হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৩৯
তোয়া নিধী দোয়েল
তুর্কির শিয়রে বসে রয়েছে উপমা। কীভাবে অসুস্থ হলো, এখন কেমন বোধ করছে; এই সব নিয়ে টুকটাক কথা হচ্ছে ওদের মাঝে। আদনান চুপচাপ অন্য পাশে বসে রয়েছে।
ফারুক জুবাইরার সাথে বারান্দায় কথা বলছেন। রেজুয়ান দরজার কাছে এসে বিদিত কণ্ঠস্বর শুনে থমকে দাঁড়ায়! ভিতরে ঢুকে উপমাকে তুর্কির শিয়রে দেখে কপালে বড় ভাঁজ পড়ে। উপমা তো ফুপাতো বোনকে দেখতে এসেছে৷ তাহলে এখানে কী করে!
আদনান, রেজুয়ানের হাতে খাবার দেখে এক পাশে রাখতে বলে।
উপমা তুর্কির সাথে কথা বলা চলমান রেখে দরজার পানে তাকায়৷ রেজুয়ানকে দেখে সোজা হয়ে বসে। অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে,
-আপনি এখানে!
রেজুয়ান ও বিস্ময় কণ্ঠে উত্তর দেয়—
-আমার ভাবি। তোমার বোন…
উপমা তুর্কির দিকে তাকিয়ে বলে,
-তোর দেবর?
তুর্কি উপরে-নিচে মাথা নাড়ায়। ফের জিজ্ঞাসা করে,
-কেনো? চেনো নাকি?
রেজুয়ান আদনানের পাশে গিয়ে বসে। আদনান, রেজুয়ানের কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
-মেয়েটাকে চিনস নাকি? কোন আকাম করছ নাই তো? মেয়ের বাবা কিন্তু বাইরে।
রেজুয়ান মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,
-ভাই, কাঠগোলাপ!
আদনান ভ্রু কুঁচকে, অবাক কণ্ঠে বলে,
-কীইই!!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রেজুয়ান উপরে নিচে মাথা নাড়ায়। আদনান দ্রুত বসা থেকে ওঠে দাঁড়ায়। রেজুয়ানের হাত ধরে ও-কে ও ওঠায়। বাইরের দিকে যেতে যেতে বলে,
-তাড়াতাড়ি ওঠ এখানে থেকে।
-আরে ভাই একটু কথা বলে যাই?
-কোনো কথা না। বাইরে মেয়েটার বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। কোনো ভেজাল করা যাবে না।
-আরে…
-চল তুই আগে।
-কী হলো আপু? বলে না তো।
আদনান-রেজুয়ানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলো উপমা। তুর্কির ডাকে শোধবোধ ফিরে পেয়ে ওর দিকে তাকায়। মৃদু হেসে বলে,
-চিনি বলতে, এমনি ফ্রেণ্ড আর কী।
-ও আচ্ছা।
বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে তুর্কি। কোলে একটা বই। ডান পা বাঁ পায়ের উপরে রেখে দোলাচ্ছে। পাশে পানি সহ আরও কিছু খাবার। যা হুমাইরা এসে দিয়ে গেছে।
দরজার ওপাশ থেকে উচ্চস্বরে রেজুয়ানের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে—
-ভাবিজান আসবো?
তুর্কি, রেজুয়ান কণ্ঠ শুনে ঠিক হয়ে বসে। ভালো মত ওড়না গায়ে জড়িয়ে বলে,
-জি, আসুন।
রেজুয়ান দরজা ঠেলে ভেতরে আসে। ওর হাতে দুইটা শরবতের গ্লাস। শরবত দুইটা খুব সম্ভবত মালটার। তুর্কির সামনে এসে গ্লাস দুইটা দিয়ে বলে—
-খেয়ে বলুন কেমন হয়েছে।
তুর্কি অবাক কণ্ঠে বলে,
-বাহ্! আপনি বানিয়েছেন?
-ভাই বাড়ি নেই। বাপের ভাই ও বাড়ি নেই। মা ও ব্যস্ত। তাই আপনার জন্য নিয়ে আসলাম।
তুর্কি গ্লাস নিয়ে বলে,
-আচ্ছা। কোনো কিছু মেশান-নি তো? আপনার মনে তো ক্রিমিনালি বুদ্ধির অভাব নেই।
রেজুয়ান চেয়ার টেনে বসতে-বসতে বলে,
-আপনি এই কথা বলতে পারলেন? আপনাকে এত ভালো একটা জামাই পাইয়ে দিছি; তার পর ও আমাকে আপনার ক্রিমিনাল মনে হয়?
– হ্যাঁ। তা অবশ্য ঠিক। যাই হোক।
মূলত, রেজুয়ান উপমার খোঁজ নেওয়ার জন্য তুর্কির সাথে ভাব জমাতে এসেছে। যাতে উপমার সাথে ওর বন্ডিং টা হয়ে যায়। রেজুয়ান গলা ঝেড়ে বলে,
-তো ভাবিজান, আপনার এমন কোনো বোন-টোন আছে; যার সাথে আমাকে মানাবে?
তুর্কি শরবত খেতে খেতে ডানে-বামে মাথা নাড়ায়।
-না তো। আমার কোনো কাজিন-টাজিন নেই।
-আরে আছে। একটু ভেবে দেখুন আছে।
তুর্কি আরেকটু ভেবে একই উত্তর দেয়। কারণ ওর আপন কোনো ভাই-বোন নেই। ওর কোনো চাচা কিংবা ফুপু ও নেই। তো কাজিন থাকার কোনো প্রশ্ন আসে না। রেজুয়ান কিছু বলতে যাবে সেই মূহুর্তে ঘরে আসে মুজাহিদ। তুর্কিকে ডেকে বলে—
-মামুনি, তোমার জন্য ডাব নিয়ে এসেছি। বেশি বেশি পানি, খাবার খাও। ইন-শা-আল্লাহ্ সুস্থ হয়ে যাবে।
তুর্কি সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলে,
-চাচ্চু, আম্মু আসার সময় অনেক গুলো নিয়ে এসেছে। আবার বাবা ও এনেছে সকালে। এত কিছু কীভাবে খাবো?
-উঁঃ! না বলে হবে না। ফিট হতে হবে।
রেজুয়ান বিরক্ত দৃষ্টি নিয়ে মুজাহিদের দিকে তাকায়। এই বাপের ভাইয়ের এখনি আসার সময় হলো। নিজে ও বিয়ে করবে না। ওর টা ও হতে দিবে না। ওদের কথার মাঝেই আবার হাজির হয় আদনান। এবার রেজুয়ানের কথা একে বারেই ধামাচাপা পড়ে যায়। রেজুয়ান জায়গা থেকে ওঠে মুজাহিদ এর গলা জড়িয়ে ধরে ঘর ছাড়ে। আজ বাপের ভাইকে টাইট দিতে হবে।
আদনান ফ্রেশ হয়ে এসে তুর্কির পাশে বসে। হাত ধরে বলে,
-কেমন লাগছে, বেগম সাহেবা?
-জি ভালো। আপনি এত দেরি করলেন কেনো?
-দুপুরের ঔষধ খেয়েছো?
তুর্কি আদনানের বুকে মাথা রেখে বলে,
-জি স্যার। সব করেছি।
রাতে খাওয়ার পর আদনান তুর্কিকে ঔষধ দেয়। চুল আঁচড়ে বেণী করে দেয়। তুর্কিকে ঠিক ভাবে শুয়ে শরীরে কাঁথা টেনে দেয়। আদানান বিছানা থেকে নামতে গেলে তুর্কি উচ্চকণ্ঠে বলে,
– স্যার, ভালোবাসি! গুড নাইট!
-গুড নাইট!
-আগেরটার উত্তর দিন।
তুর্কির কথা শোনার আগেই আদনান ওয়াশরুমে চলে যায়। তুর্কি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করে।
গুন গুন করে মিহি কণ্ঠে গান গাইতে-গাইতে ঘরে প্রবেশ করে তুর্কি। ওর শরীর এখন পুরোপুরি সুস্থ। ডানে-বামে দৃষ্টি ঘোরাতে, দৃষ্টিপাত হয় আদনান কে। যে বিছানায় বসে কী যেনো একটা বই পড়ছে৷ এই লোক সারাক্ষণ বই পড়ে কী শান্তি পায় আল্লাহ্ জানে।
তুর্কি একটু গলা ঝেড়ে আবার গান গাইতে শুরু করে করে৷
‘Kaise Bataye
Kyun Tujhko Chahe
Yaara Bata Na Paaye
Baatein Dilon Ki Zuban
Aankhon Ki Tujhe Samjhayen
Tu Jaane Na
Tu Jaane Na’
ধীরে ধীরে হেঁটে আয়নার সামনে যায়। তবে আদনানের মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে না। তুর্কি আয়নাতে একবার নিজেকে পরখ করে বিছানার কাছে যায়। আদনানের পাশে বসে বলে—
– কী পড়ছেন?
আদনানের উত্তর দেওয়ার আগেই তুর্কি ওর হাতের বইটাকে ভালোভাবে খেয়াল করে— একটা ইংরেজি উপন্যাস। তুর্কি কপালে ভাঁজ ফেলে আবার বলে—
– স্যার, ইংরেজি উপন্যাস পড়ে কী মজা পান? বাংলা উপন্যাস পড়বেন। দেখবেন তাতে কত শান্তি!
তুর্কির কথা শোনে আদনান বই বন্ধ করে ওর দিকে দৃষ্টিপাত করে। একটু চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে—
-তাই!
তুর্কি আরেকটু এগিয়ে এসে বসে বলে—
– হ্যাঁ! আমি তো কবিতা ও বানাতে পারি!
আদনান বইটা পাশে রেখে এক হাত কনুই পায়ের হাঁটুতে রেখে থুতনিতে ঠেকায়। বেশ ভাবুক চিত্তে বসে; নিজেস্ব ভঙ্গিতে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে—
– আচ্ছা! তো শোনাও একটা।
তুর্কি ঋজু হয়ে বসে; সিলিং এর দিকে তাকিয়ে কিচ্ছুক্ষণ ভেবে একটা আজগুবি কবিতা আবিষ্কার করে! গলা ঝেড়ে আদনানের উদ্দেশ্যে বলে—
-মরিতে চাইনা
আমি সুন্দর ভুবনে!
মানবের….!
পরপরই মাথা ডানে-বামে নাড়িয়ে বলে—
– না না!
-মরিতে চাইনা
আমি সুন্দর ভুবনে!
লেখা-পড়া নিয়ে বাঁচিবার চাই!
যদি জনম জনম
আদনান স্যার কে স্বামী রূপে পাই…!
নিজের আবিষ্কার করা উদ্ভট কবিতা তৈরি করে তুর্কি নিজেকেই নিজে বাহবা দেয়! আদনানের দিকে তাকিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে—
-বাহ্! স্যার। কি অসাধারণ কবিতা বানালাম তাইনা? দেখেছেন, মানুষ প্রেমে পড়লে কবি হয়ে যায়!
আদনান ঠোঁটের হাসি চেপে রেখে বলে—
-এইটা কবিতা ছিল! বাহ্! অসাধারণ!
আদনানের কথা শুনে তুর্কির হাস্যোজ্জ্বল বদনখানা ফাটা বেলুনের মত চুপসে যায়। চোখ ছোট ছোট করে বলে—
-না হওয়ার কী আছে? এত সুন্দর করে পরপর লাইন মিলিয়ে আপনাকে নিয়ে এত সুন্দর একটা কবিতা রচনা করলাম; আর আপনি হাসছেন?
আদনান বিছানা থেকে নামতে নামতে বলে—
-না না হাসলাম কই? বললাম তো অসাধারণ।
আদনানের কথা শুনে মূহুর্তেই তুর্কি চেতে যায়। এত সুন্দর একটা কবিতা রচনা করার পর ও এই লোক ও-কে নিয়ে হাসছে। তেজি কণ্ঠে বলে—
-মানে আপনি শুধু কবিতাটাই দেখছেন! আপনাকে নিয়ে যে বললাম সেটা দেখছেন না। দেখতে হবে না। থাকুন আপনার মত আপনি। কথা বলবেন না আমার সাথে। শুধু আপনাকে ভালোবাসি বলে, আপনার এত ভাব সহ্য করি! অন্য কেউ হলে মাথা ফাটিয়ে চলে যেতাম। অসহ্যকর লোক!
এই বলে তুর্কি বিছানা থেকে নামে। আদনান বইটা সেল্ফে রাখতে রাখতে বলে—
-আরে আরে রাগ করছো কেনো? আমি তো বললাম অসাধারণ হয়েছে। এই যে শোনো….
তুর্কি আর কোনো কথা শুনে তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। আদনান ওর যাওয়ার দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আর কীভাবে বললে মেয়েটা খুশি হতো!
মাগরিবের আজান পড়েছে অনেক্ষণ। তুর্কি পড়ার টেবিলে বসে পা দোলাচ্ছে। দুপুরে আদনানের সাথে ঝগড়া করে আর মুখোমুখি হয়নি দু’জন। আনমনে বইয়ের পাতায় আঁকিবুঁকি করে যাচ্ছে। আর গুন গুন করে গান গাইছে।
আদনান হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। পড়ার টেবিলে দৃষ্টিপাত হতেই দৃষ্টিগোচর হয় তুর্কিকে। যে খুব মনোযোগ সহকারে কিছু একটা করছে। গায়ে ওড়না বাদে তোয়ালে প্যাঁচিয়ে রেখেছে। আদনান গলা ঝেড়ে ঘরে ঢুকে। তুর্কি আদনানের উপস্থিতি টের পেয়ে আড় চোখে তাকায়। পরপরই মুখ বাঁকিয়ে দৃষ্টি সরয়ে নেয়। আদনান ধীর পায়ে ওর দিকে হেঁটে এসে ওর পাশে চেয়ার টেনে বসে। হাতের ব্যাগ টা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে—
-এখানে তোমার জন্য একটা শাড়ি আছে। পড়ে আসো। ঘুরতে বের হবো।
তুর্কি বইয়ের দিকে দৃষ্টি মনোযোগ রেখে আড়চোখে একবার আদনানের হাতের ব্যাগ দেখে৷ আরম্ভিক কণ্ঠে বলে,
-পারবো না। গরম লাগে। গরমের মধ্যে শাড়ি-টারি পড়তে অসহ্য লাগে।
তুর্কি কথা শুনে আদনান চোখ বড় বড় করে তাকায়! মেয়ে বলে কী! যে সব সময় শাড়ি পরে প্রজাপতির মতো উড়ে-বেড়ায় আজ সে কিনা বলছে শাড়িতে তার গরম লাগে! আদনান বিস্ময় কণ্ঠে বলে—
-কীই! ভূতের মুখে রাম রাম! যে প্রায় সময়ই শাড়ি পরে আমার চোখের সামনে ঘুরেবেড়ায় আজ সে বলছে তার নাকি শাড়িতে গরম লাগে!?
তুর্কি আঁকা-আঁকি থামিয়ে আদনানের দিকে তাকায়। চোখ ছোট ছোট করে বলে—
– হ্যাঁ! কারণ তখন নতুন বউ ছিলাম তাই। এখন পুরোনো হয়ে গেছি। এখন আর শাড়ি-টাড়ি পরে ঘুরতে ইচ্ছা করে না। এখন আমার শুধু গরম লাগে। আপনি শাড়ির বদলি একটা এসি নিয়ে আসুন! তাহলে সব সময় শাড়ি পরে ঘুরাঘুরি করবো।
তুর্কির কথায় আদনানের হাসি পায়। তবে তা চেপে যায়। তখন এই হাসির জন্য-ই বউটা চেতে গেছে। আদনান হাতের ব্যাগ টেবিলের উপর রেখে বলে—
-আচ্ছা। তোমার ইচ্ছা পূরণ হবে। তবে, তার আগে আমার ইচ্ছে পূরণ করো। স্টেডিয়ামের মাঠে মেলা হচ্ছে। রাতে মেলায় ঘোরার একটা আলাদা মজা আছে। চলো ঘুরি আসি।
মেলার কথা শুনে তুর্কির মন আনন্দে নেচে ওঠে। মূহুর্তেই সব অভিমান কর্পূরের মত উবে যায়। ও শেষ কবে মেলায় গেছে ওর মনে নেই। ছোট বেলায় বাবার সাথে যাওয়া হতো। বাবা দূরে চলে যাওয়ার পর আর তেমন ঘুরাঘুরি করা হতো না।
তুর্কি টেবিলের উপর থেকে ব্যাগ নিয়ে বলে,
-পাঁচ মিনিট, স্যার। আমি শাড়িটা পড়েই আসছি।
মেলার প্রবেশদ্বারের এক পাশে বসে রয়েছে রেজুয়ান। সাথে অভ্র। সন্ধ্যা থেকে এখানে আড্ডা দিচ্ছে ওরা। কথার মাঝে মাঝে উচ্চস্বরে হেসে ওঠছে।
আজ উপমার জন্মদিন। দিনটা সবার জীবনে বিশেষ হলেও উপমার কাছে এই দিনটি অভিশাপের। ও মনে করে ওর জন্মদিন এক অভিশাপ। যা ওর মা-কে দূরে ঠেলে দিয়েছে। বাকি দিন গুলোর তুলোনায়; এই দিনটিতে ও একটু বেশি দুঃখী থাকে।
তাই ওর মন ভালো করার জন্য সূচি ও-কে ধরে বেঁধে ঘুরতে নিয়ে এসেছে। একটু ঘুরাঘুরি করলে মন ফ্রেশ হয়ে যাবে।
মেলার প্রবেশদ্বারে উপস্থিত হওয়া মাত্র; রেজুয়ানের দৃষ্টিগোচর হয় ওদের। রেজুয়ান উচ্চস্বরে ডাকে—
-বেয়াইন!
বিদিত কণ্ঠস্বর শুনে পা যুগল থেমে যায় উপমার। আশে পাশে তাকিয়ে ডাকের মালিকে খুঁজতে থাকে। রেজুয়ান বাইক থেকে নেমে ওর দিকে এগিয়ে আসে। হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে,
-কই যাচ্ছেন?
উপমা হাসার চেষ্টা করে বলে,
-এই তো এখানে ঘুরতে এসেছি। আপনি?
-আমিও। তবে আপনাকে এখানে দেখে অবাক হলাম।
সূচি ওর কথার উত্তর দিয়ে বলে,
-অবাক হওয়ার কিছু নেই। আজ আমার ফ্রেণ্ডের বার্থডে। তবে বেচারি মুখ ভার করে বসেছিলো৷ তাই ঘুরতে বের হলাম।
রেজুয়ান অবাক কণ্ঠে বলে,
-আজ আপনার বার্থডে?!
উপমা কোনো উত্তর দেয় না। কারণ এইটা একিটা অভিশপ্ত দিন! রেজুয়ান আবার বলে,
– হ্যাপি বার্থডে, বেয়াইন। অনেক অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাই আপনাকে।
একটু থেমে আবার বলে,
– তো ট্রিট কি শুধু আপনার ফ্রেণ্ড-ই পাবে? আমি পাবো না? ফ্রেণ্ড হিসেবে না পাই বেয়াই হিসেবে তো পাই তাইনা?
উপমা সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলে,
-যদিও দিনটা আমার কাছে অভিশপ্ত! তবে একজন ফ্রেণ্ড বা বেয়াই এর অনুরোধ ফেলি কী করে? চলুন। কী ট্রিট নিবেন?
উপমার রসিকতার স্বরে বলা কথাটা যতনা অবাক করলো রেজুয়ানকে; তার থেকে বেশি অবাক করলো নিজের জন্মদিনকে অভিশপ্ত দিন বলায়। ও অবাক কণ্ঠে বলে,
-অভিশপ্ত দিন!
-ও কিছু না আসুন।
এই বলে উপমা-সূচি হাঁটা শুরু করে। রেজুয়ানের মাথায় উপমার কথা ঘুরপাক খেতে থাকে। ও পকেটে থেকে মানি-ব্যাগ বের করে দেখে কত টাকা আছে। বেশি না। তিনশো। এই টাকা নিয়ে ঘুরা যাবে না। ও পকেটে থেকে ফোন বের করে আদনানকে কল করে।
রাতের সুনসান রাস্তা দিয়ে সাইঁ-সাইঁ করে রিকশা ছুটছে। পাশাপাশি বসে রয়েছে আদনান-তুর্কি। আদনানের বাহু শক্ত করে ধরে রেখেছে তুর্কি। ওর পরনে লাল শাড়ি। আদনান শাড়ি দিয়েছে আর তা লাল হবে না তা হতেই পারে না। তুর্কি ভেবে পায় না একটা মানুষের এত লাল জিনিস পছন্দ হয় কী করে!
আদনানের ফোন বেজে ওঠে। আদনান পকেটে হাত দিয়ে ফোন বের করে।
আদনানের ফোন তুলতে-তুলতে মুজাহিদদের বলা একটা কথা স্মরণ হয় রেজুয়ানের। কবে যেনো বলেছিলো—
‘পুরুষ মানুষ হিংস্র বাঘ হওয়ার চেয়ে; টাকাওলা ইঁদুর হওয়া বেশি প্রয়োজন। যাতে দুই-তিনটা হিংস্র বাঘ সে পুষতে পারে!’
যদিও সেদিন কথাটা ও হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলো। তবে আজ মনে হচ্ছে, যদি ওর নিজের টাকা থাকতো তাহলে ভাইয়ের কাছে এই ভাবে চাইতে হতো না। আদনান ফোন তুলে বলে,
-কই তুই?
-তুমি কই?
-বাড়ি।
-টাকা লাগবে কিছু।
-কত?
রেজুয়ান কিছু ভেবে বলে,
-হাজার?
আদনান ভ্রু কুঁচকে বলে,
-কই আছিস তুই? এত রাতে এত টাকা দিয়ে কী করবি?
-দরকার। কিছু ফ্রেণ্ড আসছে।
-আচ্ছা। পাঠিয়ে দিচ্ছি। তবে বেশি রাত করবি না। তাড়াতাড়ি বাড়ি যাবি।
-আচ্ছা।
আদনানের এক বাহু ধরে চারিপাশ দেখতে দেখতে হাঁটছে তুর্কি। কত হৈ-চৈ! নাগর-দোলার ক্যাঁচ-ক্যাঁচ শব্দ। ভেসে আসছে ভাজাপোড়া, মিষ্টি, জিলাপির গন্ধ। আকাশের দিকে মুখ করে উড়ছে রং-বেরঙের বেলুন। যাদের শক্ত বাধনে আবদ্ধ করে রেখেছে দোকানী। যেনো একটু ছাড় পেলেই উড়ে যাবে আকাশের বুকে।
তুর্কি চারিপাশে একবার চোখ বুলিয়ে বলে—
– স্যার, জানেন আমি আগে কখনো রাতের বেলা মেলায় আসিনি। আজই প্রথম। তবে ছোট বেলায় গিয়েছি কিনা মনে নেই।
-কী নিবে?
তুর্কি আরও কয়েক দোকানে চোখ বুলিয়ে বলে—
-চুড়ি।
একটা চুড়ির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চুড়ি দেখতে থাকে তুর্কি। আদনান পকেটে হাত গুঁজে তুর্কিকে দেখতে থাকে৷ তুর্কি কয়েক ডজন চুড়ি আদনানের দিকে নিয়ে বলে,
– স্যার, কোন গুলা নিবো?
আদনান সর্বপ্রথম লাল চুড়ির ডজন টা দেখায়।
-এইটা নেও। ঐ কালো গুলা ও নেও।
তুর্কি দুই ডজন চুড়ি দোকানীকে দিতে বলে।
ঐ দোকানের পাশের দোকানে দাঁড়িয়ে কথা বলছে উপমা- রেজুয়ান। সূচি কিছু জিনিস কিনবে। সেই জিনিস গুলো কেনার জন্যই এখানে দাঁড়ানো। কথা বলতে বলতে এক সময় রেজুয়ানের দৃষ্টি পড়ে তুর্কির উপর। ওর বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। তুর্কি এখানে মানে আদনান ও এখানে। আদনান যদি জানিতে পারে এই সময় ও কোনো মেয়ে নিয়ে ঘুরছে ও-কে একদম মেরে ফেলবে। তাও আবার ওর প্রিন্সিপালের মেয়ে!
তুর্কি দোকানীর প্যাকেট করার অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকে। আশে-পাশে তাকাতেই কেনো যেনো ওর মনে হয় ওখানে রেজুয়ান দাঁড়িয়ে আছে। সাথে কোনো একটা মেয়ে। ও কপালে গাঢ় ভাঁজ ফেলে তাকায়।
ওপর পাশে তুর্কিকে দেখা মাত্র রেজুয়ান উপমার হাত ধরে উলটো দৌড়াতে থাকে। সূচি ওদের দৌড়ানো দেখে উপমাকে উচ্চস্বরে ডাকে।
– দোস্ত..কী হলো…?
উপমা ও ভ্রু কুঁচকে রেজুয়ানের তালে তাল মিলিয়ে দৌড়াতে থাকে।
তুর্কি আদনানের দিকে তাকিয়ে বলে,
– স্যার, ঐ-টা রেজুয়ান ভাইয়া না?
আদনান— তুর্কির ইশারার দিকে তাকিয়ে বলে,
-কই?
– ছিলো ঐ জায়গায়।
-এই যে চুড়ি।
আদনান চুড়ি গুলো নিয়ে বলে,
-ধুর আস। ও এখানে কী করবে।
– স্যার, সত্যি ছিলো এখানে।
আদনান তুর্কির কথা না শুনে ওকে টেনে নিয়ে যায়। হয়তো বা চোখের ভুল।
আদনান-তুর্কির দৃষ্টির বাইরে গিয়ে উপমার হাত ছেড়ে দেয় রেজুয়ান। এত জোড়ে দৌড়িয়েছে যে— দম নিয়ে সারতে পারছে না। উপমা হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
– এই ভাবে দৌড়ালেন কেনো?
রেজুয়ান ও হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
-ভাই…ভাই ছিলো!
-তাই বলে এই ভাবে দৌড়াবেন?
-ভাই দেখলে মাডার করে ফেলবে।
-কেনো?
নিজেদের মধ্যে অনেক্ষণ সময় অতিবাহিত করার পর বাড়ির উদ্দেশ্যে যাচ্ছে আদনান-তুর্কি। রাত প্রায় এগারোটার মত বাজে। তুর্কি আদনানের বাহু চেপে ধরে সেই বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে। আদনান বার বার কয়টা বাজে তা দেখছে। একটা চায়ের দোকান অতিক্রম করার সময়; তুর্কি দ্রুত হেলানো মাথা তুলে বলে—
– স্যার, চা খাবো।
আদনান দোকানটি দেখে রিকশা থামাতে বলে। দোকান থেকে ওদের বাড়ির দূরত্ব কয়েক মিনিট এর ব্যবধান। এইটুকু পথ হেঁটে-ই যাওয়া যাবে। তাই আদনান রিকশারওলার ভাড়া চুকিয়ে দেয়। তুর্কি গিয়ে চায়ের দোকানের সামনের বেঞ্চ এ গিয়ে বসে। দোকানী বোধহয় দোকান বন্ধ করার তোড়জোড় করছিলো। তুর্কি তা অবলকন করে অনুরোধের স্বরে ওদের দু’জনকে দুই কাপ চা দিতে বলে৷
আদনান ওর পাশে এসে বসে। ওদের মাথার উপর বিশাল একটা গাছের ছায়া। তবে কী গাছ তা অন্ধকারে ঠাওর করতে পারলো না তুর্কি। ওপর দিকে তাকিয়ে-ই আদনানের উদ্দেশ্যে বলে—
– স্যার এইটা কী গাছ?
আদনান তুর্কির দৃষ্টি অনুসরণ করে ওপরে তাকায়। আকাশে মস্ত বড় একটা চাঁদ। তার আলো পাতার ফাঁকে ফাঁকে গলে পড়ছে ওদের ওপর। আদানান কিছুক্ষণ গাছটাকে পরখ করে বলে—
-শিরিষ (কড়ই) গাছ সম্ভবত।
-কত বড়!
-হুম।
তুর্কি ওপর থেকে দৃষ্টি নামিয়ে আদনানের উদ্দেশ্যে আবার বলে,
-আমরা কি বাকি রাস্তা হেঁটে যাবো?
-হুম। বেশি দূর তো নয়।
আরও কিছুক্ষণ কথপোকথন চলার পর দোকানী চা নিয়ে আসে। আদনান টাকা পরিশোধ করে দিলে দোকানী নিজের জায়গায় ফিরে যায়।
চা অতিমাত্রায় গরম থাকায় তুর্কি পাশে রেখে দেয়। একটু ঠান্ডা হোক। তারপর আদনানের দিকে তাকিয়ে বলে,
– স্যার, পরিবেশ টা সুন্দর না? কেমন নিঝুম।
আদনান ও ওর কাপ তুর্কির চায়ের কাপের পাশে রেখে বলে,
-হুম।
তুর্কি দুটো কাপ উঠিয়ে ওর পাশে রাখে। ও আদনানের নিকটে গিয়ে আদনানের বাহু চেপে ধরে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
– এই পরিবেশে একটা গান শুনতে ইচ্ছে করছে। শোনাবেন?
-এখন?
-হুম। বেশি গাইতে হবে না। একটুখানি। প্লিজ!
-কী গাইবো? কিছুইতো মাথায় আসছে না।
-প্লিজ!
তুর্কির অনুরোধ ফেলানো দায়। তাছাড়া যে ভাবে জেদ ধরেছে দুপুরের মত আবার রাগ না করে বসে। আদনান কিছুক্ষণ ভেবে একটা গানের কলি শুরু করে। তুর্কি মাঝে যে টুকু দূরত্ব ছিলো তা ঘুচিয়ে আদনানের বাহু শক্ত করে চেপে ধরে। সন্তর্পণে মাথা রাখে ওর বাহুতে।
‘কেউ তোমাকে
ভিষন ভালোবাসুক
তুমি আর শুধু তুমি ছাড়া
অন্য কিছু না বুঝুক
কেউ তোমার কোলে মাথা রেখে
ভিষন হাসুক
তুমি একটু দূরে গেলে
লুকিয়ে আনমনে ভীষণ কাঁদুক
তুমি তো চেয়েছিলে
ঠিক এমনই একজন
দেখো না আমি পুরোটাই
তোমার ইচ্ছে মতন
তুমি আমার অনেক শখের
খুঁজে পাওয়া এক প্রজাপতি নীল
আমি রংধনু রঙে সাজিয়েছি
দেখো এক আকাশ স্বপ্নিল
তুমি হেসে উড়ে বেড়াও
আমায় ভীষণ ভালো লাগাও’
গানের কলি শেষ হলে দু’জন দুজনের দিকে দৃষ্টিপাত করে। তুর্কি মৃদু হেসে মোহময় কণ্ঠে বলে,
-আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি, স্যার। ভীষণ ভীষণ ভীষণ…ভীষণ ভালোবাসি!
বরাবরের মত এবার ও আদনান কোনো উত্তর দেয় না। মুচকি হেসে ওর নাকে টোকা দেয়। তুর্কি দু চোখ খিঁচে ফেলে। আদনান চায়ের কাপ দুটি এনে বলে,
-ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
তুর্কি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলে,
-আমি বুঝিনা, একটা মানুষ এত ঢং কীভাবে করতে পারে! বিশ্বাস করেন স্যার, আপনি শুধু আমার বড় শখের মানুষ বলে আপনার সব ভাব আমি সহ্য করি। অন্য কেউ হলে সহ্য করা তো দূর, একটুখানি ভাবের আঁচ পেলেই মাথা ফাটিয়ে ফেলতাম।
তুর্কির কথা শুনে হো হো করে হেসে ওঠে আদনান। হাসতে হাসতে চা শেষ করে। তুর্কি আদনানের হাসি দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। মুখ বাঁকিয়ে ও ওর চা শেষ করে।
চা খাওয়া হলে দু’জন বাড়ি ফেরার জন্য ওঠে। ওয়ানটাইম কাপ থাকায় আদনান দুইটা ও দূরে নিক্ষেপ করে। তুর্কি আগে আগে হেঁটে গেলে আদনান দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে ওর হাত টেনে ধরে। তুর্কি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। আদনান আরেক পা এগিয়ে এসে ওর মুখোমুখি দাঁড়ায়। শান্ত কণ্ঠে বলে,
– অপ্রকাশিত ভালোবাসা সর্বাপেক্ষা সুন্দর, বেগম সাহেবা!
আদনানের কথা শুনে কপালে ভাঁজ পড়ে তুর্কির। কিছু বলার জন্য মুখ খোলে কিন্তু, কিছু বুঝে ওঠার আগে আদনান ওকে পাঁজা কোলে তুলে নেয়। বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে বলে,
-বাকি রাস্তা এভাবে যাওয়া যাক। পরিবেশ টা ভীষণ সুন্দর!
অপ্রত্যাশিত ঘটনায় ঘাবড়ে যায় তুর্কি। দ্রুত আদনানের গলা জড়িয়ে ধরে কম্পিত কণ্ঠে বলে,
– স্যার, রাস্তায় মানুষ থাকতে পারে!
আদনান ভ্রু কুঁচকে বলে,
-তো?
– স্যার, কেউ দেখলে কী বলবে? এই ভাবে কেউ রাস্তা দিয়ে যায়?
আদনান অবাক কণ্ঠে বলে,
-তুমি আবার মানুষের ভাবনা নিয়ে পড়লে কবে থেকে? নাকি ভয় পাচ্ছো?
আদনানের কথায় তুর্কি বিব্রতবোধ করে। ভয় পাওয়ার কী হলো! এমন ভাবে কেউ দেখলে কী বলবে! তাই ভেবে বিব্রত লাগছে ওর। তুর্কি আর কোনো কথা বলে না। চুপচাপ আদনানের গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকে। আদনানের শরীরের ঘ্রাণ ওর নাকে এসে ধাক্কা দেয়। অদ্ভুত শান্ত স্নিগ্ধ অনুভূতি ওকে গ্রাস করে ফেলে। ধীর পায়ে হাঁটতে থাকে আদনান। নির্জন নিশুতি রাতের পথ ধরে।
বাড়ির প্রবেশদ্বারের সামনে এসে তুর্কিকে নামিয়ে দেয় আদনান। তুর্কি ছাড়া পেয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে বাড়িতে প্রবেশ করতে নেয়। এতক্ষণ যেনো কোনো খাঁচায় বন্দি ছিলো! তবে তার আগেই পিছন থেকে আদনান আবার ডেকে ওঠে—
-বেগম সাহেবা!
অন্য সময়ের তুলনায় এখন যেনো আদনানের কণ্ঠ অদ্ভুত শোনালো তুর্কির কাছে। ওর বুকের ভেতর কম্পন সৃষ্টি হয়। ও সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়ায়। আদনান পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে কয়টা বাজে। ১২:০১। আদনান কয়েক পা এগিয়ে এসে তুর্কির বরাবর দাঁড়ায়। চারিপাশে কোনো আলো নেই। শুধু চাঁদের আলো গলে পড়ছে ওদের ওপর। কোনো শব্দ নেই। মাঝে মাঝে পাতার মর্মর আওয়াজ ভেসে আসছে। মৃদু বাতাস দোলা দিয়ে যাচ্ছে ওদের।
আদনানের দৃষ্টি দেখে তুর্কি ঢোক গিলে; আদনানের মুখের দিকে তাকায়। আদনান দু হাত বাড়িয়ে সন্তর্পণে তুর্কির দুই গালে হাত রাখে। আদনানের স্পর্শে চোখ খিঁচে ফেলে তুর্কি। আদনান তুর্কির মুখের দিকে ঝুঁকে— ওর অধরে অধর ছুঁইয়ে দেয়।
আদনানের স্পর্শ পেয়ে — তুর্কি আদনানের হাতের উপর হাত রেখে জোরে খামচে ধরে। আদনানের হাতে তুর্কির নখের আঁচড় লাগে।
গভীর এক চুম্বন শেষে— আদনান তুর্কির অধর থেকে ওর অধর সরিয়ে নেয়। গভীর ভাবে শ্বাস নেয় দু’জন। আদনান গালে রাত রেখেই চোখ বন্ধ করে ফিসফিসিয়ে উচ্চারণ করে,
– হ্যাপি বার্থডে বেগম সাহেবা!!
আদনানের মুখে জন্মদিনের শুভেচ্ছা বার্তা শোনা মাত্র, খিঁচানো নয়ন মেলে তুর্কি। আদনান ফের ফিসফিসিয়ে বলে,
‘তোমার ঠোঁটে শুধু প্রথম স্পর্শ কিংবা‚ শুধু শুভেচ্ছা এঁকে দিলাম না।
রেখে দিলাম, আমার সব নীরব ভালোবাসা। আমার জীবনভর বলা না-বলা কথাগুলোর মৌন অনুবাদ।
যা শব্দে নয়, এই চুমুতে রইলো সেইসব কথা,
যা বলা হয়নি কোনোদিন।
দিয়ে দিলাম আমার সমস্ত ক্লান্তি, সমস্ত অপেক্ষা।
তুমি আমার প্রেম নয়,
তুমি আমার জীবনের সব শব্দের শেষে বসা নীরবতা।
যতটা না বলেছি, তার চেয়েও বেশি রেখে দিলাম
ভালোবাসা, প্রতিশ্রুতি, বিশ্বাস আর চিরকাল তোমাতে বিলীন হয়ে থাকার প্রার্থনা।
এই প্রথম স্পর্শ জানুক
এইটা শুধু আমার ‘ভালোবাসি’ নয়,
এইটা আমার ‘আমি তোমাতে বিলীন’ হয়ে থাকার অঙ্গীকার।
শুভ জন্মদিন, বেগম সাহেবা।’
হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৩৮
আদনানের হৃদয়ের সঙ্গোপনের বলা, প্রতিটা কথা তুর্কির হৃদয়ে ঝঙ্কার তুলে দেয়। সারা শরীর কাঁপুনি দিয়ে ওঠে। চোখের কার্নিশ বেয়ে পড়ে কয়েক ফোটা অশ্রু। ও চোখ বন্ধ করে ফুঁপিয়ে ওঠে।
নিজেকে শান্ত করার জন্য সমুদ্রের ঢেউয়ের মত আঁচড়ে পড়ে আদনানের বক্ষস্থলে। শক্ত করে চেপে ধরে আদনানের পিঠের শার্ট। আদনান ও শক্ত আবদ্ধে আবদ্ধ করে নেয় অর্ধাঙ্গিনীকে। তুর্কি ভেজা কম্পিত কণ্ঠে বলে ওঠে—
-ভালোবাসি স্যার! ভালোবাসি! আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি…!