অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ১৭

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ১৭
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

মাহমুদের একরোখা মনোভাবে বাঁধা সৃষ্টি করলো ভাইয়া। বিচক্ষণ মানুষ গম্ভীর স্বরে বললেন,
-“এখনই আমাদের যাওয়া ঠিক হবেনা। গতকাল মা যেহেতু গিয়েছেন, আমাদের একটু সময় নেওয়া উচিত। এখন গেলে তরীর বাবা উত্তেজিত হয়ে যেতে পারেন।”
মাহমুদের চোখেমুখে দুশ্চিন্তা। দু’হাতে মুখ চেপে ধরে শুধালো,
-“তাহলে করণীয় কী?”
ইরা বলল,

-“এখনই যেহেতু তরীকে তার পরিবার বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে না। আমার মনে হয় এখন চুপ থাকা উচিত। কিছুদিন পর নাহয় ঠান্ডামাথায় আরেকবার প্রস্তাব রাখা যাবে।”
মাহমুদ স্বস্তি পেলো না। ভাই-ভাবির কথাও ভেবে দেখলো। এখন যাওয়াটা উচিত হবেনা।
এখন আর চাইলেও তরীকে সামনে পাওয়া যাবেনা। ওর বাবা-মা নিশ্চয়ই এখন আর তাদের বাসায় আসতে দেবেনা। কপাল চেপে ধরলো দু-হাতে। ঝিমঝিম করে উঠলো মাথা।
সকালে ভাইয়ার অফিস থাকায় দ্রুত রাতের খাবার খেয়েই বেরিয়ে পড়লো তারা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শান্ত, স্নিগ্ধতার প্রতীক হয়ে আসে শরৎ। যৌবনে হেসেখেলে আবেদনময়ী করে তোলে নিজেকে। সদ্য প্রেমে পড়া প্রেমিকের মতো মুগ্ধ হয় মানুষ। শিশিরভেজা শিউলি লুটিয়ে পড়ে দূর্বাঘাসের বুকে। ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে শরৎ এর এই অনুপম সৌন্দর্যে বিভোর মাহমুদ তরীকে তুলনা করলো শিশিরভেজা শিউলির সাথে। সে দূর্বাঘাস। তার সৌভাগ্য বলে কোমল সুগন্ধি ফুল তার বুকে লুটিয়ে পড়বে কোন একসময়।

মেয়েটা তখন কতখানি লজ্জা পাবে ভেবেই হাসলো মাহমুদ। ভাবতে ভাবতেই হাতের কফি ঠান্ডা হয়ে এলো। ঘরে ফিরে ঠান্ডা কফি রেখে দিল। কলেজের জন্য বের হতেই সিঁড়িতে চোখাচোখি হয়ে গেল তরীর বাবার সাথে। মাহমুদ সচারাচর দেখা হলেই সালাম দেয়। আজও তার ব্যতিক্রম হলোনা। তরীর বাবা সালামের জবাব দিয়ে পাশ কাটিয়ে উপরে উঠে গেলেন। ভালো-মন্দ কিছু বললেন না। মাহমুদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নেমে পড়লো। আজকাল একা একাই কলেজ যেতে হয়। তরীর দেখা পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠেছে। তার দেখা পাওয়া মানে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া।

ক্লাস শেষ দিয়ে ক্লান্ত মাহমুদ ঘন্টার পথ পাড়ি দিলো। বাস জার্নি করে দাঁড়ালো তরীর ক্যাম্পাসের সামনে। রোদের তেজ ম্লান হয়ে এলেও গরম পড়ছে খুব। শার্টের টপ বোতাম দুটো খোলা। ক্লান্তি এসে ভর করেছে চোখ দুটোতে। পুরো ক্যাম্পাস ফাঁকা হয়ে গেল। তরীর দেখা পাওয়া গেল না। মাহমুদের শিথিল কপালে ঢেউ বয়ে গেল। পকেট হাতড়ে মুঠোফোন বের করে চাপলো তরীর নম্বরে। রিং হতে হতে শেষ মুহূর্তে ফোন ওঠালো তরী। নিস্তেজ কন্ঠে বলল,

-“হ্যালো।”
মাহমুদের সমস্ত গ্লানি নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। শীতল বাতাস শরীর ছুঁয়ে দিলো যেন। থেমে থেমে মোলায়েম কন্ঠে শুধালো,
-“কোথায় আপনি, তরী?”
তরী চুপ করে রইলো খানিকক্ষণ। শোনা গেল শ্বাস-প্রশ্বাসের নমনীয় শব্দ। সাড়া না পেয়ে মাহমুদ ফের বলল,

-“ক্যাম্পাসে দেখছি না কেন আপনাকে?”
এতক্ষণে তরীর মৃদু স্বর ভেসে এলো,
-“আজ ক্লাস এটেন্ড করিনি।”
-“আমি ক্যাম্পাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”
তরীর উৎকণ্ঠা টের পেলো মাহমুদ।
-“আপনি আমাকে না জানিয়ে কষ্ট করে কেন গেলেন?”
মাহমুদ তরীর অস্থিরতায় হাসলো।
কাতর গলায় শুধালো,
-“আমি ভীষণ ক্লান্ত, তরী। একটু দেখা দেবেন?”

তরী কিছু বললনা। খট করেই লাইন কে*টে দিল। মাহমুদ ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে রইলো অনেকক্ষণ। ফোন পকেটে ঢুকানোর কোন তাড়া নেই। কিছু একটার অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে চেয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরই তরীর নম্বর স্ক্রিনে ভেসে উঠলো। ঠোঁটের কোন চওড়া হলো মাহমুদের। যেন সে জানতো তরী দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে ঠিকই তাকে কল দেবে। এক ঝলক দেখা দিয়ে তৃষ্ণা মেটাবে। রিসিভ করতেই তরীর শুভ্র মুখশ্রী ভেসে উঠলো। গভীর চোখজোড়া তাকেই দেখছে। খানিকটা দ্বিধা, খানিকটা লজ্জার মিশেলে মোহনীয় রূপ সৃষ্টি হলো। মাহমুদ বিভোর নয়নে চাইলো। তরীর চিকন ঠোঁট জোড়া নড়েচড়ে উঠলো,

-“ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে। দুপুরে খেয়েছেন?”
তরীর এই যত্ন টুকু ভীষণ আদুরে আদুরে ঠেকলো মাহমুদের কাছে। সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে একটুখানি সতেজ বাতাস ছুঁয়ে দিলো শরীরের প্রতিটি লোমকূপ। নিজেকে কেমন সুখী সুখী মনে হলো। ছোটো স্বরে জবাব দিলো,
-“নাহ্, কলেজ থেকে আপনার ক্যাম্পাসে চলে এসেছি।”

তরীর ভীষণ দুঃখ দুঃখ লাগলো। কাতর চোখজোড়া টলমল করে উঠলো। মাহমুদ হাসলো। নিস্তেজ গলায় বলল,
-“এতটা মায়া দেখাবেন না, তরী। আমি যে আর দূরে থাকতে পারবোনা।”
তরীর এলোমেলো চোখজোড়া কিছু বলতে চাইছে। সময় নিয়ে অধিকার খাটিয়ে বলল,
-“তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরুন। এভাবে না খেয়ে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন।”

মাহমুদ বাধ্য ছেলের মতো মাথা ঝাঁকাল। প্রফুল্লচিত্তে লাইন ডিসকানেক্ট করে পকেটে ঢুকালো। বাস ধরলো। বাস কন্ট্রাক্টরের হাঁকডাঁকের বিরক্তিও আজ তাকে ছুঁতে পারলোনা। জানালায় উঁকি দিয়ে আকাশে তাকালো। রাশি রাশি শুভ্র মেঘ পেঁজা তুলোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। মাহমুদ বাসের সিটে হেলান দিয়ে চোখের পাতা এক করে নিলো। চোখজুড়ে তরী, শুধুই তরী।

ছোট্ট অরু ড্যাবড্যাব করে তরীকে দেখছে। তরীর নজরে পড়লো অনেকক্ষণ ধরেই অরু তাকে দেখছে। সে ভুরু উঁচিয়ে শুধালো,
-“কী?”
অরু ভাবুক হয়ে বলল,
-“তোমার কি বিয়ে হয়ে যাবে?”
-“কে বলল তোকে?”
-“আমি জানি। তোমার বিয়েতে আমি কিন্তু নাচবো। অনেক আনন্দ করবো।”
তরী বলল,

-“বিয়ে হলে তো আমি শশুর বাড়ি চলে যাবো। তখন কী করবি?”
অরু কোমরে একহাত রেখে হাত নাড়িয়ে বলল,
-“ওমা তুমি তো আবার আসবেই!”
ছোট্ট অরু বুঝলোনা বিয়ে মানে কী। শুধু বুঝলো আপুর বিয়ে হলে সে খুব আনন্দ করতে পারবে।
তরী বলল,
-“এখন চল ঘুম পাড়িয়ে দিই।”

অরু বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। তরী হাত বুলিয়ে দিলো তার মাথায়। বেশিক্ষণ লাগলোনা, অরু ঘুমিয়ে পড়লো।
তরীর চোখে ঘুম নেই। ফোন হাতে বসে রইলো। মুঠোফোনে তীব্র শব্দ হতেই ভাবলো মাহমুদ বুঝি তাকে স্মরণ করেছে। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই হাসি হাসি মুখটি ম্লান হয়ে গেল।

“তিয়াস ভাইয়া” নামটা জ্বলজ্বল করে উঠতেই তরী চমকে উঠলো। বুকের ভেতর বিষাক্ত এক যন্ত্রণা হলো। রিসিভ করার ইচ্ছে হলোনা তার। প্রথমবারেই কল কে*টে গেল। দ্বিতীয়বার কল বাজার পর তরীর মনে হলো একবার কথা বলা উচিত। তিয়াস ভাইয়াকে সে বিয়ে করতে পারবেনা ব্যাপারটা খুলে বলতে পারলে হয়তো তিনি বুঝবেন। লম্বা শ্বাস নিলো তরী। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে কল রিসিভ করলো।
ভেসে এলো পুরুষালি স্বর। কোমল হয়ে শুধালো,

-“ কেমন আছো তরী?”
তরী ওই কোমল স্বরে কোন অনুভূতি খুঁজে পেল না। তার সমস্ত আবেগ, প্রেম ওই একজনের জন্যই। তরী স্বাভাবিক গলায় জবাব দিলো,
-“ভালো।”
-“আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করবে না?”

তরী তিয়াসের প্রশ্নের জবাব দিলোনা। মেজাজ খা*রা*প হলো তার। কন্ঠের ভিত মজবুত রেখে প্রশ্ন ছুঁড়লো।
-“তুমি আমায় তুমি করে কেন ডাকছো, ভাইয়া?”
তিয়াস বোধহয় একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেল। নিজেকে সামলাতে তার খনািক সময় লাগলো। বলল,
-“এখন কি আর তুমি ছোটো আছো? বড়ো হয়েছো না?”
তরীর রাগ ধীরে ধীরে বাড়লো। চোখমুখ শক্ত করে বলল,
-“বড়ো হই আর ছোটো। তুমি আমায় তুই করেই ডাকতে। ছোটোবেলায় বোনের মতো কোলেপিঠে চড়িয়েছো। নিশি আপু তো আমার বড়ো, তাহলে তাকে কেন তুমি ডাকছো না?”

-“নিশি আর তুমি কি এক হলে?”
-“কেন নয়?”
-“তুমি কি বুঝতে পারছোনা, তরী?”
তরী কন্ঠস্বর উঁচু করলো,
-“কী বুঝবো আমি? আমি জানি তুমি আমার বড়োভাই। ব্যস, এই সুন্দর সম্পর্কে কেন অন্য সম্পর্ক টা*ন*ছো? তোমায় নিয়ে অন্যকিছু ভাবতে আমার লজ্জা হয় বিশ্বাস করো।”
-“সময়ের ব্যাপার তরী। সবটা ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।”

তিয়াস হয়তো ভাবছে তরী লজ্জা পাচ্ছে। অথচ এটা বুঝলোনা তরীর মন তাকে ঠাঁই দিতে নারাজ।
খট করে লাইন কে*টে ফোন সুইচ অফ করে রাখলো তরী। ঝিম মে*রে শুয়ে রইলো। পাগল হয়ে যাচ্ছে সে।
মাহমুদ ফোনে ট্রাই করলো তরীকে। ফোন সুইচ অফ বলছে। চিন্তা হলো তার। একবার ছাদে গিয়ে দাঁড়ালো। খোলা হাওয়ায় গা ভাসিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তরীকে আবারও ট্রাই করলো। বারবার সুইচ অফ দেখাচ্ছে। মাহমুদের মন উতলা হয়ে উঠলো। তরী যদি তার হয়ে যেতো, তবে বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখতো তাকে। চাইলেই যে সবটা সম্ভব হয়না।
কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে নেমে পড়লো সে।

দ্বাদশ শ্রেণির ইংরেজির ক্লাস নিয়ে বের হলো মাহমুদ। ফোনের স্ক্রিনে তরীর বার্তা। চোখ রাখলো মাহমুদ। বৃদ্ধাঙ্গুলি ছুঁয়ে দিতেই বার্তাটি স্পষ্ট হয়ে ধরা দিলো।
❝আমার ভার্সিটির পাশের কফিশপে আসতে পারবেন? আমি ক্লাস শেষে অপেক্ষা করবো।❞
তরী তাকে ডেকেছে! দিন দিন তরীর এই পরিবর্তন মাহমুদকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। বুঁদ হয়ে থাকতে চায় তার ডিঙি নৌকার মাঝে। মাহমুদ তরীর স্বাভাবিক কথাতেও কেমন ভালোবাসা খুঁজে পায়। সে হাসে, কারণে-অকারণে।

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ১৬

(লেইট করে গল্প দিচ্ছেন কেন? পর্ব এত ছোটো কেন?
আমি এখনো পুরোপুরি সুস্থ হইনি। কড়া ডোজের ঔষধ নেওয়ায় ক্লান্তি বাড়ছে, শুধু ঘুম পাচ্ছে।)

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ১৮