অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ১৯

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ১৯
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

তরীর কান্না থেমে গেল। পেছন ঘুরে তাকাতেই স্থির পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো এক পুরুষ অবয়ব। মাহমুদ পায়ের গতি বাড়িয়ে দূরত্ব কমালো। চাঁদের নরম আলোয় ক্রন্দনরত তরীর মুখখানা দেখে ম্লান হাসলো। কোন সতেজতা নেই সেই হাসিতে। নিস্তেজ কন্ঠে শুধালো,

-“বললেন না যে! কাঁদছেন কেন, তরী?”
তরী ফুঁপিয়ে উঠলো। মাহমুদ বলল,
-“আপনার বিয়ে হচ্ছে, এটা তো খুশির খবর। হাতে রিং ও পরেছেন। দেখি তো কতটা সুন্দর দেখাচ্ছে আপনার হাত!”
মাহমুদের কন্ঠে স্পষ্ট অভিমান টের পেল তরী। কান্না রোধ করার চেষ্টা করলো। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,
-“আমার কিছু করার ছিলো না।”
মাহমুদ হাসলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“সত্যিই কি কিছু করার ছিলোনা? আপনি নিজের অপছন্দ মা-বাবাকে জানাতে পারতেন, তরী। প্রচন্ড ভীতু আপনি। আপনি আমায় বলুন তো, আপনি ঠিক কী চান?”
তরীর চোখমুখ লাল হয়ে আছে। ফিসফিস গলায় আওড়ালো,
-“আপনাকে চাই।”
-“আপনি ভুল বললেন, তরী। আমাকে চাইলে বাবা-মাকে অন্তত নিজের অপছন্দ জানাতে পারতেন। বলতে পারতেন আপনি তিয়াসকে বিয়ে করতে চান না!”
তরী কান্নায় ভেঙে পড়লো। হেঁচকি তুলে বলল,

-“আমি বাঁধা দিতে গেলেই সমস্যা আরো বেড়ে যেতো। বাবা তখনই বিয়ের ব্যবস্থা করে আমায় ঘর থেকে বের হওয়ার পথ বন্ধ করে দিতেন। এতটুকু পর্যন্ত আসার রাস্তা থাকতো না। আমি চিনি আমার বাবাকে। সেজন্যই তখন আমি কিছু বলিনি। চুপ ছিলাম। আমার বাবা খা*রা*প মানুষ নন। কিন্তু তার একরোখা মনোভাবের জন্যই সবাই তার কাছ থেকে দূরে সরে যান। বাবা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাতেই অটল থাকবেন। ছোটোবেলা থেকেই আমি বাবার সিদ্ধান্তের উপর কথা বলিনি। বাবা এখনো তেমনটা ভেবেই বড়ো চাচ্চুকে কথা দিয়ে ফেলেছেন। তাছাড়া তিনি মনে করেন ভাইকে কথা দিয়ে কথা ফিরিয়ে নেওয়া মানে ভাইকে অপ*মান করা। তিনি ইমেজ ধরে রাখার জন্য আমার মতকে কখনোই গুরুত্ব দেবেন না। তখন রিং পরানোতে বাঁধা দিলে আমি এই মুহুর্তে ছাদে আসতে পারতামনা।”

-“ভালো থাকুন, তরী।”
বলে পেছন দিকে পা বাড়ালো মাহমুদ। তরী ধপ করে নিচে বসে পড়লো।
-“আপনি আমায় কেন বুঝতে চাইছেন না! আমি আপনাকে চাই।”
মাহমুদ সিঁড়ি ঘরে পা রাখতে গিয়েও তরীর কথায় থেমে গেল। কদম বাড়ালো তরীর দিকে। একেবারে নিকটে এসে হাঁটু মুড়ে বসলো। থুতনিতে হাত রেখে তরীর মুখখানি তুলে ধরলো। ভীষণ যত্নে মুছে দিলো চোখের জল। তরী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। থেকে থেকে হেঁচকি তুলছে। মাহমুদ শান্ত স্বরে বলল,

-“আমাকে চাইলে যে সাহসী হতে হবে, তরী। পারবেন আমার হাতটা শক্ত করে ধরতে?”
তরী কান্নামাখা চোখে বারকয়েক উপর নিচ মাথা নাড়ালো। যার অর্থ সে খুব পারবে। মাহমুদ লম্বা শ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ালো তরীকে নিয়ে। চিকন হাতটি নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
-“চলুন।”
তরী অবুঝের মতো প্রশ্ন করলো,

-“কোথায়?”
-” বিয়ে করব আমরা।”
তরীর পা থেমে গেল। বিস্ময়ে হতবাক তরীর মুখ ফোটে শব্দ বের হলোনা। মাহমুদ মলিন হেসে বলল,
-“আজ যদি এই হাত ছেড়ে যান, তবে আর কখনো আমায় পাবেন না তরী।”
তরীর মাথায় বাজ পড়লো। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলো সে। মাহমুদ ফের বলল,
-“নিজের জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নিতে শিখুন, তরী। দেখবেন সবটা সহজ হয়ে যাবে।”
হুট করেই এক শীতল হাওয়ায় ভেসে গেল তরী। কেমন করে যেন তার সাহস বেড়ে গেল। শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো মাহমুদের হাত।

তুষ্ট হলো মাহমুদের হৃদয়। ঠোঁটের কোন জুড়ে মোহনীয় হাসির ঢেউ। তরীর হাতে হাত রেখে সিঁড়ি বেয়ে নামলো। পকেটে হাতড়ে ফোন বের করে কাকে যেন কল দিলো। তরীকে নিয়ে রওনা হলো। গন্তব্য তরীর জানা নেই। সে নির্ভয়ে মাহমুদের সাথে এগিয়ে গেল। কারো সিদ্ধান্তকে পরোয়া করলো না মাহমুদ। ঘড়ির কাঁটা রাত নয়টার ঘরে পৌঁছাতে ঢের বাকি। হুট করেই মনে পড়লো কিছু জিনিস প্রয়োজন। তরীকে ঘরে পাঠালো তার নিবন্ধন কার্ডের জন্য। এক ফাঁকে নিজের কাগজপত্র গুলো নিয়ে বেরিয়ে এলো। ভাগ্যিস মিঠু তাকে সবটা জানিয়েছে।
তরী ভয়ে ভয়ে নিবন্ধন কার্ড লুকিয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসতেই মায়ের সামনে পড়লো।

-“রাতের বেলা কোথায় যাচ্ছিস?”
তরী তোতলানো শুরু করলো,
-“ছা… ছাদে।”
মায়ের ভুরু কুঁচকে গেল। সন্দিহান গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
-“ছাদে কী করতে যাচ্ছিস?”
তরী হুট করেই বলে দিলো,
-“তিয়াস ভাইয়া কল দিয়েছেন। অরু ঘুমাচ্ছে তো, তাই ছাদে যাচ্ছি।”

মায়ের শরীরটা খা*রা*প লাগছে। তিয়াসের কথা বলায় মনে মনে খানিকটা খুশি হলেন। বললেন,
-“বারান্দায় কথা বললেই পারিস। যাচ্ছিস যখন ছাদে বেশিক্ষণ থাকার দরকার নেই। তাড়াতাড়ি চলে আসবি।”
-“আচ্ছা।” বলে তরী বেরিয়ে পড়লো। দরজার বাইরে বেরিয়ে প্রলম্বিত শ্বাস ছাড়লো। এখনো বুক ধড়ফড় করছে। হুট করে তার মাথায় এত বুদ্ধি কোথা থেকে এলো, ভেবে পেলো না। মাহমুদ চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল,
-“কোন সমস্যা হয়েছে?”

তরী মায়ের কথা খুলে বলতেই মাহমুদ তরীকে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লো। সিএনজি নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে যেতেই তরীর ভয় হলো। আবারও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলো। একবার মনে হলো লুকিয়ে এভাবে বিয়ে করা কাজটা ঠিক হচ্ছে না। আবার মনে হলো এভাবে না হলে সে কখনো মাহমুদকে পাবেনা।
তরীর ভয়কাতুরে চেহারায় তাকিয়ে মাহমুদ তার হাতটি শক্ত করে ধরলো। চোখে চোখ রেখে ভরসার গলায় বলল,
-“আমি আছি তো, তরী।”

তরী ভরসা পেলো। নতুন এলাকায় মাহমুদের নতুন কিছু চলার সঙ্গী হলো। তারমধ্যে একজন তার কলিগ। সাক্ষী হিসেবে তারা থাকবে।
বিয়ে পড়ানোর সময় যখন তরীর অনুমতি চাওয়া হলো তখন তরী টলমল চোখে বসে রইলো। বুক কাঁপছে তার, হাত কাঁপছে থরথর করে। তরী কিছুই বলছেনা। মাহমুদের চেহারা মলিন হয়ে এলো। বলল,
-“আপনি না চাইলে আমরা বিয়েটা করবো না, তরী। চলুন আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিই।”

তরী চমকে তাকালো। মাথায় একটা ভাবনাই ঘুরপাক খেলো। এখান থেকে এভাবে ফিরে যাওয়া মানে তিয়াস ভাইয়ার সাথে জুড়ে যাওয়া, মাহমুদকে হারিয়ে ফেলা। তার সাধ্য নেই বিয়েটা আটকানোর। কেউ তার কথা শুনবেনা। তরী হুট করেই সম্মতি দিয়ে বসলো। মাহমুদ অবাক হওয়ার পাশাপাশি প্রশান্তি অনুভব করলো। সুখ সুখ অনুভূতি হলো। সাদামাটা ভাবে বাসার জামা পরেই বিয়েটা হয়ে গেল। সবাইকে বিদায় জানিয়ে তরীকে নিয়ে গাড়ির খোঁজে ফুটপাত ধরে হাঁটলো মাহমুদ। তার ইচ্ছে হলো আজ রাতটা তরীকে নিয়ে শহরের আনাচকানাচে ঘুরবে। কিন্তু এখন বাসায় না গেলে তারীকে বি*প*দে পড়তে হবে। আপাতত পরিস্থিতি ঘোলাটে না করাই ভালো।

তরীর এই মুহূর্তে ভীষণ লজ্জা লাগছে। হুট করে তো বিয়েটা করে নিলো, এখন কিভাবে মাহমুদের চোখে চোখ রাখবে? কিভাবে কথা বলবে ভেবেই অস্থির হয়ে উঠলো। শরীর কেমন অসাড় হয়ে আসছে। মৃদু মৃদু শরীর কাঁপছে। মাহমুদের হাতের মুঠোয় থাকা নরম হাতের কম্পন টের পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো মাহমুদ।

সরাসরি চোখ রাখলো তরীর লজ্জায় আরক্তিম মুখে। মাথা নিচু, চোখের পাপড়ি পলক ঝাপটাবার সাথে সাথে নড়েচড়ে উঠছে। মাহমুদ এক অভাবনীয় কাজ করে বসলো। তরীর হাত ছেড়ে নিজের দুহাতে কোমল গালজোড়া আলতোভাবে স্পর্শ করলো। গভীর চুম্বন করলো তরীর কপালে। তরী শক্ত হয়ে চোখমুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে রইলো। তা দেখে হাসলো মাহমুদ। তাদের পবিত্র স্পর্শের সাক্ষী হলো ল্যামপোস্টের আলো, শাঁ শাঁ গতিতে চলমান গাড়ি, আকাশের চাঁদ।
তরী কাঁপা স্বরে বলল,

-“মা আমার খোঁজ করবেন।”
মাহমুদ তপ্ত শ্বাস ফেলে মাথা ঝাঁকালো। পেলব কন্ঠে শুধালো,
-“আপনি খুশি তো, তরী?”

তরী মুখে জবাব দিলো না। সেদিনের মতো আজও মাহমুদের কনিষ্ঠ আঙুল মুঠোয় পুরে নিলো। ঠোঁটের কোনে লেপ্টে আছে লজ্জালু হাসি। মাহমুদ স্বস্তি পেলো। তরী তার। একান্তই তার। শত বাঁধা আসলেও সে লড়ে যাবে, শুধু তরীকে তার পাশে চাই। মাহমুদ ভাবলো হুট করেই কেমন মেয়েটার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়লো সে। প্রথম প্রথম লজ্জা পাওয়া মেয়েটাকে আরেকটু লজ্জা দিয়ে ভড়কে দিতে দারুণ লাগতো। সেই দারুণ লাগা থেকেই তার বুকে ভয়*ঙ্কর প্রেমনদী তৈরি হলো।
সময়ের অভাবে দুজনের একসাথে আর খাওয়া হলোনা, সময় কাটানো হলোনা। তরীকে চারতলা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে মাহমুদ তিনতলায় নেমে পড়লো। বাবা আর মা এখনো জেগে আছেন। ঘড়ির কাঁটা এগারো এর ঘর পেরিয়েছে। বাবার চোখমুখ শক্ত। গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,

-“কোথায় ছিলে এতক্ষণ?”
তরী ঢোক গিললো। মা যেহেতু পাশে আছে, তারমানে ছাদ চেইক করে এসেছেন। সে তো মাকে ছাদে যাচ্ছে বলেই বেরিয়ে গেল। বাবাকে এখন কী জবাব দেবে?

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ১৮

(অনেকেই জিজ্ঞেস করেছেন আমার শরীর কেমন আছে? আলহামদুলিল্লাহ এখন আগের তুলনায় ভালো আছি। তবে ঘুম হচ্ছে প্রচুর। যখন-তখন ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে যাই।)

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২০