হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ২৭
তোয়া নিধী দোয়েল
আকাশের বুক থেকে সোনার রবি বিদায় নিয়েছে অনেক্ষণ। পরিবেশ ধীরে ধীরে অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে। পশ্চিম দিগন্তে, জ্বলজ্বল করছে ছোট শুকতারা। মৃদু বাতাস তিরতির করে ঘরের ভেতরে ঢুকছে।
তুর্কি বারান্দা থেকে আদনানের কিছু শার্ট আর পাঞ্জাবি নিয়ে ঘরে ঢুকে। বিছানার উপর রেখে জানালা বন্ধ করতে যায়। কাঠ-বাগানের মৃদু হাওয়া এসে ও-কে ছুঁয়ে যায়। ও সব জানালা বন্ধ করে বিছানার কাছে আসে। একটা একটা শার্ট নিয়ে সন্তপর্ণে যত্ন সহকেরে ভাজ করতে থাকে।
শার্ট গুলো ভাজ করতে করতে ও গুন গুন করে, গান গাইতে থাকে। হঠাৎ, কি ভেবে যেনো ঠোঁটে মৃদু হাসি ফোটে ওর। আদনানের সেই দিন গাওয়া গান মনে পড়ে। এবার ঠোঁটের হাসি দীর্ঘ হয়। নিজের আনমনা গান বাদ দিয়ে, আদনানের সেই গান গাওয়া শুরু করে। হাতের শার্টির দুই হাত ধরে গান গায়। আর আপন মনে নাচের মত করে একা একাই ঘুরতে থাকে।
‘আমি তোমাকে আরো কাছে থেকে
তুমি আমাকে আরো কাছে থেকে
যদি জানতে চাও
তবে ভালবাসা দাও, ভালবাসা নাও
ভালবাসা দাও, ভালবাসা নাও’
এইটুকু গাইতে গাইতে রুমের মধ্যেই ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকে। শার্টের মধ্যে কল্পনা করে আদনানকে। হুটহাট এখন মনে হয়, মনে প্রজাতি উড়ে। সময়ে -অসময়ে আদনানকে নিয়ে ভাবিতে শুরু করে। যে ভাবনার কোনো শুরু কিংবা অন্ত মিলে না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এই যে এখন, মন আনন্দে নৃত্য করছে তুর্কি। তাঁর হৃদয়ের সঙ্গোপনে থাকা পুরুষ টিকে নিয়ে ভাবতে-ভাবতে, আবারও কল্পনার রাজ্যে ডুব দ্যায়।
আদনানকে নিয়ে ভাবিতে ওর বেশ লাগে। ভীষণ ভালো লাগে!
পুরো রুম জুড়ে ঘুরত ঘুরতে দরজার সামনে আসে। তখন আবির্ভাব হয় আদনানের।
হাতে নাম না জানা একটা ফুল। এইটা ঐ দিনের পর থেকে অভ্যাস হয়ে গেছে। প্রতিদিন বউয়ের জন্য কোনো না কোনো ফুল চুরি করে আনা।
তুর্কি কে ঐ ভাবে ঘুরতে দেখে ভ্রু কুঁচকায়। হাতে ওর ডার্ক ব্লু রঙের শার্ট। গলায় থাকা উড়না ঘোরার তালে তালে উড়ছে। ও মন্থর পায়ে হেঁটে আসে। হাতের ফুল পকেটে ভরে এক পাশে দাঁড়ায়৷ ছোট মেয়েটার হঠাৎ ফরিং এর মত তিড়িং-বিড়িং করা দেখতে থাকে।
তুর্কি ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ টের পায় আদনানের উপস্থিতি৷ সঙ্গে সঙ্গে পা যুগল থামিয়ে ফেলে। এই লোক কখন আসলো! কেমন পাগলের মত একা একা ঘুরছিলো। ও অন্য দিকে ফিরে শার্ট বুকে জড়িয়ে খুস খুস কেশে বলে,
– স্যার, আপনি নক করে আসেন নাই কেনো?
আদনান মৃদু হেসে ওর দিকে এগোতে এগোতে বলে,
-নক করে আসলে, এই প্রানবন্ত প্রজাতির নাচটা দেখতে পেতাম?
ও কি নাচ্ছিলো! সর্বনাশ! ও তো নাচ্ছিল না। শুধু ঘুরছিলো। মনে মনে ভাবতে থাকে তুর্কি। আদনান ওর পাশে এসে দাঁড়ালে ও গলা ঝেড়ে বলে,
-ওহ্! তাই নাকি? আচ্ছা, তাহলে আসুন এক সাথে ঘুরি।
আদনান তুর্কির সামনে এসে পকেট থেকে ফুল বের করে তুর্কির কানে গুঁজে দেয়। তুর্কি চোখ তুলে তাকায়। কানে হাত দিয়ে প্রশ্ন করে,
-কী দিলেন?
-চুরি করা ফুল।
আদনানের কথা শুনে ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে তুর্কির। যদি ও প্রতিদিনই কোনো না কোনো ফুল এনে হাতে দেয়।
আদনান তুর্কি ডান হাত ধরে হাতে থাকা শার্ট চেয়ারের উপর রাখে। আদনান বিভিন্ন ভঙ্গিতে তুর্কিকে ঘোরাতে ঘোরাতে বলে,
– পড়া-লেখা তো লাটে ওঠিয়েছো। এত দিন বলেছো, কলেজের ফাংশনের জন্য পড়বে না। তবে, আজ থেকে শুরু করবে।
আদনানের কথা শুয়ে তুর্কি একটু বিরক্ত বোধ করে। এত সুন্দর একটা মূহুর্তে পড়ার কথা কেনো তুলতে হবে? তাই তুর্কি বিরক্ত কণ্ঠে বলে,
-স্যার, এইটা হচ্ছে আপনার আসল রুপ। সব সময় পড়া আর পড়া।
আদনান কপালে ভাজ ফেলে বলে,
-সব সময় বলি?
-হ্যাঁ। এত সুন্দর একটা মূহুর্তে আপনার পড়ার কথা কেনো মনে হলো?
রেজুয়ান ফোন স্কোল করতে করতে মুজাহিদের ঘরের দিকে আসছে। অভ্র আর শিপুকে উপমার নাম্বার খোঁজার দ্বায়িত্ব দিয়েছে। বসন্ত উৎসবের দিন মুজাহিদ কে নিয়ে হাজার খোঁজা-খুঁজির পর ও উপমার দেখা পাই নি। কিন্তু, ওর তো উপমাকে লাগবে। এই বিরহ আর সহ্য করা যাচ্ছে না। ওর মন চুরি করে কোন ডালে ফুটে আছে তা জানতে হবে।
মুজাহিদ বিছানায় শুয়ে বই পড়ছিলো। দরজা ভিড়ানো ছিলো। রেজুয়ান দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করে। মুজাহিদ এক পলক বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেখার চেষ্টা করে, কে এসেছে। রেজুয়ান কে দেখে আবার ও দৃষ্টি বইয়ের পাতায় নিবদ্ধ করে। রেজুয়ান ফোনের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেখে মুজাহিদ লম্বা হয়ে শুয়ে বই পড়ছে৷ মুজাহিদের উদ্দেশ্যে বলে,
-বুচ্ছো বাপের ভাই, খুব তাড়াতাড়ি কাঠগোলাপের সন্ধান পেয়ে যাবো। আমার মন চুরি করে কোন গাছে ফুটে আছে ধরতে হবে।
মুজাহিদ ভালো-মন্দ কিছু বলে না। শুধু ছোট করে বলে,
-হুম।
মুজাহিদ যে ওর কথায় পাত্তা দিলো না, সেটা রেজুয়ান খুব ভালো ভাবে টের পেলো। তাই মুজাহিদের মনোযোগ আকর্ষনের জন্য ওর মোক্ষম টোটকা প্রয়োগ করে।
-বউ ছাড়া শুয়ে আছো; লজ্জা লাগে না?
মুজাহিদ ভ্রু কুঁচকে আড় চোখে ওর দিকে তাকায়। রেজুয়ান বিছানায় উঠে মুজাহিদের পাশে একই বালিশে মাথা রাখে৷ এক পা মুজাহিদের উপরে দিয়ে কিঞ্চিৎ দুঃখী স্বরে বলে,
-আমার জায়গায় যদি তোমার বউ থাকতো, তাহলে কত ভালো হতো বলো।
মুজাহিদ বই বন্ধ করে পাশে রেখে; রেজুয়ানের দিকে ফিরে। রেজুয়ানের ঘাড় ঠেসে ধরে বালিশের সাথে। রেজুয়ান চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। মুজাহিদ কটমট স্বরে বলে,
-আমার বউ নেই তাতে তোর সমস্যা হচ্ছে কোথায়?
রেজুয়ান চোখ খিঁচে বলে,
-আরে বাপের ভাই, ব্যথা পাচ্ছি ছাড়ো।
-তোর ঘাড়ের রগ আজ ছিঁড়ে ফেলবো, দাঁড়া।
-বাপের ভাই, এমন করো না। আমার এখনো বিয়ে করা বাকি। আমার কিছু হলে কাঠগোলাপ শুকিয়ে মারা যাবে।
-তোর বজ্জাত কোথাকার। আমি বিয়ে করি নি তাতে তোর কি। তোর ইচ্ছে হচ্ছে তুই করে আয়।
-আরে, ভাই তোমার আগে বিয়ে করেছে। এখন যদি আমি ও করি তাহলে, জাতি তোমাকে মেনে নেবে? তোমার পাওয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না?
মুজাহিদ রেজুয়ানের নিতম্বে জোরে লাথি মারে। রেজুয়ান লাথি খেয়ে বিছানার এক দম কর্নারে ছিটকে যায়। চোখ মুখ কুঁচকে মুজাহিদের উদ্দেশ্যে বলে,
-উও! বাপের ভাই। এত জোরে কেউ লাথি মারে?
আবার ও একই কণ্ঠে বলে,
-এই লাথি মারার অপরাধে; তোমাকে অভিশাপ দিলাম, তোমার যৌবনে কুত্তায় কামড় দিবে।
মুজাহিদ বিছানা থেকে উঠে বসে। রেজুয়ানের দিকে হাত বাড়িয়ে দ্বিতীয় বারের মত ওর ঘাড় চেপে ধরে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
-হারামজাদা! আমার পেটের ছাও, আমারে কয় ম্যাঁও! তোর উপর ঠাডা পরুক, ফাজিল।
রেজুয়ান ঘাড়ে তীব্র চাপ অনুভব হওয়ায় জোর গলায় চ্যাঁচিয়ে উঠে,
-ওহ্! বাপের ভাই ছাড়ো। ব্যথা বেশি পাইতেছি। ঘাড়ের রগ ছিঁড়ে গেলো।
-তোর রগ আজ ছিঁড়েই ফেলবো, হারামজাদা। আগে বল ভালো হবি কি না।
রেজুয়ান আবারও চিৎকার করে,
-ও মা…ও ভাই…! বাঁচাও আমাকে। জাহিদ মাস্টার আমাকে মেরে ফেললো।
হুমাইরা বারান্দা দিয়ে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন। রাতের খাবার পাক করতে হবে সবার জন্য। হঠাৎ, মুজাহিদের ঘর থেকে রেজুয়ানের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। কপালে ভাজ ফেলে মুজাহিদের ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। বজ্জাত দু’টা নিশ্চয়ই আবার কোনো কাণ্ড বাঁধিয়েছে।
হুমাইরা ঘরে এসে দেখে মুজাহিদ রেজুয়ানের ঘাড় ধরে বিছানার সাথে চেপে ধরে রেখেছে। তিনি মোটেও অবাক হলেন না। এ এর নতুন কি! ছোট বেলা থেকেই এরা এমন। কে বলবে এরা চাচা ভাতিজা! তিনি ধমকের স্বরে দু’জনের উদ্দেশ্যে বলে,
– এ্যাই এ্যাই, ফাজিলের দলেরা! তোরা এ রকম করতাছস কেন? কোন বাড়ির এই রকম দামড়া- দামড়া চাচা-ভাতিজা মারপিট করে?
মুজাহিদ রেজুয়ানের ঘাড় ছেড়ে হুমাইরার দিকে তাকিয়ে নালিশের স্বরে বলে,
-এই যে ভাবিজান৷ তোমার ছোট ছেলেটাকে কিছু বলবা? ও সব সময় আমার বিয়ে নিয়ে কেনো পড়ে থাকে বলো। ওকে কি করা উচিত বলো।
রেজুয়ান শোয়া থেকে উঠে বসে। ঘাড় ম্যাসাজ করতে করতে বলে,
-উহ! রে ঘাড় টা আজ শেষ। তোমার কপালে কখনো বউ জুটবে না। ছোট বাচ্চাটাকে এই ভাবে মারলা না!
হুমাইরা আবারও ধমকের স্বরে বলে,
-তুই আবার চাচার পিছনে লাগছস? কবে বড় হবি তোরা?
মুজাহিদ কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
-আমার কোনো দোষ নাই। সব দোষ তোমার ছেলের। ও -ওর কর্মের জন্যই মাইর খায়।
-আমি আর কিছু শুনতে চাই না। ফের যদি তোদের ঝামেলা শুনি, দুইজনের পিঠের ছাল ছাড়িয়ে নেবো।
রেজুয়ান মুজাহিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
-তারপর ঐ ছাল দিয়ে ডুগডুগি বানিয়ে, জাহিদ মাস্টারের বিয়েতে নাচবো।
-দেখছো ভাবিজান, দেখছো। আমি যে ওদের চাচা লাগি এইটা বলে আর আমাকে লজ্জায় ফেলো না।
এই বলতে বলতে মুজাহিদ আরও কয়েক ঘা দেয় রেজুয়ান কে। দুজনের পুনরায় মারা-মারি দেখে হুমাইরা হতাশার শ্বাস ফেলে চলে যায়। এই দুইজন এই জীবনে শোধরানোর নয়!
মুজাহিদ রেজুয়ানকে আরেকটা লাথি মেরে, পুনরায় নিজের বালিশে মাথা দেয়। রেজুয়ান লাথি খেয়ে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বলে,
-বাপের ভাই, আজ একটু বেশি মাইর খাইছি। এখন চা আর পরোটা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। চলো বানিয়ে দেও।
মুজাহিদ দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
-টয়লেট থেকে হলুদ পদার্থ এনে খা। ফাজ্জিলের জাত। বের হো এখান থেকে।
-খেলে আমি একা খাবো নাকি? তোমাকে, ভাইকে নিয়ে খাবো। হোক সেটা বিষ কিংবা টয়লেটের হলুদ পদার্থ।
-তুই যাবি এখান থেকে৷ নাকি আরেকটা লাথি দিবো?
-ভণিতা বাদ দিয়ে উঠো। আজ তিনজনে মিলে চায়ের আড্ডা দিবো। অনেক দিন ধরে দেই না। সাথে পরোটা।
-পারবো না।
রেজুয়ান দেয়াল থেকে উঠে মুজাহিদের হাত টানতে টানতে বলে,
-না করলে হবে না। আমার খেতে ইচ্ছে হয়েছে চলো।
-আমি পারবো না।
-পারতে হবে উঠোও ও ও।
-আমাকে খোঁচানোর সময় মনে থাকে না এই সব?
রেজুয়ান নাদান গলায় বলে,
-আজ্ঞে না। চলো চুপ চাপ।
মুজাহিদের ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ;রেজুয়ানের সাথে সে পারলো না। অগত্যা উঠতেই হলো। হ্যাঁ, এটা ঠিক অনেক দিন ধরে আড্ডা দেওয়া হয় না তিন জনে মিলে। কিন্তু, এই বজ্জাতকে আজ দেখতে ইচ্ছে করছে না। দেখতে ইচ্ছে করে ও লাভ নেই। ওদের ঝগড়া শিশির বিন্দুর মত ক্ষণস্থায়ী। এই মারা-মারি, এই কাটা-কাটি, এই আবার গলায় গলায় ভাব।
রেজুয়ান মুজাহিদ কে টানতে টানতে ঘর থেকে বের করে। বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে,
-তুমি যাও। আমি ভাইকে ডেকে নিয়ে আসছি।
মুজাহিদ চা বানানোর উদ্দেশ্যে নিচে চলে যায়। রেজুয়ান আদনানকে ডাকতে আদনানের ঘরের উদ্দেশ্যে যায়।
আদনান তুর্কি তখন ও ওদের নৃত্য বিদ্যমান রেখেছিলো। আদনান তুর্কির ডান হাতের আঙুল ধরে উপরে উঠিয়ে, ওকে চরকির মত ঘোরাচ্ছিল। দুইজনের ঠোঁটে বিদ্যমান হাসি। দরজা খোলা ছিলো। তাই রেজুয়ান সরাসরি ঘরে ভেতরে যায়। উচ্চকণ্ঠে ডাকে,
-ভাইইই…!
রেজুয়ানের কণ্ঠস্বর শুনে তুর্কি ভীত হয়ে যায়। এখন ওকে আবার এই নিয়ে ক্ষ্যাপাবে। ও আদনানের হাত ছেড়ে, ভীত বিড়াল ছানার মত আদনানের পিছনে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ওর কানে গুঁজা ফুল মেঝেতে পড়ে যায়।
রেজুয়ানের অসময়ে উপস্থিতি আদনানকে কিঞ্চিৎ বিরক্তিতে ফেলে। ও কপালে ভাজ ফেলে ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকায়।
চোখের সামনে এত সুন্দর দৃশ্য ধরা দিতেই রেজুয়ানের পা যুগল থেমে যায়৷ আজ ওর কপালে শনি আছে। আবার ভাইয়ের রোমান্টিক একটা সুন্দর মূহুর্তে বাধা দিয়ে ফেললো! ও ঢোক গিলে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,
-সরি, ভাই!
আদনান বিরক্তি ভরা কণ্ঠে বলে,
-তোর কী চাই এখানে?
-আসলে, তোমাকে ডাকতে এসেছিলাম। জাহিদ মাস্টারের ঘরে আসো। আড্ডা দেবো।
এই বলে রেজুয়ান দ্রুত পায়ে জায়গা ছাড়ে। এতক্ষণ মুজাহিদের কাছে মার খেয়েছে। এখন আদনানের কাছে খাবে৷ আজ রাত টাই খারাপ। তবু ও আবার দরজা দিয়ে মুখ দিয়ে বলে,
-ভাই, পরের বার দরজা একটু লাগিয়ে নিও।
আদনান মুখ দিয়ে ‘চ’ সূচক শব্দ করে রেজুয়ানকে ধরতে গেলে ও ছুটে পালায়। একে তো ওদের এত সুন্দর মূহুর্তে বাধা দিয়েছে আবার এখানে উল্টা-পাল্টা কথা বলছে৷ রেজুয়ানের কথা শুনে তুর্কির রগে রগে কাঁপুনি ধরে। ওরা তো তেমন কিছুই করছিলো না৷ তাহলে এই ভাবে বলার কি আছে? অসভ্য ছেলে। আদনান তুর্কির দিকে ঘুরে দাঁড়াতে, তুর্কি উল্টো ঘুরে বিছানার কাছে যায়। এই মূহুর্তে ও আদনানের কাছ থেকে নিজেকে লোকানোর চেষ্টা করছে। ও আবারও নিজের কাজে মন দেয়।
তুর্কি যে নিজেকে লুকানো চেষ্টা চালাচ্ছে তা দেখে আদনান মৃদু হাসে৷ ও মেঝে থেকে ফুল তুলে তুর্কির দিকে এগিয়ে যায়। আবারও ও তুর্কির কানে গুঁজে দিয়ে বলে,
-ডোন্ট মাইন্ড। ও এমনই। উল্টা-পাল্টা কথা বলার স্বভাব একটু বেশি।
তুর্কি কোনো উত্তর দেয় না। আদনান তুর্কির পাশ থেকে একটা শার্ট নিয়ে ভাজ করতে গেলে তুর্কি বাধা দেয়।
-আমি করছি তো। আপনি রাখুন।
-ওর কথায় কিছু মনে করো না।
তুর্কি প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে,
-কিসের আড্ডা দিবেন?
আদনান ভাজ করা শার্ট গুলো নিয়ে জায়গা মত রাখতে রাখতে বলে,
-এমনি, তিনজনে মিলে একটু আড্ডা দিবো। মাঝে মাঝে তিনজনে এই ভাবে আড্ডা দেই।
তুর্কি উৎসুক হয়ে বলে,
-আমি ও যাবো, স্যার।
-অনেক দিন ধরে পড়া হচ্চে না। আগে পড়তে বসো।
তুর্কি অনুনয়ের কণ্ঠে বলে,
-এসে পড়তে বসবো স্যার। প্লিজ।
আদনান কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
-কথা দিচ্ছো?
-হুম।
-ওকে। মনে থাকে যেনো।
রেজুয়ান রান্নাঘরে প্রবেশ করে দেখে হুমাইরা পরোটা বানাচ্ছে। আর পাশে দাঁড়িয়ে তা ভাজার প্রস্তুতি নিচ্ছে মুজাহিদ। রেজুয়ানের উপস্থিতি টের পেয়ে মুজাহিদ ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
-বাচ্চা, দুধ নেই। কী দিয়ে চা করবো?
রেজুয়ান মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,
– মাতাশ্রী, গুঁড়া দুধ ও নেই?
-না। থাকবে কি ভাবে? বিনা কারণে এমনি -এমনি খাওয়ার সময় মনে থাকে না?
– ওকে। আমি নিয়ে আসছি।
-টাকা নিয়ে যা।
রেজুয়ান রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বলে,
-ভাইয়ের কাছ থেকে নেবো। জেট-প্লেনের চাবি কই?
-টেবিলে।
নিচ থেকে গলা ফাটিয়ে ডাকতে বিরক্ত লাগে৷ তাই, রেজুয়ান পকেট থেকে ফোন বের করে আদনানকে কল করে টাকা নিয়ে আসতে বলে। বৈঠক খানায় চেয়ারে বসেছিলো আলামিন। রেজুয়ানের এই টাকা চাওয়ার ব্যাপার টা তার একদম পছন্দ হলো না। এত বড় ছেলে রোজগার না করে ভাইয়ের কাছে টাকা যাচ্ছে? এ কেমন কথা। তাই সে গম্ভীর কণ্ঠে রেজুয়ানের উদ্দেশ্যে বলে,
-এখন একটু নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করো। আর কত দিন ভাইয়ের পুঁজিতে চলবে? লম্প-ঝম্প কমাও।
কথাটা শুনে রেজুয়ান আলামিনের দিকে তাকায়। সূক্ষ্ণ অপমান টুকু বুঝতে বাকি থাকে না ওর। তবু ও স্বভাবতঃ বলে,
-আমি তো নিজের পায়েই দাঁড়িয়ে আছি, আব্বু। এ যে দেখো আমার পা।
আলামিন রেজুয়ানের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। কিছু বলার আগেই উপর থেকে এক পুরুষালি কণ্ঠ থেকে ভেসে আসে
-ওর নিজের পা না হওয়া পর্যন্ত; ওর ভাইয়ের পা-ই যথেষ্ট ওর জন্য। অযথা আজে-বাজে কথা বলো না। একদিন ঠিক হবে।
আলামিন আদনানের কথা শুনে সিঁড়ির দিকে তাকায়। আদনান রেজুয়ানের দিকে এসে ওর হাতে টাকা দিয়ে বলে,
-নে। কি আনবি নিয়ে আয়।
যদি ও আলামিনের কথা কে গ্রাহ্য করে না রেজুয়ান; তবু ও এই প্রথম কেমন যেনো অনুভব হয় আদনানের কাছ থেকে টাকা নিতে। ও টাকা হাতে চলে যায়। আদনান আলামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
-আমি ওকে দেখে নেবো। দয়া করে এই সব আজে বাজে কথা বলো না আব্বু।
আলামিন অবজ্ঞার স্বরে বলে,
-হুম দেখা যাবে।
সিঁড়ে দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে সব কথাই রেজুয়ানের কানে যায়। তবে, ও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। ও জানে আদনান থাকতে ওর কখনো কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু, মনের মাঝে কিছু একটা ছুটে যায়।
আশে পাশে কোনো দোকানে গুঁড়া দুধের প্যাকেট পাওয়া গেলো না। অগত্যা বাজারের উদ্দেশ্যে, সাইকেল নিয়ে চলে যায় রেজুয়ান।
বাজারে একটা দোকানের সামনে গিয়ে সাইকেল থামিয়ে দুধের প্যাকেট চায়। সাইকেলের প্যাডেলে পা দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে প্যাকেটের জন্য। আশে পাশের দোকান গুলোতে তেমন একটা ভিড় নেই। সামনের দোকানে কয়েকটা ছেলে বসে সিগারেট ফুঁকছে।
রেজুয়ান রাস্তার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে। আলামিনের বলা কথাটা, না চাইতেই ওর মাথায় আসছে। অসহ্য কর একটা ভাবনা।
হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ২৬
ওর যখন যা প্রয়োজন; সব প্রয়োজন মেটায় আদনান। যখন যত টাকা প্রয়োজন হয়, তখনই দিয়ে দেয়। তবে আজ একটা অন্য চিন্তা হৃদয়ে ঢুকলো। সেটা হৃদয় কে অনবরত খোঁচাচ্ছে।
বিক্রেতার ডাকে ধ্যান ভাঙে রেজুয়ানের। ও বিক্রেতার হাত থেকে প্যাকেট নিয়ে টাকা পরিশোধ করে; বাড়ির উদ্দেশ্যে সাইকেল ঘোরায়। হঠাৎ ঐ দোকানে বসা ছেলে গুলো এসে ওর রাস্তা আটকায়।