হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ২৮

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ২৮
সাইয়ারা মম

কেটে গেছে কয়েকদিন । দুপুরের কড়া রোদে বোঝা যায় না যে গত কয়েক দিন ধরে আবহাওয়া এমন খারাপ ছিল । রোজার দিন থাকার কারণে এখন কফি শপে তেমন একটা মানুষের আমেজ নেই । যতই কেউ রোজা না রাখুক রোজার দিনে এভাবে খাওয়াটা একটা কেমন খারাপ লাগার বিষয় । তবে এই বিষয়টিকে পাত্তা না দিয়ে একটা গরম ধোঁয়া উড়া কফি সামনে নিয়ে নীলু বসে আছে।

ওর চোখে মুখে উদ্বেগ অথবা অস্থিরতা বোঝা যাচ্ছে না । খুব শান্ত ভঙ্গিতেই কফিতে এক চুমুক দিয়ে টেবিলে রেখে দিচ্ছে । আবার কতক্ষণ ঘড়িতে টাইম দেখছে ।টাইম তো হয়ে এসেছে , তার তো এখনি আসার কথা । কিন্তু এখনো না আসায় নীলু বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না।আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরে অবশেষে সে এলো । এসেই নীলুর সামনের সিটে বসল । তাকে দেখে নীলু বিন্দুমাত্র অবাক হয় নি বরং নীলুকে অবাক না হতে দেখে সে অবাক হলো

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-তুমি আমাকে দেখে অবাক হওনি?
– কেন অবাক হওয়ার কথা বুঝি
নীলুর এমন স্বাভাবিক ব্যবহার দেখে সে আরো অস্থির হয়ে পড়লো। নীলু তার দিকে তাকিয়ে কফিতে এক চুমুক দিয়ে তাকে বলল

-তো আপনি নাকি প্রুফ দিতে পারবেন ? সেটা কোথায় ( একটু থেমে) মিস তুলি?
-হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই দেখাবো । আর এর জন্যই তো এখানে এসেছি। তবে তার আগে কয়েকটা কথা বলি সেটা একটু মনোযোগ দিয়ে শোনো
– বলুন

– মিহু আসলে আরফানকে ঠকাচ্ছে। ও আসলে তোমাকে আরফানের কাছ থেকে দূরে সরাতে চাচ্ছে । কিন্তু ও আরফানকে ভালোবাসে না । ও আমার ভাইকে ভালোবাসে । আর মাহিন ভাইও ওকে ভালোবাসে
মাহিন মিহুকে ভালোবাসে শোনার পরে নীলুর মনটা খচ করে উঠলো । চারদিকে বিষাক্ত ধোঁয়া অনুভূত হতে লাগল । হৃদপিন্ড টা অশ্বের থেকেও দ্রুত গতিতে দৌড়াতে লাগল । কিন্তু নীলু নিজেকে শান্ত রেখেছে । বাহির থেকে বোঝা যাবে না ওর ভেতরে কি ঝড় চলছে।

নীলুকে এমন চুপ থাকতে দেখে তুলি একটু বেশিই অস্থিরতা বোধ করল । এই কয়েক দিনে নীলুর সাথে কথা বলার ফলে তুলি বুঝেছিল যে নীলু হয়ত মিহুর বিরুদ্ধে তাই ও ধরা দিয়েছে । কিন্তু এখন নীলুর মৌনতা তুলিকে ভিষণ ভাবাচ্ছে । নীলু তুলি দিকে তাকিয়ে বলল
– আপনার মুখের কথায় তো আর বিশ্বাস করব না । আমি প্রুভ চাই ।

– ওকে তোমাকে দেখাচ্ছি বলে তুলি ওর ফোনে একটা ভিডিও চালু করে নীলুর চোখের সামনে ধরল । নীলু সেখানে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে গভীর রাতে মিহু ছাদে যাচ্ছে আর তার একটু পরেই মাহিন ও ছাদে যাচ্ছে । তারপর অনেকক্ষণ পরে মাহিন নেমে আসছে আর তারপরে মিহু ।
– কি এইবার তো বিশ্বাস হলো

-সে না হয় বুঝলাম কিন্তু আপনি চাইছেন টা কি? এই যে ভাবি আর ভাইয়ের বিচ্ছেদ হোক আর তারপরে ভাবি আর মাহিন ভাই একসাথে থাকুক?
– হ্যাঁ আমি এটাই চাচ্ছি
-কিন্তু আমি এটা বুঝলাম না যে মেয়েটা প্রতারণা করছে তাকে আপনি আপনার ভাইয়ের গলায় ঝুলাতে চাচ্ছেন?
– কি আর করব ভালোবাসায় তো আর প্রতারণা দাগ কাটতে পারে না । আর তাছাড়াও আমি মাহিন ভাইয়ের এই কষ্ট দেখতে পারছি না । বোন হয়ে ভাইয়ের কষ্ট কীভাবে দেখি?

– তাহলে একটা কথা ভাবুন আপনি যদি বোন হয়ে আপনার ভাইয়ের লাইফে প্রতারণা কারী একজনকে দিতে চান তাহলে আমি বোন হয়ে কীভাবে আমার ভাইয়ের ভালো থাকাটা কেড়ে নেই ?
তারপর দাঁড়িয়ে তুলির দিকে হালকা ঝুকলো । বেশ কড়া গলায় ই বললো

– আর মিস তুলি আপনি এইবার আপনার এইসব ন্যাকামো আর নাটক বন্ধ করুন । নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন আমার এমন ব্যবহার দেখে ? অবাক হওয়ার ই কথা । কারণ আমি যেমন তেমনটা কাউকে দেখাই না । আর একটা কথা কান খুলে শুনে রাখুন আমার ভাই আর ভাবির মাঝে আসার চেষ্টা করলে না, আপনার সব এমনকি জীবন শেষ । আমাকে আপনি চিনেন নি । আমি যদি আমার ভাইকে আমার ইমোশন দিয়ে সব কিছুতে রাজি করাতে পারি তাহলে তার ভালো থাকার দায়িত্ব টাও আমি নিতে পারি। বলে পেছন ফিরে চলে গেল। তুলি দাঁড়িয়ে গেল । নীলু আবার ফিরে এসে বলল

– আর নিজের লিমিটে থাকার চেষ্টা করুন । লিমিট ক্রস করলে কিন্তু তা ভালো হবে না ।বিশেষ করে একবার যেহেতু আমাকে অনুষ্ঠানে অপদস্থ করতে চেয়েছিলেন । আপনি জানেন না আমি কে ! আমি হলাম আরফান আদিত্যের বোন আফরিন নীলু ।

বলে নীলু চলে গেল । তুলি রাগে ওখানের গ্লাস জোরে আছাড় মারল । কফি শপে যে কয়েকজন লোক ছিল সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে । সবার সামনে কড়া গলায় ওকে হুমকি দিয়ে গেল আবার সেখানে বয়সে ওর চেয়ে ছোট ।
– নীলু কাজটা তুমি ভালো করলে না । ছোটদের নিজের গন্ডির মধ্যে থাকতে হয়। বড়দের গন্ডির ভেতরে প্রবেশ করার অধিকার তাদের নেই । তুমি আমাকে ইনসাল্ট করেছো । এরফল ভালো হবে না।সামনে যা হবে তার জন্য আফসোস করলেও লাভ হবে না কারণ আফসোস করার অবস্থায় তুমি থাকবে না।
‘অতি বাড় বেড়ো না ঝরে পড়ে যাবে’

আরফান আবার তার কাজে মনোনিবেশ করেছে । সে হাজার চেষ্টা করেও ডায়েরি টা উদ্ধার করতে পারেনি । বাধ্য হয়ে মিহুর দাদুকে ঘটনাটা বলতে চেয়েছিল কিন্তু তিনি আবার তার কাজের জন্য কোথাও গিয়েছেন । তাই এই কয়েকদিনে মিহুর মায়ের সম্পর্কে ও কিছুই জানতে পারেনি । যে দুদিন আরফান অফিসে যেতে পারেনি সেই দুদিনে অফিসের বেহাল দশা হয়েছে । কাজ ঠিক মতো হচ্ছিল না । একে তো ফারিশ এসব বিষয়ে তেমন অভিজ্ঞ না তার ওপর সব দায়িত্ব ছিল ওর ওপরে তাই সব সামলিয়ে উঠতে পারেনি ।

আরফান এখন নিজে দায়িত্ব নিয়ে একটা পারফিউম তৈরি করছে টেস্টিং এর জন্য । বেলী ফুলের ফ্রাগ্রান্স দিতেই ওর মিহুর কথা মনে পড়লো । এই বেলী ফুল একমাত্র মিহুর জন্যই সৃষ্টি ।বেলী ফুলের সুবাস একমাত্র একটি বেলী ফুলের শরীর থেকেই আসবে আর সেটা হলো আরফানের বেলী ফুল ।

বর্তমানে যে পারফিউম টা আরফানের হাতে আছে এইটা একমাত্র মিহুর জন্যই মনে হচ্ছে । তাই সে এটার কোনো তথ্য ই রেকর্ড রাখল না । খুব সুন্দর করে যত্ন সহকারে আরফান এই পারফিউম টা একটা স্প্রের মতো তৈরি করল । তারপর সেটা রেখে দিল একটা সুরক্ষিত জায়গায় । আরফান আগে চাচ্ছিল সব গুলো পারফিউম ই বেলী ফুলের ফ্রাগ্রান্সে হোক কিন্তু এখন সে মত পাল্টিয়ে গন্ধরাজের ফ্রাগ্রান্স সেলেক্ট করল । আরফানের হঠাৎ মত পাল্টানোয় ফারিশ অবাক হলো।

– তুই তো বেলী ফুল সব থেকে বেশি ভালোবাসো তাহলে হঠাৎ চেঞ্জ করলি কেন?
– কারণ সবাইতো আর বেলী ফুলের যোগ্য না
-মানে ?
– আই মিন সবাই তো বেলী ফুলের ঘ্রাণ পছন্দ নাও করতে পারে । তবে গন্ধরাজের ঘ্রাণ টা কম বেশী সবাই পছন্দ করে
আরফানের এমে লেইম এক্সকিউজ শুনে ফারিশ বলল

– তোর মাথাটা আসলেই গেছে । সবাই বেলী ফুল পছন্দ করবে না এটা ঠিক আছে কিন্তু সবাই গন্ধরাজ পছন্দ করবে এটা বললি কীভাবে ? তুই এখন বাসায় যা । বাকিটা আমি সামলিয়ে নেবো আর যা লাগে সেটা তুই ই ফোনে জানিয়ে দিস ।
ফারিশের কথায় সায় জানিয়ে আরফান বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল । পথিমধ্যে পিয়াসের দেখা পেলে ওকেও গাড়িতে উঠিয়ে নেয় । কিন্তু হাসি খুশি পিয়াস কে এখন দেখতে কেমন মন মরা লাগছে । একটা হাসি খুশি মানুষকে এরকম ভাবে কখনোই মানায় না । তাই আরফান জিজ্ঞেস করল
– কি ব্যাপার? এরকম মুখ গোমরা করে আছিস কেন?

আরফানের এরকম স্নেহ সূচক প্রশ্ন শুনে পিয়াস নিজেকে অতি কষ্টে কন্ট্রোল করল । ওর কান্না পেয়ে যাচ্ছিল তাই কোনো কথা বলতে পারল না । ওকে কথা বলতে না দেখে আরফান ওর কাধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল
– সিলেক্ট হোস নি ? থাক কোনো ব্যাপার না । সবাই সবার যোগ্যতা বোঝে না । তোর ট্যালেন্ট হয়ত তারা বুঝতে পারেনি । তুই আজকে সেলেক্ট হস নি তো কি হয়েছে?

পরে দেখবি একদিন অনেক বড় ফটোগ্রাফার হয়ে গেছিস । আমার এক বন্ধু আছে বুঝেছিস ও এখন অস্ট্রেলিয়া থাকে । খুব শখ ফটোগ্রাফির কিন্তু দারিদ্র্য তার কারণে আর পরিবারের চাপে পড়ে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে । তারপর যখন টাকা হয়েছে তখন ও একটা ফাউন্ডেশন করেছে । এ সম্পর্কে বেশী কিছু জানি না তবে ও দেশে আসলে তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো । আমাকে খুব ভালো চেনে । ওর নাম মনে নাই তবে আমরা ডাকতাম এ আই গামা ।

– ভাই আমি ওখানে অংশগ্রহণ ই করতে পারি নাই
– কেন !
– আজকে যে ইভেন্ট টা ছিল ঐটায় বাবার সাক্ষর লাগতো ।মানে বাবা এই খানের শর্তে রাজি হতে হবে । কিন্তু বাবাকে ফোন দিলে আমাকে ঘরে ঢুকতে নিষেধ করেছে
গাড়ি এসে পিয়াস দের বাসার সামনে থামলো । কিন্তু পিয়াস বাসায় ঢুকতে চাচ্ছে না । আর দাড়োয়ান ও ঢুকতে দিচ্ছে না । পিয়াসের বাবা তখন ঘর থেকে বের হয়ে এসে বললেন

– আরফান ওকে বের হয়ে যেতে বলো , আমার কোনো ছেলে নেই ।
– চাচ্চু এভাবে বলেন না । ছেলে মেয়েরা তো একটু আধটু ভুল করবেই তাই বলে মা বাবাও কি রাগ করে থাকবে?
– ভুল কিসের ভুল ? ওকে বার বার মানা করা শর্তেও শুনেনি । এখন যেখান থেকে এসেছে সেখানে যেতে বল
আরফান অনেক বোঝানোর পরে পিয়াসের বাবা একটু নরম হলো । তারপর বললেন
– আমার ঘরে ঢুকতে হলে ওকে ঐ ক্যামেরা বাইরে রেখে আসতে হবে । আর ওয়াদা করতে হবে জীবনেও ও ঐ দিকে যেতে পারবে না । যদি আরেকবার ভুল করে তো ওকে আমি তাজ্য পুত্র করে দেবো।

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ২৭

পিয়াস অনেক কষ্টে তার ক্যামেরাটা আরফানের হাতে তুলে দিল । তুলে দেওয়ার মুহূর্তে ওর অক্ষিদ্বয় থেকে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল । স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া তবে একেই বলে ? যে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য এত কিছু করল আজ ওকে সেই সপ্নকেই দাফন দিতে হচ্ছে । সব কিছু পূর্ণতার মাঝেও অপূর্ণতা বুঝি একেই বলে !

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ২৯