অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ১৬

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ১৬
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

থমথমে পরিবেশ। গুমোট, নিস্তব্ধতা ভেতরের অস্থিরতা বাড়িয়ে তুলছে। আয়েশা সুলতানা উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছেন। দরজার মোটা পর্দার আড়ালে এক-জোড়া পা দেখা যাচ্ছে। ভেতর ঘরে তুমুল অস্থিরতা। টানটান উত্তেজনা কাজ করছে। বাবার একটা হ্যাঁ, না তে তার জীবনের অনেক কিছু পাল্টে যাবে। হয়তো সুন্দর গোছানো একটি জীবনে পদার্পণ করবে নয়তো সবটা ওলটপালট হয়ে যাবে। তরী মনে মনে শতবার বিধ্বস্ত হলো। খুব করে চাইলো তার জীবনের জোড়াটা শক্তভাবে লেগে থাকুক মাহমুদের সাথে।

নিস্তব্ধতার বুক ছিঁড়ে রুক্ষ স্বর শোনা গেল। মরুভূমির মতো খা খা করে উঠলো অন্তঃকরণ।
বাবা গম্ভীর স্বরে আয়েশা সুলতানার উদ্দেশ্যে বললেন,
-“দুঃখিত! আপনাকে খুশি করতে পারছিনা। আমি আপাতত মেয়ের বিয়ে নিয়ে কিছু ভাবছিনা।”
আয়েশা সুলতানা খানিকটা চুপ রইলেন। নিরব হয়ে ধাতস্থ করলেন নিজেকে। শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিলেন। বললেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“এখন বিয়ে দিতে না চাইলে না দেবেন। এতে আমাদেরও খুব একটা আপত্তি নেই। আপনারা রাজি থাকলে আপাতত আংটি পরিয়ে রাখা যায়।”
তরীর মা সরাসরি কিছু বলছেন না। তবে চোখের দৃষ্টি বলে দিচ্ছে ‘তরীর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, সেটা আপনি জেনেও কীভাবে প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন?’
যদিও তরীর মা মুখ ফোটে কিছুই বললেন না, তবুও আয়েশা সুলতানার অস্বস্তি বাড়লো। লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজে পেলেন না।

তরীর বাবাকে ক্রমশ গম্ভীর দেখালো। কাঠখোট্টা স্বভাবের মানুষটি নিজের গাম্ভীর্যতা বজায় রেখেই বললেন,
-“আমি আমার বড়ো ভাইকে কথা দিয়ে রেখেছি। কথা বরখেলাপ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার ভাতিজা দেশে ফিরলেই বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে যাবে।”

আয়েশা সুলতানা আর কথা খুঁজে পেলেন না। এই মুহূর্তে কথা বলা মানে নিজের অসম্মান ডেকে আনা। উঠে পড়লেন তিনি। রামির মুখ ফ্যাকশে দেখালো। তরী আপুকে তার ভীষণ পছন্দ। অন্য কোথাও বিয়ে হবে শুনেই কেমন বুক জ্বালা করছে।
পর্দার আড়ালের পা জোড়া থেমে গেল। তর্জন-গর্জন করে বর্জ্রপাত হলো। বিদ্যুৎ চমকানোর মতো শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো তরীর। তার বিয়ে ঠিক, অথচ সে অবগত নয়। তাও আবার যাকে সারাজীবন বড়োভাই মেনে এসেছে, তাকে কিভাবে স্বামীর আসনে বসাবে?

আকাশ-পাতাল এক হয়ে গেল যেন। বিষন্নতার ভীড় ঠে*লে বাড়লো রাগের মাত্রা। টানা চোখ দুটো কানায় কানায় জলে ভর্তি। টুপটাপ বৃষ্টি ফোঁটার মতো ঝরে গেল সমস্ত আশা, আকাঙ্ক্ষা। মাথার ভেতর একদলা ভোতা অনুভূতির সঞ্চার হলো। প্রচন্ড রাগে চিড়বিড়িয়ে উঠলো মন। বাধ্য সন্তানের ট্যাগ লাগানো তরী পারলোনা বাবা-মায়ের মুখের উপর চিৎকার, চেঁচামেচি করতে। কেবল টুপ করে ভোরের ফুলের মতো ঝরে গিয়ে মিইয়ে গেল। তার জীবনের রঙিন অধ্যায় হারিয়ে সাদা-কালো অধ্যায় পাতা খুলে বসলো। ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে খিল পড়লো ভেতর থেকে। আঁটকে রাখা জলকণার ভারিবর্ষণ হলো।

তরী কাঁদছে। শব্দহীন নিরব কান্না। টকটকে লাল চোখ দুটো তার অপ্রকাশিত ভালোবাসার সাক্ষী। সে তো জীবনে প্রেম চায়নি। আর না মাহমুদকে প্রথম দেখায় মুগ্ধ হয়েছে। তার প্রেমে কোন নিমন্ত্রণ ছিলোনা। একেবারে উড়ে এসে জুড়ে বসা প্রেম। তবুও এত গভীরতা, মায়া, কেন? এই কেন এর উত্তর তরী খুঁজে পেলোনা। শুধু বুঝতে পারলো এই প্রেম তার জীবন-মরণের প্রেম।

পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া প্রেম। তার কষ্ট বুঝি কেউ উপলব্ধি করতে পারবেনা! বাবা-মাকে ও ছাড়তে পারবেনা আর না তাকে বশীকরণ করা ওই মানবকে। কেন এলো তার জীবনে? তাকে এভাবে দগ্ধ করা খুব কি প্রয়োজন ছিল? ফোন বেজে চলেছে তুমুল শব্দে। তরী ধরলোনা। অবহেলায় পড়ে থাকা মুঠোফোন বারবার শব্দ করে অতিষ্ঠ করে তুলছে তাকে। তরী এখন ফোন রিসিভ করলেই কিছু একটা অঘটন ঘটে যাবে। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলবে। এতটাও ছোট হতে চায়না সে।

মায়ের কাছে রিফিউজ হওয়ার কথা শোনার পর থেকেই প্রচন্ড মেজাজ খা*রা*প হয়ে আছে মাহমুদের। এই মুহূর্তে তরীকে খুব প্রয়োজন। মাহমুদ জানে তাকে কাছে পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। তবুও ফোনে একটুখানি প্রশান্তি খুঁজলো। অথচ মেয়েটা লাপাত্তা। তাকে ভয়*ঙ্কর যন্ত্রণায় ফেলে নিশ্চিন্তে পড়ে আছে। মাহমুদ আবারও কল দিলো। বরাবরের মতো এবারও সাড়া নেই। মাথা ধরেছে ভীষণ। মা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি আর দ্বিতীয়বার তরীদের বাসায় সমন্ধ নিয়ে যেতে পারবেন না। টিশার্ট ছাড়িয়ে ফ্যানের নিচে বসে রইলো মাহমুদ। মাথার ভেতর এখনো ধপধপ করে উঠছে।

রাতে এক আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটলো। লজ্জাবতী তরীর নম্বর থেকে কল এলো। মাহমুদ পলকহীন কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো ফোনের স্ক্রিনে। ভীষণ চেনা এই নম্বর তাকে খানিক স্তব্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। মাহমুদ ধীরে সুস্থে ফোন রিসিভ করলো। কানের পাশে শক্ত করে ধরলো মুঠোফোন। ওপাশ থেকেও নিরবতা। মাহমুদ স্তব্ধতাকে বিদায় জানিয়ে শব্দ তুললো,

-“তরী!”
ওপাশ থেকে ফুঁপিয়ে ওঠার শব্দ শোনা গেল। তরী কাঁদছে। বিচলিত হলো মাহমুদ। কন্ঠে উৎকন্ঠা ঝরে পড়লো,
-“কাঁদছেন কেন, তরী? সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছো তো!”
তরী ফুঁপিয়ে উঠে চাপা গলায় বলল,
-“কিচ্ছু ঠিক হবে না। বাবা মানবে না।”

-“আমি কি আপনাকে এমনি এমনি বোকা বলি, তরী? আপনি সত্যিই বোকা। অল্পতে ভেঙে পড়লে চলবে? আমরা মানাবো আপনার বাবাকে। কোন না কোন পথ নিশ্চয়ই আছে। আপনি একদমই কাঁদবেন না।”
-“আপনি বাবাকে জানেন না। বাবা একরোখা। নিজের সিদ্ধান্তের উপর কারো মতামত টুকুও পছন্দ নয় উনার।”
-“চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?”

অতঃপর স্বর কোমল হয়ে এলো মাহমুদের। কঠিন আবেগ নিয়ে শুধালো,
-“তরী, আপনাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। ভিডিওতে আসবেন?”
তরী এমনিতেও ভিডিও কলে ভীষণ লজ্জা পায়। তার ওপর আয়নায় তাকিয়ে দেখলো নিজের এলোমেলো অবস্থা। চোখমুখ ফুলে বি*শ্রী অবস্থা। জবাব না পেয়ে মাহমুদ আবারও বলল,
-“কী এত ভাবছেন, তরী? আপনাকে সবরকম ভাবেই আমার চোখে স্নিগ্ধ লাগে। প্লিজ আসুন না, তরী!”
তরী দ্বিধা ভরা গলায় জবাব দিলো,

-“আচ্ছা।”
মাহমুদ খট করেই লাইন কে*টে দিলো। তরী এক ছুটে ওয়াশরুম থেকে চোখেমুখে পানি দিয়ে এলো। মাহমুদ ভিডিও কল দিয়ে বসেছে। হাজারো অস্বস্তি নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে রিসিভ করে ফোন সামনে ধরলো তরী। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠলে উসকোখুসকো, মলিন চেহারা। তবে ঠোঁটের কোনে ঠাঁই পেলো নিটোল হাসি। মুহুর্তের জন্য তরীর সংকোচ দূর হয়ে গেল। ফোলা ফোলা চোখজোড়া ফোনের স্ক্রিনে নিবদ্ধ। ঘোর লাগলো তরীর। এত সুন্দর মানুষ হয়? তরীর চোখ বলছে তার দেখা সেরা রূপবান এই লোক। অনিমিখ তাকিয়ে রইলো ক্লান্তিমাখা চেহারায়। মাহমুদ চুপটি করে তাকিয়ে দেখলো তার তরীর চোখের মুগ্ধতা, ভাসা ভাসা চোখজোড়া। চমৎকার হেসে উঠলো সে। রগঢ় করে শুধালো,

-“এমনভাবে কী দেখছেন, তরী?”
তরী ভড়কালো। লজ্জায় জবুথবু হয়ে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল,
-“কিছু না।”
মাহমুদের অনুরাগী স্বর,
-“আমি অনেককিছু দেখছি, তরী। এক টুকরো স্নিগ্ধ ভোর, বিলের জলে ফোটে ওঠা রঙিন পদ্ম।
আপনার দু-অক্ষরের ছোট্ট নামটি আমার পাশে চাই তরী। আপনি কেবল আমার তরী হবেন। আপনার হাতটি ধরার সুযোগ দেবেন আমায়?”

তরী কথা খুঁজে পেলোনা। সুখ সুখ যন্ত্রণায় বুকটা ধক করে উঠলো। একটু আগের বিরহ যেন তাকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল বহুদূর। সমস্ত দুঃখ-কষ্ট ভুলে বসলো এক মুহুর্তের জন্য। তরী আবেগে ভেসে উঠলো,
-“আমি শুধু আপনার হতে চাই। আপনি ছাড়া আর কারো নয়।”
মাহমুদের চোখ ঝলমল করে উঠলো। প্রশান্তিতে ভরে উঠলো মন। প্রফুল্লচিত্তে হেসে উঠলো। ফিসফিস ধ্বনিতে আওড়ালো,
-“আপনি শুধু আমার, তরী।”

টুপ করেই কল কে*টে গেল। দ্বিতীয়বার কল ব্যাক করার পরও ধরলোনা তরী। মাহমুদ ধরে নিলো হয়তো লজ্জা পেয়েছে নয়তো ঘরে কেউ এসেছে।
তরী ঠিক থাকলে সে সবরকম যুদ্ধে নামতে রাজি।
আজ একবার ভাইয়ার নম্বরে ডায়াল করলো।
-“কিরে কেমন আছিস?”
মাহমুদ শান্ত স্বরে জবাব দিলো,

-“হুম ভালো। তোমরা দুজন কেমন আছো?”
-“আলহামদুলিল্লাহ তোর ভাবি, আমি ভালোই আছি।”
মাহমুদ ঠোঁটে ঠোঁট চাপলো। সময় নিয়ে নিচু স্বরে শুধালো,
-“কাল একবার তোমরা দুজন আসতে পারবে?”
-“কেন? জরুরি কিছু?”
-“হ্যাঁ, তোমাদের প্রয়োজন।”
-“অফিসের পর আসলে চলবে?”
-“এসো সময় করে।”
-“ঠিক আছে।”

ভাইয়ার সাথে কথা শেষ করে রামির ঘরে একবার উঁকি দিলো মাহমুদ। ছেলেটা পড়তে চায়না মোটেই। এখনো পড়ার টেবিলে উদাস হয়ে বসে আছে। কী যেন ভেবে চলেছে! মাহমুদ নিঃশব্দে পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। মাথায় দু’আঙ্গুলে টোকা দিয়ে বলল,

-“পড়া বাদ দিয়ে কী এত ভাবছিস?”
রামির কপালে চিকন দু-একটা ভাঁজ পড়লো। চিন্তিত স্বরে বলল,
-“আচ্ছা ভাইয়া, তরী আপুকে কিডন্যাপ করলে কেমন হয়? তখন দেখা যাবে আঙ্কেল মেয়ে হারানোর শো*কে রাজি হয়ে যেতে পারে।”
মাহমুদ বলল,

-“ পড়া বাদ দিয়ে এসব ভাবছিস? তোর দুষ্টু বুদ্ধি নিজের মাথায় রাখ। খবরদার আমাদের উপর এপ্লাই করতে আসবিনা। কিডন্যাপ করলে দেখা যাবে তরীর বাবা আমাদের দিয়ে জে*লে*র ঘানি টা*না*চ্ছে*ন!”
রামি ভাবুক হয়ে বলল,
-“তাহলে কী করা যায়?
আমি তরী আপুকে চাই মানে চাই। দরকার পড়লে তাদের দরজায় গিয়ে অনশন ধর্মঘট ঘোষণা করবো।”
বিরক্ত হয়ে তাকালো মাহমুদ।

-“অনশনে তুই ম*র*বি। তাতে তরীর বাবার কী?
তারচেয়ে বরং মন দিয়ে পড়াশোনা কর। এটা কাজে দেবে।”
রামি চোখমুখ কুঁচকে বলল,
-“পড়াশোনা আমার মোটেই ভালোলাগে না। কোন বাসায় কাজের লোক হিসেবে আমাকে রাখবে কি-না খোঁজ নিয়ে দেখো।”
মাহমুদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কথা বাড়াতে চাইলোনা। এক্ষুণি এখান থেকে যাওয়া উচিত। নয়তো কথা বলেই ছেলেটা সারারাত পার করে দেবে। লম্বা কদমে রামির ঘর ছাড়লো মাহমুদ।

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ১৫

সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই সময়। বড়োভাই আর ভাবি এসে উপস্থিত। সন্ধ্যার চায়ের আড্ডা বসলো মাহমুদের ঘরে। মা ছাড়া তারা বাকি চারজন উপস্থিত। মাহমুদ তরীর ব্যাপারে কথা তুললো। তাদের সম্পর্কের কথা গোপন রেখে জানালো সে তরীকে পছন্দ করে। এতে তরীর উপর চা*প কম আসবে। মা যেতে চাচ্ছেন না। মাহমুদ চায় এবার সরাসরি সে যাবে, সাথে ভাই-ভাবি। একটা হেস্তনেস্ত সিদ্ধান্ত হবে। তরীকে যে তার বড্ড প্রয়োজন।

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ১৭