কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ১১

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ১১
লেখায় নামিরা নূর নিদ্রা

“আমার তখন ২১ বছর বয়স। কিশোরী বয়সে অতি আবেগি হয়ে কখনো কাউকে ভালোবাসিনি। ভালোবেসেছি প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর। একজনের প্রতি আসক্ত হয়ে বাকি সব ছেলের দিক থেকে নজর সরিয়ে নিই। ওর নাম রায়াদ। রায়াদকে ভালোবাসার পর আর কোনো ছেলেকে ভালো লাগেনি। প্রথম প্রথম রায়াদ আমাকে গুরুত্ব দিত না। কিন্তু কিছু মাস পর সে আমাকে জানায় তার মনের কথা। আমাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দেয়।

সম্পর্ক তৈরির পূর্বেই তাকে বলেছিলাম, বিয়ের আগে কখনো তুমি আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। আমাকে কখনো কোনো ছেলে স্পর্শ করেনি। বিয়ের পর আমি আমার স্বামীর হাতেই প্রথম ছোঁয়া পেতে চাই। এতে তার কোনো আপত্তি ছিল না। আমাদের মধ্যে শুধু ফোনে কথা হতো। দেখাও খুব কম হয়েছে। আমাদের মধ্যে প্রচুর ঝামেলা হতো। তবুও আমি ভালো থাকার চেষ্টা করতাম। আমি আর রায়াদ ছিলাম টম এন্ড জেরির মত। সারাক্ষণ ঝগড়া করলেও কথা না বলে থাকতে পারতাম না। একটা সময় আমরা ভীষণভাবে একে-অপরকে চেয়েছি। এক হতে চেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু এক হওয়া হয়নি!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কথাগুলো বলার সময় কুয়াশার চোখে নোনাপানি খেয়াল করেছে সাফওয়ান। কুয়াশার মুখে অন্য ছেলের নাম শুনে হঠাৎ করেই খারাপ লাগা শুরু হলেও সে কুয়াশাকে বলে,
“এক হতে পারলে না কেন?”
কুয়াশার মুখে তখন তাচ্ছিল্যের হাসি। এই হাসির দ্বারা সে অনেক কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছে সাফওয়ানকে।

“রায়াদ আমাকে অনেক বেশি সন্দেহ করত। মানে আমি কোনো কাজের জন্য যদি ছেলেদের সাথে কথা বলতাম তখনও রায়াদ অস্বাভাবিক আচরণ করত। আমার ভাই, বন্ধু সবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলাম ওর জন্য। তবে মজার ব্যাপার কী জানো? যেখানে সন্দেহ আমার করা উচিত ছিল, সেখানে রায়াদ আমাকে সন্দেহ করেছে। ওকে সন্দেহ করার অনেক কারণ ছিল। কারণ রায়াদ মেয়েদের সাথে প্রচুর মেলামেশা করত। আমার এটা ভালো লাগেনি কখনোই। অনেক বার এসব নিয়ে ঝামেলা হয়েছে আমাদের মধ্যে। কিন্তু সে নিজেকে পরিবর্তন করেনি। একদিন সরাসরি বলে দেয়, সে আমাকে আর চায় না। মূলত এসবের জন্যই আমাদের সম্পর্কে বিচ্ছেদ হয়।”

“তুমি এখনো ভালোবাসো তাকে?”
সাফওয়ানের এমন প্রশ্নের উত্তরে কুয়াশা যা বলে তার জন্য বেচারা একদমই প্রস্তুত ছিল না।
“ওকে ভালোবাসার আর সু্যোগ কোথায়? আমি তো এখন বিবাহিতা এক নারী!”
“কী? এসব কী বলছ তুমি কুয়াশা? তুমি বিবাহিতা!”
সাফওয়ান এক লাফে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তার চোখগুলো রসগোল্লার মত বড়ো হয়ে গিয়েছে। কুয়াশা স্বাভাবিকভাবে উত্তর দেয়,

“হ্যা, কিন্তু তুমি এমন করছ কেন? এত উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছ কেন?”
সাফওয়ান কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলে,
“না মানে তুমি তো একা এখানে। আর কখনো কোনো ছেলের সাথেও কথা বলতে দেখিনি ফোনে। তাই অবাক হয়েছি আর কি!”

“আমার স্বামীর সাথে আমার সম্পর্ক ভালো না। তার সাথে আমি থাকি না।”
সাফওয়ান যেন এবার আরো বেশি অবাক হয়। কুয়াশার প্রতিটা কথা শুনেই সে চরমভাবে শকড!
“আলাদা হলে কেন?”

“আসলে তুরাব মানে আমার স্বামী আমার মামাতো বোনের প্রাক্তন প্রেমিক। আপুর উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই সে আমাকে বিয়ে করেছিল। বলতে পারো এক প্রকার খেলার অংশ এই বিয়ে। আমাকে ব্যবহার করেছে সে। শুধু সে নয়। আমার বোনও আমাকে ব্যবহার করেছে। আমাকে ব্যবহার করে তার প্রাক্তনকে শায়েস্তা করতে চেয়েছিল। মাঝখান থেকে আমি ভালো থাকতে পারলাম না। প্রথমে রায়াদ, তারপর আমার বোন এবং তার প্রাক্তন প্রেমিক মিলে আমার সমস্ত ভালো থাকা কেঁড়ে নিয়েছে। আমি সবকিছু জেনেও চুপ!”

কুয়াশার চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। সাফওয়ান খুব করে চাইছে তার চোখের পানি মুছে দিতে। কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। একজন মেয়েকে তার অনুমতি ব্যাতিত ছোঁয়ার ইচ্ছে তার নেই। নিজের মনকে স্বান্তনা দিয়ে সাফওয়ান নরম সুরে কুয়াশাকে বলে,

“তোমার চোখের পানি অনেক মূল্যবান কুয়াশা। যারা তোমাকে এত কষ্ট দিয়েছে তাদের জন্য এই মূল্যবান জিনিস নষ্ট করা বোকামি। তবে আমি তোমাকে কাঁদতে বারণ করব না। কাঁদলে নিজেকে হালকা মনে হয়। কষ্টগুলো কিছুটা হলেও দূর হয়। তাই তোমার যত ইচ্ছা কেঁদে নাও।”
সাফওয়ানের কথা শুনে কিছুক্ষণ কান্নার পর নিজেকে সামলে নেয় কুয়াশা। সে কাঁদতে চায় না। তারপরেও কেন যে বারংবার কান্নাগুলো উপচে পড়ে তার চোখ থেকে এটা বুঝতে পারে না সে!

“শেষ?”
“কী?”
“তোমার চোখের পানি শেষ?”
“মজা করছ তুমি আমার সাথে?”
“আরে না না, মজা করব কেন? চুপ করে গেলে যে। এজন্য জিজ্ঞেস করলাম।”
“এত কাঁদতে ভালো লাগে নাকি? মা থা ব্যাথা করছে আমার এখন।”
সাফওয়ান কুয়াশার দিকে এক মগ কফি এগিয়ে দিয়ে বলে,
“কফি খাও। একটু ভালো লাগবে আশা করি।”
কুয়াশা কফির মগ নিয়ে তাতে চুমুক দেয়। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“আমি ভালো থাকতে চাই। এসব অশান্তি আর ভালো লাগছে না আমার। একটু শান্তি চাই। সেই শান্তি কী কখনো আসবে আমার জীবনে?”

“অবশ্যই আসবে। ভালো থাকার জন্য চেষ্টা করতে হবে। অতীত মনে রাখলে তুমি ভালো থাকতে পারবে না। অতীতের যন্ত্রণা তোমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে। তাই ভালো থাকার জন্য সবার আগে অতীত মনে করা বন্ধ করতে হবে। এটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি তোমার জন্য।”
“চাইলেই কী অতীত ভোলা যায়?”
“জানি যায় না। তবে চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?”
“চেষ্টা করছি তো। খুব করে চেষ্টা করছি সব ভুলে যেতে। মাঝে মাঝে মনে হয়, যদি আমার স্মৃতিগুলো মুছে যেত মস্তিষ্ক থেকে, তাহলে ভালো হতো।”

“আচ্ছা তুমি কী তুরাবের কাছে ফিরে যেতে চাও? মানে সে যদি তোমাকে আবার ফিরিয়ে নিতে চায় তাহলে তুমি কী করবে?”
“এই সহজ প্রশ্নের উত্তর তুমি জানো না? যে ছেলে আমাকে এত বাজেভাবে ব্যবহার করল তার জীবনে আমি ফিরে যাব? এটা কী সম্ভব?”
“তার প্রতি অনুভূতি তৈরি হয়নি তোমার মনে?”

“একটু একটু ভালো লাগা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ভালোবাসা তৈরি হয়নি। তার জন্য যে সময়ের প্রয়োজন তার আগেই সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছে। আমি সব সত্যি জেনে গিয়েছি। সবকিছু মিলিয়ে আমি কেবল একজনকেই ভালোবেসেছি। আর সে হলো রায়াদ। সে আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা। হয়তো শেষ ভালোবাসাও!”
“রায়াদ যদি ফিরে আসতে চায়?”

“সে ফিরে আসতে চেয়েছে। আমি তাকে গ্রহণ করিনি। যে সম্পর্কে একবার তিক্ততা চলে আসে সেই সম্পর্ক পুনরায় চালিয়ে নিয়ে যাওয়া বোকামি। কারণ ততদিনে ওই সম্পর্ক স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকে না। নষ্ট হয়ে যায় সম্পর্ক।”
“তাহলে এখন তুমি কী করবে?”

“আমার ইচ্ছা হলো প্র্যাকটিস শেষে কাজে মনোযোগী হওয়া। সেই সাথে একটা বৃদ্ধাশ্রম আর এতিমখানা খোলা। আমি অসহায় মানুষদের পাশে থাকতে চাই। তাদের সাহায্য করতে চাই। হাসি ফোটাতে চাই তাদের মুখে। সবার দোয়া নিয়ে হাসিমুখে বাঁচতে চাই। প্রাণ ভরে বিশুদ্ধ অক্সিজেন নিয়ে বেঁচে থাকাটাই এখন আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
“আর সংসার? সংসার করতে চাও না তুমি? মা হতে চাও না?”

সাফওয়ানের এমন প্রশ্নে চুপ হয়ে যায় কুয়াশা। শেষের প্রশ্নটা তার বুকে গিয়ে লেগেছে। মাতৃত্বের স্বাদ কে না গ্রহণ করতে চায়? কিন্তু সবার ভাগ্যে কী সন্তান সুখ থাকে!
“আমি আমার সংসার জীবন নিয়ে আর ভাবি না। বাদ দাও এসব কথা। অনেক কথা বললাম তোমাকে। আমার জীবন নিয়ে অনেক কথা শুনলে। এবার তোমার সম্পর্কে বলো। কী করতে চাও? বিয়ে করবে কবে? বয়স তো কম হলো না।”
“আমরা কিন্তু প্রায় সমবয়সী কুয়াশা। আমাকে আবার বুড়ো বানিয়ে দিয়ো না।”
সাফওয়ানের কথায় কুয়াশা হেসে বলে,

“সমবয়সী হলেও তো এখন বিয়ের বয়স হয়েছে তোমার। পছন্দের কেউ আছে? নাকি পারিবারিকভাবে বিয়ে করতে চাও?”
“পছন্দ তো করি একজনকে। কিন্তু তাকে কীভাবে নিজের মনে কথা বলব? আমি বুঝতে পারছি না। সে আমাকে মেনে নিবে কিনা এটাই লাখ টাকার প্রশ্ন।”

“তোমার মত ছেলেকে না করার কোনো কারণ আছে? তোমার সাথে যদি আমার রায়াদের আগে পরিচয় হতো তাহলে মনে হয় আমিই তোমাকে বিয়ে করে নিতাম হাহাহাহ!”
“সত্যি বিয়ে করবে আমাকে?”
সাফওয়ানের এমন প্রশ্নে হকচকিয়ে যায় কুয়াশা। কী বলছে এই ছেলে!
“এসব তুমি কী বলছ সাফওয়ান?”

সাফওয়ান কুয়াশাকে এমন হকচকিয়ে যেতে দেখে ভারি মজা পায়। দাঁত বের করে হেসে বলে,
“সত্যি সত্যি ভাবলে? আরে আমি তো মজা করছিলাম।”
“তুমি না বড্ড ফাজিল ছেলে। আচ্ছা অনেক সময় ধরে এখানে বসে আছি আমরা। এবার আমাদের বের হওয়া উচিত। আমাকেও বাসায় যেতে হবে। রাত হয়ে যাচ্ছে।”
“চলো আমি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।”

“আজ প্রয়োজন নেই। আমি রিকশা নিয়ে চলে যেতে পারব। কেবল আটটা বাজে। একা যেতে পারব আমি।”
“পারবে তো?”
“হ্যা পারব। তুমি সাবধানে বাসায় যাও। আমিও আসি।”
“বাসায় গিয়ে কল দিয়ো।”
“আচ্ছা। আল্লাহ হাফেজ।”
“আল্লাহ হাফেজ।”

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ১০

বিঃদ্রঃ গতকাল এক পর্ব পড়েই আপনারা আমার উপর রেগে গিয়েছেন। আমি একটা কথা বলে রাখি, আমার গল্পটা ভিন্ন ধরনের। গল্পের শেষটা আপনাদের কাউকে হতাশ করবে না এই আশা করছি। কথা দিচ্ছি, আমার গল্পের শেষ গতানুগতিক ধারার মত হবে না। এই গল্পের শেষে কি হবে সেটা গল্পের শুরুতেই ভেবে রেখেছি আমি। কুয়াশা চরিত্রটা প্রতিবাদী একটা চরিত্র। আর পাঁচজনের মত সে নয়। তাই একটু ভরসা রাখুন আমার উপর। এটা আমার অনুরোধ আপনাদের সবার কাছে।

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ১২