হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ২২
তোয়া নিধী দোয়েল
আদনান দরজার কাছে যায়। সেখানে উপস্থিত হয় হুমাইরা আর তুর্কি। তুর্কি হুমাইরার পেছনে তাঁর শাড়ির আঁচল ধরে হাতের আঙুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচেতে দাঁড়িয়ে আছে।
আদনানের দিকে দৃষ্টি পড়তে স্বভাবতঃ মুখ বাঁকায়।
রেজুয়ান শুয়ে মুখ দরজার দিকে ফিরিয়ে রেখেছে। আর মুজাহিদ বিছানায় বসে। হুমাইরা আদনানের সামনে এসে ওর কান টেনে ধরে। আদনান চোখ মুখ খিঁচে ফেলে। হুমাইরা কিঞ্চিৎ কণ্ঠ কঠিন করে বলে,
-ও কে কী বলছস? ও আমার কাছে গিয়ে কান্না করতেছে?
শুয়ে শুয়ে রেজুয়ান বলে,
-ওইডারে কিছু বলা লাগে না। এমনি এমনি ব্যা..ব্যা..করে।
আদনান ঘাড় ঘুরিয়ে রেজুয়ানের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি কঠিন করে। মুজাহিদ রেজুয়ানের পশ্চাৎদেশে লাথি মেরে বলে,
-এত বকা খাস তবু ও শরম হয় না? আবার বউমার পিছনে লাগছ।
-হো সত্য কথার ভাত নাই।
-তোকে মিথ্যে কথাতেই বেশি মানায়। সত্য বলতে যাস কেন?
হুমাইরা আদনানের কান জোরে টেনে বলে,
-তুই ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করছস কেন? ঝগড়া করছস কেন?
-কখন ঝগড়া করলাম?
তুর্কি এক পা এগিয়ে এসে আঙুল উঁচিয়ে বাজখাঁই গলায় বলে,
-এক দম মিথ্যে কথা বলবেন না। একটু আগে আমার সাথে ঝামেলা করেছেন।
আদনান সুরু চোখে তাকিয়ে বলে,
-তো ঝামেলাটা কে আগে শুরু করেছিলো? তুমি না আমি?
হুমাইরা কান আরও জোরে টেনে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-আমার বউমা একশো বার ঝগড়া করবে। তুই কেন ওর সাথে ঝগড়া করবি? তুই কেন ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করবি? ও ছোট মানুষ না? তুই বুইড়া ছেলে হয়ে কেন ওর সাথে ঝগড়া করবি?
-তুমি ওর মা? না আমার মা?
-এত দিন তোর মা ছিলাম। এখন ওর মা। আমি এত কথা শুনতে চাই না। আমার বউমার দোষ থাকলে ও তুই চুপ থাকবি৷ না থাকলে ও চুও থাকবি। তুই ওর সাথে ঝগড়া করতে পারবি না। ও যদি আরেকবার আমার কাছে বিচার নিয়ে আসে। তোকে দেখিছ কী করি।
রেজুয়ান শোয়া থেকে উঠে বসে। বিদ্রোহী কণ্ঠে বলে,
– মাতাশ্রী, এইটা অন্যায়। আমার ভাইয়ের মত ভালো মানুষ পৃথিবীতে আরেকটা ও হয় না। তোমার বউমাই পাজি। সব সময় ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করে। আমি নিজে সাক্ষী।
আদনান কটমট করে তাকিয়ে বলে,
-চুপ থাকবি তুই।
রেজুয়ান অবাক হয়ে মুজাহিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
-দেখছো বাপের ভাই, যার জন্য চুরি করলাম, সেই বলে চোর।
-আমি থাকলে শুধু চোর বলতাম না। সাথে ঘাড় ধরে পুলিশের কাছে দিয়ে আসতাম। গাঞ্জুটি, তোরে এত কথা বলতে বলে কে?
হুমাইরা ছেলেকে শাসিয়ে চলে যায়। তুর্কি আদনানের দিকে এগিয়ে শয়তানি হাসি দিয়ে বলে,
-দেখলেন তো আমার পেছনে লাগার ফল কী? যদি আর কোনো দিন, কোনো মেয়ের কথা আমার সামনে বলেন, আমার পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করেন, এর থেকে খারাপ অবস্থা করবো। আজ তো শুধু কান মলা খাওয়ালাম। মনে থাকে যেনো অসভ্য লোক।
এই বলে তুর্কি মুখ ভেঙিয়ে চলে যায়। আদনান ভ্রু কুঁচকে বিড়বিড় করে,
-হায়রে আমার পিচ্চি বউ! এর জন্য এত কিছু করি, তবু ও আমার পেছনে আদা- জল খেয়ে লেগে আছে।
রেজুয়ান ব্যঙ্গ স্বরে বলে,
-আরও কিনে দেও পাঁচ হাজার টাকা দামের শাড়ি। দিলো তো বাঁশ দিয়ে। উচিত কাজ হয়ছে। জাহিদ মাস্টার চলো আমরা একটু সেলিব্রেট করি। আমাগো জীবনে একটা টাকা খাওয়া না। অথচ, বউয়ে এত দামি শাড়ি গিফট করে। এখন দিলো না বউ বাঁশ দিয়ে।
-তুমি চিন্তা কইরো না বাচ্চা। তোমার কপালে এর থেকে কঠিন কিছু জুটবো।
-হুম বা*। আমার কথা অমান্য করবো তো, শুধু কানের তিন আঙুল নিচে মারা হবে।
আদনান এগিয়ে এসে বলে,
-তুই এই কথা বলিস না। তিন বেলা এসে বলস, ভাই কাঠগোলাপকে আমার চাই। ওকে এনে দাও। ওকে না পেলে বাঁচবো না। আরও কত কী? আর তুই মারবি বউ? কি বলো জাহিদ মাস্টার?
মুজাহিদ দুই পা এগিয়ে দিয়ে বলে,
-নে সালাম কর। এখন থেকে তিন বেলা আমাকে সালাম করবি। তোগো থেকে বয়সে বড় হয়ে ও আমি সিংগেল। আর তোরা বিয়ে-শাদী করে বউয়ের হাতে উত্তম-মধ্যম খাস। ছিঃ ছিঃ ছিঃ…!
আদনান রেজুয়ানের ঘাড়ে চড় দিয়ে বলে,
-ও বলে সিংগেল। প্রতি রাতে যে এক্স এর জন্য আমরা জেনো জানিনা।
-বাপের ভাই, নাটক করে লাভ নেই। আমরা সব জানি।
-তবু ও, তোদের মত বউয়ের হাতে উত্তম-মধ্যম খাই না। কথা বাদ দিয়ে এখন খাইতে চল। আজ জুমার দিন। তাড়াতাড়ি গোসল সেরে মসজিদে যেতে হবে।
রেজুয়ান আদনান মুজাহিদের উদ্দেশ্যে বলে,
-আজ বাড়ির পেছনে তাল-পুকুরে গোসল করতে যাবো। কেমন জানি অস্থির লাগতেছে। ভ্যাপসা গরম লাগে।
আদনান বলে,
-কাঠগোলাপকে এনে দিলেই শান্তি লাগবে। কী বলো বাপের ভাই?
মুজাহিদ বলে,
-পানি ভালো?
-তাইলে। অনেক ঠান্ডা ও।
আদনান দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করে
-এই তুই বাড়ির পিছনে গেছিলি কেন? আর জানলি কীভাবে ওই পানি ঠান্ডা?
মুজাহিদ বলে,
-মনে হয় গাঁজা খাইতে গেছিলো। আর খাইতে খাইতে টাল হয়ে পানিতে পড়ে গেছিলো।
এক সাথে হেসে উঠে মুজাহিদ আর আদনান। রেজুয়ান বিছানা থেকে নেমে বলে,
-ধুর আসো তো।
গেরস্ত বাড়িতে শুক্রবারের দুপুর মানে আনন্দের মেলা। এই দিনটি তাদের কাছে ঈদের দিনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। বাকি ছয়টা দিন যে যার কর্মস্থলে ব্যস্ত থাকে। আর এই একটা দিনই সবাই এক সাথে দুপুরে জমিয়ে ভোজ সারতে পারে। আড্ডা দিতে পারে।
আজ সবাই চেয়ার-টেবিল ছেড়ে বারান্দায় পাটিতে বসে খাবে। বারান্দার উপাশে সারি সারি কাঠগাছ৷ মাঝে মাঝে দুই একটা আম, সুপারি গাছ ও আছে। আর তার কিছু দূর তালগাছে ঘেরা তাল-পুকুর।
বাড়িতে আজ রান্না হয়েছে আমন-চালের ভাত, গরুর গোশত, বেগুন ভাজি আর ডাল। শেষ পাতে পায়েস। বাড়ির পুরুষেরা এক সাথে মসজিদে গেছে জুমার নামাজ আদায় করতে। তুর্কি, মোহোনা, সূচনা বারান্দায় পাটি বিছিয়ে সব খাবার এনে সাজাচ্ছে। হুমাইরা রচনা গোসল সেরে নামাজ আদায় করছে। তুর্কির ভীষণ পছন্দ এই বাড়ি। এই বাড়ির মানুষ গুলো। কত সুন্দর মিলেমিশে থাকে। ওর সব চেয়ে বেশি পছন্দের মূহুর্ত, এই যে সবাই মিলে এক সাথে খাবার খায়। এক সাথে থাকে। ভীষণ ভীষণ ভালো লাগে।
একক পরিবারে বড় হওয়ার জন্য আগে কখনো এই রকম আনন্দ পাইনি। তার উপর বাবা ও বাইরে থাকে। সব সময় দুই মা মেয়েই থেকেছে।
মোহোনা বলে ভাবি লেবু আর শশা কাটা হয় নি। তুর্কি বলে ‘দাঁড়াও নিয়ে আসছি।’
এই বলে লম্বা বারান্দা পেরোই। মোড় ঘুরে সিঁড়িতে পা দেওয়ার সময় দেখা হয় রেজুয়ানের সাথে। পরনে সাদা পাঞ্জাবি। মাথায় টুপি। সাধারণত রেজুয়ান শুক্রবারের নামাজ ছাড়া, আর কোনো নামাজ আদায় করে না। স্বভাবতঃ তুর্কিকে জ্বলানোর জন্য বলে,
-ভাবিজান কই যান?
তুর্কি ওর ত্যাড়া কথার জবাব দেয়।
– জাহান্নামে।
-চিন্তা কইরেন না। আপনি না চাইলেও আপনার ঠাই জাহান্নামে হবে। জামাইয়ের সাথে যেমন দূর্ব্যবহার করেন! আমি আপনার ছোট্ট মাসুম একটা দেবর, আমার সাথে যেমন করেন। ফেরেশতারা আপনাকে এমনিতেই ঘাড় ধরে জাহান্নামে ফিক্কা মারবে।
তুর্কি কিঞ্চিৎ রাগ নিয়ে কপালে ভাঁজ ফেলে। রাগী স্বরে বলে,
-মাত্র না মসজিদ থেকে আসলেন? তবু ও মনে থাকা শয়তানটা দূর হয় নাই?
-হবে কীভাবে? আমি…
-তুই যাবি এখান থেকে? নাকি অন্য উত্তম-মধ্যম দিতে হবে?
রেজুয়ানের পিছনে এসে দাঁড়ায় আদনান। যার পরনে সাদা পাঞ্জাবি । রেজুয়ান আর কিছু না বলে জায়গা ত্যাগ করে। তুর্কি আদনানেদ মুখের দিকে তাকিয়ে স্বভাবতঃ মুখ বাঁকায়৷ আদনান চোখ ছোট ছোট করে বলে,
-আমাকে দেখলে কি তোমার মুখ সব সময় বেঁকে যায়?
তুর্কি আরেকবার মুখ বাঁকিয়ে বলে,
-রাস্তা ছাড়ুন। আপনার সাথে আমার কথাই বলতে ইচ্ছে করে না। মুখ বাঁকায় এই তো অনেক।
-কই যাবে?
-যেখানে মন চাই সেখানে। আপনাকে বলবো কেনো?
এই বলে তুর্কি সিঁড়ি দিয়ে নামিতে থাকে৷ আদনান ও কোনো শব্দ না করে ওর পিছু পিছু নামতে থাকে।
তুর্কি রান্নাঘরে গিয়ে লেবু শশা বের করে৷ আদনান দরজায় হেলান দিয়ে তা পরখ করে। বঁটি বের করতেই আদনান বাধা দিয়ে বলে,
-ধুয়ে নিয়ে এসো। আমি কেটে দিচ্ছি।
তুর্কি ভ্রুকুঞ্চন করে বলে,
-আপনি এখানে এসেছেন কেনো? বেরিয়ে যান।
-যাচ্ছি, আগে তোমার হাতের কাজটা করে দেই। যদি আবার হাত কেটে ফেলো। তখন ক্ষতিটা তো আমারই হবে।
-আপনার কিসের ক্ষতি?
-হাত কেটে গেলে অঙ্ক করবে কীভাবে? তো আমার ক্ষতি হলো না?
এই লোকের কাছ থেকে এই রকম উত্তর ছাড়া আর কিছু আশা ও করা ও যায় না। কিঞ্চিৎ রাগী স্বরে বলে,
-আপনি সুন্দর ভাবে কথা বলতে পারেন না? পড়া ছাড়া কোনো ভাষা নেই মুখে? কথার মধ্যে একটু মাধুর্য নেই কেনো? জন্মের সময় মুখে মধু দেয় নেই কেউ?
আদনান তুর্কির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে৷ এই পিচ্চি বউটাকে জ্বলাতে ওর ভীষণ ভালো লাগে।
তুর্কি লেবু শশা ধুয়ে নিয়ে এসে আদনানের হাতে দেয়৷ আদনান সুন্দর ভাবে সেই গুলো কাটতে থাকে।
হুমাইরা নামাজ শেষে রান্নাঘরের দিকে আসছিলো। রান্নাঘরে আদনান তুর্কিকে এক সাথে কাজ করতে দেখে আনমনে হেসে উঠে। বাচ্চা মানুষ। এই তো সকালে ঝগড়া করলো আবার এখনি মিল। সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করে ওরা যেনো সব সময় এই ভাবে খুনসুটি নিয়ে থাকতে পারে।
-এই যে নিন বেগম সাহেবা। কাটা শেষ।
তুর্কি ওর হাত থেকে বাটি নিতে গেলে আদনান বলে,
-থাক আমি নিয়ে যাচ্ছি৷ তোমার কষ্ট হবে।
তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে বলে,
-ঢং! একটু আগে না আমার সাথে বাজে ব্যবহার করলেন। এখন নাটক করছেন। দিন চুপচাপ আমার হাতে।
এক প্রকার বাটি কেড়ে নিয়ে চলে যায় তুর্কি।
বিশাল বারান্দায় সবাই এক সাথে দুপুরের ভোজন করার জন্য বসেছে। কাঠবাগান থেকে মৃদু বাতাস বয়ে আসছে। সূর্য টা যৎসামান্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। সবাই গরম ভাতের সাথে গরুর গোশত, বেগুন ভাজি আর ডাল তৃপ্তির সাথে আহার করছে। সব চেয়ে সুখময় সময় এটা। সবাই বিভিন্ন খোশগল্পে মত্ত। হাসি-ঠাট্টায় মশগুল। রেজুয়ানের প্লেটে গরুর গোশতের এক পিস চর্বি গেছে। ওর খুব বিরক্ত লাগে চর্বি খেতে। ও পিসটা উঠিয়ে মুজাহিদের প্লেটে দেয়।
-নটকা, আমাকে এই গরুর চর্বি দিতে মানা করি না। অসহ্য লাগে আমার।
মুজাজিদ আবার ওর প্লেটে দিয়ে বলে,
-সর, আমি চর্বি-টর্বি খাই না।
-ভাই, তোকে দেই?
-মাইর খাবি।
রচনা বলে,
-এই এই দিক দে। একটা চর্বির পিস নিয়ে কেমন করতাছে। ফাজিলের দল।
-তোমাকে মানা করলাম না, খালাচাচি। তবু ও আমার প্লেটে দিলে কেন?
বিকেল থেকে আকাশে ঘনকালো মেঘ জমেছে। থেকে থেকে মেঘ গর্জন করে উঠছে। গাছ-পালা গুলো মন আনন্দে মাথা দুলিয়ে নৃত্য করছে। সন্ধ্যার মুহূর্ত, তার উপর মেঘের জন্য পরিবেশ আরো নিকষ কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কায়, বিকেল থেকেই বিদুৎ নেই। গ্রাম-গঞ্জে এই একটাই সমস্যা। একটু হাওয়া দিলেই বিদুৎ উধাও।
ঘরে জ্বলছে সাদা রঙের মোমবাতি। তাঁর, হলুদ আলোয় আলোকিত চারিপাশ। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া, বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকে মোমবাতির শিখাকে দোলা দিয়ে যাচ্ছে। দোলা দিয়ে যাচ্ছে দরজায়, জানালায় ঝুলন্ত পর্দা গুলো কে।
বিদুৎ না থাকার একটাই মজা, পড়তে বসতে হয় না। তুর্কি মাগরিবের নামাজ আদায় করে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আদনান মসজিদে গেছে। বিকেলের দিকে আদনান ঘরের সব জানালা বন্ধ করে দিয়ছে। কিন্তু, এখন তুর্কির ইচ্ছে হলো, অসময়ে বৃষ্টির আগমনে সে নিজেকে একটু সতেজ করে নেবে। ও কাঠের জানালার দুই পাল্লা খুলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে এক দল হাওয়ারা এসে ওর চুল ওড়না উড়িয়ে দিয়ে যায়। ও নেত্র পল্লব বন্ধ করে ফেলে। গর্জন করে উঠে মেঘ। দেখা যায় বিদ্যুতের ঝলকানি। মেঘের গুম গুম আওয়াজের সাথে সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝড়তে থাকে। ধীরে ধীরে পরিবেশে নামতে থাকে সতেজ শীতলতা।
তুর্কি দুই হাত বাড়িয়ে দেয় বৃষ্টির সান্নিধ্য অনুভব করার জন্য। বৃষ্টির ছোঁয়া অনুভূতি হওয়ার সাথে সাথে মন নেচে উঠে। উৎফুল্লে ভরে যায় হৃদয়! ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ধীরে ধীরে রুপ নেয় বড় বড় ফোটা আকারে। তুর্কির হাত পুরো ভিজে যায়। ও কিছু পানি হাতে সংগ্রহ করে মুখে ছিটিয়ে দেয়। ঠোঁটের হাসি দীর্ঘ করে। ঝুমঝুম প্রতিধ্বনিতে মুখরিত হয় পরিবেশ।
আদনান কোনো মতে বাড়ি এসে পোঁছায়। যদি ও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি যৎসামান্য গায়ে পড়েছে। এক হাত দিয়ে চুল ঝাড়তে থাকে। অন্য হাতে গোলাপি রঙের বাগানবিলাসের ছোট একটি ডাল। যাতে কয়েকটা সবুজ পাতা ও হয়েছে।
মসজিদের পাশে দেয়াল ঘেঁষে একটা বাগানবিলাসের গাছ উঠে গেছে। ও ফেরার সময় সেখান থেকেই একটা ছোট ডাল ভেঙে নিয়ে এসেছে।
চুল ঝাড়তে ঝাড়তে সিঁড়ি বেয়ে দরজার কাছে এসে পৌঁছায়। ঘরের দিকে দৃষ্টিপাত হতেই দৃষ্টিগোচরে হয়, এক মনরোম দৃশ্য! জানালার সামনে দাঁড়িয়ে এক ছোট্ট কিশোরী, বৃষ্টি বিলাসে মত্ত। মোমবাতির হলুদ আলোয় ছোট কিশোরীর চাঞ্চল্য রুপ, হৃদয়ে এক সুখকর দোলা দেয়! ওর ঠোঁটে মৃদু হাসি ফোটে। ও ধীর পায়ে পা ফেলে রুমে প্রবেশ করে।
তুর্কি অঝোরে পড়া বৃষ্টির পানিকে হাতের তালুতে সংগ্রহ করে, মিহি কণ্ঠে গুন গুন করে উঠে,
-মন মোর মেঘের ও সঙ্গী,
উড়ে চলে দিগ্দিগন্তের পানে…
পেছন থেকে একটি পুরুষালী কণ্ঠ থেকে, পরের দুই কলি ভেসে আসে।
-নিঃসীম শূন্যে
শ্রাবণ বর্ষণ সঙ্গীতে….
রিমি ঝিম , রিমি ঝিম , রিমি ঝিম॥
তুর্কি অবাক চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। আদনান গুন গুন করতে করতে টেবিলের কাছে যাচ্ছে। ও নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না! আচ্ছা ও কি ভুল শুনলো। ওই অসভ্য লোকটা কি সত্যি গান গাইলো? এ কি করে সম্ভব।
আদনান টেবিলের ড্রয়ার থেকে আরেকটা মোমবাতি বের করে ; জ্বলানো মোমের শিখা থেকে আগুন নেয়। তুর্কির দিকে দৃষ্টিপাত করতেই তুর্কি দৃষ্টি সরিয়ে জানালার বাইরে নেয়। আনমনে হেসে উঠে। আদনান এক হাতে ফুল আরেক হাতে মোমবাতি নিয়ে এগিয়ে আসে। তুর্কির পাশে দাঁড়িয়ে মোম ওদের মাঝে জানালার সামনে রাখে। তুর্কি জানালার বাইরে হাত দিয়ে বৃষ্টি স্পর্শ করে আদনানের উদ্দেশ্যে স্বভাবতঃ মুখ বাঁকায়৷ আদনান জানালার বাইরে তাকায়। হাতের ফুল মোমবাতির পাশে রাখে। বাতাসের দরুন শিখা দুলতে থাকে। ভারী বর্ষনে মুখরিত পরিবেশ।আদনান কে এই রকম স্থির ভাবে ওর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তুর্কি আড়চোখে তাকিয়ে বলে,
-আপনি আবার গান ও গাইতে পারেন? বাব্বা!
আদনান তুর্কির কথা শুনে আড়চোখে তাকায়। দুইজনের দৃষ্টি সংযোগ হলে, তুর্কি চোখের মণি ঘুরিয়ে সামনে দিকে নেয়। হাতে সংগ্রহকৃত পানি উপরে নিক্ষেপ করে। বৃষ্টির পানির সাথে সংঘর্ষ লেগে কয়েক ফোঁটা আদনানের গায়ে ছিটে। আদনান জানালার বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
-এই গান কই শুনছো? লেখক কে জানো?
তুর্কি পূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকায়।
-তাই তো বলি; পড়া ছাড়া আপনার মুখে গান! অসম্ভব! নিশ্চয়ই এর মাঝে কোনো ভেজাল আছে।
আদনান দুই হাত পেছনে মুড়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে বলে,
-বৃষ্টি কেমন লাগে?
তুর্কি আবারও আড়চোখে তাকায়। এ লোক যে ওকে এখন পড়তে বসাবে ও খুব ভালো করেই জানে। তাই ও জানালার বাইরে তাকিয়ে বলে,
-কারেন্ট নেই। পড়তে পারবো না। এই মোমের আলোয় আমার পড়া হবে না। তাই, পড়ার প্রসঙ্গ তুলবেন না।
আদনান ঘাড় ঘুরিয়ে পূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। মৃদু হেসে এক অদ্ভুত প্রশ্ন ছুঁড়ে।
-কখনো টিনের চালের বৃষ্টির আওয়াজ শুনেছো?
তুর্কি ঘাড় ঘুরিয়ে আদনানের দিকে তাকায়। এই লোকের হলো কী! পড়ার কথা বাদ দিয়ে বৃষ্টির কথা বলছে! তুর্কি ডানে বামে মাথা নাড়ায়। যার অর্থ ও শোনে নি। পরপরই বলে,
-আমার কখনো ইচ্ছে হয়নি, ঐ আওয়াজ শোনার। বৃষ্টি নামলে যদি দেখতাম আম্মু ঘুমে, তাহলে ছাদে গিয়ে ভিজতাম। আমার খুব ভালো লাগে ভিজতে।
-শুনবে ওই আওয়াজ?
বিষ্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকায় তুর্কি৷ অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করে
-কই পাবো?
আদনান জানালার বাইরে তাকিয়ে বলে,
-শুনবে নাকি বলো।
তুর্কি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
– কী হয়েছে আপনার বলুন তো। পড়ার কথা বাদ দিয়ে আজ বৃষ্টির কথা বলছেন? ওই রান্নাঘরের ভূত আবার আপনার ঘাড়ে চাপলো না তো!
-বললে তো কারেন্ট নেই। তাই পড়বে না। সেই জন্য বললাম।
তুর্কি ভাবলেশহীন হয়ে বলে,
-আমি আগে কখনো শুনিনি।
আদনান মোম উঠিয়ে বলে,
-আসো তাহলে। ছাদে ছোট একটা চিলেকোঠা আছে। ওইটার উপরে টিন। মাঝে মাঝে আমি জাহিদ মাস্টার আর মীম গল্প করি।
এখানে দাঁড়াও আমি দুই কাপ চা অর্ডার দিয়ে আসি।
তুর্কি সম্পূর্ণ ঘুরে বলে,
-চা অর্ডার দিবেন মানে?
আদনান হাঁটা বিদ্যমান রেখে বলে,
-আমার পার্সোনাল শেপ, জাহিদ মাস্টারের কাছে।
আদনান আর কোনো কথা না বাড়িয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। তুর্কি ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আবার জানালার দিকে তাকায়৷ বৃষ্টির বেগ আরও বাড়ছে। পরিবেশ আরো গভীর কালো হচ্ছে। থেকে থেকে বিদ্যুতের ঝলকানি দিচ্ছে। ও জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে আবার বৃষ্টি স্পর্শ করে। ক্ষণকাল পর আদনান ডাকে।
-বেগম সাহেবা।
তুর্কি হাত ভেতরে এনে ঘর থেকে বের হয়। ছাদের পথে যেতে যেতে তুর্কি জিজ্ঞাসা করে,
-আপনার হঠাৎ আমাকে বৃষ্টি দেখানোর ইচ্ছে কেনো হলো?
আদনান হাঁটতে হাঁটতে ঘাড় ঘুরে বলে,
-এমনি।
চিলেকোঠাটি ছাঁদের ডান পাশের কর্নারে। বৃষ্টির বেগ প্রবল। শূন্য মাথায় গেলে দুইজনই কাক ভেজা হবে। তাই আদনান নিচে গিয়ে ঘটক ছাতা নিয়ে আসে। এই ছাতা তুলনামূলক বড়। ও এক হাতে ছাতা ধরে। আরেক হাতে মোমবাতি। ওই একই হাতে আবার বাগানবিলাসের ডাল। তুর্কি পায়জামা এক হাত দিয়ে একটু উঁচু করে ধরে৷ বৃষ্টির জন্য ছাঁদে পানি জমে টইটম্বুর। আদনান ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
-এক সাথে হাঁটবে। তা না হলে ভিজে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
তুর্কি ডান দিকে মাথা ঝাঁকায়।
এক সাথে উভয়ের ডান পা বৃষ্টিতে জমা ঠান্ডা পানিতে দেয়। শিরশির করে উঠে তুর্কির সর্বাঙ্গ। অঝোরে পড়তে থাকে বৃষ্টি। মাঝে মাঝে মেঘ ও গর্জন করে উঠে। তবে তা বেশি প্রবল নয়।
এই ভাবে এক পা এক পা করতে করতে এগোতে থাকে দুই জন। হাওয়া জন্য মোমবাতির শিখা এক পাশ হয়ে তীব্র ভাবে দুলতে থাকে। এক সময় দুলতে থাকা মোমবাতির শিখা মৃদু শব্দ তুলে নিভে যায়। অন্ধকারে ঢেকে যায় চারপাশ। দুইজনের পা যুগল থেমে যায়। তুর্কি অন্ধকারের মধ্যে আদনানের দিকে তাকিয়ে বলে,
-আল্লাহ্! এই বার কীভাবে যাবো?
আদনান ওর বাম হাতের বাহু এগিয়ে দিয়ে বলে,
-এইখানে ধরো। এখন ফোন বের করতে পারবো না। ঐখানে পৌঁছানোর পর মীমকে কল করে দিয়াশলাই দিয়ে যেতে বলবো।
তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে বলে,
-আপনার হাত ধরতে ইচ্ছে করে না আমার।
-যদি পড়ে যাও? ওলরেডি দুইবার গোসল করে ফেলেছো। আর এই অসময়ের বৃষ্টির পানি ভালো না। ভিজলে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
তুর্কি আদনানের বাহু দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে। কটমট স্বরে বলে,
-কী মোম এনেছেন, হ্যাঁ? একটুখানি হাওয়া দিলেই নিভে যায়?
আদনান চোখ ছোট ছোট করে বলে,
হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ২১
-এটা আমার দোষ?
-হ্যাঁ। আপনারই তো দোষ। ভালো মোম আননলে এই ভাবে নিভতো না।
দুইজন নিজেদের মধ্যে তর্কাতর্কি চালিয়ে যেতে থাকে। অঝোরা বৃষ্টির মাঝ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গন্তব্যে পৌঁছিয়ে যায়।