কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ২৮

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ২৮
লেখায় নামিরা নূর নিদ্রা

নীল রঙের শার্ট, কালো রঙের জিন্স, সাথে হাতে বড়ো ডায়ালের একটা ঘড়ি আর চুলগুলো হালকা ব্রাশ করা লুকে সাফওয়ানকে বেশ সুন্দর লাগছে। কুয়াশাকে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে সাফওয়ান কুয়াশার অনেকটা কাছে এসে বলে,
“শুভ জন্মদিন কুয়াশা।”

এতক্ষণে কুয়াশার মনে পড়ে আজ তার পঁচিশ তম জন্মদিন। যা সে একদম ভুলেই গিয়েছিল। সবার “শুভ জন্মদিন” চিৎকারে মুখরিত আজ চারপাশ। সেই সাথে গম্ভীর মুখের অধিকারী মেয়েটার মুখেও আজ প্রাণোচ্ছল হাসি বিরাজমান। এমন সুন্দর মুহূর্তগুলো যদি এখানেই থেমে যেত তাহলে হয়তো পরবর্তী ঝড়ের সম্মুখীন আর কাউকে হতো না।
সাফওয়ান ইশারায় একজনকে কিছু একটা বলে। অতঃপর কুয়াশাকে নিয়ে অপর পাশে চলে যায়। পেছন পেছন বাকিরাও যায়। সাফওয়ান কুয়াশাকে একটা টেবিলের সামনে নিয়ে এসে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“এই হলো তোমার জন্মদিনের কেক।”
“এটা জন্মদিনের কেক? এটা তো আইসক্রিম কেক।”
“হ্যা আইসক্রিম কেক। সবাই সাধারণ কেক কেটে জন্মদিন উদযাপন করে। তুমি তোমার পছন্দের আইসক্রিম কেক কেটে জন্মদিন স্মরণীয় করে রাখবে।”

“আচ্ছা এই সবকিছুর পরিকল্পনা কার কার?”
মলি কুয়াশার কাছে এগিয়ে এসে এক গাল হেসে উত্তর দেয়,
“আমার, আদ্রিতার আর সাফওয়ান ভাইয়ার। আমরা তিনজন অনেক ভেবেচিন্তে তারপর সবকিছুর আয়োজন করেছি। সাফওয়ান ভাইয়া অবশ্য সবচেয়ে বেশি কষ্ট করেছে এসবের জন্য। তাই বিশেষভাবে তোর ভাইয়াকে ধন্যবাদ জানানো উচিত।”

কুয়াশা সাফওয়ানের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বলে,
“কখনো ভাবিনি আমার জীবনের এত উত্থানপতনের পর আমি এইভাবে কোনোকিছু উদযাপন করতে পারব। সেটাও কিনা আমার জন্মদিন! সবকিছুর জন্য তোমাকে অনেক বেশিই ধন্যবাদ সাফওয়ান।”
“ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য অনেক সময় আছে ম্যাডাম। আগে কেক কাটুন। নয়তো পুরো কেক গেল যাবে এখন।”
কুয়াশা সবাইকে সাথে নিয়ে কেক কাটতে যাবে এমন সময় আদ্রিতা বলে ওঠে,

“এই তুই মোম নিভাবি না?”
“আমার অন্ধকার জীবনটাকে আরো অন্ধকার কেন করব? তার থেকে মোমবাতি যেভাবে জ্বলছে সেভাবেই জ্বলুক।”
“আচ্ছা।”
কুয়াশা কেক কেটে সর্বপ্রথম মা’কে খাইয়ে দেয়। তারপর সাফওয়ান, বাবা, ভাই, বাচ্চাদের, মলি, আদ্রিতা সবাইকে খাইয়ে দেয়। সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলে তার নিজের কাছেও আজ অনেক ভালো লাগছে।
সবার মাঝ থেকে বের হয়ে হাতে একটা মাইক নিয়ে আদ্রিতা কিছুটা ভাব নিয়েই বলে,

“সবাই একটু শান্ত হয়ে নিজ নিজ আসন গ্রহণ করুন। কারণ আর কিছু মুহূর্তের মধ্যেই আজকের সবচেয়ে বড়ো ধামাকার সাক্ষী হতে যাচ্ছি আমরা। তাই এখন সমস্ত আলো বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করছি।”
আদ্রিতার বলতে দেরি, কিন্তু আলো নিভে যেতে দেরি হয়নি। অন্ধকারের মধ্যে কেউ একজন কুয়াশার হাত টেনে ধরে একটা জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেয়। কুয়াশার সাথে কি হচ্ছে তার কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। মলিকে উদ্দেশ্য করে সে কিছু বলতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে কিছু আলো জ্বলে ওঠে। আবছা আলোয় কুয়াশা নিজের সামনে সাফওয়ানকে আবিষ্কার করে।

“প্রথম দেখায় ভালোবাসা হয় কিনা জানি না। তোমায় যখন প্রথম দেখেছিলাম তখন শুধুমাত্র কথা বলার জন্যই এগিয়ে গিয়েছিলাম। কেন না আমি খুব বেশিক্ষণ চুপচাপ থাকতে পারি না। আমি কথা বলার সময় তুমি বিরক্ত হচ্ছিলে সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু তবুও কথা বলেছি। আমরা পাশাপাশি থেকেছি অনেকটা দিন। এখনো আমরা একসাথে আছি। এই সময়ের মধ্যে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটেছে।

সাথে পরিবর্তন ঘটেছে আমার অনুভূতিগুলোর। কয়েক মাসের ব্যবধানে অচেনা তুমি হয়ে উঠলে আমার মনোহারিণী। ঠিক কবে, কখন, কীভাবে তোমার প্রেমে পড়েছি তা আমি জানি না। আচ্ছা, ভালোলাগা, ভালোবাসা তো হুট করেই হয় তাই না? আমিও তোমাকে হুট করেই ভালোবেসে ফেলেছি। আমি তোমার সম্পর্কে প্রায় সবই জানি। সবকিছু জেনেই আমি তোমাকে গ্রহণ করতে চাই। কারণ তোমার সাথে যা যা হয়েছে তাতে তোমার কোনো দোষ নেই। আমি তোমাকে করুণা করছি না। বরং তোমার থেকে আমার ভালোবাসা ভিক্ষা চাচ্ছি। তুমি কী হবে আমার? আমার মনকুঠুরিতে কী রাজ করবে তুমি? আমার ভালোবাসা গ্রহণ করে আমাকে বাঁচাবে কী তুমি?”

এতক্ষণ স্তব্ধ নয়নে নিজের সামনে দুই হাঁটু গেড়ে অসহায় চাহুনি নিয়ে বসে থাকা ছেলেটার কথা শুনছিল কুয়াশা। তার মধ্যে অবাক হওয়ার চিহ্ন মাত্র নেই। হয়তো সে সবকিছুই আন্দাজ করতে পেরেছিল। সাফওয়ান এক দৃষ্টে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে আছে। সে অপেক্ষা করছে তার উত্তর শোনার আশায়। অজানা এক ভয় গ্রাস করে রেখেছে তাকে।
কুয়াশা চারপাশে তাকিয়ে সবার চেহারা দেখে নেয়। সবাই তার উত্তর শোনার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে। প্রার্থনা করছে যেন সে সন্তোষজনক কোনো উত্তর দেয়। কিন্তু কুয়াশা সবার আশায় লবণ ছিটিয়ে বলে ওঠে,

“আমি জানতাম এমন একটা দিন আসবে। তবে সেই দিনটা এত তাড়াতাড়ি আসবে সেটা ভাবিনি। আমি খুব ভালো করেই জানি, একজন ছেলে আর একজন মেয়ের মধ্যে কখনো বন্ধুত্ব হতে পারে না। এইক্ষেত্রে হয় ছেলে দুর্বল হয়। নয়তো মেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। অথবা দু’জনেই দুর্বল হয়ে যায়। কিন্তু আমি তোমার থেকে এটা আশা করিনি সাফওয়ান। আমি চেয়েছিলাম আমাদের বন্ধুত্বটাকে সুন্দর একটা পরিণতি দিতে। তবে এখন হয়তো সেটা আর সম্ভব হবে না।”

“মানে?”
“আমাদের মধ্যে যে বন্ধুত্ব আছে সেটা আমি আজকেই শেষ করে দিতে চাই!”
“কুয়াশা!”
“আমার কাছে আর কোনো উপায় নেই সাফওয়ান। এমনিতেই পরিস্থিতি আমার অনুকূলে নেই আর। আমাকে ভালোবেসে তুমি কষ্টের সাগরে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছ। কারণ আমার জীবনে আমি আর কোনো পুরুষকে চাই না। আমি বাকিটা জীবন সঙ্গিহীন থাকতে চাই।”

“কারণ? তুমি কি রায়াদ কিংবা তুরাবের প্রতি এখনো কিছু অনুভব করো?”
“না, আমার কারোর প্রতি কোনো অনুভূতি কাজ করে না এখন। যে প্রাক্তন প্রেমিক আমাকে তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে শেষ করার চেষ্টা করেছে তার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করা কিংবা যে স্বামী আমাকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে পর মুহূর্তে ছুঁড়ে ফেলেছে তার প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে অতি ন্যাকা নারী সেজে সকলের কাছে মহান হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই।

জীবনটা আমার। এতদিন এই জীবনের সুখ বিসর্জন দিয়ে সবার কথা ভেবেছি। কিন্তু আর নয়। এখন নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। আমি আসলে আর কোনো সম্পর্কে জড়াতে চাই না। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যদি এখন আমি তোমার সাথে জড়িয়ে যায়, তাহলে তুমি আনার সাথে কখনোই সুখী হবে না। এটাই মূল কারণ।”

কুয়াশার কথাগুলো সাফওয়ানের মনে ঝড় তুলছে। সে আকুতিভরা কণ্ঠে বলে,
“আমি তোমাকে অনেক বেশিই ভালোবাসি কুয়াশা। ভালোবাসা তো বলে কয়ে আসে না। এখানে আমার কি দোষ বলো? ভালোবাসা কি পাপ? আমি কি ভালোবেসে অন্যায় করেছি? আমার কি ভালোবাসার অধিকার নেই?”

“ভালোবাসা পবিত্র। তুমি ভালোবেসে অন্যায় করোনি। তোমার ভালোবাসার অধিকার আছে। কিন্তু তুমি ভুল সময়ে ভুল মানুষকে ভালোবেসেছ। জানি, এতে তোমার কোনো দোষ নেই। দোষটা হয়তো আমার। তোমার সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলার আগে এই সম্পর্কের পরিণতি পরবর্তীতে কি হবে তা ভাবা উচিত ছিল আমার।”

“কেন এমন করছ তুমি? সঙ্গিহীন কি বাঁচা যায়?”
“যায় তো। এমন কত মানুষ আছে যারা জীবনে কখনো বিয়েই করেনি। তারা কি বেঁচে নেই? ম রে যাওয়ার আগে যারা সঙ্গিহীন ছিল তারা কি সময়ের আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছে? না তো তাই না? তাহলে আমি কেন পারব না? তাছাড়া আমার কাঁধে এখন অনেক দায়িত্ব। নিজের দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করা, অনেকগুলো মানুষের দেখাশোনা করা, বাচ্চাদের খেয়াল রাখা, পরিবারের বড়ো মেয়ে হিসেবে বাবা-মাকে আগলে রাখা, নিজেকে একজন সফল আইনজীবী হিসেবে গড়ে তোলা, সবকিছু মিলিয়ে আমি বেশ ভালোই থাকব।”

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ২৭

“তুমি তো ভালো থাকবে। কিন্তু আমার ভালো থাকা নিয়ে তুমি ভাববে না?”
“ভুল মানুষকে ভালোবাসলে বরাবরই কষ্ট পেতে হয়। এটা আমার জীবন সম্পর্কে ধারণা পেয়েও বুঝতে পারোনি তুমি?”
কুয়াশার এমন “না” বোধক উত্তরে আশাহত হয় সবাই। কুয়াশার কাছে এসে সবাই অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে যেন সে সাফওয়ানকে মেনে নেয়। কিন্তু সে তার সিদ্ধান্ত থেকে এক পা পেছনে ফেলতে রাজি নয়!

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ২৯