হৃদয়হরণী পর্ব ৫৫

হৃদয়হরণী পর্ব ৫৫
তানিশা সুলতানা

দিন দিন সকলে ছোঁয়াকে যত দেখছে অবাক হয়ে যাচ্ছে। সেই দিনের ছোঁয়া যে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেললো লাফালাফি করে। সারাক্ষণ দুষ্টুমি করাই ছিলো যার পেশা। সেই ছোঁয়া এখন কোমরে ওড়না বেঁধে স্বামীর সেবা করে যাচ্ছে। রান্না থেকে শুরু করে সাদির জামাকাপড় ধোঁয়া সবটা একা হাতে করে যাচ্ছে সে।

কাউকেই কিচ্ছু করতে দিচ্ছে না। এতে অবশ্য ছোঁয়ার চেহারায় অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। এই কয়েকদিনেই জাদু ছোঁয়া খানিকটা শুকিয়ে গিয়েছে। ধবধবে ফর্সা মুখ খানায় একটুখানি কালচে বর্ণের দেখা মিলেছে। চোখের নিচেও কালি জমে গেছে। সার জেগে সাদির হাতে পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। এটা অবশ্য সাদি জানে না। সে ঘুমিয়ে পড়লেই ছোঁয়া এ কাজ করে। ছোঁয়ার ধারণা রাতে হাতে পায়ে ব্যাথা করবে আর কষ্টে সাদির ঘুম ভেঙে যাবে। হাত বুলিয়ে দিলে ব্যাথা কমবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সাত দিন পার হয়েছে। পায়ের ব্যাথা খানিকটা কমেছে। আজকে ব্যান্ডেজ খুলে দেওয়া হবে। এক পা দু পা বাড়াতে পারে সাদি। একটু কষ্ট হলেও ম্যানেজ করে নিতে পারে।
সাদির শরীর মুছিয়ে তার গায়ে শার্ট চাপিয়ে ছোঁয়া নিজে গোছল করতে গিয়েছে। সাদির সাথে সেও যাবে। তাকে হাজারবার না করেছে সাদি। বলেছে যেতে হবে না। কিন্তু ছোঁয়া মানতে নারাজ সে যাবেই। এটা নিয়েও সাদি হতাশ। সেখানে গেলে কেঁদে কুটে অস্থির হয়ে যাবে। ডাক্তার ভালো মন্দ কিছু বললেও সে কাঁদবে। কিন্তু কি আর করার?
বউ যখন যাবে বলেছে তাকে নিতেই হবে। উপায় নেই।

সাদি উঠে দাঁড়ায়। এক পা এক পা করে এগোতে থাকে। দরজা ওবদি আসতেই হাঁপিয়ে উঠেছে সে। ব্যান্ডেজ না থাকলে অবশ্য এতোটা কষ্ট হতো না। হুইল চেয়ারও আনা হয়েছে তার জন্য। কিন্তু তাতে খুব প্রয়োজন ছাড়া সাদি বসে না।

দরজা ধরে দাঁড়িয়ে যায়। ভেবেছিলো নিচে যাবে। কিন্তু এই অবস্থায় যাওয়া সম্ভবই না। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সাদি। দরজা ধরে দাঁড়িয়েই থাকে ছোঁয়ার আসার অপেক্ষায়। এই মুহুর্তে সে ছোঁয়ার সাহায্য ছাড়া খাট ওবদি যেতেই পারবে না।

মুচকি হাসে সাদি। এক্সিডেন্ট হওয়াতে তার এতটুকুও আক্ষেপ হচ্ছে না৷ বরং মনে হচ্ছে ভালোই হয়েছে। এক্সিডেন্ট না হলে কখনোই ছোঁয়ার এই রূপটা দেখতে পেতো না। কখনোই বুঝতে পারতো না তার বউ এতোটা যত্নশীল।
চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হয় ছোঁয়া। কিছু দিন আগেও শীতের মধ্যে গোছল করতে ভয় পেতো। বায়না ধরে বসতো। সেই ছোঁয়া এখন কোনো বায়না ছাড়াই গোছল করে ফেলে।

সাদিকে দরজার সামনে দেখে কলিজা কেঁপে ওঠে ছোঁয়ার। সে দৌড়ে আসে।
“কি হয়েছে আপনার? এখন কেনে এসেছেন? কিছু লাগবে? আমাকে কেনো ডাকলেন না?
ছোঁয়ার উত্তেজনা দেখে সাদি তার ডান হাতটা আলতো করে ছোঁয়ার গালে রাখে।
” ঠিক আছি আমি। একটু হাঁটার চেষ্টা করছিলাম।

ছোঁয়ার আঁখি পল্লব ভিজে উঠেছে। এখুনি গড়িয়ে পড়বে গাল জুড়ে।
“একা একা হাঁটার চেষ্টা করতে হবে না। আমি আছি তো। আমি সাহায্য করে দিবো।
সাদি ভদ্র ছেলের মতো মাথা নারায়। এই মুহুর্তে এতটুকুও অবাধ্যতা করলে তার আধপাগল বউ কেঁদে কেটে পুরো বন্যা বানিয়ে ফেলবে।
ছোঁয়া হাত ধরে সাদিকে খাটে এনে বসায়। তারপর ভেজা কাপড় মেলতে যায়। সাদি দেখতে থাকে তার ম্যাচুউট বউকে।

কেটে যায় দুটো মাস। সাদি এখন পুরোপুরি সুস্থ। তাকে আর তার ভাড়া বাড়িতে যেতে দেওয়া হবে না। সাদিও আর যেতে চায় না। ছোঁয়ার ইন্টার ফাস্ট ইয়ারের এক্সাম শেষ হয়েছে। পরিক্ষা খুব খারাপ দিয়েছে। ক্লাস করে নি ঠিকঠাক তারপর বাড়িতেও বই ছুঁয়ে দেখে নি। এক্সাম খারাপ হওয়ারই কথা। দুই সাবজেক্টে ফেল করবে এটা ছোঁয়া ভালো করেই জানে।

সাদি অফিসে যাওয়া শুরু করেছে। দু মাস রেস্টে থাকার পরে আজকেই তার প্রথম অফিস। সকাল সকাল অফিসের জন্য তৈরি হয়ে গিয়েছে সে। ছোঁয়া এখন আর সাদির পেছনে লেগে থাকে না। মা এবং শাশুড়ীর হাতে হাতে কাজ করে দেয়। আজকেও তেমন কোমরে ওড়না গুঁজে রুটি বেলছিলো।
সাবিনা রুটি ভাজি করছে।

” ছোঁয়া মা যা তুই। আমরা পারবো। অনেক বেলেছিস।
সাবিনা বলে ওঠে।
ছোঁয়া রুটি বেলায় মনোযোগ দিয়ে বলে
“বড় মা যেতে বলিও না। সংসার করা শিখছি গো। ইন ফিউচার আমার যখন বারোটা বাবু হবে তখন তো আমাকে সব কাজ করতে হবে তাই না? এতো এতো রুটি বেলতে হবে।
নাজমা বেগম সবজি কাটছিলো। তিনি চাকু রেখে মেয়ের পানে তাকায়। সাবিনাও হতদম্ভ।

” কয়টা বেবি?
বড়বড় চোখ করে সুধায় নাজমা।
“কয়টা আবার? বারোটা।
এগারোটা ছেলে আর ১ টা মেয়ে।
সাদি এসেছিলো খাওয়ার জন্য। ছোঁয়ার এমন কথা শুনে তার কাশি উঠে যায়। ছোঁয়া বেলুন রেখে তারাহুরো করে সাদিকে পানি দেয়। নাজমা এবং সাবিনা মুচকি হেসে নিজেদের কাজে মন দেয়।
সাদি ছোঁয়ার হাত থেকে পানির গ্লাস না নিয়ে কান টেনে ধরে।

” কয়টা বেবি না?
ছোঁয়া কান ছাড়ানোর চেষ্টা করে জবাব দেয়
“চব্বিশটা
সাদি আরও একটু জোরে কান টেনে ধরে। ছোঁয়া ব্যাথা পায়।
” এবার বলো কয়টা?
ছোঁয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বলে
“বারোটা

সাদি আরও একটু জোরে টেনে ধরতেই ছোঁয়া বলে ওঠে
” দুটো দুটো
দুটো বাচ্চা নিবো।
আমি সরকারি স্লোগান জানি তো
“দুটো সন্তানের বেশি নয় একটা হলে ভালো হয়”
সাদি কান ছেড়ে দেয়।
“হুমম গুড গার্ল। যাও খাবার নিয়ে এসো আমার জন্য।

ছোঁয়া ভেংচি কেটে খানিকটা দূরে যায় সাদির থেকে। তারপর বলে ওঠে
” আমি সরকারের স্লোগান ভেঙে দিবো। ছোঁয়া নিজের স্লোগান ঘরে ঘরে পৌঁছে দিবে
“বারোটা সন্তানের বেশি নয় চব্বিশটা হলে ভালো হয়”

হৃদয়হরণী পর্ব ৫৪

সাদি পায়ের জুতো খুলতে যেতেই ছোঁয়া এক দৌড়ে পালিয়ে যায়। নাজমা এবং সাবিনা শব্দ করে হাসতে থাকে। কতোদিন পরে মেয়েটার বাচ্চামি দেখলো তারা। এতোদিনে বোধহয় বাড়ির প্রাণ ফিরে এলো।
সাদিও হাসে। তার আধপাগল বউ যে নিজের রূপে ফিরে এসেছে এটা ভেবেই তার মনের মধ্যে সুখ বয়ে যাচ্ছে।

হৃদয়হরণী পর্ব ৫৬