হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৩২

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৩২
তোয়া নিধী দোয়েল

রেজুয়ান টেবিলের উপর থেকে ফোন নিয়ে দেখে কয়টা বাজে। ১১:৪৫। ঘাড় ঘুরিয়ে মুজাহিদের উদ্দেশ্যে বলে,
-বাপের ভাই, তাড়াতাড়ি করো। ১১ টা ৪৫ বেজে গেছে।
মুজাহিদ একটি সেন্টার টেবিল ডেকোরেশন করছে। ডেকোরেশন প্রায় শেষ এর দিকে। এক গুচ্ছো গোলাপ এনে টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলে,
-এই তো বাচ্চা। কাজ প্রায় শেষ। শুধু গোলাপ গুলো জায়গা মত রাখবো, কেক আনবো আর ক্যান্ডেল জ্বলাবো। তাহলেই শেষ।
রেজুয়ান একটু খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে এসে বলে,

-গোলাপ গুলো আমার কাছে দেও। আমি রাখছি। তুমি ক্যান্ডেল নিয়ে আসো।
মুজাহিদ রেজুয়ানের কাছে গোলাপের গুচ্ছ দিয়ে কেক আর ক্যান্ডেল আনতে নিচে চলে যায়। ছাদের এক কোণে একটি সেন্টার টেবিল রাখা হয়েছে। সেটাকে ডেকোরেশন করছে দুই চাচা-ভাতিজা মিলে। হয়তো কোনো স্পেশাল মিশন আছে ওদের!
রেজুয়ান গোলাপের গুচ্ছ এনে টেবিলের উপর ফুল দানিতে রাখে। আদনানের প্রিয় গোলাপ। রেজুয়ান গুচ্ছো থেকে একটা টকটকে লাল গোলাপ তুলে। যদিও ওর কাঠগোলাপ বেশি পছন্দ। তবুও এই টকটকে গোলাপ ও-কে আকৃষ্ট করেছে!
গোলাপ টার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবে। ঠোঁটে মুচকি হাসি নিয়ে গোলাপ টা পকেটে ভরে।
এক হাতে কেক আর অন্য হাতে একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে হাজির হয় মুজাহিদ৷ ব্যাগ টা রেজুয়ানের হাতে দিয়ে খুব সাবধানে কেক টা টেবিলের উপর রাখে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-বাচ্চা, ব্যাগ টা খোল। ক্যান্ডেল সহ আরও কিছু জিনিস আছে দেখ।
রেজুয়ান ব্যাগের জিনিস টেবিলের উপর নামায়। দিয়াশলাই দেখতে না পেয়ে বলে,
-বাপের ভাই, ম্যাচ কো?
মুজাহিদ কেক ডেকোরেশন করতে করতে বলে,
-কেন? ঐখানে নাই?
-না। দেখি না তো।
-সারাদিন সিগারেট টানোস তোর কাছে তো থাকার কথা।
রেজুয়ান বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে,
-নিজের দোষ আমার উপর দিও না বাপের ভাই। নিজে যে এক্স এর শোকে খাও, সেটা আমি ভালো ভাবেই জানি। চুপ চাপ দেও।

-লাত্থি খাবি। আমাকে কখনো খাইতে দেখছস?
-আমাকে দেখছো?
মুজাহিদ আত্মবিশ্বাস এর সাথে বলে,
-শুধু সিগারেট কেন; তুই গাঁঞ্জা ও খাস। এইটা ও আমি খুব ভালো ভাবেই জানি!
রেজুয়ান একটা স্নো স্প্রে হাতে নেয়। ধীরে ধীরে হেঁটে এসে মুজাহিদের পুরো মাথায় মুখে স্প্রে করে। মুজাহিদ চোখ মুখ বন্ধ করে দুই হাত কেক এর উপর ধরে। যাতে কেক নষ্ট না হয়।
-সর ফাজিলের জাত। কেক নষ্ট হবে।
-এইটা তোমার পাপের শাস্তি।

-এক দম বাজে কথা বলবি না। আমার নিজস্ব পাপ বলতে একটা পাপ ও নেই। যে টুকু আছে এই সব তোদের পাপ। তোদের সাথে মিশে মিশে হয়েছে।
-যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ। বুচ্ছো?
এই বলে আরেকবার স্প্রে করে মুজাহিদ এর চোখ মুখ ঢেকে ফেলে রেজুয়ান। মুজাহিদ দ্রুত চোখ মুছে রেজুয়ানের পিছনে ধাওয়া করে।
-তোর ফাজিলের জাত। দাঁড়া তুই।
রেজুয়ান স্পে ফেলে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। যদিও পা ব্যথায় চিনচিন করে উঠে। তবে এদের কে থামাবে!
-বাপের ভাই। বাপের ভাই। আমার পায়ে কিন্তু ব্যথা।
পায়ে ব্যথা থাকার দরুন; খুব সহজে মুজাহিদ রেজুয়ানকে ধরে ফেলে। দুই হাত পিঠমোড়া করে ঘাড় ধরে বলে,
-তোর পা আজ আমি ভাঙবো।
-আরে বাল। ১২ টা বাজতে চললো। দৌড়াদৌড়ি পরে কইরো।

বেঘোরে ঘুমাচ্ছে তুর্কি। আদনান পা যুগল বিছানায় দিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছে। ডান পা বাঁ-পায়ের উপরে দিয়ে নাড়াচ্ছে। কোলে একটা বই। নিদিষ্ট পৃষ্ঠার শেষ লাইনটি পড়ে; বই বন্ধ করে টেবিলে রাখে। বিছানা থেকে পা নামিয়ে জগ থেকে পানি ঢেলে খায়। বিছানার দিকে চোখ পড়তে দৃষ্টিগোচর হয় ঘুমন্ত তুর্কি কে।
ও আনমনে হেসে টেবিলে ডান হাতের বাহু ঠেকিয়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে গালে ঠেকায়। ঠোঁটে আঁকা হাসি নিয়ে চেয়ে থাকে বধূর দিকে। ওর করা কর্ম-কাণ্ডের কথা মনে করে, ঠোঁটের হাসি প্রশস্থ করে।
গালের হাত নামিয়ে চেয়ার টেনে ঝুঁকে বসে ওর মুখের দিকে। বাতাসের দরুন তুর্কির কপালে চুল মুখে এসে পড়েছে। আদনান সন্তপর্ণে চুল গুলো কপাল থেকে সরিয়ে দেয়।

কিছু বলতে যাবে সেই মূহুর্তে দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ হয়। আদনান চোখ মুখ কুঁচকে দরজার দিকে তাকায়। এত সুন্দর মূহুর্তটা কে নষ্ট করলো। যদি রেজুয়ান হয় ওর ঘাড়ের রোগ ছিঁড়ে ফেলবে।
আরও কয়েকবার টোকা পড়তে আদনান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। দরজার কাছে এসে দরজা খুলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে ওর চোখে লাল কাপড় পড়ে যায়। আদনান চোখে হাত দিয়ে বলে,
-আরে বাপের ভাই। কী করছো!?
মুজাহিদ সতর্কতার স্বরে বলে,
-চুপ। তোকে অপহরণ করা হচ্ছে। কোনো কথা বলবি না।
আদনান দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করে,
-মানে? এই রাত-দুপুরে আবার কী পাগলামি শুরু করেছো?
-চুপ কথা বলবি না। চুপচাপ চল।
মুজাহিদ আদনানের চোখ বেঁধে, হাত ধরে ছাদের দিকে পা বাড়ায়।

টেবিলের সামনে বসেছে তিনজন। ছোট ছোট ক্যান্ডেল দ্বারা সেন্টার টেবিলটি সুন্দর ভাবে ডেকোরেশন করা হয়েছে। ছোট একটি ফুল-দানিতে টকটকে লাল গোলাপ। তার সুমিষ্ট ঘ্রাণ বাতাসের সাথে ভেসে আসছে।
আদনান কপালে ভাঁজ ফেলে বসে আসছে। ওর চোখ তখন ও বাঁধা৷ এক নাগারে বলে চলেছে— ওরা করছেটা কী!
ঘড়ির কাটা সই বারোটা এক মিনিটে পৌঁছানো মাত্র— চোখের বাঁধন খুলে দেয় মুজাহিদ৷ আদনান চোখ খুলে বিস্মিত হয়ে যায়! ঘটনা টা আরেকটু বুঝে ওঠার আগে; মুজাহিদ পাশ থেকে দুই হাত বাড়িয়ে আদনানকে আলিঙ্গন করে বলে উঠে,

– হ্যাপি বার্থডে মাই সন। ম্যানি ম্যানি রিটার্নস অফ দ্যা ডে!
আদনান কী বলবে বুঝে ওঠতে পারছে না! তাই থম মেরে বসে থাকে। এ নতুন নয়! ওর জীবনে এই বিশেষ দিনটি সব সময় মুজাহিদ সবার আগে মনে করিয়ে দেয়। ওর কোনো দিন ও মনে থাকে না ওর জন্মদিনে কথা। প্রতি বছর মুজাহিদ-রেজুয়ান ও-কে কোনো-না কোনো ভাবে সারপ্রাইজ দেয়৷ আর ও অবাক হয়ে যায়! আজ ও তার ব্যতিক্রম হয়-নি।
উপর পাশ থেকে রেজুয়ান ও ভাইকে আলিঙ্গন করে শুভেচ্ছা জানায়।
– হ্যাপি বার্থডে ভাই।
আদনান দুই হাত ছড়িয়ে দেয় মুজাহিদ রেজুয়ানের কাঁধে। তিন মাথা এক হতেই, আদনান উৎফুল্ল চিত্তে বলে উঠে,
-হোয়াট আ্য সারপ্রাইজ!!
মুজাহিদ এক হাত আদনানের পিঠে দিয়ে বলে,

– দীর্ঘজীবী হো বাচ্চা। সুখ-শান্তিতে ভরে যাক তোর আর বউ-মার জীবন।
পাশ থেকে রেজুয়ান ও এক হাত আদনানের পিঠে দিয়ে বলে,
-আমি এত সুন্দর দোয়া করতে পারবো না। শুধু এই টুকু বলবো, আমার একটা ভাইস্তা-ভাস্তি এসে যাক। এতেই আমার শান্তি। ওদের সাথে আমি ফুটবল খেলবো। ওকে।
রেজুয়ানের কথা হো হো করে হেসে উঠে আদনান।
-ইন-শা-আল্লাহ্!
-তবে (ঘাড় কিঞ্চিৎ মুজাহিদ এর দিকে করে) বাপের ভাই কে আগে বিয়ে করাও। নইলে…
রেজুয়ান আর কথা শেষ করতে পারে না। তার আগেই মুজাহিদ ওর কান টেনে ধরে।
-চুপ থাকবি তুই, হারামজাদা।
আদনান দ্রুত বাধা দিয়ে বলে,

-ওই ওই, আজ কোনো মারা-মারি না।
মুজাহিদ ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে,
-ও যদি আরেকবার আমার বিয়ে নিয়ে পড়ে, ওর কিন্তু খবর আছে।
রেজুয়ান স্নো স্প্রে হাতে নিয়ে বলে,
-আরেকবার আমার উপর হামলা করলে, তোমার বাম পাঁজর থেকে যে সৃষ্টি হয়েছে তাঁর অন্য জাগায় বিয়ে হয়ে যাবে৷ আমিন। অভিশাপ দিলাম।
মুজাহিদ দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে। এ ছেলে কে কিছু বলা বৃথা। তাঁর এ জীবন ওর অভিশাপ পেতে পেতেই চলে যাবে। ওর কথার উত্তর না দিয়ে শুধু কটমট করতে করতে বলে,
-পরে দেখে নেবো তোকে। বাচ্চা কেক কাটিং শুরু কর।
আদনান কেক কাটিং শুরু করে। রেজুয়ান ওপর থেকে স্নো স্প্রে ছড়িয়ে দেয়। আদনান কেক কেটে প্রথমে মুজাহিদ তার পর রেজুয়ানকে খাইয়ে দেয়। তিনজন ভীষণ আনন্দের সাথে ভাগা-ভাগি করে নেয় সময়কে। ওদের সাথে যোগ দান করে রাতের নির্মল বাতাস, স্নিগ্ধ রাতের আকাশ। তিনিজনের উৎফুল্লতা দেখে তাদের ও যেনো ইচ্ছে হলো ওদের সাথে মেতে ওঠার।
রেজুয়ান ব্যাগ থেকে কিছু বাজি বের করে উঠে দাঁড়ায়। আদনান বাধা দিয়ে বলে,

-তোর পায়ে কিন্তু ব্যথা। বেশি তিড়িং-বিড়িং করিস না।
-আরে কিচ্ছু হবে না।
-এত রাতে শব্দ হলে কিন্তু, বাড়ির লোক জেগে যাবে৷ তখন…
-আরে ভাই। কিচ্ছু হবে না।
রেজুয়ান একটা বাজি ফাটিয়ে দ্রুত আদনানের পাশে এসে বসে। বাজিটা আকাশে গিয়ে আওয়াজ করে রংবেরঙের আলো তৈরি করে। তিনজনে মিলে দীর্ঘক্ষণ খোশগল্প করে। মাঝে মাঝে তিনজনে উচ্চস্বরে হেসে উঠে। হাসির শব্দে প্রতিধ্বনি হয় চারিদিকে।
তিনজন লম্বা একটা সময় অতিবাহিত করার পর; যাঁর যাঁর ঘরে ফিরার জন্য প্রস্তুতি নেয়। তবে রেজুয়ান এর মাথায় বদ বুদ্ধি হানা দেয়। ও আদনানের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা করে। আদনান ও চোখ টিপে ওর ইশারা সমর্থন করে। রেজুয়ান ওর জায়গা ছেড়ে উঠে আসে।
-বাপের ভাই, তোমাকে একটু খাওয়াই?

মুজাহিদ কপালে ভাঁজ ফেলে তাকায়। এখন যে ওর সাথে খারাপ কিছু হবে, তা মনে মনে আন্দাজ করে। কারণ, প্রতিবারই ওদের তিনজনের মধ্যে যাঁর জন্মদিনই থাক না কেন, শেষে কেক মাখামাখি করাটা জাতীয় কাজ। যে কোনো একজন মুরগি হবেই। মুজাহিদ ভ্রু কুঁচকে বলে,
-তোর মতিগতি আমার ঠিক লাগছে না। দূরে যা আমার থেকে।
-আরে এমন করো কেনো? বেশি না। অল্প খাওয়াবো।
-একটু ও না।
রেজুয়ান হাতে কেকের পিস নিয়ে মুজাহিদের দিকে আসে। মুজাহিদ উঠে দাঁড়ায় পালানোর জন্য। পেছন থেকে জাপটে ধরে আদনান। রেজুয়ান পিস নিয়ে এসে মুজাহিদ এর পুরো মুখে ঘসতে ঘসতে বলে,
“সব সময় মন বলে— বিয়ে করবো হই হই
ঘটক এলে পালাও আবার কই কই?
বিয়ের কথা বললেই ঘাম ঝরে
অথচ হৃদয় করে ধুমধাম।
আবার বিয়ের কথা উঠলেই বলো—
“আন্টি আমার বয়স এখনো ছোট মাপ!” (বয়সে ছোট)
আদনান বলে,

-হলুদ দেও, মেন্দি দেও, কেক দেও। তারপর দৌড়ে পালাও…!
আদনান-রেজুয়ান মুজাহিদকে ইচ্ছে মত কেক মাখিয়ে ছুটে ছাদ থেকে নামে। মুজাহিদ দুই হাতের সাহায্যে শুধু চোখ পরিষ্কার করে ওদের উদ্দেশ্যে বলে,
-দাঁড়া ফাজিলের জাতেরা।
এই বলে এক থাবা দিয়ে কিছু পরিমাণ কেক উঠিয়ে সে ও ছুটে ছাদ থেকে নামে।
-ভাই তাড়াতাড়ি দৌড়া। বাপের ভাই আইলো।
মুজাহিদ আসতে আসতে ততক্ষণে আদনান রেজুয়ান নিজেদের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে৷ আজ যদি মুজাহিদ ওদের ধরতে পারে পঁচা পুকুরে ডোবাবে।

আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে উঠে তুর্কি। মুখের উপর থেকে দুই হাত দিয়ে চুল সরিয়ে খোঁপা করে। বিছানা থেকে নামতে গেলে উপস্থিত হয় আদনান। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
-কেমন লাগছে এখন শরীর?
আদনানের বাড়িয়ে দেওয়া হাত দেখে, চোখ বড় বড় করে তাকায় তুর্কি। ও কি ঘুমের ঘোরে আছে? এ কী করে সম্ভব! এই লোক ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে কেনো? ও-কে পড়তে না বসিয়ে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে? তুর্কিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে আদনান ফের জিজ্ঞাসা করে
-ব্যথা কি একটু ও কমে নি? নাকি আরও বেড়েছে?
আদনানের কথা শুনে ভ্রু কুঞ্চন করে তাকায় তুর্কি। ওর আবার কিসের ব্যথা কমবে? মনে দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করে,
-মানে? কিসের ব্যথা কমবে?
আদনান চোখ ছোট ছোট করে বলে,

-কাল রাতে যে বাথরুমে পড়লে…
আদনানের কথা শেষ করতে না দিয়ে-ই; তুর্কি খুস খুস করে কেশে উঠে। কোমড়ে হাত দিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে ব্যথিত কণ্ঠে বলে,
-ওওও! না স্যার। একটু ও কমে নি। ওমা…গো!
তুর্কির মাঝে মূহুর্তে পরিবর্তন লক্ষ্য করে আদনানের কপালে ভাঁজ পড়ে। তুর্কি আদনানের বাড়িয়ে দেওয়া হাত খপ করে ধরে বলে,
– ওয়াশরুমে যাবো। একটু হেল্প করুন।
আদনানের বিষয় টা খটকা লাগলে ও- ও তুর্কির হাত ধরে ও-কে উঠানোর চেষ্টা করে। তুর্কি আদনানের বাহু শক্ত করে ধরে হাঁটতে থাকে। আদনানের ডান হাত দৃষ্টি পড়তে আঁতকে উঠে তুর্কি। হাতের ব্যান্ডেজ এই রকম লাল হয়েছে কীভাবে? ওর চলন্ত পা যুগল থেমে যায়। অস্থির কণ্ঠে আদনানের ডান হাত টেনে বলে,
-আল্লাহ্! স্যার। আপনার হাতের এই অবস্থা কীভাবে হলো?
রাতে তুর্কিকে উঠাতে গিয়ে চাপ লেগেছিলো। আবার ছাদে দৌড়াদৌড়ি করর সময়-ও বোধহয় লেগেছে। ঘরে এসে আর পরিষ্কার করতে খেয়াল হয়নি। ও ভাবলেশহীন স্বরে বলে,

-এমনি। চলো তুমি।
তুর্কি চিকোন ভ্রু কুঁচকে কিঞ্চিৎ তেজি স্বরে বলে,
-এমনি মানে? ব্যান্ডেজটা এই রকম লাল হয়ে ওঠেছে। আর আপনি বলছেন এমনি? তাড়াতাড়ি চলুন। এইটা পরিষ্কার করতে হবে।
আদনানকে আর কিছু বলতে না দিয়ে ওকে টেনে বিছানায় বসায়। পরিষ্কার করার ঔষধ-পথ্য এনে দ্রুত পরিষ্কার করে দেয়। পুনরায় ঔষধ লাগিয়ে দেয়। আদনান বিছানা ছেড়ে ওঠে বলে,
-ফ্রেশ হয়ে নেও। আমি খাবার নিয়ে আসছি।
তুর্কি আদনানের হাত টেনে ধরে বলে,
-ফ্রেশ হয়ে নেও মানে? বললাম না ওয়াশরুম যাবো? একটু দিয়ে আসুন। একা কীভাবে যাবো? আমি হাঁটতে পারি না।
আদনান চোখ ছোট ছোট করে বলে,

-একটু আগে তো খুব সুন্দর করে পারলে।
তুর্কি দৃষ্টি চঞ্চল করে বলে,
-কিন্তু, এখন আর হাঁটতে পারবো না। ব্যথা বেড়েছে।
কোমড় চেপে ধরে বলে,
-ও আল্লাহ্! ব্যথায় মরে গেলাম।
আদনান তুর্কি নাটকীয় কথা শুনে সন্দিহান দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। তুর্কি আদনানের মুখের সামনে তুড়ি মেরে বলে,
-হাঁ করে কী ভাবছেন? সাহায্য করুন। ধরুন ধরুন।
তুর্কি আদনানের হাত শক্ত করে ধরে ওঠে দাঁড়ায়। পায়ে বেশ গভীর আঘাত লেগেছে এমন ভাবে খুড়িয়ে হাঁটতে থাকে।
তুর্কি ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় বসে। আদনান খাবার নিয়ে আসে। ও হাত দিয়ে খেতে গেলে তুর্কি বাধা দেয়। বলে আপনার হাতে আঘাত। আমি খাইয়ে দিচ্ছি। দুইজনে এক সাথে খেতে আরম্ভ করে। তুর্কি একবার নিজে খায়। আরেকবার আদনানকে খাওয়ায়। খাওয়ার মাঝে-ই তুর্কি অনবরত ওর আবোল-তাবোল, উল্টা-পাল্টা কথা চলমান রাখে। আদনান মনোযোগী শ্রোতার মত খাবার চিবাতে চিবাতে শ্রবণ করতে থাকে। ওর ঠোঁটে লেগে থাকে আঁকা হাসি। মেয়েটা এত কথা বলতে পারে!! তবুও কখনো বিরক্ত লাগে না। আর বিরক্ত লাগলেই কী! তুর্কিকে থামাবে কে? অগত্যা ও-কে শুনতেই হবে।

আদনান কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। তুর্কি বিছানায় শুয়ে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। আদনান তৈরি হতে হতে ওর উদ্দেশ্যে আদেশবানী দিচ্ছি। কিছুতেই যেনো লাফা-লাফি না করে। কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হলে মোহোনা-সূচনা অথবা হুমাইরা কে ডাকে।
আদনানের সব কথাই তুর্কি কানে আসছে। তবে তাতে ওর মন নেই। ও মুগ্ধ নয়নে আদনানের দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটাকে অনেক সুন্দর! সব শার্টেই সুন্দর লাগে। তবে, ব্ল্যাক শার্টে যেনো ভিন্ন রকমের সুন্দর লাগে।
আদনান পুরো তৈরি হয়ে আয়ানাতে-ই তুর্কির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। ওকে ঐ ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ওর কপালে ভাঁজ পড়ে। ও ঘাড় ঘুরিয়ে তুর্কির দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচায়।
-কি বললাম শুনেছো?
– স্যার, আপনাকে এই শার্টে আবুলের মত লাগছে। এইটা চেঞ্জ করুন।
আদনান কপালের ভাঁজ আরও গভীর করে বলে,

-কিহ্!
– হ্যাঁ। অন্য কালার পরুন। এইটা কেমন যেনো।
আদনান টেবিল থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিতে-নিতে বলে,
-পাগলামি না করে চুপ-চাপ শুয়ে থাকো। আমার টাইম নেই। আর এতক্ষণ যা বললাম সব মেনে চলবে।
তুর্কি আদনানের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলে,
-কোনো দিন ও না। যদি আপনি শার্ট চেঞ্জ না করেন; আমি আপনার কোনো কথা মেনে চলবো না। উলটো তিড়িং-বিড়িং করে ব্যথা বাড়াবো। তখন ক্ষতি আপনারই। আমাকে পড়তে বসাতে পারবেন না।
তুর্কি কথা শেষ করে বেশ ভাব নিয়ে আদনানের দিকে তাকায়। আদনান ঘাড় কিঞ্চিৎ বাঁকা করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তুর্কি আবার বলে,

-চেঞ্জ করবেন কি করবেন না?
-আমি বুঝতেছি না। এইটাই প্রব্লেম হচ্ছে কী?
-অনেক প্রব্লেম হচ্ছে। আপনি বুঝবেন না। আমি এইটা পড়ে আপনাকে যেতে দিবো না। কথা না বাড়িয়ে ফাস্ট চেঞ্জ করুন। আপনার টাইম আরও নষ্ট হচ্ছে।
আদনান গভীর শ্বাস নিয়ে বলে,
-তুমি জানো, তোমার মাথায় বড়ো কোনো সমস্যা আছে?
তুর্কি ওঠে বসার চেষ্টা করে বলে,
-আপনি এত দিনে বুঝলেন আমার মাথায় সমস্যা আছে? স্ট্রেঞ্জ!! যেখানে আমি শুরু থেকেই আপনার জন্য পাগল। আমার মন, হার্ট, ব্রেইন, কলিজা, ফুসফুস, কিডিনি যাবতীয় সব কিছু অনবরত আপনার নাম জপে। আমার দিন-রাত, ঘুমের-ঘোর সহ সব খানে আপনি বিচরণ। সেখানে আমি সুস্থ মস্তিষ্কের কীভাবে হবো?
কথা শেষ করে তুর্কি নিজের কায়দায় ভ্রু নাচায়। আদনান দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ওর দিকে গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। দুইজনের দৃষ্টি সংযোগ হলে ক্ষণকাল দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তুর্কির ঠোঁটে মৃদু হাসি লেগে আছে।
তুর্কি আদনানের ভাবনার সুতো ছেঁড়ার জন্য বাঁ চোখ টিপে। ওর চোখ মারা দেখে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয় আদনান। তুর্কি ঠোঁট টিপে হাসে। আদনানের উদ্দেশ্যে বলে,

-আপনি শার্ট বের করবেন? নাকি আমি ওঠে এসে শার্ট বের করবো?
আদনান বাধা দিয়ে বলে,
-না। চুপচাপ শুয়ে থাকো। আমি নিজেই চেঞ্জ করছি।
তুর্কি বিজয়ের হাসি হাসে। আদনান ওর কথা মত ব্ল্যাক শার্ট চেঞ্জ করে ডার্ক ব্লু শার্ট পরে। তুর্কি আদনানকে দেখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলে,
-এইবার ঠিক আছে। এখন একটু কম সুন্দর লাগছে। মাশাল্লাহ! কারো নজর না লাগুক। শুধু আমার নজর লাগুক।
তুর্কি কথাকে উপেক্ষা করে বলে,
-দুপুরে মা কে বলে তৈরী হয়ে থেকো। হসপিটাল এ যাবো।
হাসপাতালের কথা শুনে তুর্কির অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। ও আদনানের দিকে তাকিয়ে কম্পিত কণ্ঠে বলে,
-কেনো স্যার? হাসপাতালে যাবো কেনো?
আদনান পুনোরায় সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে ওর দিকে ঘুরে তাকায়। শার্টের কফ ভাঁজ করতে করতে বলে,
-কোমড়ে যে ভাবে ব্যথা পেয়েছো; একবার এক্স-রে করানো দরকার। তা না হলে ব্যথা আরও গুরুতর হতে পারে।
তুর্কি ঢোক গিলে বলে,

-কোনো দরকার নেই স্যার। আমি সম্পূর্ণ সুস্থ।
আদনান বের হতে হতে বলে,
– দরকার আছে। আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না। বসে বসে সিলেবাস শেষ করো। যত বাহানা-ই বের করো; এক্সমে কিন্তু বসতে হবে। আর যা যা বলাম সব মেনে চলো। লাফালাফি করে ব্যথা বাড়িয়ে ও না। মনে থাকে যেনো।
আদনান চলে যেতে এক লাফে ওঠে বসে তুর্কি। পরীক্ষা যাতে না দিতে হয়, সেই আশায় ইচ্ছে করে ওয়াশরুমে শ্যাম্পু ফেলে নাটক টা সাজিয়ে ছিলো৷ কিন্তু, এই লোকতো ও-কে পরীক্ষার হলে বসিয়ে ছাড়বে। আর তার থেকে ও বড় ব্যাপার, ডাক্তারের কাছে গেলে সম্পূর্ণ নাটক ফাঁস হয়ে যাবে। আল্লাহ্!
ও দাঁত দিয়ে নখ কামড়িয়ে আরও ভাবতে থাকে। অন্য কোনো প্ল্যান ভাবতে হবে। এই কয়দিনের মধ্যে সিলেবাস শেষ করা অসম্ভব। তার উপর হাসপাতালে কিছুতেই যাওয়া যাবে না।

আদনানের কথা মনে করে ফুঁসে ওঠে। শালার লোকটাকে এত ভালোবাসে, লোকটার জন্য এত পাগল তবুও ওকে বিন্দু মাত্র বুঝে না। একটুখানি বাথরুমে পড়ে গেলে হাসপাতালে যেতে হবে কেনো? অসহ্য লাগে।
কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর তুর্কিকে ডাকতে ডাকতে ঘরের দিকে আসে হুমাইরা। এইদিকে তুর্কি রুমে পায়চারী কর‍তে কর‍তে আরেকটা প্ল্যান সাজাচ্ছিল। হুমাইরার ডাক কানে আসতেই এক লাফে বিছানায় উঠে শুয়ে পড়ে। চোখে মুখে কিঞ্চিৎ ব্যথার ছাপ আনে। হুমাইরা এক বাটি ফল কেটে নিয়ে এসেছে। ওর কাছে এসে বসতে বসতে বলে,

-কীভাবে যে ব্যথা পেলি! খুব ব্যথা করছে শরীর?
-না আম্মু। এখন একটু কমেছে।
-এই গুলো খা। রান্না হলে আমি এসে খাইয়ে দিয়ে যাবো। উঠবি না। ঠিক আছে? আর কিছু প্রয়োজন হলে আমাকে ডাকবি। ঠিক আছে?
তুর্কি বাধ্য মেয়ের মত মাথা নাড়ায়। হুমাইরা চলে যেতে; তুর্কি প্লেট থেকে এক টুকরো আপেলের পিস তুলে আবারও ভাবনার সাগরে ডুব দেয়।
ওর ভাবনার সুতো ছিঁড়ে মোহনা-সূচনা কথায়। ওরা খুব উচ্চস্বরে আদনানকে ডাকতে ডাকতে ছুটে আসছে।
-ভাবি, ভাইয়া কই?

তুর্কি মিষ্টি করে হেসে জবাব দেয়
-কলেজে চলে গেছে। কেনো?
মোহনা কপাল চাপড়ে বলে,
-ইসস! এত তাড়াতাড়ি আসলাম তবু ও পেলাম না।
সূচনা বিরক্ত কণ্ঠে বলে,
-ধ্যাত্! কত আশা করে আসলাম উইস টা করবো। রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার জন্য করতে পারে নি।
তুর্কি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
-কিসের উইস?
-আজ তো ভাইয়ার বার্থডে।
তুর্কি শোয়া থেকে এক লাফে বসে পড়ে। কণ্ঠে বিষ্ময় এনে বলে,
-কীইই!! আজ স্যার এর বার্থডে?
-হ্যাঁ। কেনো জানেন না?
তুর্কি দ্রুত বিছানা থেকে নেমে বিড়বিড় করে,

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৩১

-আজ আমার জান পাখির বার্থডে!! অথচ আমি জানিনা? চাচু কে ধরতে হবে।
তুর্কি ছুটে রুম থেকে বের হয়। মোহনা-সূচনা হইহই করে উঠে,
-ভাবি আপনার পায়ে কোমড়ে তো ব্যথা। এই ভাবে ছুটছেন কেনো?
তুর্কিকে কে থামাবে? ও ছুটে চলেছে মুজাহিদ এর ঘরে। এত বিশেষ দিন আজ। অথচ ও জানেন না। আদনানকে তো সারপ্রাইজ দিতে হবে। নিশ্চয়ই স্যার এর মনে নেই। খুব স্পেশাল ভাবে এই বিশেষ দিনটি সেলিব্রেট করতে হবে৷ এক মনে বিড়বিড় করতে করতে চলে যায় তুর্কি।

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৩৩