্রস্তুতি নিচ্ছে নামার। হয়তো কালবৈশাখী নামবে এই রাতেই।
তামান্নার সেই রহস্যময় হাসিটা দেখে তালহার কপালে ভাঁজ পড়ে গেল। ভ্রু কুঁচকে তাকাল সে, ভেতরে ভেতরে একটা অস্বস্তি কাজ করছে তার মনে।
“হাসছ কেন, তামান্না ভাটিয়া?”
চোখ ছোট করে জিজ্ঞেস করল তালহা।

“না, এমনি।”
কাঁধ ঝাঁকাল তামান্না।
“একদম না। কিছু একটা হয়েছে, বলো।”
“কচু হয়েছে।”
চোখ ঘুরিয়ে হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়াল তামান্না। তালহাও গিটার হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।
“ধ্যাৎ!”
কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করল তালহা।
আকাশের গর্জন যেন আরও কাছে আসছে। হাওয়াটা ঠান্ডা, কাঁধে এসে লাগছে ফিসফিস করে।
“ঝড় হতে পারে… আবহাওয়াটা ভালো লাগছে না।”
একটু থেমে আবার বলল তামান্না,
“চলুন, খেয়ে নিই। ভাইয়াও বোধহয় এখন খাবেন।”
“হুঁ… চলো।”
তালহা নিচু স্বরে বলল। মাথা হেলিয়ে সামনে পা বাড়াল তামান্না। তালহাও গিটারটা এক হাতে ধরে তার পেছন পেছন হাঁটতে লাগল চুপচাপ।

আজ প্রথমবার অরার হাতের রান্না খেয়েছে আরিশ, তাও আবার নিজের পছন্দের সব খাবার! সাধারণত ভদ্রলোক কড়া ডায়েট মেনে চলে। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় কার্ব কম, প্রোটিন বেশি – সবকিছু নিখুঁত হিসেবেই চলে। স্বাস্থ্য সচেতনতা তার জীবনের অপরিহার্য অংশ। তেজরিন খান আরিশ নিজের ফিটনেস ধরে রাখতে বরাবরই দৃঢ়সংকল্প। তবে আজ সব নিয়মের বাঁধন আলগা করেই পেটভরে খেয়ে ফেলেছে। ভালোবাসার মানুষ যখন নিজের হাতে রান্না করে, তখন আর ক্যালোরির হিসেব চলে না।
আরিশ খাওয়া শেষে ধীরে ধীরে হাত-মুখ ধুয়ে উঠল। চোখেমুখে তৃপ্তির ছাপ স্পষ্ট। ঠিক সেই সময় তালহা আর তামান্না এসে ঢুকল ডাইনিং রুমে। অরার খাওয়াও শেষ হয়ে গেছে।
“ ভাবি, আপনি কেন কষ্ট করলেন? আমাকে একবার ডাক দিলেই তো হতো!”

মিনমিনে গলায় বলল তামান্না।
ততক্ষণে তালহা চেয়ার টেনে বসে পড়েছে। তাসলিমাও এসে খাওয়ার জায়গায় বসেছেন, তবে সাবিহা নিজ ঘরে। তার এখন কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না।
“ডাক দিতে হবে কেন, তামান্না?”
চোখ সরু করে বললেন তাসলিমা।
“তোমার কাজই তো এটা দেখাশোনা করা – কে কখন খাবে, কে বসেছে কে আসেনি এসব। আর তালহা, তোকে একটা কথা বলেছিলাম আমি। মনে হয়, ভুলে গেছিস।
তাসলিমা খাতুনের স্বরে একটা চাপা রাগ ছিল। তালহা কিছু বলল না চুপ করে রইলো । তামান্না মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
তখনই আরিশ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“একদিন খেয়াল না রাখলে এমন কিছু হয়ে যায় না, চাচি। আফটার অল, ওর বয়স তো সাবিহার মতোই। বরং তার চেয়েও ছোটো। ইচ্ছেমতো কিছু করার, বা না করার বয়স এটা। আর তালহার গানের গলা দারুণ – ও তো শুধু গান শুনছিল।”

তাসলিমা খাতুন চুপ করে গেলেন। মনে মনে নিজের ছেলের ওপর ভীষণ রাগ করলেন। কখন আবার আরিশ কী বলে সেই ভয় অরা মাথা নিচু করে বসে আছে। আরিশের হালকা মন্তব্যে তামান্নার মুখে আবার হাসি ফুটেছে। একটু স্বস্তির ছাপ নিয়ে সে সবার সামনে খাবার পরিবেশন করছে।
হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল আরিশ। চোখ পাকিয়ে অরার দিকে তাকাল, তারপর এক ভরসা-মেশানো ইশারায় বলল, নিজের ঘরে যেতে। অরা বসা উঠে ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে সোজা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় চলে গেল।
“ সাবিহা খেয়েছে? “
শুধালো আরিশ। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন তাসলিমা। বললেন,
“ মেয়েটা খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে ফেলেছে প্রায়। “

আরিশের কপালের ভাঁজ গাঢ় হলো। কিছু না বলে ঘুরে দাঁড়াল, আর ডাইনিং রুম থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল।
জানালার পাশে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে সাবিহা। পরনে সাদামাটা একটি টি-শার্ট আর ঢিলেঢালা প্লাজু। শহরে আসার পর তার ভিতরে বেশ কিছুটা বদল এসেছে – চেহারায়, পোশাকে, ভাবনায়। এখন সে অনায়াসে ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরতেও জানে। তার দৃষ্টি এখন বাইরের ঝাপসা আলোয় নয়, ভেতরের অন্ধকারে আটকে আছে।
মাথায় কেবল একটাই ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে – কীভাবে অরাকে চিরতরে আরিশের জীবন থেকে মুছে ফেলা যায়।
চাইলেই হয়তো চলে যেতে পারে সে এই বাড়ি থেকে। কিন্তু যাওয়ার আগে এমন কিছু করতে চায়, যেন অরার অধ্যায়টা বন্ধ না হলেও অন্তত নড়বড়ে হয়ে পড়ে। যেন ওর দম নিতে কষ্ট হয়, যেন আরিশ আর কখনো চোখ বুজে ওকে বিশ্বাস করতে না পারে।

“ সাবিহা? “
চেনা কণ্ঠ শুনে চমকে উঠল সে। তড়িৎ গতিতে ঘুরে তাকাল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আরিশ। পরনে কালো টি-শার্ট আর জিন্স। মুখে একরাশ ক্লান্তি আর চোখে কড়াভাবে চাপা রাগ।
“আরিশ! ভেতরে এসো।”
আরিশ ঘরে ঢুকে ধীরে চেয়ার টেনে বসল। সাবিহা সামনাসামনি এসে দাঁড়াতেই বলল,
“ আরিশ না, আরিশ ভাইয়া বলে ডাকবে তুমি। বয়সে তোমার থেকে বড়ো আমি, সেটা কি ভুলে যাও?”
আরিশের কণ্ঠে গাম্ভীর্যের ছাপ স্পষ্ট। সাবিহার গা জ্বলে উঠলো ভেতরে ভেতরে। ভাবছিল, খাবারের কথা বলবে, হয়তো মমতা দেখাবে। তা না করে, জ্ঞান দিচ্ছে।

“ সরি। “
“ ইট’স ওকে। খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করছো না কেন? “
“ আমি বিদেশে যাবো না, আরিশ। “
একটু থেমে ফের বলল সে,
“ আমি বিদেশে যাবো না, ভাইয়া। “
“ কেন যাবে না? কতো ছেলেমেয়ের স্বপ্ন দেশের বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করবে, আর তুমি সেই সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করতে চাচ্ছ! “
একমুহূর্ত নীরব থাকে বলল সাবিহা,
“ আমি তোমাদেরকে ছেড়ে থাকতে পারবো না। “
আরিশ চুপ করে গেল। এক দৃষ্টিতে তাকাল সাবিহার দিকে। তারপর ঠান্ডা গলায় বলল,

“ দেখো সাবিহা, তুমি অরার সাথে যা করেছ তারপর তোমাকে এই বাড়িতে রাখার কোনো ইচ্ছে আমার ছিলো না। কিন্তু চাচার মেয়ে তুমি। তোমার সাথে অবিচার করতে পারবোনা আমি। চাচা আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন। তাই জন্য বলছি, দেশের বাইরে যাও। লেখাপড়া করো, নিজের ক্যারিয়ার তৈরি করো। “
আচমকা সাবিহা আরিশের সামনে ফ্লোরে বসে পড়লো। আরিশ বিরক্ত হলো তাতে, কপাল কুঁচকে এলো তার।
“ প্লিজ! আরিশ… ভাইয়া আমাকে দূরে পাঠিও না। আমি এখানেই থাকতে চাই। “
বসা থেকে উঠে দাঁড়াল আরিশ। রাগে চোখ লাল হয়ে গেছে তার।
“ দূরে তো তুমি অবশ্যই যাবে সাবিহা। হয় পড়াশোনার জন্য নয়তো অন্য কিছুর জন্য। আমার অরার আশপাশেও রাখবো না তোমাকে। “

আরিশ হনহনিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে গেল সব, ক্ষণেক বাদে রাগে চেয়ারটা উপড়ে ফেলে দিলো সাবিহা। নিজের চুল টানতে লাগলো। মৃত বাবার ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। মরার আগে কিছু জায়গা সম্পত্তি অন্তত তাদের নামে লিখে দিয়ে যেতেন! ঢাকা শহরে এতো কিছু আরিশের অথচ তালহাদের নামে কিচ্ছু নেই। আছে কেবল গ্রামে কয়েক বিঘা জমি….
অনেকক্ষণ হলো, ঘরে এসে বিছানায় চুপচাপ বসে আছে অরা। বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে সে। আরিশ কি রাগ করেছে? না, রাগ করারই বা কী আছে? মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, আর সেসবের উত্তরও যেন নিজেই দিচ্ছে অরা। বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না তার। ভাবলো, শুয়ে পড়বে। ঠিক তখনই দরজা আটকে যাওয়ার শব্দে চমকে তাকাল সে।

আরিশের চোখে চোখ পড়তেই বুকের ভেতর কেমন করে উঠল অরার– ভয়ে দৃষ্টি নত করে নিজেকে গুটিয়ে নিলো বিছানার এক কোণে।
আরিশ ধীরে ধীরে এগিয়ে এল তার দিকে। বিছানায় বসতে বসতে নিজের টিশার্ট খুলতে খুলতে শান্ত গলায় বলল,
“হোয়াটস হ্যাপেন, হামিংবার্ড?”
অরা ধীরে ধীরে মাথা তুলো তাকাল। উন্মুক্ত শরীরে অপূর্ব লাগছে তার রাগী ভূতকে। কিন্তু ভদ্রলোকের চোখগুলো অমন লাল কেন? কার সাথে রাগ করলো? অরার ভয়ার্ত দৃষ্টি দেখে মুচকি হাসল আরিশ। অরা একটু হলেও স্বস্তি পেলো তাতে।
“ আপনি রাগ করেছেন কেন?”
“ কারণ আমি তোমার রাগী ভূত, সেজন্য। “
চমকাল অরা। উনি কীভাবে জানলেন এই নাম? আমতা আমতা করে শুধালো,
“ আপনি কীভাবে….. “
আরিশ অরার দিকে এগোল, জাপ্টে ধরে কোলে তুলে বসালো তাকে। শাড়ি পরে এভাবে বসতে একটু অস্বস্তি লাগছে অরার। কিন্তু কী আর করার!
“ ওই যে সেদিন? নেশার ঘোরে বলেছিলে। “
লজ্জায় চোখমুখ কুঁচকে ফেলল অরা। আর কী কী বলেছিল, করেছিল সেসব ভেবেই হাসফাস করছে।
“ আর কী কী করে…ছিলাম? “

থেমে থেমে প্রশ্ন করছিল অরা। আরিশ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার চোখের গভীরে। তারপর নিঃশব্দে হাত রাখল অরার কোমরে। অরা নিঃশ্বাস আটকে তাকিয়ে রইল, বুঝতে পারছিল কী হতে যাচ্ছে। আরিশ ধীরে এগিয়ে এল, তার চোখ আটকে রইল অরার ঠোঁটে। আরিশের আগ্রাসী চুম্বনে এলোমেলো হতে লাগলো সে। মিনিট পাঁচেক ওভাবেই চলল। যখন আরিশ থামল তখন অরার টালমাটাল অবস্থা। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে। আরিশের চোখেমুখে দুষ্টমির ঝিলিক।
“ এসব করেছিলে, হটি। “
হটি! চোখ বড়ো বড়ো করে ফেলল অরা। আরিশ তাকে হটি বলল কেন? তারমানে নেশার ঘোরে সে এরকম আদর করেছে? ছিহ! ছিহ! নিজের হাত দিয়েই চোখমুখ চেপে ধরল অরা। আরিশ ওর অবস্থা দেখে হাসছে। এমনিতেই কিস করতে গিয়ে ঠোঁটের সব লিপস্টিক ঘেঁটে গিয়ে থুতনিতে লেগে গেছে, তার ওপর এমন বোকা বোকা কাজকর্ম!

“ ওরে লজ্জা রে! সেদিন কোথায় ছিলো, এত লজ্জা? তখন তো আমি বারণ করা স্বত্তেও শোনোনি। “
অরা কিছু বলল না। চুপ করে রইলো, ওভাবেই।
“ আজ আমিও বারণ শুনবো না, পাখি৷ আই ওয়ান্ট ইউ টু বি মাইন, রাইট হিয়ার, রাইট নাউ। আই ক্যান্ট টেক ইট এনিমোর, আই নিড ইউ।”
আচমকা আরিশের এমন আবদারে ঘাবড়ে গেলো অরা। চেহারা থেকে হাত সরিয়ে কিছু একটা বলতেই যাবে এমন সময় আরিশ হাত দিয়ে অরার মুখ চেপে ধরল। অরা আরিশের দিকে তাকাল। চোখেমুখে তীব্র মোহ তার। ভয় পেলো অরা। না জানি কী করে এবার আরিশ।
“ চুপ! না বলবে না, হামিংবার্ড। আজকে আমি আর ধৈর্য ধরতে পারছি না। তুমি জানোই তো, আমি বড্ড অধৈর্য।

আরিশ কথা বলতে বলতেই বিছানায় শুইয়ে দিলো অরাকে। শাড়ির আঁচল পাশে সরিয়ে, অরার ওপর চড়াও হলো সে। মুহূর্তের মধ্যে অরার পুরো মুখমণ্ডল এবং গলা আরিশের ঠোঁটের স্পর্শে ভরে উঠল। হাসফাস করছে অরা। আরিশ তাকে কিছু বলারই সুযোগ দিচ্ছে না। সেই পাগলামি, সেই হিংস্রতা! এমনিতে আরিশ সাধারণত শান্ত এবং স্বাভাবিক থাকে, তবে বিশেষ মুহূর্তে তার আবেগের তীব্রতা তাকে কখনোই পুরোপুরি শান্ত থাকতে দেয় না। এই মুহূর্তগুলোতে তার অনুভূতি আরও গভীর হয়ে ওঠে, যা তার আচরণে পরিবর্তন নিয়ে আসে।
“ আরিশ প্লিজ শুনুন। “
“ ইশশ! চুপপপ… অন্য কিছু বলো পাখি। যেমন, কিস মি আরিশ অথবা আই ওয়ান্ট মোর… প্লিজ বেবি সে দ্যাট!”
অরার চুল খামচে ধরে বলল আরিশ। সে সম্পূর্ণভাবে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে অরার শাড়ি, চুড়ি, গয়নাগুলো। অরা চাইলেও থামাতে পারছে না আরিশকে। তাই বাধ্য হয়ে চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরিশের মেজাজ বিগড়ে গেলো। শোয়া থেকে উঠে বসে হাঁপাতে লাগলো সে।

“ সমস্যার কথা, আগে বলোনি কেন? “
“ বলতেই তো চেয়েছিলাম। আপনি শোনার অবস্থায় ছিলেন?”
কপাল চেপে ধরে বসে আছে আরিশ। গলা শুকিয়ে গেছে তার। বিছানা থেকে পোশাক হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। অরাও উঠে বসেছে, গায়ে বিছানার চাদর। আরিশের চোখে-মুখে তীব্র রাগ, যেন একটি আগুনের শিখা। অরাকে একেবারে চমকে দিয়ে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙতে শুরু করলো আরিশ। অরা ভয়ে, আতঙ্কে কিছু বলতে পারলো না। সে শুধু নিঃশব্দে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর, ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো আরিশ। ঘরের ভাঙাচোরা অবস্থায় তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল অরা। সবকিছু তছনছ করে ফেলেছে আরিশ।

সারারাত ওইভাবে বসে রইলো অরা, অপেক্ষা করতে লাগলো আরিশের। কিন্তু সে আর ফিরে এলো না ঘরে। ফজরের আজানের আগে আগে চোখ লেগে এলো অরার। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল, টেরও পেলো না সে।
ভোরের আলো ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করছে, সকালের নরম রোদ জানালা দিয়ে ভেসে আসছে। বাইরে যানবাহনের ককর্শ শব্দ কানে ভেসে আসে, তবে জানালা বন্ধ রাখলে শব্দটা অনেকটাই কমে যায়। কিন্তু অরা সব সময় জানালা খোলা রেখেই ঘুমায়। রাতের আকাশে মেঘ জমেছিল, তবে ঝড়বৃষ্টি হয়নি, শুধুমাত্র এক মৃদু ঠাণ্ডা হাওয়া গুঞ্জরিত হচ্ছিল।

এলার্ম-ঘড়ির শব্দে হঠাৎ নড়েচড়ে উঠল অরা। সকাল সাড়ে আটটার এলার্মটা সেট করা ছিল। এটি মূলত আরিশের অফিসে যাওয়ার জন্য, তবে প্রতিদিনের মতো আজও অরার ঘুম আগে ভেঙে গেছে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঘুমঘুম চোখে কিছু সময়ের জন্য তাকিয়ে থেকে অরা বুঝতে পারলো – আজও সে আরিশের বুকের মধ্যে শুয়ে আছে। পুরো বিষয়টা বুঝতেই তার ঘুমঘুম ভাব একেবারে কেটে গেল। চোখে ভালো করে তাকিয়ে দেখল –হ্যাঁ, আরিশ তার সামনে শুয়ে আছে। আর অরা আরিশের হাতের ওপর শুয়ে, তার বুকের দিকে মুখ গুঁজে আছে।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো অরা। মনে মনে ভাবলো, যাক, লোকটার রাগ কমেছে। তবে, অরার মনে কোনো দোষ ছিল না। অনেকবার সে চেয়েছিল বলার, সমস্যা আছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা!

“ গুড মর্নিং, হামিংবার্ড। “
আরিশের ঘুম জড়ানো কণ্ঠটা দারুণ লাগে অরার। মিষ্টি করে হাসল অরা।
“ গুড মর্নিং। “
“ সাড়ে আটটা বেজেছে?”
“ হ্যাঁ, ঘড়ি তো তাই বলছে। আটটা চল্লিশ বেজেছে। “
আড়মোড়া ভেঙে অরাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আরিশ। মনে হচ্ছে টম তার জেরিকে বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে। অরা আরিশের বুকে মুখ গুঁজে আছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। আরিশের গায়ের গন্ধটা খুব ভালো লাগে ওর।
“ তাহলে এখন উঠতে হবে, জান। অফিসে যাইনি তিনদিন হলো। গিয়ে দেখতে হবে কী অবস্থা এখানকার। “
শোয়া থেকে উঠে বসলো আরিশ। অরাও উঠে বসেছে।

“ হ্যাঁ যেতে তো হবেই। “
“ আর বলো না, একটু চোখের আড়াল করলেই সবাই লুটেপুটে খাওয়ার চেষ্টা করে। বিয়ের পর থেকে ইতালিতে একবারও যাওয়া হয়নি বলে ওখানকার অবস্থা কী হয়েছে তা তো শুনলে। একা মানুষ, দুই জায়গায় থাকাও সম্ভব না। ভাবছি তালহাকে ভালো করে কাজকর্ম শিখিয়ে, ইতালি পাঠিয়ে দেবো। কেমন হবে? “
অরার অবাক লাগছে। আরিশ তার সাথে কাজের বিষয় আলোচনা করছে!

হামিংবার্ড পর্ব ৩৩

“ হামিংবার্ড? সে সামথিং। “
“ হ্যাঁ, ভালোই হবে। নিজেদের লোক থাকলে আপনাকে আর টেনশন করতে হবে না। “
“ হ্যাঁ সেটাই। থাকো, ফ্রেশ হয়ে আসছি আমি। “
“ আচ্ছা। “
ওয়াশরুমের দিকে এগোল আরিশ। অরা চটজলদি জামাকাপড় চেঞ্জ করে রান্নাঘরের দিকে এগোল।

হামিংবার্ড পর্ব ৩৫