হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৩৮

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৩৮
তোয়া নিধী দোয়েল

পিঠের কাছাকাছি অত্যুষ্ণ নিশ্বাসের উপস্থিতি টের পেয়ে, নিদ্রা হালকা হয়ে যায় আদনানের। ঘুমে আচ্ছন্ন চোখ খুলে পাশে থেকে ফোন নিয়ে ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে তাকাতেই দেখে—
তুর্কি জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে। বালিশ ও নেই মাথার নিচে। হাত-পা গুটিয়ে শুয়ে আছে, যেনো শীতে কাঁপছে ও কিঞ্চিৎ! তুর্কির জুবুথুবু অবস্থা দেখে আদনানের ঘুম নিমেষেই উবে যায়। ও দ্রুততরে শোয়া থেকে ওঠে বসে।
ডান হাত বাড়িয়ে তুর্কির কপাল স্পর্শ করে। শরীরের তাপমাত্রা অনুমান হতেই; বুকের মাঝে তীক্ষ্ণ কিছু ছুটে যায়! শরীরে এত তাপমাত্রা! কপাল যেনো পুড়ে যাচ্ছে।

কাঁথা ও নেই গায়ে।
ও বিছানা থেকে নেমে ফ্যানের স্প্রিড কমিয়ে বাতি জ্বালায়। পায়ের কাছে পড়ে থাকা কাঁথা এনে তুর্কিকে ঠিক করে শোয়ায়। তারপর কাঁথা দুই ভাঁজ করে ওর শরীর ঢেকে দেয়।
কখন এত জ্বর এলো মেয়েটার! আদনানের মাথা যেনো শূন্য হয়ে গেছে। কী করবে? কীভাবে জ্বর কমাবে যেনো ভেবেই পাচ্ছে না।
ও দ্রুত ওয়াশরুমে গিয়ে মগে করে পানি নিয়ে আসে। বারান্দা থেকে তোয়ালে এনে এক প্রান্ত ভিজিয়ে তুর্কির কপালে রাখে।
আদনানের কেমন যেনো পাগল-পাগল লাগছে। এই মূহুর্তে জল-পট্টি দেওয়া ব্যতীত; আর কী করা উচিত কিছুই ওর স্মরণে আসছে না।
ক্ষণে ক্ষণে তোয়ালের প্রান্ত নিংড়ে তুর্কির কপালে রাখছে। এক হাত দিয়ে তুর্কির মাথায় সন্তপর্ণে বুলিয়ে দিচ্ছে। তুর্কি জ্বরের ঘরেই অস্ফুটস্বরে বিড়বিড় করছে। আদনান তুর্কির দিকে একটু ঝুঁকে শোনার চেষ্টা করে। তবে কিছুই শুনতে পায় না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আদনান আনমনে কিছু ভেবে হাসে। হয়তো মেয়েটা ঘুমের ঘোরেই ও-কে নিয়েই ভাবছে! আদনান ওর মুখশ্রী তুলে তুর্কির ললাটে অধর ছুঁয়ে দেয়। তারপর তুর্কির ডান হাত কাঁথার নিচ থেকে বের করে আঙুলের মাঝে আলতো স্পর্শে চুম্বন করে। হাত শক্ত করে ধরে তুর্কির মুখের পানে চেয়ে থাকে।
তুর্কির কর্ম-কাণ্ডের কথা মনে হতেই ঠোঁটে ফোটে মৃদু হাসি। তুর্কির উদ্দেশ্যে মনের এক অভিব্যক্তি প্রকাশ করে—
-আই ফিল কমপ্লিট ইন মাই লাইফ; যখন ভাবি আমার জীবনে তোমার মত একটা বউ আছে! আমার অদ্ভুত প্রেমের লাইব্রেরিতে যতগুলো বই আছে, সেখানে শুধু তোমাকে নিয়েই লেখা। আর যে নতুন পৃষ্ঠা যোগ হবে, সেখানে ও তোমাকে নিয়েই থাকবে। আমাদের কাটানো রঙিন মূহুর্ত আর অফুরন্ত ভালোবাসা। আমার মনের গহীনে থাকা সকল প্রণয় শুধু তোমার জন্য হোক, বেগম সাহেবা!
ভিজে তোয়ালে দিয়ে হাত, পায়ের পাতা ও মুছে দেয়। বার বার কপালে হাত দিয়ে অনুমান করে জ্বরের প্রখরতা।

তুর্কির সেবা করতে করতে কখন যে দিনের আলো ধরণীতে এসে পৌঁছিয়েছে তা জানা নেই আদনানের। ও তুর্কির পাশেই; তুর্কির হাত ধরে বসে, খাটের হেডবোর্ডের সাথে পিঠ ও মাথা ঠেকিয়ে তন্দ্রায় নিমজ্জিত। সারারাত জাগ্রত থাকায় ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছিলো।
জানালা দিয়ে বাইরের আলো ভিতরে প্রবেশ করায় ঘুম ভেঙে যায় আদনানের। ও চোখ কচলিয়ে পাশে তাকায়। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তুর্কি।
আদনান হাত বাড়িয়ে তুর্কির শরীরের তাপমাত্রা অনুমান করে। জ্বর কিছুটা কমেছে৷ ও বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে আসে। যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি ফিরতে হবে।

ঘুম-ঘুম চোখ মেলার চেষ্টা করে তুর্কি। ঘুমজড়ানো কণ্ঠে ডাকে—
– স্যার! কই আপনি?
আদনান ওর পাশেই বসা ছিলো। কিচ্ছুক্ষণ আগে জুবাইরা এসে হালকা চা-নাস্তা দিয়ে গেছে। যদিও তার কিছুই আদনান মুখে তুলেনি। সে উৎকণ্ঠিত হয়ে বসে রয়েছে অর্ধাঙ্গিনীর শরীরের অবস্থা শোনার। তুর্কি ডাকতেই আদনান জিজ্ঞাসা করে—
-এখন কেমন লাগছে?
তুর্কি কপালে আঙুল চালাতে-চালাতে বলে,
-মাথাটা কেমন যেনো ঝিম-ঝিম করছে। পেট ব্যথা করছে।
-ওঠো। খাবার খেয়ে ঔষধ খেয়ে নেও। ঠিক হয়ে যাবে।
তুর্কি কিছু বলে না। আদনান আবার বলে,

-বাড়ি ফিরতে হবে।
-আজই?
-হুম।
আদনান ওঠতে গেলে তুর্কি আবারও পিছন থেকে ডাকে—
– স্যার!
আদনান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। তুর্কি মৃদু হাসি নিয়ে বলে,
-আপনাকে ভালোবাসি!
আদনান বুকে হাত দিয়ে বলে,
-উফ্! বুকে ব্যথা করে!
তুর্কি কপালে ভাঁজ ফেলে চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। বিরক্ত কণ্ঠে বলে,

– ইংরেজি তে বললে বলেন কোন টেন্স! বাংলায় বললে বলেন বুকে ব্যথা! সমস্যা কী আপনার? দোয়া করি, আপনার বুকে যখন আমি নেই; ঐ বুকে গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা হোক। দিন দিন ঐ ব্যথা বেড়েই চলুক। আমিন!
আদনান তুর্কির দিকে সম্পূর্ণ ঘুরে ওর দিকে ঝুঁকে স্বভাবতঃ নাকে টোকা দিয়ে বলে,
-যখন ইংরেজিতে বলো ‘আই লাভ ইউ’ তখন কোনো অনুভূতি টের পাই না।
কিন্তু, যখন বাংলায় বললে ‘ভালবাসো’ তখন ঠিক এই বুকে এসে লাগলো! মনে হলো এইটাই অনুভূতির তীব্রতা যেনো বেশি! উফ্! ব্যথায় মরে গেলাম!
আদনানের কথা শুনে শোয়া থেকে এক লাফে বসে পড়ে তুর্কি। আদনান দ্রুত কণ্ঠে বলে,

-এই এই কী করছো? শুয়ে পড়ো। কাল রাতে কি পরিমাণ জ্বর এসেছিলো জানো?
তুর্কি নিজের হাতে চিমটি কেটে ঘটনা বাস্তবে ঘটলো নাকি স্বপ্নে তা অর্থোদ্ধার করার চেষ্টা করে। এই লোক সত্যি এমন একটা কথা বললো? অবিশ্বাস্য!
হাতে ব্যথা অনুভব হওয়ায় তুর্কি মৃদু কণ্ঠে শব্দ করে ’আও’ তারপর অস্থির কণ্ঠে বলে,
– স্যার স্যার, কী বললেন? আরেকবার বলুন।
– তাড়াতাড়ি করো। আমাদের বের হতে হবে। আবার আমাকে কলেজে ও যেতে হবে।
তুর্কি ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে বলে,
-আরে একটু আগে কী যেনো বললেন ওইটা আবার বলুন!
-তাড়াতাড়ি করো।
এই বলতে বলতে আদনান জায়গা ছাড়ে। তুর্কি আদনানের যাওয়ার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

তুর্কির শরীর সকালে ঠিক থাকলে ও বেলা বারার সাথে সাথে যেনো আরও বেশি খারাপ হতে থাকে। জ্বরের মাত্রা তো বেড়েছেই সাথে তীব্র মাথা ব্যথা ও বমি। আবার বার বার বাথরুমে যাওয়াতে আরও বেশি কাহিল হয়ে পড়েছে। ক্ষণে ক্ষণে পেট গুলিয়ে বমি আসছে।
বিছানায় বিশ্রব্ধ হয়ে শুয়ে আছে তুর্কি। চোখের পাতা বন্ধ। কপালে জল-পট্টি। পাশে একটা লেবু গাছের ডাল। যাতে লেবুর ঘ্রাণে তুর্কির আর বমি না হয়। হুমাইরা তুর্কির পাশে বসে অস্থির হয়ে বাতাস করছে আর দোয়া-দরূদ পড়ে ফুঁ দিচ্ছে। যদিও সিলিং পাখা চলছে।
বাড়ির কোনো পুরুষ-ই বাড়ি উপস্থিত নেই। যাঁর সাহায্যে তুর্কিকে হাসপাতালে নিতে পারবে। আদনান-ও ফোন তুলছে না। বোধহয় কোনো মিটিং এ ফেঁসে গেছে। হুমাইরা রচনার দিকে তাকিয়ে অস্থির কণ্ঠে বলে—

– কিরে? কেউ ফোন তুললো?
রচনা কখন থেকে বাড়ির পুরুষদের ফোন করছে। কিন্তু কেউ ফোন তুলছে না। সেই জন্য হুমাইরা গ্রাম্য অথবা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তুর্কির জ্বর, বমি আটকানোর চেষ্টা করছে। রচনা ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বলে—
-না আপা।
হুমাইরা আবারও দোয়া-দরূদ পড়ে তুর্কিকে ফুঁ দেওয়া শুরু করে। রচনা এগিয়ে এসে বলে—
– আল্লাহ্! মেয়েটার কী হলো? কোনো অশরীরী ভর করলো না তো। আল্লাহ্! মেয়েটারে সুস্থ করে দেও।
গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে বারান্দা দিয়ে যাচ্ছে রেজুয়ান। রেজুয়ানের কণ্ঠস্বর শুনে রচনা দ্রুত বারান্দায় যায়। রেজুয়ানকে সব বলা মাত্রই রেজুয়ান ছুটে বাড়ির বাইরে যায় কোনো গাড়ি আছে কিনা দেখতে৷ আর যাওয়ার সময় বলে যায় দ্রুত তৈরি হতে।

তুর্কিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর; কিছু টেস্ট এর মাধ্যমে জানা যায় তুর্কির গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস (পেটের ফ্লু) হয়েছে। ভয়ের কিছুই নেই। কোনো দূষিত খাবার খাওয়ার ফলে হয়েছে। তবে শরীর বেশি দূর্বল হয়ে পড়ায় একটা স্যালাইন দিয়েছে।
মেয়ের খবর শুনে ছুটতে ছুটতে এসেছে জুবাইরা। হুমাইরা, রচনা, রেজুয়ান হাসপাতালেই। হুমাইরা কে ধরে চোখের পানি বিসর্জন দেয় জুবাইরা। হুমাইরা সান্ত্বনা দেয় কিচ্ছু হয়নি তুর্কির৷ খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।
তুর্কির কথা শোনা মাত্র আদনান যত দ্রুত সম্ভব ছুটে আসে। অস্থির হয়ে জানতে চায় তুর্কির কথা। হুমাইরা ও-কে জানায় তুর্কি ভালো আছে। এখন ঘুমাচ্ছে। তবে, ও-কে একটা বার দেখার জন্য ওর হৃদয় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মেয়েটা কীভাবে এত অসুস্থ হয়ে পড়লো! সকালে যখন বাড়ি এসেছিলো তখন তো প্রায় সুস্থ-ই ছিলো। তাহলে এখন কী হলো।

ও অপেক্ষা করতে থাকে কখন তুর্কির সাথে কথা বলতে পারবে। কথা বলার সুযোগ হলেও সবার ভীড়ে তেমন কিছুই বলতে পারি-নি। সবাই উদগ্রীব হয়ে আছে৷ তার ওপর নার্স বেশিক্ষণ সময় ও দেই-নি।
রাতে সবাই বাড়ি চলে গেলে ও জুবাইরা আর আদনান হাসপাতালেই রয়ে গেলো। ভাগ্যক্রমে কেবিন খালি ছিলো বলে; প্রথমেই তুর্কিকে কেবিনে নেওয়া হয়েছে৷ জুবাইরা তুর্কির সাথে কেবিনে থাকবেন। তাই আদনান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে; কেবিনের বাইরে করিডোরে থাকার পরিকল্পনা করে। যদিও মন উতলা হয়ে আছে তুর্কির অবস্থা জানার জন্য। ওর কেমন লাগছে। এত রাতে কেবিনে যাওয়া ও সম্ভব নয়। কারণ জুবাইরা আছেন।
তাই মাঝ-রাত সজাগ-ই কেটেছে আদনানের। কেবিনের সামনে পায়চারি করেছে। তবে তাতে কোনো শান্তি মিলে-নি।
ও হাঁটা থামিয়ে বেঞ্চে গিয়ে বসে। দুই হাত দিয়ে মুখ মুছে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। তারপর সিলিং এর দিকে তাকায়। স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে ওদের কাটানো রঙিন মূহুর্ত গুলো৷ তুর্কির সঞ্জীবনী মুখশী, না পড়ার বাহানা। শতবার আই লাভ ইউ বলা। ছোট ছোট বায়না। প্রজাপতির মত তিড়িং-বিড়িং করা। সব! অজান্তেই আদনানের ঠোঁটে ফোটে মৃদু হাসি। মনে মনে দোয়া করতে থাকে ‘তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও বেগম সাহেবা।’

তুর্কির অবস্থা এখন আগের তুলনায় ভালো। যদিও সকালে দুইবার বাথরুমে গেছে। তার ওপর শরীর ও অনেক বেশি দূর্বল হয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছে ঠিক মত খাওয়া-দাওয়া করলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
ওর কেবিনে ভীড় জমিয়েছে সবাই। বাড়ির লোক একে একে দেখে যাচ্ছে ও-কে। আজকের মধ্যেই হয়তো রিলিজ হবে তুর্কির।
তুর্কি অসহ্য লাগছে সব কিছু। বাড়ির সবাই এখানে উপস্থিত! অথচ ওর হৃদয় যাঁর জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে; নয়ন জোড়া যাকে দেখার জন্য তৃষ্ণার্ত, সে-ই উপস্থিত নেই!
জুবাইরা কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-এখন কেমন লাগছে মা?
এই কথা বলতে বলতে ওর মুখ ব্যথা হয়ে গেছে। তাই ও সেটা উপেক্ষা করে অস্থির কণ্ঠে বলে,
-আম্মু, স্যার কই?

-ভাই (বেয়াই/আলামিন) সারফারাজকে নিয়ে হোটেলে গেছে। ছেলেটা কাল থেকে কিছু খাইনি। সারারাত এখানে ছিলো। তাই সকালে ভাই জোর করে হোটেলে নিয়ে গেছে।
আদনানের কথা শুনে তুর্কি আরও অস্থির হয়ে যায়। এমনিতে তো ও-কে খাবার নিয়ে ভীষণ বকাঝকা করতে পারে। আর নিজেই এখন না খেয়ে রয়েছে। আসুক আজ! জুবাইরা ফোন এগিয়ে দিয়ে বলে—
-নে, তোর আব্বু কল দিছে।
তুর্কি ফোন হাতে নিয়ে বাবার সাথে কথা বলে৷ শহিদ হাসান মেয়ের অবস্থা দেখে অঝোরে কাঁদতে থাকে। তুর্কি বাবাকে সান্ত্বনা দিয়ে বোঝায়; ও এক দম সুস্থ আছে। কথা শেষ হলে জুবাইরা কেবিন থেকে বাইরে বের হয়ে যায়। তুর্কি জুবাইরাকে বলে দেয়; বাইরে আদনানকে দেখেতে পেলে যেনো ভিতরে পাঠিয়ে দেয়।

আদনান যখন বাইরে গেছিলো তখন তুর্কি ঘুমে ছিলো। বাইরে থেকে ফিরে এসে যখন শোনে তুর্কি জাগ্রত হয়েছে; তখন ছুটে কেবিনে আসে। তুর্কি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে ছিলো। কেবিনের দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দরজার দিকে নেয়। আদনানের উপস্থিতি দেখে ওঠার চেষ্টা করে। আদনান বাধা দিয়ে বলে,
-ওঠো না। আমি আসছি।
– স্যার, আপনি কই ছিলেন?
এই বলে এক হাত বাড়িয়ে দেয় তুর্কি। আদনান ওর হাত ধরে ও-কে আধশোয়া হয়ে বসতে সাহায্য করে। পিঠে একটা বালিশ দেয়। আদনান ওর পাশে বসে এক হাত দিয়ে ওর ক্যানুলা পড়া হাত ধরে। তুর্কি আদনানের অন্য হাত নিয়ে, ওর পিঠের পাশ দিয়ে নিয়ে ওর বাহুতে রাখে। বালিশ থেকে মাথা সরিয়ে আদনানের বক্ষস্থলের বাম পাশে রাখে। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে—

-আপনি নাকি কাল থেকে আজ সকাল পর্যন্ত না খাওয়া ছিলেন?
আদনান অবসাদ কণ্ঠে বলে,
-এখন কেমন লাগছে?
-আমি আগে প্রশ্ন করেছি।
-কে বলেছে খাইনি? মাত্র তো রুটি খেয়ে আসলাম।
তুর্কি একটু তেজি স্বরে বলে,
-আমাকে তো খুব খাওয়া নিয়ে কথা শোনাতে পারেন। এইটা খাও। এইটা করো। আর এখন নিজে? নিজে কী করছেন?
-আমি তোমার মত অসুখ করেছি?
তুর্কি কিছু বলে না। ও আদনানের বক্ষস্থলে ওম খোঁজায় ব্যস্ত। ধীর কণ্ঠে বলে,
– স্যার, আমার একটা জিনিস লাগবে!
আদনান এক ভ্রু উঁচু করে বলে,

-কী?
তুর্কি আদনানের হাত থেকে হাত সরিয়ে, তর্জনী আঙুল নিয়ে কপালে ঠেকায়। আদনান ওর ইশারা বুঝতে পেরে মৃদু হাসে৷ হাত আবার ধরে বিনা বাক্যে তুর্কির কপালে চুম্বন এঁকে দেয়। আবার মাথার ঠিক মাঝখানে ও একটা চুম্বন এঁকে দেয়। তুর্কি প্রিয় পুরুষের স্পর্শ পেয়ে যেনো মূহুর্তেই চাঙ্গা হয়ে ওঠে। আদনান ধীর কণ্ঠে বলে—
-জানো, আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম। আল্লাহর কাছে শত- কোটি শুকরিয়া, তোমাকে আবার সুস্থ করে দিয়েছে।
তুর্কি আদনানের বুক থেকে মাথা তুলে বলে—
– স্যার, আমি আগের থেকে আরও কয়েক গুন সুস্থ হয়ে গেছি। আজ বাসায় যাবো।
আদনান তুর্কির উচ্ছলতা দেখে আম্ভরিক কণ্ঠে বলে,
-কোনো কথা না। চুপ চাপ শোও। ডাক্তার একটু পর ভিজিটে আসবে। আমি কথা বলে দেখছি কী বলেন।
তুর্কি জেদি কণ্ঠে বলে,

-না। কিছুতেই না। প্লিজ স্যার। আমার এখানে দম বন্ধ হয়ে আসে। বাসায় গেলে দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবো।
আদনান বালিশ ঠিক করে তুর্কিকে শুতে সাহায্য করতে করতে বলে,
-হুম। দেখছি তো। তুমি কোনো রকম নড়াচড়া না করে চুপ চাপ শুয়ে থাকো।
-প্লিজ!
-বললাম তো দেখছি।
ওদের কথার মাঝেই একটা নার্স এসে জানায় ডাক্তার পরিদর্শনে আসছে। আদনান তুর্কিকে ঠিক ভাবে শুইয়ে বাইরে বের হয়ার জন্য উদ্যত হয়৷ তুর্কি পিছন থেকে ডেকে বলে,
– স্যার!
আদনান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। তুর্কি মিষ্টি করে হেসে বলে,
-ভালোবাসি!
আদনান কিছু বলতে যাবে; সেই মূহুর্তে সেখানে উপস্থিত হয় ডাক্তার। তুর্কি ডাক্তারকে দেখে হকচকিয়ে যায়। ইসস্! ডাক্তার বুঝি শুনে ফেলেছে!

আজই তুর্কির রিলিজ হবে। তাই রচনা-হুমাইরা বাড়ি গিয়ে আর আসে নি। রেজুয়ানের কাছে উপস্থিত সবার জন্য শুধু সকালের খাবার রান্না করে পাঠিয়েছে। হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার করিডোরে হাঁটছে রেজুয়ান। পিছন থেকে এক পুরুষের উচ্চকণ্ঠস্বর শুনতে পায়। যে খুব জোরে ফোনে কথা বলছে৷ রেজুয়ান তা দেখার জন্য ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়।
আকাশী রঙের থ্রি-পিস পরা একটা মেয়ে ও একজন বয়স্ক পুরুষ খুব তাড়াহুড়ো করে এই দিকে আসছে। ও একবার দেখেই চোখ ফিরিয়ে নেয়।
পরপরই কপালে ভাঁজ ফেলে পিছনে তাকায়। উপমাকে দেখে অবাক হয়ে যায়! ও কি ভুল দেখছে? এই সকাল বেলা এই মেয়ে এখানে কী করছে? কোনো বিপদ হয়েছে নাকি? ও আর সামনে না এগিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। উপমা মাথা নিচু করে হাঁটছে। যেই না মাথা একটু উঁচু করে রেজুয়ান কে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ওর সামনাসামনি এসে দাঁড়িয়ে যায়। পুরুষ টা আগে আগে চলে যায়। উপমা অবাক কণ্ঠে বলে,

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৩৭

-আপনি এখানে কী করছেন?
রেজুয়ান ও একই স্বরে বলে,
-তুমি এখানে কী করছো?
-আমার ফুপাতো বোন অসুস্থ৷ ও-কে দেখতে এসেছি। আপনি?
-আমার ভাবি অসুস্থ। সেই জন্যই আসা।
-ও আচ্ছা।
পরপরই উপমা আবার বলে,
-আচ্ছা আমি যাই। আব্বু চলে গেছে। পরে কথা হবে।

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৩৯