অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ১৮

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ১৮
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

শরৎ এর কোমল, স্নিগ্ধ বিকেলে আকাশে কালো মেঘ জমলো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি প্রেমময় অনুভূতির বার্তা পাঠালো। মাহমুদের সামনে সাদা জামায় আচ্ছাদিত এক লাজুক রমণী। লজ্জায় হেলেদুলে পড়া রমণীকে মুহূর্তেই কাশফুল মনে হলো। যে মৃদু বাতাসে নিপুণ তালে হেলেদুলে নেচে ওঠে। কাশফুল শুভ্রতার প্রতীক।

তরীও ঠিক শুভ্রতায় মোড়ালো নিজেকে। আঁটসাঁট করে বাঁধা চুলগুলো খানিকটা ঢিলে হয়ে কানের পাশ গড়িয়ে বেরিয়ে এলো। তরী হাত বাড়িয়ে সেগুলো কানের পাশে গুঁজে নিলো। সামনেই মাহমুদ তাকে দেখে চলেছে। অথচ সে মাহমুদকে ডেকে আনার যথাযথ কারণটি বলতে পারছেনা। তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকা মাহমুদ কোন তাড়া দেখালোনা। তরী ঠোঁট ভেজালো। নিজেকে ধাতস্থ করে শক্ত গলায় বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“কাল তিয়াস ভাইয়া কল দিয়েছেন।”
মাহমুদের দৃষ্টি নড়ে উঠলো। ভুরু উঁচিয়ে শুধালো,
-“তিয়াস কে?”
তরী শান্ত চোখে তাকালো মাহমুদের চোখে। হুট করেই কেমন তার সাহস বেড়ে গেল৷ আজকাল মাহমুদকে দেখলেই তার অস্বস্তি হয়না। তবে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়। আজ তেমন কিছুই ঘটছেনা। স্বাভাবিক গলায় জবাব দিলো,

-“বাবা যার সাথে বিয়ে ঠিক করেছেন! মানে আমার কাজিন।”
মাহমুদের চোয়ালে কঠিন হয়ে উঠলো। কপালের পাশ ঘেঁষে নীল রঙা রগগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। শান্ত, শক্ত গলায় প্রশ্ন করলো,
-“কী বলেছে?”
-“তুই থেকে তুমিতে নেমে এসেছে।”

শান্ত মাহমুদ রা*গ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় নামলো। চোখ বুজে হেলান দিয়ে বসলো। মিনিট দুয়েক পার হতেই ধপ করে চোখের পাতা খুলে বসলো। একেবারে শান্ত, যেন কিছুই হয়নি। মাহমুদ বলল,
-“কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
তরীর রা*গ হলো। মানুষটা কিভাবে এতটা শান্ত আছে! তার কী রাগ বলতে কিছুই নেই? ফোঁস করেই নিশ্বাস ছাড়লো। মাহমুদকে আর কিছুই বলার প্রয়োজন মনে করলোনা। কফি প্রায় ঠান্ডা হয়ে এসেছে। তরী ঢকঢক করে গিলে নিলো। মাহমুদ শান্তভাবে তাকিয়ে আছে। তাকে কিছু না বলেই তরী হনহনিয়ে বেরিয়ে পড়লো কফিশপ থেকে। মাহমুদ পিছুপিছু গেলোনা। বসে রইলো আরও ঘন্টাখানেক।

বেলা গড়াবার সাথে সাথে দূর দিগন্তে সূর্য ডুবি ডুবি। নীল আকাশে সাদা-কালো মেঘের ভেলায় ঝুপ করেই ছড়ালো লালিমা আস্তরণ। এগিয়ে এলো সন্ধ্যা। ঘন হলো অন্ধকার। মাগরিবের নামাজ আদায় করে মসজিদ থেকে বের হলেন তরীর বাবা। পাশাপাশি এগিয়ে এল মাহমুদ। সালাম বিনিময় করে ভালোমন্দ খোঁজ নিলো।
তরীর বাবা তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন। রাশভারি গলায় বললেন,

-“কিছু বলতে চাও? তরীর ব্যাপারে হলে আমি শুনতে চাইছিনা।”
মাহমুদ দুর্বোধ্য হাসলো। পথটা সুন্দরভাবে পরিষ্কার হয়ে গেল। তাকে কোন ছুতা খুঁজতে হলোনা। তরীর বাবা নিজেই তরীর কথা তুললেন। মাহমুদ নম্র ভাবে জিজ্ঞেস করলো,
-“তরীর নাকি বিয়ে ঠিক?”
-“হ্যাঁ, শোনোনি তোমার মায়ের কাছে?”
মাহমুদ মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দিলো,
-“জি শুনেছি।”
অতঃপর প্রশ্ন করলো,
-“তরী কি বিয়েতে রাজি?”

তরীর বাবার এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা বিরক্তি এবার রা*গে পরিণত হলো। রাগত স্বরে বললেন,
-“সে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। তরী আমার মেয়ে। ওকে চিনি আমি। আমার উপর কখনো কথা বলবে না আমার মেয়ে।”
মাহমুদ হালকা হাসলো। তরীর বাবা জ্বলে উঠলেন।
-“হাসছো কেন?”

-“এই যে আপনার কঠিন আত্মবিশ্বাস নিজের প্রতি! যে আত্মবিশ্বাসের বলে সন্তানের উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছেন। একবারও তার মতামত জানার প্রয়োজন মনে করলেন না। আপনি জানেন আপনার মেয়ে কখনো আপনার সিদ্ধান্তের উপর কথা বলবেনা। এটাকে পুঁজি করেই যা ইচ্ছে করতে পারবেন, কিন্তু ভেতর থেকে মেয়েটাকে পড়তে পারবেন না। একসময় নিজের দুঃখগুলো বলার জন্যেও তখন মেয়েটা আপনাদের ভরসা করবে না।”

-“আমি তরীর বাবা। তার জন্য যেকোন সিদ্ধান্ত আমি অনায়াসে নিতে পারি। তাছাড়া তোমার সমস্যা কোথায়, আমি বুঝলাম না।”
-“ভুল কিছু বলে থাকলে ক্ষমা করবেন আঙ্কেল।
তরীকে আমি পছন্দ করি। তাই তার মতামত জানাটা আমার জন্য জরুরি।”
তরীর বাবার মনে হলো এতদিন নম্র-ভদ্র ছেলে বলে যাকে জানতেন, সে এক নি*র্ল*জ্জ ছেলে। কিভাবে মুখের উপর বলে দিলো সে তরীকে পছন্দ করে! বি*স্ফো*রণ ঘটলো যেন!

মাহমুদ মাথানিচু করে আছে। এতটুকু নি*র্ল*জ্জ না হলে যে তরীকে আর পাওয়া হবে না।
তরীর বাবা চোয়াল শক্ত করে বললেন,
-“তুমি কি আমার মেয়ের বিয়েতে বাঁধা দিতে চাইছো?”
-“আমি শুধু তরীর মতামত জানতে চেয়েছি।”
তরীর বাবা তীব্র আ*ক্রো*শে ফেটে পড়লেন। নিজেকে ঠান্ডা রা*খা*র চেষ্টা করে বললেন,

-“তোমার সাথে আমাদের কোন শ*ত্রু*তা নেই। শুধু শুধু ঝা*মে*লা করোনা। দ্রুত অন্য বাসা দেখো।”
লম্বা কদম ফেলে কয়েক ধাপ সিঁড়ি পার করে নিলেন তরীর বাবা। মাহমুদ অলস ভঙ্গিতে ঘরে ফিরলো।
তরীকে শান্তনা দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু পরিস্থিতি যে হাতের বাইরে চলে গিয়েছে। তরীর বাবা নিজ জায়গা থেকে ঠিক। ভাইকে কথা দিয়ে তার খেলাপ করতে পারবেন না তিনি। কিন্তু অন্যদের চোখে উনার একটা ত্রুটি স্পষ্ট। সেটা হলো মেয়ের মতামত না নেওয়া।

মাহমুদ বুঝলো খুব সহজে তরীর বাবা মানবেন না। তবে সেও এত সহজে হাল ছেড়ে দেবে না। অজান্তেই তরী তার হয়ে বসে আছে। মাহমুদের দায়িত্ব তাকে ধরে রাখা। শক্ত বন্ধনে আটকে রাখা।

ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরলো তরী। বাসার পরিবেশ বেশ রমরমা। বড়ো চাচা-চাচি সহ অনেকেই উপস্থিত। তরীকে দেখে চাচি এগিয়ে এলেন। আদুরে স্বরে আফসোস করলেন,
-“আমার মেয়েটাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। দেখো ঘামে ভিজে কী অবস্থা!”
তরী সালাম দিয়ে পাশ কাটিয়ে গেল। অন্য সময় হলে চাচির এই আদরটুকু সে অনায়াসে লুফে নিতো। এখন কেমন যেন স্বা*র্থ মনে হয় সবকিছু।
গোসল সেরে বসতেই মিঠু হুড়মুড়িয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। তরী ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,

-“কী হয়েছে?”
মিঠু একবার পেছনে দরজার দিকে তাকালো। দরজা ভিড়িয়ে সাবধানে এসে দাঁড়ালো তরীর পাশে। সরল চোখে তাকিয়ে বলল,
-“তুমি কিছু বলবে না?”
তরীর বোধগম্য হলো না মিঠুর কথা। জিজ্ঞেস করলো,
-“কী বলবো?”
-“তুমি কি সত্যিই তিয়াস ভাইয়াকে বিয়ে করে নিবে? তাহলে মাহমুদ ভাইয়া?”

তরী আৎকে উঠলো। মিঠু কি মাহমুদের কথা জেনে গিয়েছে? তপ্ত শ্বাস ছেড়ে পাশে বসলো মিঠু। হুট করেই কেমন বড়ো হয়ে গেল ছেলেটা। ভরসার গলায় বলল,
-“আমি বাবা-মাকে কিছু বলিনি আপু।”
তরী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
-“কী করবো আমি? বাবা যদি জানে আমিও মাহমুদকে পছন্দ করি, তাহলে আরও আগেই মানবেন না। প্রেম-ভালোবাসার বিয়ে বাবার পছন্দ নয়।”

-“তাই বলে চুপ করে থাকবে? আজ বড়ো চাচা আর চাচি কেন এসেছে জানো?”
তরী প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো। মিঠু বলল,
-“বাবা খবর দিয়ে এনেছেন। আজ না-কি তোমাকে রিং পরিয়ে যাবে।”
তরীর দুনিয়ায় ঘুরে উঠলো। চোখেমুখে বিস্ময়ের সাথে সাথে স্থান নিয়েছে আতঙ্ক।
হঠাৎই মায়ের আগমন।

-“দুজন এখানে কী গল্প জুড়েছিস? তরী একটা নতুন জামা পরে তৈরি হয়ে বাইরে আয়। মিঠু তোকে তোর বাবা ডাকছে।”
মিঠু বেরিয়ে যেতেই মা আলমারি থেকে একটা জামা বের করে দিলেন। তরী এখনো ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মায়ের সাথে জামা পরে বেরিয়ে এল বসার ঘরে। এক এক জনের আদর ভালোবাসা আজ আদিখ্যেতা ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না। চাচি তরীর হাত টে*নে রিং পরিয়ে দিলেন বিনা বাক্যে। তরী স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। সবার দু-একটা কথা কানে বেজে চলেছে। তার মধ্যে চাচি বেশ হেসে হেসেই বললেন,

-“আমাদের তরীটা যে এখনো ছোটোবেলার মতোই লাজুক রয়ে গিয়েছে। তিয়াসের সাথে কথা বলতেও নাকি লজ্জা পায় মেয়েটা। সমস্যা নেই। সামনের সপ্তাহে ফোনে বিয়েটা হয়ে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
তরীর বাবা বললেন,

-“হ্যাঁ আপাতত বিয়েটা হয়ে গেলেই নিশ্চিন্ত। তিয়াসও দেশে ফিরুক আর তরীরও পড়াশোনা শেষ হোক। তখন নতুন করে সব আয়োজন করা যাবে। আজকাল মানুষের বিশ্বাস নেই। তিনতলার ছেলেটা হয়তো ঝা*মে*লা বাঁধাতে পারে!”
তরীর আজ চমকে যাওয়ার দিন। একের পর এক শক সে নিতে পারছেনা। সামনের সপ্তাহে বিয়ে মানে কী?
মাথা ঘুরে উঠলো তার। তরী কেমন অস্থির হয়ে উঠলো। মা ব্যাপারটি খেয়াল করে জিজ্ঞেস করলেন,

-“শরীর খা*রা*প লাগছে?”
তরী হ্যাঁ সূচক মাথা দুলালো। বড়ো চাচা বললেন,
-“মেয়েটা জার্নি করে এসেছে। যাও বিশ্রাম নাও।”

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ১৭

তরী উঠে গেল। সন্ধ্যা নাগাদ সবাই বাসায় ফিরে গেলেন। মিঠু অনেকক্ষণ ধরেই বাসায় নেই। মাহমুদকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। রিং হচ্ছে কিন্তু রেসপন্স নেই। রাতের আঁধারে বেরিয়ে পড়লো তরী। সিঁড়ি ডিঙিয়ে ছাদে উঠলো। বুকের ভেতর হাউমাউ কান্নার শব্দ হলো। বাইরের জগতের কাকপক্ষী ও জানতে পারলোনা। নিরবে চোখের জল গড়ালো। পেছন থেকে শান্ত স্বর শোনা গেল,
-“কাঁদছেন কেন, তরী?”

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ১৯