হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৩৭
তোয়া নিধী দোয়েল
মুমিনুলের কথা শুনে মূহুর্তে স্তব্ধ হয়ে যায় উপস্থিত সবাই। মুজাহিদ ভাত মাখাচ্ছিলেন। মুমিনুলের কথা শুনে হাত থেমে যায় তাঁর। আলামিনের মুখের কাছে তোলা ভাতের লোকমার হাত থেমে যায়। সে ভুলে যায় সেটা মুখে তুলতে। হুমাইরা অস্থির কণ্ঠে বলে,
-এই সব কী বলছো, ভাই!!
মুজাহিদ ভাতের প্লেট থেকে হাত ওঠিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। বাপ-মা মারা যাওয়ার পর, এই ভাইদের কাছেই বড় হয়েছে সে। কখনো ভাবতে পারে না, এই ভাইদের ছেড়ে থাকতে হবে। অবাক কণ্ঠে বলে,
-ভাই…কী বলছো এই সব?
আদনান রেজুয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,
-প্লেট নিয়ে উপরে যা।
রেজুয়ান সবে ভাতে হাত দিয়েছিলো। ভাইয়ের আদেশ পেয়ে প্লেট নিয়ে ওঠে যায়। যদিও জানা নেই, এই রকম একটা কথা শোনার পর ভাত আর গলা দিয়ে নামবে কী না!
আদনান তুর্কিকে ও ইশারা করে উপরে যেতে। তুর্কি ও বিনাবাক্যে রেজুয়ানের পিছু পিছু উপরে চলে যায়। ওর মন কেমন যেনো করছে। এই বাড়ির মানুষ গুলো ওর ভীষণ প্রিয়। সব সময় একটা আনন্দে থাকে সবাই। মনে মনে প্রার্থনা করে, খারাপ কিছু যেনো না হয়।
আলামিন চেয়ার থেকে ওঠে বলে,
-কী বলছিস এই সব? কিসের সংসার আলাদা চাস?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মুমিনুল মাথা নিচু করে ফেলে। আসলে গত তিন মাসে তাঁর ব্যবসায় অনেক লস হয়েছে। সেই ক্ষতিপূরণ করতে জমানো পুঁজি সব ঢেলে দিয়েছে। তিন মাসে সংসারে কোনো টাকা দিতে পারিনি। তার ওপর মোহোনা-সূচনা ও রয়েছে। যদি ভাইয়েরা বা ভাইয়ের বউ কিছু বলে, সেই ভয়ে সে সংসার আলাদা করার কথা তুলেছে। যাতে নিজে যেভাবেই চলুক তাঁর ভাইয়েদের ওপর যেনো কোনো বিপদ না আসে।
সব শুনে আলামিন বেশ চটে যায়। এই সামান্য কারণে কেউ সংসার আলাদা করে? আলামিন এগিয়ে এসে বলে,
-তোকে এই নিয়ে তোর ভাবি কিছু বলেছে?
মুমিনুল দ্রুত ডানে বামে মাথা নেড়ে বলে,
-না না। ভাবি তো মায়ের…
আলামিন চোখ গরম করে বলে,
-ভাবি যখন মায়ের মত তাহলে ভাবলি কীভাবে, এই সামান্য একটা কারণ নিয়ে ও তোকে কথা শোনাবে? এই চিনলে তোর ভাবি কে? সেই ছোট থেকে এই দেখে আসছিস?
মুজাহিদ এগিয়ে এসে বলে,
-দয়া করে সংসার ভাঙার কথা বলো না, ভাই। আমরা একটা পরিবার। পরিবারে সবার কিছু না কিছু সমস্যা থাকতেই পারে। সেই সমস্যা দূর করার জন্য বাকি সদস্য অবশ্যই এগিয়ে আসবে। আমরা যদি সবাই মিলে সবার উত্থান-পতন, সুখ-দুঃখে পাশে না থাকি তাহলে পরিবার কীভাবে টিকবে? কীভাবে আমরা সামনে এগোবো?
পরিবার হচ্ছে সেই আকাশ, যার নিচে আমরা যতবার ভেঙে পড়ি, ততবারই নতুন করে জোড়া লাগার সাহস পাই। আর সেই সাহস সঞ্চার করে দেয় পরিবারের সদস্যরা। যদি পরিবার-ই ভেঙে যায় তাহলে কীভাবে জোড়া লাগবো আমরা?
হুমাইরা এগিয়ে এসে বলে,
-তুমি তোমার সমস্যা আমাদের কাছে বলতে পারতে, ভাই। দোহাই লাগি, ওমন কথা আর মুখে এনো না। আর রচনা কই? ও তো একটা বার আমার কাছে বলতে পারতো।
মুমিনুল অনুশোচনার স্বরে বলে,
-মাফ করো ভাবি। আমি এত কিছু ভেবে বলি নি। রচনা ঘরে। ও যখন থেকে শুনেছে সংসার আলাদা করবো, তখন থেকে কেঁদে চলেছে।
হুমাইরা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে দ্রুত রচনার ঘরে যায়। মুমিনুল আলামিনের দিকে এগিয়ে এসে বলে,
-মাফ করো ভাই। আমি এত কিছু ভাবি নাই। আমি ভেবেছি…
-রাখ তোর ভাবা-ভাবি। আমি তোদের সবার বড়। ছোট থেকে তোদের মানুষ করেছি। তোদের আগলে রেখেছি। কোনো সমস্যা হলে আমার কাছে বলবি। মনে রাখবি আমি তোদের আরেক বাপ। মনে রাখবি পরিবার থেকে বিচ্ছেদ হলে আর কখনো জোড়া লাগতে পারবি না।
ভাইয়ের কথা শুনে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে মুমিনুলের। আলামিন এগিয়ে এসে দুই ভাইকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে। কিঞ্চিৎ ভেজা কণ্ঠে বলে,
-তোরা জানিস না, তোরা আমার কাছে কী। তোদের আলাদা করে দিয়ে আমি কখনো শান্তি-তে থাকতে পারবো? তোরা কখনো আমার কাছ থেকে আলাদা হতে চাইস না।
আদনান স্বস্তির শ্বাস ফেলে। ও জানে ওর বাবা থাকতে এই পরিবার ভাঙতে দিবেন না।
হুমাইরা রচনার ঘরে গিয়ে কয়েক ধমক দেয় বোনকে। এত বড় কথা কেনো চেপে রেখেছে সেটা জানার জন্য। রচনা বোনকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। হুমাইরা রচনাকে শান্ত করে বলে,
-আর কখনো এই সব ভাবিস না। কোনো সমস্যা হলে আমাদের জানবি। আমরা সবাই মিলে সেই সমস্যা দূর করার চেষ্টা করবো।
তুর্কি-রেজুয়ান বারান্দায় পায়চারি করছে। রেজুয়ান ভাতের প্লেট পাশের হাফ ওয়ালের উপর রেখেছে। আদনান বারান্দায় আসতেই তুর্কি-রেজুয়ান ঝাঁপিয়ে পড়ে আদনানের ওপর। অস্থির কণ্ঠে বলে,
– স্যার, নিচে কী হলো?
-ভাই…।
আদনান হাসি প্রশস্ত করে রেজুয়ানের কাঁধে হাত দিয়ে বলে,
– রিল্যাক্স ব্রাদার। খারাপ কিছুই হয়নি। সামান্য একটু প্রবেল্ম হয়েছিলো। কিন্তু, এখন সব ঠিক।
তুর্কি-রেজুয়ান দুইজন হাঁফ ছেড়ে বলে,
– আলহামদুলিল্লাহ!
রেজুয়ান ভাইয়ের গলায় হাত দিয়ে বলে,
-ভয় পেয়ে গেছিলাম।
আজ তুর্কির পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আল্লাহর নাম নিয়ে, দোয়া পড়তে পড়তে পরীক্ষা গুলো দিয়েছে। ফেল তো করবে নিশ্চিত! তবে, মাথা থেকে একটা বিরাট বোঝা নেমে গেছে।
শেষ পরীক্ষা দিয়ে আজ বাবার বাড়ি এসেছে ও। অনেক দিন যাবৎ মায়ের সাথে দেখা হয় না। আদনান ব্যস্ত ছিলো বিধায় রেজুয়ান সাথে এসেছিলো। কিচ্ছুক্ষণ থেকে আবার তখনই বাড়ি ফিরে গেছে ও।
রাত প্রায় এগারোটার কাছাকাছি। তুর্কি এতক্ষণ মায়ের সাথে খোশগল্পে মত্ত ছিলো। কত কথা জমা ছিলো পেটে। মা’কে পেয়ে গল্পের ঝুড়ি খুলে বসেছিলো। ঘরে এসে সময় দেখে কপালে ভাঁজ পড়ে। রাত এত হয়ে গেল, অথচ আদনানের কোনো পাত্তা নেই। লোকটা কি আসবে না?
ও ফোন হাতে নিয়ে আদনানকে কল করে।
মুজাহিদের ঘরে লুডু খেলছে আদনান, মুজাহিদ আর রেজুয়ান। বিছানার উপর গোল হয়ে বসেছে তিনজন। মাঝে লুডুর বোর্ড। পাশে চানাচুর দিয়ে মুড়ি মাখা আর কোমল পানীয়। ওদের উপচে পড়া হাসির শব্দ প্রতিধ্বনি হচ্ছে ঘরে। টান-টান উত্তেজনা তিনজনের মাঝে! তিনজনের-ই আর মাত্র একটা গুটি রয়েছে। যদিও আদনান- রেজুয়ান অনেকবার জোচ্চুরি করে মুজাহিদ এর গুটি খেয়েছে। তা না হলে মুজাহিদ-ই জিতে যেতো। এই নিয়ে কত বাক-বিতণ্ডা হলো তিনজনের মাঝে। আদনান এক মুঠো মুড়ি মুখে নিয়ে গুটি নাড়ে। ওর শেষ হলে ছক হাতে নেয় রেজুয়ান।
মুজাহিদ এর গুটির তিন ঘর পিছে রেজুয়ানের গুটি। রেজুয়ান দান ছাড়লে ভাগ্যক্রমে এইবার সত্যি সত্যি তিন ওঠে। রেজুয়ান খুশিতে শিস বাজিয়ে ওঠে। মুজাহিদ বিদ্রোহী কণ্ঠে বলে,
-আমি মানিনা। তোরা বার-বার আমার সাথে চিটিং করতাছস।
রেজুয়ান হাসি থামিয়ে বলে,
-তোমার বউ ছাড়া জীবনে, ছকের গুটি খাওয়া যায় এই তো বেশি। আবার কান্দো কোন কারণে? চুপচাপ গুটি সরাও।
এই নিয়ে কিছুক্ষণ ওদের মধ্যে যুদ্ধ চলে। যুদ্ধের মাঝে বেজে ওঠে আদনানের ফোন। আদনান ফোন হাতে নিয়ে বিছানা ছেড়ে নামে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে অভিমানী কণ্ঠস্বর থেকে ভেসে আসে কিছু কথা—
-আপনি কই? এখনো আসছেন না কেনো?
তুর্কি অভিমানী কণ্ঠস্বর ভেসে আসতেই আদনান ভ্রু কুঁচকে বলে,
-কই যাবো?
তুর্কি এবার অভিমান সরিয়ে তেজি স্বরে বলে,
-কই যাবো মানে? আমি যে এই বাড়ি, আপনার খেয়াল নেই? বউ ছাড়া এতক্ষণ রয়েছেন কীভাবে!
আদনান মৃদু হেসে বলে,
-কতদিন পর মায়ের সাথে দেখা হয়েছে, নিজের মধ্যে সময় কাটাও। পড়া ছেড়ে একটু স্বস্তি পেলে। আমি তোমাদের মাঝে গিয়ে কী করবো?
তুর্কি কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
-আপনি এসে কী করবেন মানে? আপনি জানেন না, আপনাকে ছাড়া আমার ঘুম আসে না!
তুর্কির বাচ্চাসুলভ কথা শুনে ঠোঁটের হাসি প্রশস্ত করে আদনান। মুড়ি খেতে খেতে আদনানের কীর্তিকলাপ দেখছে মুজাহিদ আর রেজুয়ান। বুঝেছে বউ ফোন করেছে। আদনানের হাসি দেখে রেজুয়ান মুজাহিদ কে খোঁচানোর জন্য বলে,
-বাপের ভাই, জীবন ভরে শুধু বাচ্চার প্রেমই দেখে যাও। এ জীবনে আর বউয়ের সাথে প্রেম করতে হবে না।
মুজাহিদ, রেজুয়ানের খোঁচা শুনে আড় চোখে তাকায়। ভাঁজ করা বাঁ পা বের করে রেজুয়ানের পশ্চাৎদেশ বরাবর লাথি দেয়। রেজুয়ান লাথি খেয়ে বেঁকে যায়।
-তুই শুধু আবার ফুল কিনতে বলিস। পামু নি তখন।
-উফ্! মরলাম।
আদনান হাসি থামিয়ে বলে,
-অনেক রাত হয়েছে। এখন কীভাবে যাবো? কাল সকালেই যাই?
তুর্কি পূর্বের কণ্ঠস্বর বজায় রেখে বলে,
-সকালে আসবেন মানে? তো আজ কি আমি নির্ঘুমে কাটাবো? আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। আপনার কাছে ‘না’ কোনো অপশন নেই। হয় আসছি; নয় এই তো রেডি হয়ে বের হচ্ছি! এই দুইটার মধ্যে যে কোনো একটা উত্তর দিতে হবে।
তুর্কির কথা শুনে আদনান দ্বিধায় পড়ে যায়। ও দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলে,
– এই এত রাতে কেউ শ্বশুর বাড়ি যায়? মানুষ কী বলবে?
-বয়ে গেছে মানুষের কথা শুনতে আমার। মানুষের যা ইচ্ছে ভাবুক। আমি আপনাকে ছাড়া ঘুম আসতে পারবো না। তাই, আর ভণিতা না করে চুপ চাপ চলে আসুন।
আদনান কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
-আচ্ছা। দেখছি কী করি।
-কী করি মানে? কোনো কিছু করা-করি নেই। আপনি আসছেন মানে আসছেন। আমি মায়ের শাড়ি পরে তৈরি হচ্ছি আপনার জন্য! আর কথা না বাড়িয়ে এক্ষুনি রওনা দিন। বুঝেছেন?
-হুম। ‘বউ’ এত সুন্দর করে বুঝাচ্ছে আর আমি না বুঝে থাকবো কীভাবে বলো!
তুর্কি ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলে,
-আর শুনুন, আসার সময় আমার জন্য কিছু নিয়ে আইসেন।
-কী আনবো? কী খাবে?
তুর্কি কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
-কিস ইউ!
আদনান, রেজুয়ান-মুজাহিদের হট্টগোলে ভালোভাবে শুনতে পারেনি কথাটা। ও-ওদের দিকে তাকিয়ে আবার প্রশ্ন করে,
-কী বললে? বুঝিনি।
-কিস মি চকলেট! ঐ যে টিভিতে মাঝে মাঝে এড দেখায়। কী যেনো নাম চকলেট টার? মনে নেই। শুধু মনে আছে চকলেট টা খেতে খেতে বলে কিস মি! তো ঐ চকলেট টা নিয়ে আইসেন।
তুর্কির কথা বোধগম্য হয় না আদনানের। এই রকম কোনো চকলেটর নাম ও কখনো শুনেছে কী না তা ওর জানা নেই। ও ভ্রু কুঁচকে বলে,
-এই টা আবার কোন কোম্পানির চকলেটর নাম? কখনো তো শুনেনি।
তুর্কি চোখ বন্ধ করে শ্বাস নেয়। এই লোক যে এমন কেন আল্লাহ্ জানে। ও ভাবলেশহীন হয়ে বলে,
-আমার শাশুড়ী মায়ের বানানো কোম্পানি। তবে সেটা আপাতত বন্ধ আছে। আপনি চিনবেন না। থাক চিনতে হবে না। আপনি সময় নষ্ট করা বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি আসুন। আমি অপেক্ষা করছি আপনার জন্য।
এই বলে তুর্কি লাইন কেটে দেয়। আদনান, মুজাহিদ-রেজুয়ান কে বলে, এখন শ্বশুর বাড়ি যেতে হবে। বউ অপেক্ষা করছে। এই বলে বিদায় নিয়ে নিজের ঘরে যায়। রেজুয়ান বিছানায় শুয়ে শুয়ে মুজাহিদ এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করে
-ইস্! আজ যদি আমার বাপের ভাইয়ের একটা বউ থাকতো, আমার বাপের ভাই ও বউয়ের টানে ছুটে যেতে পারতো!
মুজাহিদ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ওর দিকে তাকায়। এতক্ষণ গুঁতা খাওয়ার পর ও, ওর শরম-লজ্জা বিন্দু মাত্র হয় না।
-অপেক্ষা কর, তোর শাশুড়ী কে নিয়ে আসুম নি।
রেজুয়ান এক লাফে বিছানায় শোয়া থেকে ওঠে বলে,
-খবরদার! আমার শাশুড়ীর দিকে নজর দিও না। আর এমনি তে ও, তোমার মতো বুড়ো লোককে পাত্তা দিবো না।
-দেখা যাবে৷ বেয়াইন আমার কত সুন্দর!
মায়ের থেকে একটা খয়েরী রঙের শাড়ি নিয়েছে তুর্কি। জুবাইরা যখন শুনেছে আদনান আসছে, তখনই সে রান্নার আয়োজন করেতে চলে গেছে। তুর্কি আয়নার সামনে বসে বসে সাজছে। তবে ওর শরীর টা বেশি ভালো নয়। কেমন যেনো জ্বর-জ্বর ভাব শরীরে। তবুও মনের রঙ এক ফোটা কমেনি।
আদনান তুর্কির কথা মত ওর জন্য এক বক্স চকলেট সহ বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি ও কিছু ফলমূল কিনেছে। রাস্তায় তেমন ভিড় নেই। তাই শ্বশুর বাড়ি আসিতে তেমন কাঠখড় পোড়াতে হয়নি।
তুর্কি বৈঠক খানায় অপেক্ষা করছে আদনানের জন্য। দজায় কলিংবেল বেজে ওঠতেই ওর বুক ছ্যাঁত করে ওঠে। এসে গেছে ওর ‘জান পাখি’। ও চেয়ার থেকে ওঠে ছুটে দরজা খুলতে যায়। তবে রান্নাঘর থেকে মূল দরজা কাছে বেশি। তাই জুবাইরা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে দরজা খুলতে যায়। তুর্কি মাকে বাধা দিয়ে বলে,
-মা মা মা… দাঁড়াও! আমি খুলছি।
মেয়ের কণ্ঠ শুনে দাঁড়িয়ে যায় জুবাইরা। তুর্কি দ্রুততরে দরজা খুলে চমৎকার হাসি দেয়। উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে,
-জা…
‘জান’ বলতে গিয়ে থেমে যায়! আদনান ভ্রু নাচিয়ে বোঝায় পিছনে মা দাঁড়িয়ে আছে। ও আদনানের ইশারা বুঝে গলা ঝেরে বলে,
– স্যার!
আদনান তুর্কিকে উপেক্ষা করে আগে শাশুড়ী কে সালাম দেয়। নিশ্চয়ই শাশুড়ীর সামিনে দাঁড়িয়ে বউয়ের সাথে আগে কথা বলা সুন্দর দেখায় না। জুবাইরা সালামের উত্তর নিয়ে হাসি মুখে কথা বলে, আদনানের হাতে থাকা জিনিস নিয়ে চলে যায়। জুবাইরা চলে যেতে আদনান তুর্কির হাতে চকলেটের বক্স দেয়। তুর্কি একটু এগিয়ে গিয়ে আদনানের হাত থেকে বক্স নিয়ে ওর বাহু চেপে ধরে। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
-এখন শান্তি! সারাদিন যেখানেই থাকেন না কেনো; দিন শেষে আপনার সান্নিধ্য না পেলে আমার শান্তি লাগে না।
আদনান মৃদু হেসে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-তাই?
তুর্কি ওপরে নিচে মাথা নাড়ায়। আদনান ফের বলে,
-তোমাকে তো বেশ সুন্দর লাগছে!
আদনানের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে বরাবরের মত পেটে প্রজাপতি উড়তে থাকে তুর্কির। ঠোঁটে ফুটে লাজের হাসি। হাঁটতে হাঁটতে আদনানকে নিজের ঘরে নিয়ে যায়। ফ্রেশ হয়ে হালকা পাতলা কিছু খাবার খায়।
বিছানার পাশে জানালার সামনে বসে রয়েছে আদনান-তুর্কি। ঘরের লাইট বন্ধ। জানালা দিয়ে কিছু পরিমাণ আলো ঢুকছে ঘরে। জানালার ওপাশ দিয়ে বয়ে গেছে এক নদী। যতদূর চোখ যায় শুধু পানি। তবে রাতের দরুন তেমন বোঝা যাচ্ছে না।
আকাশে তেমন নক্ষত্ররাজি নেই। তুর্কি দুই হাঁটু বুকের সাথে মিশিয়ে দুই হাত দিয়ে ধরে বসেছে। মৃদু বাতাস বইয়ে আসছে। থেকে থেকে ব্যাঙের ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ আওয়াজ ভেসে আসছে। এর-ই মাঝে তুর্কি বহুত কথা বলে ফেলেছে। আদনান নিত্য দিনের মত তা শ্রবণ করে গেছে। ও ভেবে পায় না মেয়েটা রোজ এত কথা বলে; তবুও পরের দিন এত কথা পায় কই?
কিচ্ছুক্ষণ নীরবতা পালন করে তুর্কি বলে ওঠে,
– স্যার, সেই দিন আপনার এক্স…
কথাটি বলে থেমে যায়। আবার বলে,
-সরি! কোহেলি আপু কল দিয়েছিলো।
আদনান ওর দিকে না তাকিয়ে বলে,
-কেনো?
-বিয়ের পর কেমন আছেন, সেই গীত শুনতে!
আদনান মৃদু হেসে বলে,
-তাই।
-হুম। আমি ও গীত শুনিয়ে দিছি। বলে দিয়েছি, যদি নেক্সট টাইম আমার বর কে কল করে, আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।
আদনান কিছু বলে না। তুর্কি আবার বলে,
-তবে ওনার নাম টা ভীষণ সুন্দর। আমি ডিসাইড করে নিয়েছি, যদি আমাদের মেয়ে হয় তাহলে, আপনার এক্সের নাম টাই রাখবো। যাতে, যখন আপনি ঐ নাম ধরে ডাকবেন, তখন উত্তরে আব্বু ডাক শুনবেন। আর আমি তা শুনে শান্তি পাবো।
আদনান বাঁকা চোখে তাকিয়ে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,
-কতবার বলবো, ও আমার এক্স নয়। জাস্ট পছন্দ করতো।
তুর্কি বিরক্ত চোখে আদনানের দিকে তাকায়। চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– হ্যাঁ, এটাই তো সমস্যা। এ যুগে মানুষ পছন্দ করলেই ভাবে আপনার সাথে তাঁর কোনো সম্পর্ক রয়েছে! এতে আপনি প্রেম করুন বা না করুন। আর আপনার অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে গেলে, ভাবে আপনি তাঁর এক্স। তাই আমাদের মেয়ের নাম রেখে সবাইকে বোঝাবো, আপনি শুধু আমার। ঐ মহিলার সাথে আপনার কিছু ছিলো না।
আদনান কোনো উত্তর দেয় না। তুর্কি চলমান কথা উপেক্ষা করে চকলেট আনতে যায়। বিছানা থেকে নামিতে গেলে পেছন থেকে হাত টেনে ধরে আদনান। তুর্কির বুক ছ্যাঁত করে উঠে।
– আম্মা বললো, শরীরে নাকি জ্বর-জ্বর? আমাকে তো একবার বললে না?
আদনানের ছোঁয়ায় মেরুদণ্ড সোজা হয়ে যায় তুর্কির। ও ঘুরে আদনানের দিকে বসে বলে,
-বললে কী করতেন? আসতেন তো আর না। কত জোর করে আনলাম আপনাকে!
আদনান তুর্কির কানে উড়তে থাকা চুল কানে গুঁজে দিয়ে বলে,
-জানলে আর আসতেই দিতাম না। এখন কেমন লাগছে?
তুর্কি কিছু বলে না। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে আদনানের দিকে। আদনান ও তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। জানাল দিয়ে মৃদু বাতাস বয়ে এসে আদনানের কপালে থাকা চুল কিঞ্চিৎ নাড়িয়ে দেয়। আদনানের যৎসামান্য স্পর্শে তুর্কির হৃদয় কম্পিত হয়। ওর মনে হচ্ছে অন্ধকারে ও আদনানের চাওনি ও-কে অন্য একটি অনুভূতির সাক্ষাৎ দিচ্ছে! ও দ্রুত দৃষ্টি নামিয়ে ফেলে। চঞ্চল হয়ে যায় ওর দৃষ্টি। আদনান ওর লাজুক মুখশ্রী দেখে হো হো করে হেসে ওঠে। আদনানের হাসিতে আরও অপ্রস্তুত হয়ে যায় তুর্কি। ও ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আদনান হাসি থামিয়ে বলে,
-ভাবা যায়, বউয়ের কাছ থেকে ট্রেনিং প্রাপ্ত; দ্যা গ্রেট আনরোমান্টিক লোক সারফারাজ আদনান ও নাকি তাঁর বউয়ের লাজুক মুখশ্রী অবলোকন করছে!
আদনানের কথা শুনে আরও ভড়কে যায় তুর্কি। আমতা আমতা করে বলে,
-মোটেও…আমি লজ্জা পাই-নি।
আদনান হাসি থামিয়ে তুর্কি দুই গালে হাত রেখে, কিঞ্চিৎ ওর মুখের দিকে ঝুঁকে বলে,
-তাই!
তুর্কি চোখ মুখ খিঁচে ফেলে। যেনো তাকালেই ও লজ্জায় মরে যাবে। আদনান আরেকটু ঝুঁকে ওর কপালে অধর ছুঁয়ে একটা চুমু এঁকে দেয়। আদনানের চুম্বনে তুর্কির চোখ আরও খিঁচে যায়। আদনান গাল থেকে হাত সরিয়ে বলে,
-ভয় পেও না। তোমার অসুস্থ শরীরে আমি কিছুই করবো না। তবে, আমার কাছে থাকা সব থেকে সুন্দর স্পর্শটুকু তোমায় দিলাম! তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও, বেগম সাহেবা।
হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৩৬
আদনানের কথা শুনে চোখ মেলে তাকায় তুর্কি। আদনান ততক্ষণে শোয়ার জন্য নিজের জায়গায় চলে গেছে। তুর্কি থম মেরে বসে থাকে নিজের জায়গায়। আপন মনে ভাবতে থাকে প্রিয় পুরুষের প্রথম স্পর্শ! প্রথম চুম্বন। তবে, কপালের চুম্বন সত্যি সব থেকে সুন্দর স্পর্শ! তুর্কি আরও কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থেকে আদনানের দিকে তাকিয়ে দ্রুত কণ্ঠে বলে,
-আরেকটা, প্লিজ!