কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ১৩

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ১৩
লেখায় নামিরা নূর নিদ্রা

“কুয়াশা আমি কী তোমার হাতটা ধরতে পারি? আমরা কী একসাথে পথ চলতে পারি?”
সাফওয়ানের এমন কথায় কুয়াশা কিছুটা হকচকিয়ে যায়।
“এসব তুমি কী বলছ সাফওয়ান?”

“দেখ কুয়াশা আমাদের পরিচয়ের সময়টা কিন্তু ছয় মাসের কাছাকাছি। প্রায় অর্ধ বছর ধরে আমরা একে-অপরকে চিনি। এতদিন আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে তোমার পাশে ছিলাম। এখন থেকে থেকে আমি বন্ধু হয়ে তোমার পাশে থাকতে চাই। বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে চাই তোমার দিকে। তুমি কি গ্রহণ করবে আমাকে বন্ধু হিসেবে?”
সাফওয়ানের কথায় কুয়াশা লম্বা শ্বাস নিয়ে হাসিমুখে তাকায় তার দিকে। যাক, তার ভয় সত্যি হয়নি। এই ভয় সত্যি হলে যে সাফওয়ানের সাথে আর কথা বলা হতো না!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“কেন গ্রহণ করব না? তোমার মত বন্ধু কি সবাই পায় নাকি? আমি তোমাকে বন্ধু হিসেবে পাচ্ছি। এটা তো আমার সৌভাগ্য।”
“তার মানে তুমি আমার বন্ধুত্ব গ্রহণ করছ?”
“অবশ্যই। কেন নয়? তুমি যেভাবে এতদিন আমার পাশে ছিলে এরপরেও সেইভাবে পাশে পাব এটা ভেবেই তো আমার ভালো লাগছে। আমি সত্যি অনেক খুশি হয়েছি সাফওয়ান।”

কুয়াশার কথায় সাফওয়ান খুশি হয়ে কুয়াশার হাতে হাত রাখতে চেয়েও হাত সরিয়ে নেয়। কুয়াশা এটা খেয়াল করে মুচকি হাসে। অনেক দিন আগে কথায় কথায় সে সাফওয়ানকে বলেছিল, আমার অনুমতি ব্যতিত কোনো ছেলে আমাকে স্পর্শ করলে আমি তাকে সহ্য করতে পারি না। সেটা যদি হাত ধরা হয় তবুও তাকে আমি অপছন্দের তালিকায় রাখি। ছেলেটা এখনো সেই কথা মনে রেখেছে ভেবেই কুয়াশার মন ভালো হয়ে যায়।

“আরো একটা কথা বলতে চাই। বলতে পারো তোমার কাছে এটা আমার আবদার।”
“কী আবদার?”
“আমি তোমার কাজে তোমাকে সাহায্য করতে চাই।”
“কোন কাজে?”
“এই যে তুমি এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম চালাতে চাও। অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়ালেখার দায়িত্ব নিতে চাও। এই কাজগুলোতে আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই তোমার পাশে থেকে।”

“এতে তো আমারই ভালো হবে। আমরা সবাই মিলে একসাথে কাজ করলে কাজ করা অনেক সহজ হবে।”
“আমরা সবাই মানে?”
“আমার এই উদ্যেগ একার নয়। আমার সাথে মলি মানে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড মল্লিকা আর আদ্রিতা যুক্ত আছে। আমার মা আমার পাশে আছে। তাছাড়া আমার কাছের আরো কয়েকজন বন্ধু আমার সাথে কাজ করতে চায়।”
“বাহ্! তাহলে তো অনেক ভালো হবে।”

“হ্যা। তোমাকে পেয়ে আরো ভালো হলো। আচ্ছা এটাই তোমার জরুরি কথা?”
“হুম। আমি আসলে ভয় পাচ্ছিলাম যে তুমি আমাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে কিনা। তুমি তো ছেলেদের এখন খুব একটা পছন্দ করো না। এজন্য আরো বেশি ভয় পাচ্ছিলাম।”
“তোমাকে যদি অপছন্দ করতাম তাহলে কী আজ এখানে আসতাম তোমার সাথে?”
“আচ্ছা তোমার তো বাসায় ফিরতে হবে। আগে কিছু খেয়ে নিই আমরা। তারপর তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিব আমি।”
“আরে না না এসবের দরকার নেই।”

“আজ না করো না। অনুরোধ করছি তোমাকে। একসাথে খেলে কি খুব সমস্যা হবে?”
“তা নয়। কিন্তু আদ্রিতা আমার জন্য আজ না খেয়ে বসে থাকবে। ওও বলেছে একসাথে খাবে।”
“সমস্যা নেই তো। ওকে ডেকে নাও। আমরা আজ একসাথে রাতের খাবার খাব।”
“এখানেই খাবে?”

“হ্যা। আজ আমি নিজের হাতে রান্না করব।”
“বাব্বাহ! তুমি রান্না করতে পারো?”
“বেশ ভালোই রান্না করতে পারি। মানে মুখে দিতে পারবে এটুকু নিশ্চয়তা দিতেই পারি।”
“আদ্রিতার আসতে ঘন্টাখানেক সময় লাগবে।”
“আমার ততক্ষণে রান্না হয়ে যাবে। তুমি ওকে ডেকে নাও।”
“আচ্ছা।”

অতঃপর কুয়াশা আদ্রিতাকে কল করে এখানে আসার ঠিকানা দিয়ে দ্রুত চলে আসতে বলে। অন্যদিকে সাফওয়ান রান্নার ব্যবস্থা করছে। কুয়াশা সাফওয়ানের পাশে গিয়ে বলল,
“এটুকু একটা কুটিরে রান্নার জন্য জায়গা আছে। আবার থাকার জন্য একটা বিছানা তৈরি করা। তুমি কি মাঝেমধ্যে এখানে এসে থাকো নাকি?”
“হ্যা। যখন আমার সম্পূর্ণ একা থাকতে ইচ্ছা করে তখন এখানে আসি আমি। আমার সবচেয়ে পছন্দের জায়গাগুলোর মধ্যে এই জায়গা অন্যতম।”

“ভালোই তো। আমাদের বাড়িতে ছাদের উপর আমার জন্য তৈরি করা একটা ঘর আছে। আমার মনের মত করে সাজানো ঘর। ওই ঘরে আমার অনুমতি ব্যতিত সকলের প্রবেশ করা নিষেধ। শুধুমাত্র মা ঢুকতে পারে আমাকে না বলে।”
“কী আছে ওই ঘরে?”
“আহামরি কিছু নেই। আবার অনেক কিছুই আছে। তুমি কখনো আমাদের বাড়িতে গেলে তোমাকে দেখাবোনি ঘরটা।”
“ওই ঘর দেখার জন্য হলেও তো যেতে হবে দেখছি।”
“আচ্ছা এরপর আমি বাড়িতে যাওয়ার সময় তোমাকে নিয়ে যাব।”
“সত্যি?”

“তিন সত্যি। এই তুমি কী রান্না করবে আজ?”
“গরম গরম খিচুরির সাথে কালা ভুনা কেমন লাগে তোমার?”
“আমার তো পছন্দের খাবার এটা।”
“আমারো খুব ভালো লাগে। সেইজন্য আজ খিচুরি আর কালা ভুনা রান্না করব।”
“আমিও তোমাকে সাহায্য করি। দু’জন একসাথে করলে তাড়াতাড়ি হবে।”

দু’জন গল্প করতে করতে রান্না শুরু করে। এরমধ্যেই আদ্রিতা এসে হাজির। কুয়াশা আদ্রিতাকে রাস্তা থেকে কুটির পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। আদ্রিতা বেচারির এই জায়গা খুঁজে পেতে খুব কষ্ট হয়েছে সেটা তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কুয়াশা তাকে চেয়ারে বসিয়ে পানি দিয়ে বলল,
“এই নে পানি। একটু শান্ত হ দোস্ত।”
আদ্রিতা এক নিঃশ্বাসে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে দম নেয়।
“ভাই এই জায়গা খুঁজতে আমার অনেক বেগ পেতে হয়েছে। এতগুলো রাস্তা এখানে। আমি একবার এই রাস্তায় যাই তো আরেক বার অন্য রাস্তায়। খুঁজেই পাচ্ছিলাম না এই কুটির।”

“আহারে বাচ্চাটা। থাক কষ্ট পাস না। এই দেখ সাফওয়ান আমাদের জন্য আজ রান্না করছে।”
আদ্রিতা সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ভাইয়া তো দেখি সবদিক দিয়েই এগিয়ে আছে। উকিল সাহেব এখন রাঁধুনি হাহাহাহাহ!”
সাফওয়ান খাবার সাজিয়ে টেবিলে আনতে আনতে বলে,

“সবকিছুই শিখে রাখছি। যেন ভবিষ্যতে আমার বউয়ের আফসোস করতে না হয় যে তার বর কিচ্ছু পারে না।”
“ভালো ভালো। এমন বর তো ভাগ্য করে পাওয়া যায়। আপনার ভবিষ্যৎ বউ নিঃসন্দেহে ভাগ্যবতী একজন।”
“এত প্রশংসা করো না। আগে খেয়ে তো দেখ কেমন হয়েছে।”
সবাই হাত ধুয়ে এসে থালায় খাবার বেড়ে নেয়। খাবার মুখে দেওয়ার সাথে সাথে কুয়াশা আর আদ্রিতাকে একে-অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে দেখে সাফওয়ান ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে,
“রান্না ভালো হয়নি?”

“আরে ভাইয়া অসাধারণ হয়েছে। অনেক মজা হয়েছে।”
আদ্রিতার কথায় কুয়াশা সম্মতি জানিয়ে বলে,
“সত্যি অনেক ভালো হয়েছে। আমার থেকেও ভালো রান্না করো তুমি।”
“সেটা তো তোমার হাতের রান্না খাওয়ার পর বুঝবো যে কে বেশি ভালো রান্না করে।”
“আচ্ছা আগামীকাল আমি রান্না করে নিয়ে আসব তোমার জন্য। খুশি?”
সাফওয়ান মুখে কিছু না বলে হেসে খাবার খেতে শুরু করে। অনেক হাসি, মজা, আড্ডা দিতে দিতে সবাই খাওয়া শেষ করে। কুয়াশা ফোন হাতে নিয়ে দেখে রাত নয়টার কাছাকাছি সময় এখন।

“এই আমাদের এখন বের হতে হবে। দশটার মধ্যে বাসায় যেতে হবে।”
“আচ্ছা আমি রেখে আসি তোমাদের।”
“না না, তোমাকে এত কষ্ট করে এই রাতের বেলা আর যেতে হবে না। আমরা দু’জন যেতে পারব। তুমি শুধু বড়ো রাস্তার মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দাও আমাদের।”
“ঠিক আছে চলো। আর কোনো সমস্যা হলে সাথে সাথে আমাকে কল দিবে।”

“ইনশাআল্লাহ কোনো সমস্যা হবে না। আর কোনো সমস্যা হলে তোমাকে জানাব। তুমি চিন্তা করো না।”
সাফওয়ান কুয়াশা আর আদ্রিতাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে নিজের বাসায় চলে যায়। বাসায় এসে দু’জন ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। কুয়াশা সাফওয়ানের সাথে কলে কথা বলে ফোন রেখে আদ্রিতার দিকে তাকায়।
“এই আদ্রিতা জানিস? রায়াদ বিয়ে করেছে গতকাল। আবার আজ সকালে কুরিয়ার থেকে একটা পার্সেল দিয়ে গিয়েছে আমাকে। রায়াদ পাঠিয়েছে পার্সেল।”

কুয়াশার এহেন কথায় আদ্রিতা লাফ দিয়ে উঠে বসে।
“এসব কী বলছিস তুই? রায়াদ ভাইয়া বিয়ে করেছে? ওও না কিছুদিন আগেও তোর পেছনে ঘুরছিল।”
“বাদ দে। সুখী হোক নতুন জীবনে এই দোয়া করি।”
“পার্সেলে কী আছে?”
“এখনো খুলিনি। সকালে সময় ছিল না। তাই পার্সেল ওইভাবে রেখেই বের হয়েছিলাম।”
“চল খুলে দেখি কি আছে।”

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ১২

কুয়াশা পার্সেল নিয়ে বিছানায় বসে আদ্রিতাকে বলে,
“তুই খুলে দেখ। আমার ভালো লাগছে না।”
অগত্যা, আদ্রিতা একটা কাঁচি নিয়ে এসে পার্সেল খুলতে শুরু করে।

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ১৪