কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ১২

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ১২
লেখায় নামিরা নূর নিদ্রা

“কুয়াশা তুমি ফিরে এসো আমার জীবনে। আমি তোমাকে ফিরে পেতে চাই। আমাকে কী মাফ করে দেওয়া যায় না?”
কলের অপরপ্রান্তে থাকা মানুষটার এমন কথায় কুয়াশা একরাশ বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,
“মিস্টার তুরাব তৌহিদ! আপনার কী আমাকে ফেলনা মনে হয়? আপনি কোন সাহসে ফিরে যাওয়ার কথা বলেন?”
“জানি তুমি আমার উপর রেগে আছো। আর এটাই স্বাভাবিক। আমাকে যত ইচ্ছা বকাবকি করো। কিন্তু ফিরে এসো।”

“এটা আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। আপনার জীবনে আমি ফিরে যাব না।”
“তাহলে ডিভোর্স দিচ্ছো না কেন?”
“এই কৈফিয়ত আমি আপনাকে এখন দিব না। সময় আসলে নিজেই উত্তর পেয়ে যাবেন।”
“তুমি কী আমাকে ভালোবাসো না?”
“ভালোবাসা আর আপনি? কীভাবে সম্ভব? আপনার মত একজন মানুষকে ভালোবাসা যায় না। ঘৃণা করা যায়। আমি আপনাকে ঘৃণা পর্যন্ত করি না। কেন জানেন? কারণ ঘৃণা করতে হলেও মনে জায়গা দিতে হয়। আমি আপনাকে আমার মনে জায়গায় দিতে চাই না।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আমি অসুস্থ শুনে ঢাকা থেকে ছুটে এসেছিল কেন হাসপাতালে আমাকে দেখতে?”
“আমার সাথে অন্যায় করা মানুষটা এত সহজে দুনিয়া থেকে চলে যাবে? তার মধ্যে অনুশোচনা জাগার আগেই সে বিদায় নেবে? সেটা কী করে হয়? তাই আপনি বেঁচে আছেন কিনা সেটা দেখতে গিয়েছিলাম।”
“আর খাবার?”

এই প্রশ্নের জবাবে কুয়াশা কিছু বলে না। কথা ঘোরানোর জন্য বলে,
“আপনি এত কিছুর পরেও আমার সাথে কথা বলছেন কীভাবে? লজ্জা করছে না?”
“লজ্জা থাকলে কী তোমার কাছে আসতে চাইতাম? আমি জানি আমি খুব বড়ো অন্যায় করেছি। আমি এখন নিজের ভুল শোধরাতে চাই।”
“আর সবকিছু বাদ দিলাম। কিন্তু যে ছেলে বিয়ের পরেও ঘরে বউ রেখে অন্য মেয়ে নিয়ে হোটেলে যায় তার সাথে আদৌও থাকা যায়?”
“কুয়াশা!”

“ভাবছেন এসব আমি কীভাবে জানলাম? আপনার বাড়ি ছেড়ে আসার আগের দিন রাতে আমি একবার আপনার ফোন নিয়েছিলাম। আপনার ম্যাসেজ অপশনে ঢুকে আমি স্তব্ধ সেদিন রাতেই হয়েছিলাম। পরের দিন আপনার সাথে এসব বিষয়ে কথা বলার জন্যই ছাদে উঠেছিলাম। আর তারপর যা হয়েছে সেটা তো সবার জানা। আপনার এসব কুকীর্তি আমি কাউকে বলিনি। নিজের কাছেই লজ্জা লাগে। আমার স্বামী আমাকে ঘরে রেখে অন্য মেয়ের কাছে যায়। এর থেকে লজ্জার আর কিছু হতে পারে না একজন বিবাহিতা নারীর জন্য।”

তুরাব নিশ্চুপ হয়ে কুয়াশার কথা শুনছে। এই মুহূর্তে কিছু বলার মুখ তার নেই। সে ভেবেছিল কুয়াশা এসব জানে না। কিন্তু এই মেয়ে তো সবকিছু জানে। ফলস্বরূপ তুরাব নিজে থেকেই কল কেটে দেয়। কুয়াশা ফোনের দিকে তাকিয়ে নিরবে হাসে। এই হাসি সুখের হাসি নয়। এই হাসির মধ্যে লুকিয়ে আছে মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা সহস্র যন্ত্রণা!

ফোনের ডাটা অন করে ফেসবুকে ঢুকতেই চরম এক ধাক্কা খায় কুয়াশা। চোখের সামনে ভেসে উঠেছে রায়াদ আর তার নববিবাহিতা স্ত্রীর ছবি। গতকাল রাতে অতিরিক্ত ক্লান্ত থাকায় ফেসবুকে আসা হয়নি তার। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমে তুরাবের কল আর তারপর রায়াদের বিয়ের ছবি দেখে কুয়াশা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। চোখের পাতা ফেলতে পারছে না সে। চোখগুলো আটকে আছে ছবিতে। ফোনের রিংটোনে ঘোর কাটে কুয়াশার। কণ্ঠ কাঁপছে ভীষণ। তবুও নিজেকে সর্বোচ্চ শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলে,

“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ম্যাম কুরিয়ার অফিস থেকে বলছি।”
“জি বলুন।”
“আপনার নামে একটা পার্সেল এসেছে।”
“আমি তো কিছু অর্ডার করিনি।”
“ম্যাম এটা হয়তো উপহার হিসেবে এসেছে আপনার জন্য। আপনি পার্সেলটি কখন রিসিভ করবেন?”
“আপনি চাইলে এখনই দিয়ে যেতে পারেন। আমি বাসায় আছি।”
“আচ্ছা আমি ২০ মিনিটের মধ্যে আসছি।”
“ঠিক আছে।”

ফোন রেখে কুয়াশা ভাবনায় মগ্ন হয়ে যায়। সে তো কিছু অর্ডার করেনি। তবে কে তার জন্য পার্সেল পাঠালো!
প্রায় ২০ মিনিট পর ডেলিভারি ম্যান এসে কুয়াশার হাতে পার্সেল দিয়ে চলে যায়। আজ বাসায় আদ্রিতা নেই। সে সকাল সকাল তার প্রয়োজনীয় একটা কাজে বের হয়েছে। কুয়াশা পার্সেল নিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে বসলো। পার্সেল খোলার জন্য উদ্যত হলে সে খেয়াল করে প্রেরকের জায়গায় তার চিরচেনা নাম্বার।

এই নাম্বার তার বড্ড চেনা। এটা যে রায়াদের ফোন নাম্বার! কুয়াশা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে সামলে নিল। সে জানে এই পার্সেলে কি আছে। খুব সম্ভবত সেই ডায়েরি যেটা কুয়াশা তাকে দিয়েছিল। পার্সেলটা যত্নসহকারে পড়ার টেবিলের উপর রেখে সে তৈরি হয়ে নেয় প্র্যাকটিসে যাওয়ার জন্য। সে প্রায় প্রস্তুত উকিল হওয়ার জন্য। আর মাত্র কয়েক দিন পর সে পরিপূর্ণ উকিল হবে। আর হয়তো চার/পাঁচ দিন আছে। তারপরেই তার নতুন যাত্রা শুরু হবে।

পার্সেল রেখে দেওয়ার কারণ হলো এখন এই পার্সেল খুললে কুয়াশা হয়তো নিজেকে সামলাতে পারবে না। তাই রাতে যা হওয়ার হবে। এখন তার প্র্যাকটিসে যাওয়া ভীষণ জরুরি।
দূর থেকে কুয়াশাকে হেঁটে আসতে দেখে সাফওয়ান হাসিমুখে সেদিকে এগিয়ে যায়।
“আজ তোমার আসতে দেরি হলো কেন? তোমার শরীর ঠিক আছে?”
“হ্যা, ঠিক আছি আমি। আসলে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছে।”

“আচ্ছা তুমি কী আজ আমাকে একটু সময় দিতে পারবে প্র্যাকটিসের পর? তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে।”
“আচ্ছা সমস্যা নেই।”
একে-অপরের সাথে কথা বলতে বলতে কুয়াশা এবং সাফওয়ান ভেতরে চলে যায়। বিকালের দিকে দু’জন বেরিয়ে আসে। আজ কাজ কম থাকায় তাড়াতাড়ি বের হতে পেরেছে তারা।
“এখন কোথায় যাবে?”
“আজ কোনো রেস্টুরেন্ট বা ক্যাফেতে বসবো না। আজ তোমাকে আমার খুব পছন্দের একটা জায়গায় নিয়ে যাব।”
“কোথায় সেটা?”
“গেলেই দেখতে পাবে। চলো আমার সাথে।”

সাফওয়ান কুয়াশাকে একটা খোলামেলা জায়গায় নিয়ে যায়। চারপাশে সবুজের সমারোহের মাঝে ছোট্ট একটা কুটির। মূলত এটা সাফওয়ানের দাদার জায়গা। সাফওয়ান কুয়াশাকে নিয়ে সেই কুটিরের মধ্যে প্রবেশ করে। এ যেন বইয়ের এক রাজ্য। চারপাশে বইয়ের তাঁকে শতশত বই সাজানো। একপাশে বারান্দার মত একটা জায়গায় দু’টো বেতের তৈরি চেয়ার আর একটা টেবিল রাখা।
“এখানে বসে আমি মাঝেমধ্যে বই পড়ি। এখান থেকে প্রকৃতিকে সুন্দরভাবে অনুভব করা যায়। আমি বেশ উপভোগ করি এসব।”

“এত সুন্দর একটা জায়গায় তুমি আমাকে আগে কেন নিয়ে আসোনি সাফওয়ান?”
“তোমার ভালো লেগেছে এই জায়গা।”
“ভীষণ ভালো লেগেছে। আমি বরাবরই বইপ্রেমী মেয়ে। তার উপর এমন মনোরম পরিবেশ হলে তো কথায় নেই!”
“আমারো বই পড়তে ভালো লাগে।”
“আচ্ছা এটা কার জায়গা?”

“এটা আমার দাদুর জায়গা। আমার আঠারো তম জন্মদিনে দাদু আমাকে এই জায়গা উপহার দিয়েছে। মানে আমার জন্যই এই জায়গা কেনা হয়েছে এবং আমার মনের মত করে সাজানো হয়েছে।”
“বাহ্! ভারি সুন্দর!”
“হুম।”
“আচ্ছা তুমি কখনো তোমার পরিবার সম্পর্কে আমাকে কিছু বলোনি। কেন?”
“তুমি কখনো জিজ্ঞেস করেছ আমায়?”
কুয়াশা কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দেয়,

“তা করিনি৷ কিন্তু তুমি নিজে থেকে তো বলতে পারতে।”
“আজ বলছি। আমি ঢাকারই ছেলে। আমার পরিবারের সবাই এখন আমেরিকায় থাকে। শুধুমাত্র আমি বাংলাদেশে আছি৷ আমার নিজের দেশ ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না তাই।”
“ওও আচ্ছা। তোমার পরিবারে কে কে আছে? আর সবাই আমেরিকায় কেন গিয়েছে?”

“আমাদের যৌথ পরিবার। আমার পরিবারে সবাই আছে। আমার বাবা, মা, ছোট বোন, দাদু, দিদা, ফুপি, ফুপির ছেলে-মেয়েরা, সবাই একসাথে থাকে। আসলে আমার দিদা আমেরিকান। দাদু আর দিদার প্রেমের বিয়ে বুঝেছ? বিয়ের পর যখন আমার বাবা হয় তখন দাদু দিদাকে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল।

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ১১

এরপর বাংলাদেশ আর আমেরিকায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল আমার পরিবারের মানুষদের। এক সময় সবাই আমেরিকায় থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক লম্বা কাহিনি। আজ এসব কথা থাক। অন্য একদিন গল্প করব এসব নিয়ে। আজ আমার কথাগুলো তুমি মনোযোগ দিয়ে শুনবে।”
সাফওয়ানের কথায় কুয়াশা মা থা নেড়ে সম্মতি জানায়।

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ১৩