অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২০

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২০
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

বাসার পরিবেশ বেশ থমথমে। বাবার চোয়াল শক্ত, মায়ের চোখেমুখে চিন্তার আভা। ভয়কাতুরে তরীর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো। শুরু হলো কাঁপা-কাঁপি। ভয়ে বুক ধড়ফড় করে উঠছে। কন্ঠ নালি কাঁপছে। কী জবাব দেবে বাবাকে? বাবার ধারালো নজর তরীর তটস্থ চোখজোড়া দেখতে ব্যস্ত। জবাবের আশায় উৎকণ্ঠিত। তরীকে চুপ থাকতে দেখে মৃদু ধমক দিলেন,

-“কথা বলছো না কেন? তোমাকে নিয়ে চিন্তা হয় না আমাদের?”
তরী কেঁপে উঠলো বাবার ধমকে। চোখে পানি টলমল করছে। রোধ হয়ে আসা কন্ঠ নালি ভেদ করে উচ্চারণ করলো,
-“বাবা আ..
-“আমি ছাদে ছিলাম বলে তোমার মেয়ে সোজা নিচে চলে গিয়েছে। নতুন নতুন বিয়ে ঠিক হলে ঢং বেড়ে যায়, হুহ।”
মিঠুর কন্ঠে ঠাট্টা প্রকাশ পেলেও আলগোছে সে বোনকে বাঁচিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় আছে। সে আন্দাজ করে নিয়েছে তরী মাহমুদের সাথেই ছিল। তরী চকিতে তাকালো মিঠুর দিকে। বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“আমি বাইরে থেকে আসার সময় তো দেখলাম না তোমায়।”
তরী থেমে থেমে বলল,
-“পেছন দিকে ছিলাম।”
বাবা এবার বড়োসড়ো ধমক দিলেন।
-”এতরাত পর্যন্ত বাড়ির পেছনে কী? তুমি জানো কত বি*প*দ হতে পারে?”
তরী মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। বাবা ফের বললেন,

-“আর যেন এভাবে রাতবিরেতে বেরতে না দেখি। কথা বলার দরকার হলে ঘরে বসে কথা বলবে। যাও ঘরে যাও।”
আদেশ পেয়ে তরী কৃতজ্ঞ চোখে মিঠুর দিকে তাকালো। অল্পবয়সী মিঠু কত সহজেই বুঝদার হয়ে গেল। সবার আড়ালে একটুখানি হাসলো মিঠু। দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো তরী। এখনো বুকের কাঁপন থামেনি। চোখ বুজে এলোমেলো ভাবে শরীর এলিয়ে দিলো বিছানায়। ফোনের আলো জ্বলছে অনেকক্ষণ ধরে। সাইলেন্ট থাকায় শব্দ হচ্ছে না। তরী ফোন উঠিয়ে স্ক্রিনে চোখ রাখলো। মাহমুদ কল দিয়েছে। হুট করেই কেমন ভালোলাগা অনুভূত হলো, সাথে একরাশ ভয়। সামনে কোন ঝা*মে*লা অপেক্ষা করছে সেই ভয়টাই তরীকে কাবু করে নিচ্ছে। ধীরেসুস্থে মাহমুদের কল রিসিভ করলো। কথা বললোনা। মাহমুদ কোমল স্বরে ডাকলো,

-“তরী।”
চোখজোড়া আবেশে নিভে গেল তরীর। শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো যেন। এত কেন ভালোবাসা মেশানো গলা তার? তরীর সাথে সাথে রাগ হলো। সবার সাথেই কি এমন মধুর সুরে কথা বলে? গাল ফুলিয়ে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মাহমুদ তরীর চুপ থাকাতে উৎকণ্ঠিত হলো। জিজ্ঞেস করলো,
-“কোন সমস্যা হয়েছে, তরী?”
তরী রাগত স্বরে জবাব দিলো,
-“হলেই বা আপনাকে বলতে হবে কেন?”

মাহমুদ অডিও কল কে*টে ভিডিওতে আসলো। তরী গাল ফুলিয়ে সময় নিয়ে রিসিভ করলো। তবে ব্যাক ক্যামেরা অন করে বসে রইলো। মাহমুদ তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,
-“কী সমস্যা তরী? না বললে আমি বুঝবো কিভাবে? সামনে আসছেন না কেন?”
তরীর হুট করেই মনে হলো সে একটু ন্যাকা টাইপ আচরণ করছে। ভেবেই তার লজ্জা হলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে ক্যামেরার সামনে আসলো। মাহমুদ ফের শুধালো,

-“এবার বলুন, কী হয়েছে? কেন এত রাগ আমার ওপর?”
তরী মাথা নাড়ালো। বলল,
-“বাবা-মা জেগে ছিলেন। প্রশ্ন করছিল অনেক, সেজন্যই একটু মেজাজ খা*রা*প ছিলো।”
তরী ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে স্পষ্ট খেয়াল করলো মাহমুদের কপালে চিন্তার রেখা ফোটে উঠেছে। বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-“কী বলেছেন আপনি? কোন বড়োসড়ো সমস্যা হয়েছে?”
তরী মাহমুদকে আশ্বস্ত করলো।
-“চিন্তার কিছু নেই। মিঠু সবটা সামলে নিয়েছে।”
গাল ফুলিয়ে ঠোঁট গোল করে নিশ্বাস ছাড়লো মাহমুদ।
তার কেমন ঘোর লেগে যাচ্ছে তাকিয়ে থাকতে থাকতে। তরীকে ভীষণ আদুরে আদুরে লাগছে। ইচ্ছে করছে একটুখানি ছুঁয়ে দিতে। মেয়েটা তখন লজ্জাবতী গাছের মতো মিইয়ে যাবে, লুটিয়ে পড়বে তার বুকে। নিজেকে সামলে নিলো মাহমুদ। বলল,

-“এখন ঘুমিয়ে পড়ুন। ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে।”
তরীর একটু মন খা*রা*প হলো। তবে টুঁশব্দ করলোনা। বিনাবাক্য ব্যয়ে মেনে নিলো মাহমুদের কথা। কল কেটে ঘুমাতে গেল। তার ঘুম হচ্ছে না। চোখ বুজলেই বারবার মানুষটি এসে কল্পনায় ধরা দিচ্ছে।
শেষরাতে ঘুমিয়ে পড়লো তরী।

কল কে*টে মাহমুদ ঘুমালোনা। বারান্দায় দাঁড়ালো। চিন্তা করলো পরবর্তী ধাপ নিয়ে। এক সপ্তাহের মাঝে তরীর বিয়ে। তার আগেই সবটা সবাইকে জানাতে হবে। তরীর বাবা-মা জানার পর ভয়াবহ তান্ডব শুরু হবে। পরিবারকে না জানিয়ে এভাবে তরীকে বিয়ে করার ইচ্ছে তার ছিলোনা। পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়েছে। তরীকে পাওয়ার জন্য এই অন্যায় টুকু করতে হলো তাকে। তার ভ*য় হয় তরীকে নিয়ে। মেয়েটা পরনির্ভরশীল। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারেনা। কখনো যদি মা-বাবার কথায় তার হাত ছেড়ে দেয়? বুকের ভেতর ভীষণ জ্বালা করছে। মাহমুদ আর ভাবতে পারলোনা। মাথাটা ঝিমঝিম করছে।

নাস্তার টেবিলে বসেও তরী খেতে পারলোনা। বুকের ভেতর ধুকধুক করছে। আতঙ্ক নিয়ে বসে আছে সবার সামনে। এই বুঝি বাবা সন্দেহজনক কিছু একটা প্রশ্ন করে বসলো। মা জিজ্ঞেস করলেন,
-“খাচ্ছিস না কেন, তরী?”
-“আমার খেতে ইচ্ছে করছেনা।”

বলে তরী উঠে পড়লো। ব্যাগ কাঁধে তুলে দ্রুত বেরিয়ে গেল বাসা থেকে। মাহমুদের অপেক্ষা না করেই রিকশা নিয়ে চলে গেল। বাস স্টপেজে এসে অশান্ত চোখ দুটো মাহমুদকে খুঁজে বেড়িয়েছে। একটা বাস মিস দিলো। এই বাস মিস দিলে ক্লাস ধরতে পারবেনা। তাই একরাশ মন খারাপ নিয়েই বাসের সিটে চড়ে বসলো তরী। আকাশে কালো মেঘ জমলো। মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে গেল। তরী বিষন্ন হলো। আকাশেরও বুঝি তার মতই মন খা*রা*প! জানালার বাইরে মুখ বাড়িয়ে উদাস হয়ে তাকিয়ে রইলো।

লেকচার শেষ দিয়ে বের হলো তরী। চোখজোড়া বরাবরের মতোই মাহমুদকে খুঁজলো। মানুষটি কোথাও নেই। তীব্র মন খা*রা*প নিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। কল দিয়েও তাকে পাওয়া গেল না। তরী বাসে চড়তে যাবে এমন সময় হাতের কব্জিতে টা*ন পড়লো। আৎকে ওঠা তরী পিছু ফিরতেই দেখতে পেল চেনা মুখ। ঘেমে-নেয়ে একাকার, ক্লান্ত চেহারা। এলোমেলো চুল, চুপেচুপে ঘামে ভিজে আছে পরনের শার্ট।

তরীকে একপাশে টে*নে আনলো মাহমুদ। তরীর মায়া হলো, তবে গাঢ় হলো অভিমান। সারাদিনে তার কোন খোঁজ নেই। মুখ ফিরিয়ে নিলো সে। মাহমুদ মলিন চেহারাতেও কেমন নিখুঁত হাসলো। শব্দহীন সেই হাসিতে তন্ময় হয়ে রইলো তরী। তার সমস্ত রাগ, অভিমান গলে পড়লো বরফের মতো। মাহমুদ বলল,
-“রা*গ করেছেন, তরী? সরি! সারাদিন দৌঁড়ঝাপের উপর ছিলাম। নতুন বাসা খুঁজতে বেরিয়েছি ক্লাস শেষ দিয়ে।”
তরী তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। প্রশ্ন করলো,

-“নতুন বাসা কিসের জন্য?”
মাহমুদ মেকি আফসোসের স্বরে বলল,
-“শশুর আব্বা ওয়ার্নিং দিয়েছেন যাতে দ্রুত নতুন বাসা খুঁজে নিই। উনার বাসায় থাকা চলবেনা।”
তরী ব্যথিত হলো। চোখ ফেটে কান্না আসতে চাইছে। মানুষটিকে আর দেখবেনা সে! হুট করে তার চোখ পড়লো মাহমুদের ডান হাতে। চামড়া উঠে রক্ত ঝরছে। বিচলিত হয়ে মাহমুদের হাত টে*নে নিজের হাতের ভাঁজে তুলে নিলো। ছুঁয়ে দিলো কা*টা হাত। ব্যথাতুর কন্ঠে শুধালো,

-“কিভাবে এমন হলো?”
মাহমুদ হাত সরিয়ে নিলো। বলল,
-“কিছুনা। গাড়ি থেকে নামার সময় চলন্ত রিকশার সাথে লেগে সামান্য একটু লেগেছে। ঠিক হয়ে যাবে।”
তরী গরম চোখে তাকালো। রাগী গলায় বলল,
-“কতটুকু সামান্য আমি দেখতেই পাচ্ছি। চলুন আমার সাথে।”

মাহমুদকে টে*নে একটা ফার্মেসিতে নিয়ে গেল। ঔষধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো হাত। মাহমুদ তরীর পাগলামোতে হাসছে। তার ভীষণ সুখ সুখ অনুভূতি হচ্ছে। কে বলবে এই রণচণ্ডী রূপ ধারী মেয়েটি একটুখানি লজ্জা পেয়েই নুইয়ে পড়ে! ফার্মেসি থেকে বেরিয়ে মাহমুদ বলল,
-“খিদে পেয়েছে, তরী। দুপুরে খাওয়া হয়নি আমার।”
-“খেলেন না কেন? কিসের এত ব্যস্ততা আপনার?”

তরীর অধিকারবোধ মাহমুদকে ভীষণ অবাক করে তুলছে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না এই মেয়েটি তার লজ্জাবতী তরী। মাহমুদ তাকে জ্বালানোর পায়তারা খুঁজলো। করুণ গলায় বলল,
-“ডান হাতে ব্যথা হচ্ছে, তরী। খাবো কিভাবে? আপনি খাইয়ে দেবেন?”
কোথা থেকে সমস্ত অস্বস্তি এসে ঘিরে ধরলো তরীকে। অশান্ত হয়ে বারবার চোখের পলক ঝাপটালো। মাহমুদ মৃদু হেসে বলল,

-“আচ্ছা সমস্যা নেই। বাসায় গিয়ে খেয়ে নেব।”
বাসায় যেতে এখনো ঢের দেরি। তরী নিচু গলায় বলল,
-“চলুন, আমি খাইয়ে দেবো।”
মাহমুদের চোখজোড়ায় ঝুমঝুম করা খুশি। সাথে খেয়াল করলো তরীর গাল দুটো ক্রমশ লাল হয়ে ফুলে উঠছে। ইচ্ছে হলো একবার গাল দুটো ছুঁয়ে দিতে। পরক্ষণেই নিজের ইচ্ছেকে দমন করে হাত গুটিয়ে নিলো। একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে খাবার অর্ডার করলো মাহমুদ। আধাঘন্টা পর দু’জনের খাবার দিয়ে গেল। মাহমুদের মুখের সামনে খাবার তুলে ধরতেই তরী স্পষ্ট টের পেল, তার হাত অসম্ভব কাঁপছে। শরীর কাঁপছে। মাহমুদ শব্দ করে হাসলো। বলল,

-“ঠিক আছে তরী, আমি চামচ দিয়ে খেয়ে নেব। রেখে দিন।”
তরী রাখলোনা। কাঁপা হাত বাড়িয়ে ধরলো মাহমুদের মুখের সামনে। অরু আর মিঠুকে কতবার মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছে, অথচ এখনই তার যতসব কাঁপা-কাঁপি শুরু হলো। মাহমুদ বলল,
-“নিজে খাচ্ছেন না কেন?”
নিচু স্বরে জবাব দিলো তরী,
-“পরে খাবো।”
মাহমুদ তার কথা শুনলোনা। বলল,
-“আপনি এখনই খাবেন।”

তরী আর না করলোনা। মাহমুদকে খাওয়ানো ফাঁকে ফাঁকে নিজেও খেয়ে নিলো। বিল মিটিয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতেই তরী চোখমুখ অন্ধকার করে বলল,
-“কবে উঠবেন নতুন বাসায়?”
-“কালই উঠবো।”

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ১৯

তরীর ভেতরটা তড়াক করে উঠলো। টলমল চোখ লুকিয়ে মাথানিচু করে হাঁটলো। জনমানবহীন নির্জন পথে এসেই থেমে গেল মাহমুদ। এদিকটায় মানুষের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে না। তরীর থুতনিতে হাত রেখে মুখ উঁচু করলো। ভেঁজা চোখদুটো যত্ন করে মুছে দিলো। ডান গালে ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে দিলো, অতঃপর বাঁ গালে। তরী চোখ বুজে নিলো। তার বন্ধ চোখের পাতাতেও ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে দিলো মাহমুদ। অনুরাগী স্বরে বলল,
-“যেখানেই থাকি না কেন? আপনি আমার হৃদয়ে থাকবেন, তরী।”

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ২১