হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ১৯+২০

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ১৯+২০
তোয়া নিধী দোয়েল

মুখমণ্ডলে ঠান্ডা পানির ছিটা পড়তে ঘুম ভেঙে যায় আদনানের। আজ শুক্রবার। তাই নামাজ আদায় করে তুর্কিকে ঘুমাতে বলছে। আর নিজেও শুয়েছিলো।
কিন্তু, হঠাৎ পানি এলো কোথায় থেকে! ও কপালে ভাঁজ ফেলে; এক হাত দিয়ে মুখ মুছে চোখ মেলে তাকায়। তুর্কি সবুজ রঙের শাড়ি পরে হাতে ভেজা চুলের আগা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আদনান দুই ভ্রুর মাঝে ভাঁজ ফেলে। এই মেয়ের মাথায় সকাল সকাল কোন ভূত চাপলো আবার! তুর্কি লম্বা করে হেসে বলে,
‘উঠুন, স্যার। অনেক সকাল হয়ে গেছে। এতক্ষণ কেউ ঘুম আসে? অফিস যাবেন কখন? খাবার খাবেন কখন? উঠুন উঠুন?’

আদনান শরীর উপর থেকে কাঁথা সরিয়ে উঠে বসে। তবে, ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে তুর্কির দিকে। এই মেয়ের হলো কি সাত সকালে! রেজুয়ানকে ধরতে হবে। ও নিশ্চয়ই বাড়িতে গাঁজা পাতা এনেছে। সেই পাতার ঘ্রান বাতাসে বাতাসে এসে ওর বউয়ের উপর প্রভাব ফেলছে৷ যার ফলস্বরূপ সকাল সকাল মাথা খারাপ হয়েছে। আদনান দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করে,
‘অফিস যাবো মানে?’
তুর্কি কপাল চাপড়ে বলে,
‘দেখুন আপনার সাথে যখন আমার বিয়ে হয়ে-ই গেছে। আপনাকে তো আর ছাড়তে পারবো না। তো তাই আপনাকে রোমান্টিক বানানোর চেষ্টা করছি স্যার। আপনার বউ একটু বেশি রোমান্টিক তো। যাতে আমার রোমান্টিকতার জন্য আমাকে ছেড়ে না দেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তো শুনুন রোমান্টিক হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে, প্রতিদিন স্বামীকে ভেজা চুলের পানি দিয়ে ঘুম থেকে তোলা। আর স্বামী ঘুম থেকে উঠে বউয়ের চুল মুছে দেওয়া। ওকে? তারপর এক সঙ্গে খাবার শেষ করা।
তারপর অফিস থেকে এসে বউকে শার্টের বোতাম খুলতে বলা।’
তুর্কি আড়চোখে আদানানের দিকে তাকায়। আদনান ঘাড় কাত করে চোখ ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে৷ তুর্কি হেসে বলে,
‘লজ্জা পাবেন না স্যার। প্রথম প্রথম একটু লজ্জা লাগবে। পরে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন। ঠিক আছে। তো পরের কথা শুনুন।’

তুর্কি পাশ থেকে চেয়ার টেনে বসে। ভেজা চুল চেয়ারের উপর দিয়ে হেলান দিয়ে বসে। আবার বলা শুরু করে
‘কিন্তু, আমাদের বেলায় তা উলটো। যেখানে আমার স্বামী আমাকে ঘুম থেকে তোলে। তবে (আদনানের দিকে তাকিয়ে) এইটা কিন্তু আলট্রা-প্রো-ম্যাক্স রোমান্টিক কাজ৷ কিন্তু, আমার বর আমার মুখে পানি ঢেলে ঘুম থেকে তোলে৷ কারণ সে আল্ট্রা প্রো ম্যাক্স আনরোমান্টিক! সে জানে-ই না বউয়ের সাথে কিভাবে রোমান্টিক ব্যাবহার করতে হয়। এই যে এত সুন্দর শাড়ি পরে তার সামনে এসেছি অথচ একটা কমপ্লিমেন্ট পর্যন্ত দিলো না।’
আদনান তুর্কিকে পরখ করে বলে,
‘শাড়িটা কার?’
‘আমার শাশুড়ী মায়ের। সুন্দর না?’
পরপরই একটু দুখি স্বরে বলে,

‘ইসস! আমার কত ইচ্ছে ছিলো বিয়ের পর শাশুড়ী মায়ের সব শাড়ি পড়ে ঘুরে-বেড়ানোর। সব সময় স্বামীর সেবা করার। পাকা গিন্নির মত রান্না-বান্না করার। বাড়ির সব কাজ করার। বাচ্চা-কাচ্চা সামলানোর। কিন্তু…’
তুর্কি আড়চোখে আদানানের দিকে তাকায়। পরপর-ই হেসে বলে,
‘নাহ্! বাচ্চা-কাচ্চা সামলানোর ভাগ্য তো আমার নেই। আমার বর একটু বেশি আনরোমান্টিক। সমস্যা নেই স্যার। আপনি আমাকে ছোট ছোট দুইটা জমজ পুঁচকু কিনে এনে দেবেন। জমজ বেবি আমার ভীষণ পছন্দের! আমি ওদের নিজের মত করে মানুষ করবো ওকে।’
আদনান দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলে,

‘আই নো, তোমার বয়স এখনো আঠারো হয়নি। ফর দ্যাট তোমাকে তোমার মত করে প্রিপেয়ার হওয়ার টাইম দিয়েছি। আরেকটু ম্যাচিউর হওয়ার জন্য টাইম দিয়েছি। এখন দেখছি এইটা আমার সব চেয়ে বড় ভুল!’
‘এইতো স্যার লাইনে এসেছেন। আমি তো আপনাকে এইটা বোঝানোর চেষ্টা করছি। আমি বিয়েই করেছি পড়া-লেখা না করার জন্য। স্বামী সেবা করার জন্য। ছোট ছোট পুঁচকু সামলানোর জন্য। কিন্তু আপনি? আলট্রা-প্রো-ম্যাক্স আনরোমান্টিক। বউয়ের সাথে রোমান্টিক কথা তো দূর এতদিন বিয়ে হয়েছে অথচ এখন পর্যন্ত বউয়ের হাত পর্যন্ত ধরে দেখেনি! একটা চুমা ও খেয়ে দেখেনি।’
এই বলে তুর্কি আড়চোখে আদানানের দিকে তাকায়। আদনানের মাঝে কোনো পরিবর্তন হয় নি। ও একই ভাবে বসে রয়েছে। তুর্কি পূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বলে,
‘লজ্জা পাবেন না স্যার। একদম লজ্জা পাবেন না। আপনি তো আনরোমান্টিক তাই আপনার শুনতে হয়তো খারাপ লাগছে।’

আদনান এক হাতের কনুই হাটুতে ঠেকিয়ে আঙুল থুতনিতে ঠেকায়। ঘাড় বাঁকা করে বলে,
‘সকাল সকাল মীমের সাথে দেখা হয়েছিলো?’
তুর্কি অবাক চোখে তাকিয়ে বলে,
’মীম কে!’
‘রেজুয়ান।’
‘সত্যি কথা বলুন, মীমকে। কোয়েল ম্যাডাম আপনার গার্লফ্রেন্ড জানতাম। কিন্তু, এখন আবার মীম নামে কাকে জুটালেন? এমনিতে তো বউয়ের সামনে ভাজা মাছটা উলটে খেতে জানেন না। একটা রোমান্টিক কথা বললে ঘাড় ধরে পড়তে বসান। এখন আবার তলে তলে এত গুলা রিলেশন করেন?’
’স্টোপ ইউর ননসেন্স! রেজুয়ানের নাম মীম। যেটা জিজ্ঞাসা করেছি সেটার উত্তর দেও।
তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে বলে,

‘কুত্তায় কামড়ায়ছে। সাত সকালে ওই চিটার- বাটপারের মুখ দেখে দিন নষ্ট করবো।’
‘তাহলে সাত সকালে এই সব আবোল-তাবোল কি বলছো?’
তুর্কি দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলে,
‘আপনার কাছে এই সব আবোল-তাবোল কথা মনে হচ্ছে?’
‘নাহ। মনে হচ্ছে নেশা করে এসেছো।’
তুর্কি চোখ বড় বড় করে বলে,
‘নেশা করলে কি মানুষ রোমান্টিক হয়? তাহলে আমি প্রতিদিন আপনার খাবারে একটু করে নেশার জিনিস মিশিয়ে দিবো যাতে আপনি রোমান্টিক হয়ে যান।’
আদনান শরীর থেকে কাঁথা সরিয়ে বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে বলে,
‘ও ও বেগম সাহেবা। ইউ নো দ্যাট, হাসবেন্ড ওয়াইফের মাঝে আরও কিছু হয়! আরো ডিপ কিছু। সেই জন্য তোমাকে একটু ম্যাচিউর হওয়ার টাইম দিয়েছিলাম। কিন্তু, এখন দেখি আমার বউ আমার থেকে বেশি ম্যাচিউর। ওকে কাম হেয়ার।’

তুর্কি এক লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে। চেয়ারের পেছনে গিয়ে কোমড়ে গোঁজা শাড়ির আঁচল খুলে ফেলে। আদনান চেয়ারের ওই পাশে দাঁড়ালে তুর্কি ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে,
‘স্যার! স্যার! এখন আমার ঘাড় ধরে পড়তে বসাবেন তাই-তো? ওকে ওকে যাচ্ছি।’
আদনান তুর্কি চেয়ারকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে। আদনান তুর্কিকে ধরার চেষ্টা করে বলে,
‘না না পড়তে বসাবো না। একটু আগে যেটা চাচ্ছিলে সেটা দেবো। দৌড়াচ্ছো কেনো। কাম হেয়ার। কাম হেয়ার।’
‘না না স্যার। আমি কিছুই চাচ্ছিলাম না। এতক্ষণ ধরে ঘুম আসলে আপনার শরীর খারাপ হবে তাই ডেকে তুললাম।’
‘ওকে বেগম সাহেবা। নো প্রবলেম। কাম হেয়ার। ঘুম থেকে উঠে বউকে চুমা দিতে হয়। একটু আগে বললে। তো আসো।।’

‘না, স্যার আমার চাইনা।’
‘স্যার, আপনি এই ভাবে দৌড়াচ্ছেন কেনো? আপনাকে আমি রোমান্টিক কথা বলতে বলেছি৷ অন্য কিছু কর‍তে বলিনি।’
‘না না। একটু আগে যেনো কী বলছিলে? তোমার টুইন লিটল বেবি চাই। তো এখন দৌড়াচ্ছো কেনো!’
আদনান তুর্কি চেয়ারকে কেন্দ্র করে ঘোরা বিদ্যমান রেখে কথা চালিয়ে যেতে থাকে।
‘আরে স্যার, আমি তো ছোট পুঁচকু কিনে এনে দিতে বলেছি। আমি কি পাগল আপনার মত বলদ বলদ চেহারার লোকের বেবি চাবো? পরে সবাই বলবে, কি রে তুই এত সুন্দর। কিন্তু তোর পুঁচকু গুলো এই রকম বলদ বলদ চেহারার কেনো? তখন আমি কি বলবো?

আমি আমার পুঁচকু গুলো নিয়ে কোনো রিস্ক নিতে চাই না। তাই ওদের কিনে আনবো। আমি তো জাস্ট আপনাকে রোমান্টিক কথা বলা শিখতে বলেছি। আপনার সাথে কথা বলতে গেলে আপনি সব সময় আমাকে পড়তে বসান। এইটা কোন টেন্স? ওই টা কোন ছাঁই? এই সব জিজ্ঞাসা করেন। সেই জন্য রোমান্টিক কথা শিখাতে চাইছিলাম।’
আদনান দাঁড়িয়ে বলে,
‘আমার রোমান্টিক কথা বলা পছন্দ না। সেটা কাজে করতে বেশি পছন্দ।’
তুর্কি ও চেয়ারের ওই পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
‘ওকে। তাহলে আমি আই লাভ ইউ বললে আর জিজ্ঞাসা করবেন না এইটা কোন টেন্স। ওকে?’
‘পড়ার সময় অন্য কথা আমার পছন্দ না।’
‘আচ্ছা এখন তো পড়ছিনা। তাহলে এখন বলি? স্যার, আই লাভ ইউ।’
’এই দিকে আসো।”
আদনান হাত দিয়ে টান মেরে চেয়ার সরায়। তুর্কি ঘোরা বাদ দিয়ে ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আদনান ও ওর পিছু পিছু রুম থেকে বের হয়।

তুর্কি লম্বা বারান্দা দিয়ে ছুটছে। সবুজ শাড়ির আঁচল, লম্বা চুল বাতাসের দরুন এলোমেলো হয়ে উড়ছে। আদনান পিছু নেওয়া বাদ দিয়ে দরজায় এক হাত দিয়ে ওর ছুটে যাওয়া দেখে। অজান্তে-ই ঠোঁট চেপে হাসে। কি অদ্ভুত সুন্দর এই ছোট মেয়েটি! কি চঞ্চল! মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, পৃথিবীতে এত মেয়ে থাকতে কেনো হৃদয়ের সঙ্গোপনে এই ছোট কিশোরীটি বাঁধলো! কেনো এই ছোট কিশোরীকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করলো! কী মায়ায় বেঁধেছে ওকে?’
আদনান ঘুরে রেজুয়ানের ঘরে যায়। ওই ফাজিলের জন্য-ই সাত সকালে ওর বউ এমন ক্ষেপেছে।
তুর্কি সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় দেখে নিচে একজন বয়স্ক মহিলা বসে রয়েছে। ও একবার উপরে তাকিয়ে দেখে আদনান আসছে নাকি। নাহ নেই। ও বুকে হাত দিয়ে শ্বাস নেয়। তারপর শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে নেয়। মহিলা ওকে দেখে ডাকে,

‘ওই আদুর বউ এনে আয়। তোর তো দেহাই পায় না। জামাই নিয়া খালি ঘরে-ই থাকছ। আমাগো ওইদিক তো বেড়াইবার ও যাস না।’
তুর্কি মৃদু হেসে মহিলার কাছে যায়। মহিলা ওর মাথা পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,
‘ভালো আসো বইন।’
‘জি। আপনি কেমন আছেন?’
‘এইতো। কবে জানি উপর থিকা ডাক আহে যাওনের। তা বইনে জামাই আদর সোহাগ করে তো?’
তুর্কি কিছু বলে না। হেসে মনে মনে আওড়ায়,
‘যে ঢংয়ের জামাই আমার। একটা রোমান্টিক কথা বলতে জানে না।’
‘ সুখে থাকো বইন। জামাই সব।
তা বইনে পুলাপান হইবো কবে? বিয়া তো কবে হইছে। পুলাপান নিয়া ফালাও। তা না হইলে পরে ঝামেলায় পড়বা।’

তুর্কি মুখে হাসি রেখে মনে মনে আওড়ায়,
‘যে লোকের সাথে বিয়ে হয়েছে, পোলাপান তো দূর একটা রোমান্টিক কথা বললে দশটা অংক করতে দেয়।’
রচনা এসে বলে,
‘কি যে বলেন আম্মা। মাত্র বিয়ে হলো। তার ওপর বাচ্চা মানুষ। এখনি বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে কি করবো। যাক আরও কয়েক বছর।’
‘কি দিন আইলো। আমাগো বেলায় তো বিয়ার কয় দিন যাওনের লগে লগে পুলাপান পেটে ধরছি। আর এহনকার বউরা পুলাহান নিবারই চাই না।’
রান্নাঘর থেকে হুমাইরা রচনাকে ডাকে। মুজাহিদকে চা দিয়ে আসতে। তুর্কি রচনাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
‘চাচিয়াম্মু আমি যাচ্ছি।’

‘না না। তুমি বউ মানুষ তুমি কাজ করবে কেন?। আমি যাই।’
‘না না চাচিয়াম্মু। প্রতিদিন তো কলেজে থাকি। আজ একটু কাজ করি।’
এক প্রকার জোর করে তুর্কি রান্নাঘরে যায়। হুমাইরা বলে মুজাহিদকে চায়ের কাপ দিয়ে আসতে।
কাল এত রাতে শোয়ার দরুন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে রেজুয়ান। আদনান দরজা খুলে রেজুয়ানের শরীর থেকে কাঁথা সরায়। পাশ থেকে জগ নিয়ে সম্পূর্ণ পানি ওর মুখের উপর ঠেলে দেয়। রেজুয়ান আতকে উঠে বলে, ‘কাঠগোলাপ। কাঠগোলাপ।’
আদনান রেজুয়ানের কান টেনে বলে,
‘তোর কাঠগোলাপর বাচ্চা। কাল রাতে বাড়ি গাঁজা পাতা নিয়ে আসছস?’
রেজুয়ান চোখ বড় বড় করে বলে,

‘আস্তাগফিরুল্লাহ! ভাই, কাঠগোলাপ আমার বউ। তুমি এইটা কি বললা? আমাগো বাচ্চার নাম থাকবে কচুগোলাপ।’
‘চুপ। আগে বল বাড়িতে কি গাঁজা পাতা নিয়ে আসছস?’
‘ধুর। গাঁজা পাবো কই? আমি তো সিগারেট খাওয়াই বাদ দিছি। ঠোঁট কালা হলে আবার কাঠগোলাপ কিস করবো না।’
‘তো আমার বউ নেশা করলো কই থেকে? ও সাত সকালে উল্টা-পাল্টা কথা শুরু করছে।’
রেজুয়ান ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে বলে,
‘হয়তো রাতের বেলা ভালো মতো আদর করো নাই। তাই সকাল বেলা আবল-তাবল বলছে।’
আদনান ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘লাথি খাওয়ার আগে ওঠ। ও নিচে গেছে। গিয়ে পাহারা দে। কোনো বড় কাজে যেনো হাত না দেয়।’
‘তোমার বউ তুমি যাও। আমি ঘুম আসবো। শরীর হ্যাং হয়ে গেছে। ’
‘আমার কিছু কাজ আছে। কাজ শেষ করে আসছি। তুই যা আপাতত।’
‘ভাই।’

‘যেতে বলছি। আমার চোখে যদি পরে ও কোনো কাজে হাত দিছে, তাহলে তোর খবর আছে। বিয়ে করার শখ মিটিয়ে দেবো। আমি নিজে কাঠগোলাপকে অন্য ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে আসবো। তাড়াতাড়ি যা।’
‘না ভাই, এমন করো না। যাচ্ছি। তোমাগো জন্য আমার বিয়েটা বেহেস্তে যাবে কেনো।’
মুজাহিদ টেবিলে বসে বই পড়ছিলো। তুর্কি দরজায় দাঁড়িয়ে বলে,
‘চাচ্চু আসবো।’
মুজাহিদ দরজার দিকে তাকিয়ে চমৎকার করে এসে বলে,
‘আরে মা। আসো আসো। বাপের ঘরে আসতে আবার অনুমতি লাগে নাকি।’
তুর্কি ধীর পায়ে হেঁটে মুজাহিদ কে চা দেয়। মুজাহিদ বলে,
‘বসো মা।’
‘না চাচু। নিচে কাজ আছে।’
মুজাহিদ চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে তুর্কির কথা শুনে মুখ পুড়িয়ে ফেলে। অবাক হয়ে বলে
‘তুমি কাজ করবে মানে?’

‘এমনি আম্মার সাথে বসে দেখবো। প্রতিদিন তো কলেজে-ই থাকি। বাড়ির কাজ আমার ভীষণ ভালো লাগে।’
‘ও আচ্ছা। আচ্ছা যাও। কিন্তু, খবরদার কাজে হাত দিও না। তোমার জামাই জানতে পারলে আমাদের দুই পাহাদার কে পিটাবে।’
‘পাহারাদার মানে!’
অবাক হয়ে প্রশ্ন করে তুর্কি। মুজাহিদ হেসে বলে,
‘ও তুমি বুঝবে না। সাবধানে যাও।’
তুর্কি মুজাহিদকে বিদায় জানিয়ে রুম থেকে বের হয়। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় আবির্ভাব ঘটে রেজুয়ানের। ও তুর্কির পথ আটকিয়ে বলে,
‘ভাবিজান। কই জান? আপনে এখন থাকেন কই? দেখাই পাওয়া যায় না?’
তুর্কি চোখ মুখ শক্ত করে বলে,
‘কবরে। সরুন।’

‘ইসস! মাটির নিচে অনেক গরম? আমাকে নিয়ে যেতে পারেন না। বাতাস করার জন্য। আপনি গরমে কালা হয়ে গেলে আপনার জামাই আমাদের জীবন কয়লা করে দিবে।’
তুর্কি ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘আপনার কোনো কাজ নেই তাইনা? তাই সব সময় আমার পেছনে পড়ে থাকেন?’
‘কাজ নেই মানে? আমার সব চেয়ে বড় কাজ আপনাকে পাহারা দেওয়া। যার বিনিময়ে আমার ভাই আমার পছন্দ করা মেয়েকে আমার কাছে এনে দিবে।’
তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে বলে,
‘সরুন এখান থেকে।’
তুর্কি রেজুয়ানকে উপেক্ষা করে নামতে গেলে রেজুয়ান আবারো সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
‘আরে বলবেন তো যাচ্ছেন কোথায়।’
‘রান্নাঘরে। শুনেছেন? এখন সরুন।’
‘রান্নাঘরে কেনো যাবেন?’
‘রান্নাঘরে মানুষ কিসের জন্য যায়?’

‘আরে, আপনি রান্নাঘরে গেলে আপনার জামাই আমাদের রান্না করে ফেলবে। শোনেন, আমাদের রান্নাঘরে যে ভূত আছে এই কথা মা আপনাকে বলে নাই?’
তুর্কি ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘ভূত!’
‘আরে হো ভূত। আমাদের রান্নাঘরের পেছনে একটা হিজল গাছ আছে। ওই গাছে হিন্দু বাড়ির এক বউ ফাঁসি দিয়ে মারা গেছিলো। সে শুধু খাইতো। জামাইয়ের খাবার ও খেয়ে ফেলতো। তাই জামাই মারছিলো। সেই দুঃখে ফাঁসি দিছিলো। সেই থেকে ওই বউয়ের আত্মা আমাদের রান্নাঘরের আশে পাশে ঘুরে বেরায়। মরার পর ও খাবারের জন্য ঘুর ঘুর করতো।

আমার এক দাদি। থুক্কু আমার দাদি তো একটা-ই। তো আমার দাদি একা একা এক দিন সন্ধ্যা বেলা রুটি বানাইতেছিলো। রুটি ভাজার সময়, রান্নাঘরের পাশে যে জানালা ওই জানালা দিয়ে লাল সাদা চুড়ি পরা একটা হাত বাড়িয়ে রুটি চাইছিলো। আমার দাদি খুব সাহসী ছিলো। তাই, ভয় না পেয়ে একটা রুটি দিছিলো। ওই রুটি শেষ করে আবারো হাত বাড়ায়ছিলো। সেই থেকে যেই একা রান্নাঘরে রান্না করে ওই বউ হাত বাড়ায়। আর যে খাবার না দেয় তার গলা টিপে মেরে ফেলে। তাই বলতেছ, আপনি রান্না ঘরে যাইয়েন না।’
তুর্কি আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে,
‘ভাবলেন কী ভাবে আপনার মত বাটপারের কথা বিশ্বাস করবো? আপনি কি পরিমাণ চিটার সেটা আমার জানা বাকি নেই। তাই, এই সব উল্টা-পাল্টা কথা আমাকে শুনিয়ে লাভ নেই। সরুন।’
তুর্কি রেজুয়ানকে সরিয়ে নিচে নামে। রেজুয়ান সিঁড়ি থেকে বলে,
‘হ্যাঁ, যান। ঘাড় মটকিয়ে দিলে বুঝবেন।’

তুর্কি মুখ বাকিয়ে চলে যায়। তবে মনে মনে ওই ভূতের কথা চিন্তা করতে থাকে। যদি ও ঐ বাটপারের কথা ও বিশ্বাস হয় না। এক নাম্বারের চিটার ওই ছেলে। মাঝে মাঝে মন চাই ঝুঁটি টেনে ছিঁড়ে দিতে।
রান্নাঘরে গেলে হুমাইরা বলে আটা মাখতে। তিনি বাগান থেকে সবজি আনতে যাবে। আটা দেখে তুর্কির একটু ভয় লাগে। যদি সত্যি সত্যি ওই হাতটা আসে! পরক্ষণে-ই ভাবে ওই বাটপারের কথা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। তবে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে তাকায়। জানালার পাশে কোনো হিজল গাছ নেই। বিশাল পুকুর রয়েছে। ও জানে ওই চিটার মিথ্যা কথা বলেছে।

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ১৮

তাই, ও নিশ্চিন্তে তক্তার উপর থেকে আটার বয়াম পেরে বাটিতে আটা ঢালে। বয়াম জায়গা মত রাখতে গেলে একজোড়া হাত ওর হাতের পাশে দেখে। ভয়ে ‘ আ আ ভূত’ বলে চিৎকার করে উঠে। হাত থেকে আটার বয়াম ফস্কে যায়। সামনে থাকা ব্যাক্তিটিকে জাপটে ধরে। আটার বয়ামের মুখ খোলে ওদের দুজনের উপর সব আটা পড়ে। তুর্কি ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার করতে থাকে,
‘ভূত! ভূত! আল্লাহ! বাঁচাও আমাকে! আমাকে খেয়ে ফেললো! আল্লাহ! ভূত ভূত!’

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ২১