হীরকচূর্ণ ভালোবাসা গল্পের লিংক || রাউফুন

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ১
রাউফুন

‘যাক বান্ধবীর বিয়ে খাওয়ার দৌলতে নিজের বাড়ির কয়েক বেলার ভাত বেঁচে গেলো তোদের। ক-বেলা অন্তত ভালো মন্দ খেতে পারছিস তোরা দুই বোন! জীবনে এরকম খাবার চোখে দেখেছিস বলে তো মনে হয় না। যেভাবে খাচ্ছে তোর বোন।’
বান্ধবীর বিয়ে। সবে মাত্র খেতে বসেছে তুলিকা আর তার বোন মিষ্টি।

সে এক লোকমা পোলাও মুখে দিবে ঠিক সে মুহুর্তে তার কর্ণকুহর হলো কিছু কটাক্ষের বানী। তার বেস্টফ্রেন্ডের ভাই শিপনের তীব্র শ্লেষাত্মক মন্তব্যটি যখন শুনলো অপমানে থমথমে হয়ে গেলো তার মুখ। তড়িৎ বেগে খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পরলো তুলিকা কিন্তু মিষ্টির এসবে কিছুই যায় আসে না। সে আরামছে খাবার খাচ্ছে। গোগ্রাসে খাচ্ছে বলা যায়। তুলিকা নিজের বোনের দিকে তাকালো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মিষ্টি ছোট ওর হইতো কিছু না কিন্তু তার গায়ে ফোসকা পরার মতো কথাটা গেঁথে গেছে। সে এক মুহুর্ত দেরি না করে উঠে এলো।কোনো দিকে না তাকিয়ে দৌঁড়ে চলে আসে সেখান থেকে। বিয়ে বাড়ি, বাড়ি ভরতি মেহমান তাই সে সিনক্রিয়েট করলো না। সে চাইলেই এই নোং’রা লোকটাকে এই কথাটা বলার জন্য যথাযথ জবাব দিতে পারতো। এই লোকটা তাকে সব সময় এভাবেই কথা শোনাবে। অনেক দিন আগের কথা। সে রোজা রেখেছিলো তখনও শিপন বলেছিলো,

‘কি-রে রোজা রেখেছিস? এভাবে হাড়গোড় বেরিয়ে গেছে যে। রোজা তো রেখেছিস যেনো তোদের খাবার বেঁচে যায় তাই না? কত গুলো চাল বাঁচলো রে? তোদের জন্য রমজান মাস এসে ভালোই হয়েছে কি বলিস!’
তুলিকা তখন শান্ত ভাবে মুচকি হেসে উত্তর দিয়েছিলো, ‘শিপন ভাই আপনি রোজা না-ই রাখতে পারেন কিন্তু তার মানে এই না যে একজন রোজাদার ব্যক্তিকে রোজা রাখা নিয়ে কথা শোনাবেন। আর আমি রোজা রেখেছি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য! আমার এক বেলার খাবার জোগান কিন্তু আপনি দিয়ে আসেন না। আমরা দুজন বোন, হতে পারে আমরা এতিম। মা-বাবা নেই। আত্মীয় স্বজনরা মাথার উপর কেউ-ই নেই। কিন্তু তার মানে এই না যে আমরা দুই বোন না খেতে পেয়ে ম’রে যাচ্ছি।’

সব সময় লোকটা তাকে কথা বলার জন্য একেবারে মুখিয়ে থাকে। কেন যে এই লোকটা তাকে দু-চক্ষে সহ্য করতে পারে না এই বিষয়টা সে আজও জানতে পারেনি। মনে হয় সে ওই লোকটার পথের বিষাক্ত কা’টা। তার অক্ষিকুল ভিজে উঠছে বার বার। সে সোজা তার বান্ধবীর কাছে চলে গেলো। সাজানোর রুম থেকে হাসাহাসির শব্দ আসছে। সে দরজাটা ফাঁক করে দেখলো তার বান্ধবীকে। কি সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। সে এই খুশির মুহুর্তে টা খারাপ করতে চাইলো না। চোখের পানি লুকিয়ে হাসি মুখে সে দ্রুত ওখানে গেলো।

‘তোকে খুব সুন্দর লাগছে জানুউ। নজর না লাগুক।’
‘তুই তো খেতে গেছিলি তুলি। এতো তারাতাড়ি খাওয়া হয়ে গেলো?’
‘হ্য-হ্যাঁ হবে না কেন? তুই তো জানিস আমার সময় লাগে না খেতে।’
‘তাই বলে তুই আমাকে এটা শেখাস না দুই মিনিটের মধ্যে কারোর খাওয়া শেষ হয়।’
‘আরে ছাড় না। তোর বিয়ের সেইম সেইম লেহেঙ্গা আমাকে কিনে দেওয়ার কথা ছিলো না? কোথায় সেটা?’
‘কথা ঘুরাস তুলি। খাস নি কেন? আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে কি মন খারাপ? নাকি কেউ কিছু বলেছে?’
‘ছাড় না এসব আশু!’

‘নাহ ছাড়তে পারছিনা। তুই খাবি না আর আমি চুপ থাকবো। মুখের কি অবস্থা হয়েছে দেখেছিস?’
‘আপনার বান্ধবী আসলেই খাইনি ভাবি।’
তুলিকা আর আশফি দুজনেই তাকালো দরজায়। তাকিয়ে দেখলো লম্বা, সুঠাম দেহি একজন সুপুরুষ সুন্দর হেসে দাঁড়িয়ে আছে। সে আশফির খালাতো দেবর। সম্পর্কে ছোট হলেও বয়সে সে আশফির বড়।
‘আরে মাইজিন ভাই আপনি ?’

‘হ্যাঁ আমি। আমি দেখেছি উনি না খেয়েই টেবিল ছেড়েছেন। এমন কি এক লোকমা খাবার ও সে মুখে দিতে পারেনি।’
‘কি বলছেন কি আপনি?’
‘হ্যাঁ ঠিক বলছি।’
তুলিকা নত মস্তকে কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। এই লোকটা এতো সব কখন খেয়াল করেছে? সে প্রথম থেকেই লক্ষ্য করেছিলো মাইজিন কেমন তার পিছনে পিছনে ঘুরঘুর করছিলো। তার চাহনিতে সে বা’জে কোনো ইঙ্গিত পাইনি। যা ছিলো মুগ্ধতা! মানুষটাহ খাওয়ার সময়ও সেসব খেয়াল করেছে। সেখানেও কেউ এভাবে যায় নাকি?
‘কি-রে তুলি খেলি না কেন?’

‘কি করে খাবে? কেউ যদি খাবার মুখে দেওয়ার আগেই শুনতে পায়, ক-বেলার খাবার বাঁচাতে খেতে বসেছে তাহলে সে কি করে খাবার মুখে দিয়ে সেটা গলা দিয়ে নামিয়ে পেট অব্দি নিয়ে যাবে?’
আশফি এবারে যা বুঝার বুঝে গেলো। সে ভেবেছিলো আজকের দিনে অন্তত পক্ষে তার ভাইটা এরকম করবে না৷ রোজ রোজ তার ভাইটা এরকম দুর্ব্যবহার কেন করে তুলির সঙ্গে বুঝে পায় না আশফি। তুলিকা নিরবে চোখের পানি ফেলছে।
‘ক্ষমা করিস আমাকে তুলি। আমি ক্ষমা চাইছি ভাইয়ার পক্ষ থেকে তোর কাছে। তুই থাক আমি খাবার নিয়ে আসছি এখানে।’
‘আরে আরে ভাবি আপনার যেতে হবে না। আমি খাবার নিয়ে এসেছি।’পেছনে ধরে রাখা খাবার বের করলো মাইজিন।
‘থ্যাংক ইউ মাইজিন ভাই।’

তুলিকা মাথা তুলে তাকিয়ে দেখলো মাইজিনকে। খাবার হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ টাকে যেনো অদ্ভুত লাগলো। বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে তার।আশফি খাবার নিয়ে খাওয়াতে গেলে তুলিকা তার হাত ধরে বাঁধা দিলো।
‘স্যরি রে আশফি।আমাকে এই খাবার খেতে বলিস না।আমি এই খাবার খেতে পারবো না।’
‘কেন খাবি না শুনি? ভাইয়ার কথায় কিছু মনে করিস না প্লিজ। জানিস তো ভাইয়া এরকম ই!’
‘হুম জানি তো। তাই তো এই খাবার টা আমি খেতে পারবো না। আমি তোর বাড়ির পানিও মুখে দিতে পারবো না। তাহলে যে আমার নিজেকে নিজের ছোট করা হবে। বলেছিলাম না তোর বিয়েতে সবচেয়ে বেশি আমিই খাবো এই-যে খাওয়া হলো।’

ডুকরে কেঁদে উঠে আশফি। তুলিকার চোখ দিয়ে পানি পরছে অনর্ঘ। আশফি শব্দ করে কান্না করছে দেখে থামলো তুলিকা।
‘এই এই কাঁদিস কেন? তোর মেক-আপ নষ্ট হয়ে গেলে তোর আসল রুপ বেরিয়ে আসবে!’
‘আসল রুপ বেরিয়ে আসবে মানে?’ ভ্রুকুটি করে শুধাই মাইজিন!
‘হ্যাঁ আসল রুপ বেরিয়ে আসবে বেয়াই সাহেব।’
‘এই কি বলছিস তুই?’

‘তোকে যে শাক-চুন্নীর মতো দেখতে সেটা তো মেক-আপের আঁড়ালে পরেছে। কাঁদলে চোখের পানিতে মেক-আপ ধুঁয়ে সেটা বেরিয়ে পরবে না? তাছাড়া কি যে বিচ্ছিরি লাগে বুচি মানুষ কাঁদলে। নাক টা থেতলে যাওয়ার মতো হয় কিনা!’
না চাইতেও ফিক করে হেসে দিলো আশফি।
‘আসি ভাবি। আপনারা গল্প করুন। আপনার বান্ধবী কিন্তু খুব মজার মানুষ! আমার তাকে ভীষণ ভালো লেগেছে।’
কোনো দিকে না তাকিয়ে মাইজিন তাদের রুম ত্যাগ করে। আশফি হাসি থামিয়ে বললো,

‘আমি তোকে খাইয়ে দিলেও খাবি না তুলি?’
‘খাবো তো। যখন তোর নতুন সংসার হবে সেখানে গিয়ে খাবো। তোর নিজের বাড়ির খাবার আমার মুখে রুচবে না!’
বলেই চলে আসছিলো তুলিকা। আশফি হাত টেনে ধরাই ‘আহ!’ শব্দ বেরিয়ে এলো তার মুখ থেকে। স্পষ্ট ব্যথিত ফেইস তার।

‘কি হয়েছে তুলি? দেখি তোর হাত!’ অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো আশফি।
‘উফফ আশু কিছু না। আজ তোর বিয়ে
আর তুই আমাকে নিয়ে পরে আছিস?’
‘নাহ আমাকে হাত দেখা। আমি দেখবো।’ জোর করে আশফি তুলিকার হাত দেখলো। তুলিকার হাত ফুলে টইটম্বুর।
‘এমন লাল হয়ে ফুলে গেছে কেন? কি করেছিস তুই?’ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে।
‘বড় ভাবি একটু রসুন বেটে দিতে বলেছিলো৷ তাই দিয়েছিলাম!’

লুকিয়েও লাভ নেই তাই সে সত্যিটা বললো। ভীষণ বেশিই জ্বালা করছে তার হাত। এক সাথে এতো গুলো রসুন বেটে তার হাত ভীষণ বাজে ভাবে ফুলে, ফোসকা উঠে গেছে। দু-চোখ ঝাপসা হয়ে টপটপ করে পানি পরলো আশফির৷
‘তুই এতো বোকা কেন তুলি? তুই কি বুঝিস না তোকে কষ্ট দিতে ওঁরা ইচ্ছে করেই এসব করেছে। আমাদের বাসায় ব্ল্যান্ডার আছে। তবুও তোকে দিয়ে এতো গুলো রসুন কোন ইনসাফে বেটে নিলো বড় ভাবি?’
‘আমি জানি না আশু। তাছাড়া আমি কোনো কেলেংকারি চাইছিলাম না। ‘

‘আমার বিয়েতে তোমার খাওয়া হবে না অথচ কেউ-ই কাজ করাতে ভুলেনি। আমি শুধু এটাই ভেবে পাই না এঁরা আমার ফ্যামিলি হলো কিভাবে? এই পরিবারে জন্ম গ্রহন করেছি ভাবলেই কেমন গা ঘিনঘিন করে।’
‘উফ আশফি চুপ কর। পুরো বাড়িতে মানুষ গিজগিজ করছে। কেউ শুনলে কি ভাববে?’
‘তুই এখনো এতো ভাবছিস আমাকে নিয়ে?’

‘তোকে নিয়ে ভাববো না তো কাকে নিয়ে ভাববো আশু? তুই তো আমার সব কিছু! আমার সুখ, দুঃখের সাথী!’
আশফিকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলো তুলিকা। চোখ মুছে আশফিও তাকে জড়িয়ে ধরে। আর মনে মনে ভাবে,’একদিন তোর সব কষ্ট দূর হবে দেখিস! যে আমার চেয়েও তোকে বেশি আগলে রাখবে। দুঃখের পরই তো সুখ আসে!’

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ২