কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ২৯

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ২৯
লেখায় নামিরা নূর নিদ্রা

“কুয়াশা তুমি তো এখন মা। তোমার এখন দুইটা সন্তান আছে। তুমি সব সময় চেয়ে এসেছ যেন ওয়ানিয়া আর নিহাল বাবা-মায়ের না থাকাটা বুঝতে না পারে। অন্তত ওদের জন্য হলেও সাফওয়ানকে মেনে নাও।”
মায়ের কথায় কুয়াশা ধীর কণ্ঠে উত্তর দেয়,

“মা আমি তো মানুষ একটাই তাই না? এক মনে কয়জনকে জায়গা দিব? কয়জনকে ভালোবাসতে পারি আমি? আমি সাফওয়ানকে কখনো সেই নজরে দেখিইনি। তাছাড়া সাফওয়ান আমার সাথে বন্ধুর মতোই মিশেছে। ওর কোনোকিছুতে আমি এটা বুঝতে পারিনি যে ওও আমাকে ওর জীবনসঙ্গী হিসেবে চায়। আমি বাচ্চাদের জন্য ওকে বিয়ে করলে ওর সাথে অন্যায় করা হবে মা। কারন আমি কখনোই ওর সাথে আর পাঁচটা দম্পতির মতো সংসার করতে পারব না।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“কেন পারবে না? অনেকেরই তো দুই/তিনটা বিয়ে হয়। এটা কী অন্যায়?”
“আমি আজ আরেকটা বিয়ে করলে লোকে বলবে, আমাকে দয়া করে বিয়ে করেছে আমার স্বামী। লোকের কথায় কখনো কান দিই না আমি। তবে এই কথাগুলো সহ্য করার ক্ষমতা সত্যিই আমার নেই। আমার জীবনে যা যা হয়েছে তাতে আমার হাত ছিল না। আমি পরিস্থিতির শিকার। এখানে আমার দোষ কোথায়? আমাকে কেন বাজে কথা শুনতে হবে? আমি পারব না এসব মেনে নিতে।”

এতক্ষণ মলি আর আদ্রিতা চুপ করে থাকলেও এবার এগিয়ে আসে কুয়াশার সাথে কথা বলার জন্য।
“দেখ কুয়াশা আমরা জানি তোর জীবনে অনেক ঘটনা ঘটেছে। তুই অনেক বার ঠকেছিস। তুই ভালোবাসার বদলে ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু চাসনি কখনো। কিন্তু তোকে সবাই কষ্ট দিয়েছে। তোর পক্ষে এখন একজনকে বিশ্বাস করা অনেক কঠিন। তবে সাফওয়ান ভাইয়া অনেক ভালো মানুষ। তার মতো একজনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেলে তুই খুব সুখী হবি রে।”

আদ্রিতার কথার সাথে তাল মিলিয়ে মলি বলে,
“আদ্রিতা ভুল কিছু বলেনি কিন্তু। তুই একটু ভেবে দেখ, আর কতকাল একা থাকবি? তুই ত্রিশ বছরও পার করিসনি। এত অল্প বয়সে এমন সিদ্ধান্ত কেন নিচ্ছিস তুই?”
সবার কথা শুনে কুয়াশা অসহায় চোখে বাবার দিকে তাকায়। এই মানুষটা বরাবরই চুপ করে থাকে এসব বিষয়ে। কিন্তু আজ কুয়াশা চায় যেন তার বাবা অন্তত তার কথাগুলো বোঝে। একমাত্র এই মানুষই তার কাছে হাজারো চিন্তার মধ্যে এক টুকরো মোমের আলোর মতো। মেয়ের অসহায় চাহুনি দেখে কুয়াশার বাবা এগিয়ে আসে। মেয়ের মা থা য় হাত বুলিয়ে বলে ওঠেন,

“তোমরা কেন ওকে জোর করছ? জোর করে সবকিছু হয় না। ভালোবাসা তো কখনোই হয় না। যেখানে কুয়াশা জানে সে আর কারোর সাথে সংসার করতে পারবে না সেখানে এভাবে জোর করার কোনো মানে হয় না।”
এরপর তিনি এগিয়ে যান এক জায়গায় নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাফওয়ানের দিকে।

“বাবা আমি তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। বুঝতে পারছি তোমার মানসিক অবস্থা এখন কি রকম। কিন্তু তোমার পুরো জীবন পড়ে আছে। তুমি কুয়াশাকে ভালোবাসো। যাকে ভালোবাসো তাকে বিয়ে করে এত কাছে পেয়েও যখন দেখবে তোমাদের মধ্যে অনেকটা দুরত্ব তখন সেটা আরো বেশি কষ্টদায়ক হবে। কুয়াশার জীবনে অনেক কিছু হয়েছে যাতে আমার মেয়েটা নিরপরাধ হয়েও শাস্তি ভোগ করেছে। এখন ওর মনে হচ্ছে ওও একা থাকলেই ভালো থাকবে। তাই আমাদের উচিত ওকে ওর মতো করেই ছেড়ে দেওয়া।”

বাবার কথায় যেন কুয়াশা কিছুটা শান্তি অনুভব করে। আজ তার বাবা তার মনের কথাগুলো বুঝতে পেরেছে। বরাবরই বাবার সাথে কুয়াশার সখ্যতা কম। বাবার সাথে বসে গল্প করার সৌভাগ্য কখনো হয়নি তার। সেই মানুষটা আজ কত সুন্দরভাবে তার অব্যক্ত কথাগুলো বুঝতে পেরেছে।

“বাবা ঠিকই বলেছে। সাফওয়ান তোমার সাথে আমার আর দুইটা বছর আগে দেখা হলেও হয়তো আমাদের গল্পটা অন্য রকম হতো। আমি তোমার প্রস্তাব মেনে নিতাম। কিন্তু এখন আমি সেই অবস্থায় নেই। এই পৃথিবীতে একেক জনের চিন্তাভাবনা একেক রকম। আমার চিন্তাভাবনা বরাবরই অন্য রকম হয়। আমি যতদিন বাঁচব ততদিন একাই বাঁচতে চাই। আমি তোমাকে মেনে নিতেই পারি। তবে এতে করে তুমি ভালো থাকবে না।

আমাকে না পেলে তুমি সাময়িক কষ্ট পাবে। কিন্তু আমাদের বিয়ে হলে তোমাকে সারাজীবন এমন একটা সংসার বয়ে বেড়াতে হবে যেখানে কোনো অনুভূতি থাকবে না। থাকবে না কোনো সুখ, শান্তি। আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেললাম। আমাকে তুমি মাফ করে দিয়ো।”

আচমকা কুয়াশা সাফওয়ানের হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। এই প্রথম কুয়াশার স্পর্শ পেল সাফওয়ান। সে চকিত দৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে।
“এই মেয়ে, কাঁদছ কেন? তোমার কথাগুলো আমি বুঝতে পেরেছি। তুমি কেঁদো না। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আমি একদম কষ্ট পাব না। সব ভালোবাসার পূর্ণতা পেতে হবে এমন কোনো কথা আছে নাকি? আমি আর সবার মতো বলতে পারব না যে তোমাকে ভালোবাসতে হবে না আমাকে। আমি একাই ভালোবেসে আমাদের সংসার সাজাবো। এমন কথা বললে সেটা মিথ্যা বলা হবে। কারণ শুধুমাত্র একজনের ভালোবাসায় আমাদের সংসার গড়ে উঠলে সেই সংসারে কোনো সুখ থাকবে না।”

“আমাকে এক অসীম অপরাধবোধ ঘিরে রেখেছে। তোমাকে কষ্ট দেওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। বিশ্বাস করো তোমাকে কখনো হারাতে চাইনি। একজন প্রকৃত বন্ধুর যা যা করণীয় তুমি সব করেছ। আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব তোমার কাছে। যে ছেলেটা আমাকে এত সাহায্য করল আজ তার কষ্টের কারন আমি। এর থেকে বাজে কিছু আর কি হতে পারে?”
“চুপ, একদম চুপ। কে বলেছে তুমি আমার কষ্টের কারণ? এসব একদম ভাববে না। আমার তোমাকে নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। তুমি যদি একা ভালো থাকো তবে তাই হোক।”

“আমাকে মাফ করবে তো তুমি?”
“তোমাকে মাফ করার কোনো প্রশ্নই আসে না। কারণ তুমি কোনো অন্যায় করোনি। জোর করে ভালোবাসা হয় না। তুমি যা করেছ একদম ঠিক করেছ। আমি নিজেই চাই না, তুমি নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করো। তাই তোমার সিদ্ধান্ত আমি মেনে নিলাম।”
কুয়াশার দিকে তাকিয়ে সাফওয়ান অদ্ভুত এক আবদার করে বসে।

“আমি কি একবার তোমাকে স্পর্শ করতে পারি? শুধু তোমার চোখের পানি মুছে দিতে চাই। অনুমতি দিবে?”
কুয়াশা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে “হ্যা” বোধক জবাব দেয়। সাফওয়ান আলতো হাতে কুয়াশার চোখের পানি মুছে দেয়।
“অনেক তো কাঁদলে। এবার একটু হাসো। তুমি কি জানো? তোমার মুখের হাসি তোমার সৌন্দর্য হাজার গুণ বাড়িয়ে দেয়। সব সময় এই মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখো কুয়াশা।”

“আমি তো তোমার আবদার পূরণ করলাম। এবার তুমি আমার একটা আবদার পূরণ করবে?”
“অবশ্যই পূরণ করব। কখনো তো কিছু চাওনি। বলো কী করতে হবে?”
“তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করবে না। খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করবে। সুখী পরিবার হবে তোমার। বউকে অনেক অনেক ভালোবাসবে। কী বাসবে তো? আমাকে কথা দাও তুমি।”

সাফওয়ান কিছু বলতে যাবে তার আগেই কুয়াশা আবারো বলে ওঠে,
“দয়া করে না বলবে না। তুমি না বললে আমি সারাজীবন অপরাধ বোধ করে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাব। তুমি কী এটাই চাও?”
সাফওয়ান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শান্ত কণ্ঠে বলে,
“আমি রাখব তোমার কথা। কবে, কখন আর কাকে বিয়ে করব সেটা জানি না। তবে কোনো একদিন তোমার এই আবদার অবশ্যই পূরণ করব আমি। কথা দিলাম তোমাকে।”

সাফওয়ানের এমন উত্তরে কুয়াশা চোখ বন্ধ করে লম্বা নিঃশ্বাস নেয়।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য আদ্রিতা আর মলি কিছু করতে যাবে তার আগেই সাফওয়ান সবাইকে বিদায় জানিয়ে চলে যায়। কুয়াশার মন খারাপ থাকায় সে নিজেও বাসায় যেতে চায়। বাসায় গিয়ে ঘরের দরজা লাগিয়ে চুপচাপ বসে থাকে সে।
“আমার জীবনে কখনো কেউ স্থায়ী হয় না। যাকে নিজের সবচেয়ে কাছের একজন ভাবলাম তাকেও হারিয়ে ফেললাম। আচ্ছা আর কী কোনো পরিক্ষা দেওয়া বাকি আছে আমার? নাকি এখানেই সবকিছুর সমাপ্তি হবে? আমি যে বড্ড ক্লান্ত!”

বিঃদ্রঃ গতকালকের পর্বে অনেকেই বলেছেন এই পর্বটা নাটকীয় লাগছে। আপনাদের বারবার এক কথা বলতে বলতে আমি ক্লান্ত। এখন তবে শুনুন সবাই, এই গল্পের মেইন ক্যারেক্টারগুলো বাস্তবেও আছে। কুয়াশা এবং সাফওয়ানও বাস্তবে আছে। এবং তাদের দু’জনের সম্পর্কের পরিণতি কি হয়েছে সেটাই আমি এই গল্পে তুলে ধরছি। সুতরাং এখানে আমি মনগড়া কোনো কাহিনি লিখছি না।

বরং বাস্তব জীবনের কুয়াশা যে সিদ্ধান্ত নিয়ে জীবন অতিবাহিত করছে এবং সাফওয়ান যা করেছে সেটাই লিখছি। এখন গল্পটা আপনাদের বাজে, নাটকীয় লাগলেও আমার কিছুই করার নেই। কুয়াশা সাফওয়ানকে মেনে নেয়নি। পুরো গল্প শুরু থেকেই ভাবা ছিল আমার। কারণ ঘটনাগুলোর সাক্ষী আমি। একটা মেয়ে তার জীবনে একা থাকবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার সে ব্যতিত আর কারোর নেই।

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ২৮

বাস্তবে এমন হলে তো বাহবা দেন। তাহলে গল্পে হলে নাটক লাগে কেন? বাস্তবে কেউ কী একা থাকে না? কারোর ভালোবাসা কী অপূর্ণ থাকে না? সত্যিই কী আমি ন্যাকামিতে ভরপুর এবং নাটকীয় গল্প লিখছি? বাস্তবতা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। আপনারা যা চাইবেন সেই অনুযায়ী কারোর জীবন চলবে না। আপনারা আমার উপর রাগ করছেন। কিন্তু কুয়াশার জীবনে যা যা হয়েছে সেটা আমার হাতে ছিল না। আজও আমার হাতে নেই। তাই গল্পটা এখন সবার খারাপ লাগলেও আমি সমাপ্তি যেভাবে দেওয়ার কথা ভেবেছি সেভাবেই দিব।

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে শেষ পর্ব